ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ও টিকা সংকট নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১১ জুন ২০২১, ০৪:২৪ পিএম

করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা দিচ্ছেন এক ব্যক্তি

করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা দিচ্ছেন এক ব্যক্তি

একদিকে করোনার টিকা সংকট আর অন্যদিকে ডেল্টা ভ্যারিয়ান্ট ছড়িয়ে পড়ায় জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি নিয়ে আবারো উদ্বেগ বাড়ছে। গত কয়েকদিন ধরে দেশে মৃত্যু ও সংক্রমণ ঊর্ধ্বগতি দেখা যাচ্ছে। সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির এ বাস্তবতায় প্রায় দেড় মাস ধরে গণটিকা কার্যক্রমও বন্ধ রয়েছে। এ অবস্থায় টিকার সংকট কাটিয়ে গণটিকা কার্যক্রম আবার কবে শুরু করা যাবে সেটি এখনো নিশ্চিত করে বলতে পারছে না স্বাস্থ্য বিভাগ। 

এদিকে প্রায় দেড় মিলিয়ন মানুষের জন্য অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার দ্বিতীয় ডোজ নিশ্চিত করতে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ। পরিস্থিতি সামাল দিতে চীনের কাছ থেকে দেড় কোটি ডোজ টিকা কিনতে গিয়ে তার দাম প্রকাশ করে দেয়ায় আরেক জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।

দেশে এখন কোন ধরনের করোনাভাইরাস বেশি ছড়াচ্ছে- সেটি খুঁজে দেখতে সংক্রমিত বিভিন্ন এলাকার ৫০টি নমুনার জিনম সিকোয়েন্সিং করে চারটি ধরন পাওয়া গেছে। চারটি ধরনের মধ্যে ৮০ শতাংশই ইন্ডিয়ান বা ডেল্টা ভ্যারিয়ান্ট। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট বা আইইডিসিআর'র সাম্প্রতিক তথ্যে বলা হচ্ছে, নমুনার বাকি ১৬ শতাংশ বিটা বা দক্ষিণ আফ্রিকান ভ্যারিয়ান্ট আর একটি নমুনা বা ২ শতাংশ হলো অজানা ভ্যারিয়ান্ট।

গত ১৬ মে বাংলাদেশে ভারতীয় ভ্যারিয়ান্ট পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছিল আইইডিসিআর। আর এখন তারা বলছে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের ডেল্টা বা ভারতীয় ভ্যরিয়ান্টের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বা সামাজিক সংক্রমণ হয়েছে।

আইইডিসিআরের পরিচালক তাহমিনা শিরীন বলেন সতর্কতা এখন আরো বাড়ানো দরকার। তিনি বলেন,  যে কোনো ভ্যারিয়েন্টের থেকে এটার ছড়ানোর ক্ষমতা কিন্তু বেশি। সেক্ষেত্রে সাবধানতাটা আমাদের আরো বেশি পালন করতে হবে। যেখানে কিন্তু আমরা কোনো রকমের সচেতনতা কারো মধ্যে দেখছি না সেইভাবে।

সংক্রমণের এ পর্যায়ে জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, কার্যকর বিধিনিষেধ, স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করার সাথে গণহারে টিকা দিতে পারলে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটতো। সরকারিভাবে জানা যাচ্ছে, চীন, রাশিয়ার কাছ থেকে টিকা কেনা এবং কোভ্যাক্স থেকে টিকা পাওয়ার অপেক্ষায় আছে বাংলাদেশ। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হার্ড ইমিউনিটির জন্য অন্তত ৭০-৮০ শতাংশ মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনতে হবে। ভ্যাকসিন বিশেষজ্ঞ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক উপদেষ্টা ড. মুজাহেরুল হক মনে করেন, টিকা জোগাড় করাই এখন দেশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।আমরা যদি ধরে নেই যে ৭০% লোককে আমরা টিকা দেব তাহলে এখন বাংলাদেশকে এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ২৫ কোটি ডোজ টিকা জোগাড় করতে হবে।

একইসাথে ড. মুজাহেরুল হক বলেছেন, ২৫ কোটি ডোজ পাওয়া সহজ কথা নয়। আবার যদি বুস্টার ডোজ লাগে তাহলে আরো সাড়ে ১২ কোটি ডোজ লাগবে। তার মানে আমাদের ৪০ কোটি ডোজ টিকার একটা মজুদ রাখতে হবে বা সম্ভাবনা রাখতে হবে। এইটা তখনই সম্ভব যখন আমরা নিজে টিকা তৈরি করতে পারবো।

মূলত ভারত থেকে টিকা আসা বন্ধ হওয়ার পরই চীন রাশিয়ার কাছে টিকা পেতে বাংলাদেশের তৎপরতা দৃশ্যমান হয়। চীন থেকে একদফা পাঁচ লাখ ডোজ টিকা উপহার হিসেবেও পেয়েছে বাংলাদেশ। দ্বিতীয় দফায় উপহারের ছয় লাখের মত টিকা আসবে বলে জানা যাচ্ছে।

তবে চীনের সিনোফার্মের কাছ থেকে প্রথমে দেড় কোটি ডোজ টিকা কেনার সিদ্ধান্ত হয়। দামও নির্ধারিত হয় দুই পক্ষের মধ্যে। কিন্তু গোপনীয়তার শর্তযুক্ত ওই টিকার দাম প্রকাশ করার পর সেটি নিয়ে তৈরি হয় ভিন্ন জটিলতা। যার প্রভাবে টিকা পেতে যেমন বিলম্ব হচ্ছে, তেমনি ভবিষ্যতে ক্রয়মূল্যেও একটা প্রভাব পড়তে পারে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বলেন, এতে করে ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে বেশি দামে টিকা কিনতে হবে। পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে মুজাহেরুল হক বলেন, বাংলাদেশ ইতিমধ্যে দুঃখ প্রকাশ করেছে। সুতরাং এ অবস্থায় আমার মনে হয় আমরা টিকাটা পাচ্ছি এবং আগের দামেই পাচ্ছি। তবে কথা হচ্ছে আগের দামে যা পেতাম আগামীতে অন্য যে টিকা চায়না দেবে সেটা হয়তো দশ ডলারে নাও দিতে পারে, সেটা ১৫ ডলারে যেতে পারে। এ জন্য যেতে পারে কারণ চাইনিজ টিকা বাজারজাত করার সময় আমাদের পার্শ্ববর্তী শ্রীলংকাকেই ১৫ ডলারে দিয়েছে।

এদিকে করোনাভাইরাসের টিকা নিয়ে বিশ্বজুড়ে চলছে ভিন্ন ধরনের এক কূটনীতি। দ্বিপাক্ষিক, আঞ্চলিক, বহুপাক্ষিক সর্বপরি আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভ্যাকসিন ডিপ্লোম্যাসি এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সাথে চীনা টিকার চুক্তি বিষয়ে গোপনীয়তা লঙ্ঘনের যে ঘটনা সেটি স্পষ্টতই বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক লাইলুফার ইয়াসমিন মনে করেন, এ ধরনের ঘটনা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে আস্থার সংকটও তৈরি করতে পারে। সংকট যে তৈরি হয়েছে সেটা কিন্তু শুধু চায়নার সাথেই নয়, সেক্ষেত্রে কিন্তু অন্যান্য রাষ্ট্রও এটাকে একটা উদাহরণ হিসেবে নিতে পারে যে বাংলাদেশকে কতটুকু বিশ্বাস করা যায়। 

তিনি বলেন, আমি মনে করছি যে এটা একটু অন্যরকম একটা প্রভাব আনতে পারে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাথে অন্যান্য রাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে। সেজন্য আমি মনে করছি যে এখানে আমাদের একটা বিশাল সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য কাজ এখানে করতে হবে।

এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কবে থেকে আবার গণটিকা শুরু করতে পারবে সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছেনা স্বাস্থ্য অধিদফতর। চীন- রাশিয়ার সাথে টিকা কেনার পাশাপাশি বাংলাদেশে টিকা উৎপাদনেরও পরিকল্পনার কথা বলা হচ্ছে।

বাংলাদেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটির আওতায় টিকা পাওয়ার অপেক্ষা করছে। বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রী ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, সবাই আশ্বাস দিচ্ছে কিন্তু টিকা পাওয়া যাচ্ছে না।

আইইডিসিআর এর পরিচালক তাহমিনা শিরীন বলছেন, এখন যেহেতু আমরা কোনো টিকা উৎপাদনকারী দেশ না। অন্যের ওপর নির্ভর করতে হয়। সেক্ষেত্রে কিছুটা বাধা থাকে। আসলে অনেক চেষ্টা করা হচ্ছে। চেষ্টার কোনো ত্রুটি নাই। দেখা যাক কী হয়। শিগগিরই আমরা জানতে পারবো। তখন আপানারাও জানতে পারবেন।

জনস্বাস্থ্যবিদরা মনে করেন, টিকা কর্মসূচি পরিচালনায় বাংলাদেশের বেশ সুনাম রয়েছে। করোনাভাইরাসের টিকা কার্যক্রমের একটা ভালো সূচনা হলেও সেটি ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে একটিমাত্র টিকার ওপর নির্ভরশীলতার কারণে। একাধিক দেশ থেকে টিকা সংগ্রহ এবং উৎপাদন শুরু করাটাই এখন জরুরি বলে মত বিশেষজ্ঞদের।

মুজাহেরুল হক বলেন, ভারতের মতো বৃহত্তম দেশ টিকা নিজে উৎপাদন করে আবার অন্য দেশের টিকাও তারা উৎপাদন করছে। পাকিস্তানও তাই করছে। সুতরাং বাংলাদেশেরও উচিৎ হবে বেশ কয়েকটা সোর্স থেকে টিকা আমদানি করা। পাশাপাশি টেকনোলজি ট্রান্সফারের মাধ্যমে কোন টিকা আমাদের দেশে তৈরি করা যায় কিনা- সে সম্ভাবনা দেখে তা বাস্তবে রূপ দেয়ার চিন্তা করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নাই।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বৃহস্পতিবার বলেছেন টিকা উৎপাদনের বিষয়ে শিগগিরই আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসবে। দেশে টিকা উৎপাদন নিয়ে চীন ও রাশিয়ার সাথে আলোচনা চলছে। এখন দেখার বিষয় এই আলোচনা কতো দূর আগায়।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh