ভ্রমণ

সান্তা-ফে শহরের রকমারি দৃশ্যবাহার

মঈনুস সুলতান

প্রকাশ: ১৩ জুন ২০২১, ০৫:৫৩ পিএম | আপডেট: ০৮ জুলাই ২০২১, ০৮:৫৭ এএম

প্রাপ্তবয়স্কদের সঙ্গে বাইক চড়ছে বাচ্চারা

প্রাপ্তবয়স্কদের সঙ্গে বাইক চড়ছে বাচ্চারা

যুক্তরাষ্ট্রের সান্তা-ফে শহরের প্রান্তিকে পাথুরে পাহাড়ের ঢালে যে নির্জন কটেজে আমার বসবাস, তার পেছন দিকের পিনিওন বৃক্ষে ভরপুর উপত্যকায় আছে একটি বাইক-পাথ। কয়েক মাইলের পিচঢালা এ সড়কে গাড়ি কিংবা মোটরবাইকের প্রবেশ নিষেধ। বাইক-পাথ বা এ সংকীর্ণ পথটি ব্যবহৃত হয় কেবলমাত্র বাইসাইকেল চালানো ও জগিং করা এবং হেঁটে হাল্কা চালে ঘুরে বেড়ানোর জন্য। একদিন ভোরে মাউন্টেন বাইক হাঁকিয়ে গোলাকার টিলাটির প্যাঁচানো ফুট ট্রেইলের এবড়ো-খেবড়ো পাথর ও ক্যাকটাসের কাঁটাঝোপ মাত্র ডিঙিয়েছি। তারপর বাইক-পাথে ঢুকে পড়ে স্মুদ সড়কে হাল্কা চালে প্যাডেল মারি। 

আজ একাকী বাইক হাঁকাতে হচ্ছে বলে বাইসাইকেলিংয়ে ঠিক জোশ আসছে না। কথা ছিল, বান্ধবী রোজ্যান নিউমি বা রোজ তার মাউন্টেন বাইকসহ আমার সঙ্গে সাইকেলিংয়ে শরিক হবে। সিয়েরা লিওনে আমার চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আমি সান্তা-ফে শহরে এসে স্রেফ কর্মহীন হালতে দিন গুজরান করছি। রোজ্যান বা রোজের সঙ্গে আমার সৌহার্দ্যরে সূচনা হয়, অনেক বছর আগে সাউথ আফ্রিকার প্রিটোরিয়া নগরীতে বসবাসের সময়। আমি আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলবিষয়ক বইপত্র পড়ে, সে অঞ্চলের নানাবিধ ইস্যু নিয়ে আলোচনা করার জন্য জানাশোনা কয়েক জনকে নিয়ে গড়ে তুলেছিলাম একটি বুক-ক্লাব। পাশ্চাত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ দূতাবাসে কর্মরত রোজ এ বুক-ক্লাবে আসতো জিম্বাবুয়ের রাজনৈতিক ডিসটারবেন্স ও বনদস্যুদের হাতে হর-হামেশা নিহত হাতি ও গন্ডার নিয়ে আলোচনা করার জন্য। প্রতি উইকেন্ডে আমার ভদ্রাসনে বুক-ক্লাবের বিষয়-আশয় মোট মির্জা ভালোই চলছিল। তবে আপ্যায়নের কফি ও স্নাকস জোগান দিতে গিয়ে আমি গলদ্ঘর্ম হচ্ছিলাম। রোজ নিজে থেকে রিফ্রেসমেন্টের দায়িত্ব অনেকটা তার কাঁধে তুলে নিয়ে আমার তারিফ অর্জন করেছিল। প্রয়োজনে চেনা মানুষকে সাহায্য করার একটা সহজাত প্রবণতা তার চরিত্রে আছে, যা আমাদের দু’জনার মাঝে কাজ করছিল সেতুবন্ধন হিসেবে। 

বুক-ক্লাবে অধ্যয়নের হপ্তাওয়ারী অনুশীলন জারি রাখতে দরকার পড়ছিল প্রচুর পরিমাণে প্রসঙ্গিক বইপত্রের, যা প্রিটোরিয়ার বুকস্টোরস থেকে জোগাড় করা মুশকিল হলে- রোজ তার হাইস্পিড ইন্টারনেট ব্যবহার করে, আমাজন ডট কম এর হিল্লা ধরে ক্রেডিট কার্ডে তা খরিদ করত। তারপর ডিপ্লোমেটিক পাউচ মারফত প্রয়োজনীয় কেতাবগুলো এসে হাজির হতো আমাদের গ্রন্থপাঠের মজলিশে। এ কারণে হাজেরান পাড়-পাঠকরা তাকে ‘অ্যা রিয়েল ডার্লিং’ সম্বোধন করতে শুরু করেছিল।

সান্তা-ফে শহরে এসে অনেক দিন পর রোজের সঙ্গে ফের দেখা হওয়া মাত্র অনুভব করি যে- সে আগের মতোই আছে। বেচারি বছর তিনেক আগে চাকরিচ্যুত হয়ে এ শহরে একাকী বাস করছে। মাস কয়েক আগে ক্যান্সারের সঙ্গে যুজে সে রিকভার করেছে। 

তার জীবনে এত কিছু ঘটে গেলেও- চেনাজনকে সাহায্য করা বাবদে সক্রিয়ভাবে উদ্যোগ নেওয়ার প্রবণতাতে খামতি আসেনি এক বিন্দু। আমি সান্তা-ফে’তে বসবাস করতে এসেছি শুনে, পৌঁছার ঘণ্টা খানেকের ভেতর আমার কটেজে রোজ এসে হাজির হয়েছে, অভেনে বেক করা ব্রেড ও হটকেসে তপ্ত স্যুপ নিয়ে। আমি বোরডোম কাটানোর জন্য ক্রাইম থ্রিলার পড়তে চাচ্ছি জানতে পেরে- পরদিন ফের হাজির হয়েছে সে, টনি হিলারম্যান নামক খ্যাতনামা এক রহস্য ঔপন্যাসিকের সাতখানা বই নিয়ে। টনি হিলারম্যানের বইগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- তিনি আমেরিকান সাউথ ওয়েস্ট অঞ্চলের বর্ণনা দেন রীতিমতো চিত্রময় ভাষায়। তাঁর কিছু রহস্য-রচনার প্রেক্ষাপট হচ্ছে- সান্তা-ফে অঞ্চলের আশপাশের সানোরা ডেজার্ট, সাংগ্রে দে ক্রিস্ত পাহাড় থেকে রকি মাউন্টেন ইস্তক। তো, আমি খোলা বেলকনির রিক্লাইনার জাতীয় চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বইগুলো পড়ে অত্র এলাকার জিওগ্রাফিক বৈচিত্র্য সম্পর্কে জানতে পারছি বিশদভাবে। শরীরে উচ্চ রক্তচাপ এবং ক্রমবর্ধমান শর্করার ট্রেন্ডের জন্য ডাক্তার আমাকে প্রতিদিন বাইসাইকেলিং এর বিধান দিয়েছেন। রোজ ক্যান্সার থেকে কেবলমাত্র রিকভার করছে, তাকেও ডাক্তার এক্সারসাইজ করতে পরামর্শ দিয়েছেন। সে অন্যান্য এক্সারসাইজের চেয়ে বাইসাইকেলিং করাটা বেশি পছন্দ করে। সাইকেলিংয়ে আমারও আগ্রহ আছে জানতে পেরে- সে সপ্তাহ দেড়েক আগে আমার জন্য তার পুরনো মাউন্টেন বাইকখানা এসইউভি গাড়ির পেছনের  র্যাকে করে নিয়ে এসেছে। সঙ্গে তার সদ্য কেনা লেটেস্ট মডেলের ঝকঝকে মাউন্টেন বাইক। তার উৎসাহে আমরা প্রতিদিন যুগলে এ সড়কে বাইসাইকেলিং করতে শুরু করেছি। ঘন্টা খানেক বাইক হাঁকিয়ে আমরা একটি ভাঙা ক্যাম্পার ট্রেইলারে চালু মেক্সিকান ক্যাফেতে তমালে বা তরতিয়া স্যুপের সঙ্গে পান করি এক পেয়ালা আইস-ল্যাতে জাতীয় কফি। তো, আজকে বাইসাইকেলিংয়ের ট্রিপে রোজ না আসাতে সকালবেলা চা এর সঙ্গে সংবাদপত্র না পড়ার মতো খালি-খালি লাগে।

কিন্তু কারও অনুপস্থিতিতে জিন্দেগীর চলমান প্রবাহ তো থেমে থাকে না। আমাকে আজ একলা বাইসাইকেল হাঁকাতে হয়। জোরে প্যাডেল মেরে আমি চলে আসি একটি ভূগর্ভস্থ টানেলের কাছে। উল্টা দিক থেকে দাঁড়িয়ে প্যাডেল করতে করতে টানেল থেকে বেরিয়ে- গতি একটু কমিয়ে- আমার দিকে হাতের দু’আঙ্গুলে ভি চিহ্ন এঁকে পাশ দিয়ে সাঁই সাঁই করে বেরিয়ে যান অচেনা এক মাউন্টেন বাইক রাইডার। টানেলের ওপর দিয়ে চলে গেছে অজস্র মোটর-কারের চলাচলে ব্যস্ত হাইওয়ে। আমি টানেলের খানিক স্যাঁতসেঁতে আধো অন্ধকার পরিসর পাড়ি দিয়ে চলে আসি ওপারে। ওখানে বাইক-পাথের পাশে পড়ে থাকা বিশাল এক রকে পায়ে ঠেকা দিকে আমার বাইসাইকেলটিকে থামাই। প্রান্তরের হাল্কা গাছপালা ছাড়িয়ে দৃষ্টি চলে যায় দিগন্তে। ওদিকে রকি মাউন্টেনের পাথুরে ফর্মেশনকে দেখায়- চীনা ল্যান্ডস্ক্যাপ চিত্রে আঁকা এক সারি বৌদ্ধ মন্দিরের মতো।

রোজের আজ কী হয়েছে, তার বাইক-পাথে না আসার পেছনে ঘটনা কী- না জেনে আগ বাড়তে ইচ্ছা হয় না। তো আমি সাইকেলের পিটে বসে তাকে রিং করি। জবাবে তার ঘুম জড়ানো কণ্ঠস্বরকে কেমন জানি ভাঙাচোরা শুনায়। দীর্ঘ হাই চাপতে চাপতে সে জানায় যে, রাতে তার ঘুম হয়নি একদম। নিজের স্ট্রেস সম্পর্কে লিখতে বসেছিল সে। লিখতে লিখতে কিছু বিষয় সাইকেলের চাকায় লেপ্টে যাওয়া শুকনা পাতার মতো তার করোটিতে ফরফর করতে থাকে। সারারাত বিষয়টি তর্পণ করেও তা সে মাথা থেকে সরাতে পারছে না। ‘যা লিখেছ, তা আমার সঙ্গে শেয়ার করা যায় কী রোজ?’ জানতে চাইলে সে ম্রিয়মান ভাবে ‘ আই থিংক ইয়েস’ বলেই আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে লাইন কেটে দেয়।

আমি আবার প্যাডেল মারি। ক্যান্সারের সংক্রমণ থেকে ক্লিয়ার হওয়ার পর রোজ ভুগছে স্ট্রেসজনিত ডিপ্রেশনে। বিষয়টি জানতে পেরে আমি তাকে যে সব ইস্যু তার মনজগতে সৃষ্টি করছে চাপ, তা ডায়েরির মতো করে লিখতে বলেছিলাম। ভেবেছিলাম যে- লিখতে লিখতে হয়তো স্ট্রেস লাঘব হবে; কিন্তু হিতে বিপরীত হয়েছে জানতে পেরে দারুণ উদ্বেগ হয়। আরও মাইল দুয়েক একটানা বাইসাইকেল চালিয়ে ক্লান্তি লাগে। তাই সাইকেলটি স্ট্যান্ডে দাঁড় করিয়ে বসে পড়ি সড়কের পাশে পাতা বেঞ্চে। 

বসেই দেখতে পাই, ওয়াকারে ভর দিয়ে বেঞ্চের দিকে এগিয়ে আসছেন মি. অ্যাংখেল। বিকালবেলা বাইক-পাথে হাঁটতে এলে প্রায়ই মি. অ্যাংখেলের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। ইতালিয়ান বংশোদ্ভূত বয়োবৃদ্ধ এ সাবেক সৈনিক কোরিয়ান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে লড়ে কোমরে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন । সার্জেন্ট হিসাবে রিটায়ার করে কিছুকাল স্থানীয় এলিমেন্টারি স্কুলে পার্ট-টাইম হিস্ট্রি টিচার ছিলেন। তাঁর স্ত্রী বিয়োগ হয়েছে ৯ বছর আগে। সংসারে সন্তানাদি থাকলেও তাদের সঙ্গে বৃদ্ধের কোনো যোগাযোগ নেই। তিনি বাইক-পাথের কাছেই এক কামরার একটি কেবিনে একাকী বাস করেন। মি. অ্যাংখেল কথা বলতে ভালোবাসেন, দেখা হলেই জানতে চান-আমি চাকরি-বাকরি খুঁজছি কি না, বয়স আরেকটু ভাটির দিকে হেললে কোথায় যাব? তত্ত্বতালাবি করার মতো কোনো খেশকুটুম বা আশ্রয় নেওয়ার মতো আমার কোনো জায়গা আছে কী... ইত্যাদি। একটু বাচাল প্রকৃতির হলেও মানুষটিকে আমি পছন্দ করি, তাই বেঞ্চে বসে তাঁর আসার জন্য অপেক্ষা করি। মি. অ্যাংখেল দাঁড়িয়ে পড়ে ওয়াকারে ভর দিয়ে বাইনোকুলারে প্রান্তরের গাছপালা খুঁটিয়ে দেখেন। ভদ্রলোক শখের বার্ড ওয়াচার। কয়েক দিন আগে মি. অ্যাংখেল পাখি পর্যবেক্ষণের জন্য ব্যাকপ্যাক থেকে বাইনোকুলার বের করতে গেলে-  তাঁর নাকের ব্রিজ থেকে খুলে পড়ে যায় বাইফোকাল চশমাটি। তারপর থেকে প্রতিদিন বাইক-পাথে এসে তিনি নিরিখ করে তাঁর চশমাটি খুঁজতেন। ঘটনা সম্পর্কে অবহিত হয়ে আমিও চশমা খোঁজাখুঁজিতে হাত লাগাই; কিন্তু ঠিক কোথায় তা ড্রপ করেছেন, পিনপয়েন্ট করে তা বলতে না পারায় আই-গ্লাসটি আর খুঁজে পাওয়া যায় না। 

মি. অ্যাংখেল এখনো নতুন আই-গ্লাস কিনে নিতে পারেননি, তাই কাছে এসে কপালে হাত দিয়ে খুব নিরিখ করে তাকান। আমি ‘হ্যালো’ বলতেই তিনি আমাকে শনাক্ত করতে পেরে বসতে বসতে অভিযোগ করেন, মিলিটারি সার্ভিসের জন্য তিনি যে মেডিকেল ইনস্যুরেন্স পান, তা আই-গ্লাস ক্রয়ের কস্ট কভার করে না। আর নিজের পয়সায় আই-গ্লাস কিনতে গেলে চার-পাঁচশ’ ডলারের ধাক্কা। আমি এ অপ্রিয় প্রসঙ্গ থেকে আলাপকে অন্য দিকে ঘুরানোর জন্য বলি,‘আই সি ইউ হ্যাভ অ্যা বাইনোকুলার টুডে মি. অ্যাংখেল, তা নতুন ধরনের কোনো পাখি দেখতে পেলেন কী?’ তিনি উৎসাহের সঙ্গে জবাব দেন,‘ অহ্ ইয়েস, বার্ড মাইগ্রেসনের সিজন শেষ হতে চলছে, তবে ছোটখাটো কিছু পাখি এ রুট ধরে উড়ে যাচ্ছে দক্ষিণে। একটু আগে আমি এক ঝাঁক ব্ল্যাক হেডেড গ্রুজবিক পাখিকে স্পট করলাম।’ আমি আলাপকে আরও দীর্ঘায়িত করার জন্য বলি,‘ ওয়াজ দ্যাট অল? ডিডন্ট ইউ সি এনি আদার বার্ড স্পিশিস?’ তিনি ফোকলা দাঁতে তাঁর হাসিকে বিস্তৃত করে জানান,‘ আই সো সামথিং আন ইউজ্যুয়েল টুডে, মনে হলো, দলছুট চারটি সোনালি ওরিওল পাখি আশপাশের পিনিওন বৃক্ষের ঝোপঝাড়ে পাইন-নাট খুঁজছে, ওয়াচ আউট ফর দেম।’ আমি এবার জানতে চাই, ‘মি. অ্যাংখেল, ইজ সান্তা-ফে অ্যা মেজর মাইগ্রেসন রুট?’ তিনি জবাব দেন,‘ উত্তরের তুষারপাত এড়িয়ে দক্ষিণ দিকে উড়ে যাওয়ার জন্য পরিব্রাজক পাখিরা এ রুট ব্যবহার করে থাকে। রুটটি বার্ড ওয়াচারদের কাছে সেন্ট্রেল ফ্লাইওয়ে নামে পরিচিত। গেল এক শত বছরে সান্তা-ফে শহরের ওপর দিয়ে উড়ে গেছে কম-ছে-কম পাঁচ শত প্রজাতির অভিবাসী পাখি।’ আমার সেলফোনে পিং শব্দ হলে আমি উঠে পড়ি। স্ট্যান্ড থেকে মাউন্টেন বাইকটি নামাতে নামাতে জানতে চাই, ‘মি. অ্যাংখেল, ডু ইউ হ্যাভ অ্যা প্ল্যান ফর দি আফটারনুন।’ তিনি ফোকলা দাঁতে মিটে হেসে ইতালীয় ভাষায় জবাব দেন, ‘ইল ডুলছে ফার নিয়েনতে, বা চেষ্টা করছি বিকেলের দিকে কিছু না করার মিষ্টি অনুভূতিতে নিমজ্জিত হতে।’ আমি মাথা ঝুঁকিয়ে গুডবাই বলে আবার প্যাডেল মারি।

খানিকটা বাইক চালানোর পর অস্থির লাগে। আমি সচেতন যে রোজের কাছ থেকে ম্যাসেজ এসেছে এবং তা পাঠ না করে বাইক চালিয়ে আগ বাড়া মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। তাই সাইকেলটি একটি স্প্রুস গাছে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে আমি ম্যাসেজটি খুলি। দীর্ঘ এটাচমেন্টে রোজ গেলরাতে তার ডায়েরিতে যা লিখেছে- তার বেশ খানিকটা পাঠিয়েছে। আমি স্ক্রিনে স্ক্রল করে তার লেখনী থেকে মেইন পয়েন্টসগুলো অনুধাবন করার চেষ্টা করি। রোজের জন্ম হয় নিউ মেক্সিকো অঙ্গরাজ্যের লস আলামস শহরের লাগোয়া হোয়াইট রক ক্যানিওনে। জায়গাটি ‘বার্থ প্লেস ফর এটোমিক বম্ব’ বলে পরিচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ওখানকার একটি ল্যাবরেটরিতে তৈরি হয় আনবিক বোমা। মারণাস্ত্রটি জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে ব্যবহারের আগে লস আলামসের কাছাকাছি নেটিভ আমেরিকান বা রেড ইন্ডিয়ানদের পল্লী-গ্রামে নিবিড় এক উপত্যকায় পরীক্ষামূলকভাবে বিস্ফোরণও করা হয়। তেরো বছর বয়সে রোজের জননী সাত মাসের একটি শিশুসন্তান রেখে ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করেন। সতেরো বছর বয়সে তার পিতারও মৃত্যু হয় একই রোগে। পরবর্তী জীবনে রোজের এক ভাই ও বোনের মৃত্যু হয় ক্যান্সারের প্রকোপে। আমি সেলফোন পকেটে ঢুকিয়ে বিষয়টি নিয়ে ভাবি। লস আলামসের আশপাশে বসবাস রত মানুষজনদের মাঝে গেল তিন প্রজন্ম ধরে নানা রকমের ক্যান্সার ছড়াচ্ছে, বিষয়টি আমি পত্রপত্রিকায় পড়েছি। রোজের পরিবারে যা ঘটেছে- তা শুধু ট্র্যাজিকই না, মারাত্মকভাবে বিপজ্জনকও বটে। কারণ, শুনেছি যে, কিছু কিছু ক্যান্সার চিকিৎসাতে নির্মূল হলেও তা ফিরে আসছে দু-তিন বছর পর। তখন রোগীকে সারিয়ে তোলা সত্যিই কঠিন হয়ে পড়ে। তার ম্যাসেজ নিয়ে ফের ভাবতেই মানসিকভাবে হতদ্যোম হয়ে পড়ি। এ ক্ষেত্রে আমি অসহায়, তাকে কোনো প্রকারের সহায়তা প্রদান আমার সাধ্যের অতীত। তখনই স্মৃতিতে ফিরে আসে, সাউথ আফ্রিকার প্রিটোরিয়া শহরে যাপিত চমৎকার দিনগুলোর কথা। তখন আমার জীবনে সংকট দেখা দিলে রোজকে সহমর্মী হিসাবে কাছে পেয়েছি সব সময়। আমি আবার মাউন্টেন বাইকের প্যাডেলে পা দিতেই- তার দুর্যোগে কাছাকাছি যেতে চাওয়ার প্রেরণা লোহার কাছাকাছি হওয়া চুম্বকের টুকরার মতো ফিরে আসে আমার মধ্যে। তাকে জবাবে কী ম্যাসেজ পাঠানো যায়- তার ড্রাফ্ট ভাবতে ভাবতে আমি সাইকেল চালনার গতি বাড়াই।

সান্ত-ফের চকমিলান ক্যাথিড্রাল


বাইক-পাথের এদিকে আছে অনেক বার্চ ও অ্যাসপ্যান নামের বেশ বড় বড় গাছ। কিছু দূর পর পর সারি দিয়ে লাগানো এসব গাছের মাঝে মাঝে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সোনালি পত্রালিতে ভরপুর কটনউডের বর্ণাঢ্য বৃক্ষগুলো। অটাম শেষ হতে চলছে, তাই সবুজ পত্রালি বিবর্তিত হয়ে ঝলসাচ্ছে সোনার আভায়। আমি মাউন্টেন বাইকের স্পিড কমিয়ে দিয়ে- গাছের পাতায় তেরছা হয়ে পড়া সূর্যরশ্মির আলোাছায়া দেখতে দেখতে আগ বাড়ছি। একটি বার্চ গাছের কাণ্ডে হাত রেখে মি. ফুমিহিরো হাঁক পাড়েন,‘স্টপ হিয়ার অ্যা বিট ম্যান, এরা গাছপালার আর কিছু জীবিত রাখবে বলে মনে হয় না।’ মি. ফুমিহিরো নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ে জাপানিজ-আমেরিকান। তার পূর্বপুরুষ তিন প্রজন্ম আগে জাপান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কল-কারখানায় কাজ করতে আসে অভিবাসী হয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁর পিতাকে জাপ বাহিনীর গুপ্তচর হিসেবে মিথ্যা তমদ দিয়ে অন্তরীণ করা হয়েছিল। এ বাইক-পাথে বিকালে হাঁটাহাঁটির সময় মি. ফুমিহিরোর সঙ্গে আমার আগেও বার কয়েক কথাবার্তা হয়েছে। 

পেশায় পরিবেশ বিজ্ঞানী এ ভদ্রলোকের থুতনিতে আছে মাছের লেজের মতো বিচিত্র শেইপের দাড়ি। ইনি অরিগ্যান অঙ্গরাজ্য থেকে সান্তা-ফেতে এসেছেন ছুটি কাটাতে। বাইক-পাথে ইনি কখনো সাইকেল চালান না, হাঁটাহাঁটিও তাঁর ধাতে নেই। ব্যতিক্রমি শেইপের দাড়ির জন্য বিচিত্র দেখতে এ প্রৌঢ় মানুষটি তার বাহন হিসাবে ব্যবহার করেন রোলারস্কেটের চাকাওয়ালা জুতা। তা পরে তিনি দুই-দুইটি লাঠিতে নৌকার লগির মতো ভর দিয়ে সামনে বাড়েন। চলতে চলতে পথের পাশে কোনো গাছ নজরে পড়লে- থেমে বিশেষ ধরনের লেন্স দিয়ে তার জকড়ি-মকড়ি লাগা পাতার ফটো তুলেন। আর কারও সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হলে সে পথচারিকে থামিয়ে- বৃক্ষগুলোর সঠিক মতো তত্ত্বতালাবি হচ্ছে না -বলে আফসোস করেন। এ ভদ্রসন্তানের রলারস্কেটে ঘরঘরিয়ে ঘুরে বেড়ানোর প্রক্রিয়া আমাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করেছে। বিষয়টি জানতে পেরে রোজও আগ্রহী হয়ে ওঠেছে। তার বাড়িতে পড়ে আছে কয়েক জোড়া রোলারস্কেটের জুতা। তো তার কাছ থেকে এক জোড়া ধার করে এনে আমাকে সে রোলারস্কেটিং প্র্যাকটিশ করার প্রস্তাব দিয়েছে। মি. ফুমিহিরোও আমাকে ভরসা দিয়েছেন-রেলারস্কেটিং কঠিন কিছু না, তিনি আমাকে চাকাওয়ালা জুতা পায়ে ঘুরে বেড়ানোর সবক দিতে রাজি হয়েছেন; কিন্তু আমি এখনো সাহস সঞ্চয় করে ওঠতে পারিনি।

মি. ফুমিহিরোর অভিযোগ আমলে না এনে সামনে বাড়া মুশকিল হয়। তাই মাউন্টেন বাইকটি স্ট্যান্ডে দাঁড় করিয়ে আমি তাঁকে গুডমর্নিং বলি। গৃহপালিত ধবলী গাইয়ের কাঁধে দাঁদের ক্ষত পরীক্ষা করার মতো তিনি বার্চ গাছটির শুকিয়ে কোঁকড়া হয়ে আসা বাকলে দিশা ধরে কিছু দেখছেন। আমার সঙ্গে চোখাচুখি হতেই বলেন, ‘জাস্ট লুক হিয়ার ম্যান, দিস ইজ অ্যা ক্লিয়ার সাইন অব ক্লাইমেট চেঞ্জ। আবহাওয়ার পরিবর্তন না ঘটলে এ সিজনে বার্চ গাছের বাকল এতো শুকনা হয় কীভাবে? এ ডিহাইড্রেশন বা জলসল্পতা ধীরে ধীরে সত্তর-আশি বছরের বৃদ্ধ গাছটিকে ঠেলে দেবে অকাল মৃত্যুর দিকে।’ আমি গাছপালার জীবনপ্রণালি সম্পর্কে তেমন কিছু জানি না, তবে মি. ফুমিহিরোকে কিছু বলতে তো হয়, তাই বেআক্কেলের মতো মন্তব্য করি, ‘দিস ইজ রিয়েলি ওয়ারিসাম, সত্যিই বড় দুশ্চিন্তার বিষয়।’ তিনি আমার কমেন্ট শুনে কটমট করে তাকিয়ে আংগুল দিয়ে আরেকটি কাঁটাওয়ালা গাছ দেখিয়ে বলেন,‘আকাশিয়া প্রজাতির এ গাছটির নাম ক্যাটক্লো, এতে চমৎকার হলুদ রঙের খুব সুগন্ধী ফুল ধরে। বাট দিস প্ল্যান্ট শুড নট বি হিয়ার। বার্চ গাছের কাছাকাছি এ ধরনের একটি পুষ্পবতী ক্যাটক্লো থাকলে স্রেফ ফুল ফোটানোর প্রয়োজনে এটি শুষে নেবে তাবৎ আর্দ্রতা।’ আলোচনা জটিল হচ্ছে দেখে আমি বিশেষ কিছু বলি না। 

আমার নীরবতায় তেতোবিরক্ত হয়ে মি. ফুমিহিরো শ্বেতশুভ্র ফুলের ভারে ঈষৎ নত একটি লতানো উদ্ভিদ দেখিয়ে ছাত্রকে পড়া ধরানোর মতো প্রশ্ন করেন,‘ডু ইউ আন্ডাস্ট্যান্ড হোয়াট দিস ভাইনি প্ল্যান্ট ইজ?’ আমি রীতিমতো বিপাকে পড়ে ঠিক কী জবাব দেবো বুঝতে পারি না। তিনি আমার মন্তব্যের বিশেষ তোয়াক্কা না করে ফের বলেন,‘ দিস প্ল্যান্ট ইজ কল্ড দাতুরা, এর বোতামের মতো বীজ পানিতে ফুটিয়ে খেলে মাথায় স্বর্গ-নরক একাকার হয়ে যাবে। দিস প্ল্যান্ট শুড নট বি হিয়ার অ্যাজ ওয়েল।’ মি. ফুমিহিরো বার্চ গাছটিকে ছেড়ে দিয়ে তার দুটি লাঠিতে লগির মতো ঠেকা দিয়ে রোলারস্কেটে বাইক-পাথ হিট্ করেন। চাকাওয়ালা জুতায় আগ বাড়তে বাড়তে ঘাড় পেছন দিকে বাঁকিয়ে বলেন,‘ বাইক-পাথের গাছপালার দায়িত্বে আছে যে ফরেস্ট রেঞ্জার- তার সঙ্গে আমি আজ কথা বলবো। দিস টু প্ল্যান্টস্ মাস্ট বি রিমুভড্ ফ্রম হিয়ার।’

গাছপালার স্বাস্থ্য বা ক্লাইমেট চেঞ্জ নিয়ে দুশ্চিন্তা করার মতো মানসিক অবস্থা আমার নেই। মাউন্টেন বাইকে ফের প্যাডেল মারতে গিয়ে অনুভব করি, শীতের সকালে পুকুরের ওপর আবছা ধূসর হয়ে উত্থিত কুয়াশার মতো আমার অবচেতন থেকে ওঠে আসছে মারাত্মক একটি রোগে বিপন্ন রোজের জন্য প্রগাঢ় সহমর্মিতা। সে ফোনালাপে একটু আগে লাইন কেটে দিয়েছে, আবার রিং করতে দ্বিধা হয়। বাইক-পাথে এখানে যুক্ত হয়েছে নুড়িপাথর ছড়ানো ধূলিধুসরিত একটি ফুটট্রেইল। তাতে দুই প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ বাইকারদের সঙ্গে সাইকেল হাঁকাচ্ছে দুটি বাচ্চা। তাদের পেছন পেছন আমি পিচঢালা বাইক-পাথ ছেড়ে নেমে আসি কাঁচা ট্রেইলে। 

এ ট্রেইলটি আসলে একটি ড্রাই রিভার বেড। সান্তা-ফের এ অঞ্চল প্রাকৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে শুধু মরুভূমিই না, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আট হাজার ফিট উচ্চতায় এর অবস্থান বলে অত্র এলাকা হাই ডেজার্ট বলে পরিচিত। এখানে বৃষ্টিপাত হয় কদাচিৎ; কিন্তু যখন ঝুম বৃষ্টি নামে, তখন বিশ-পঁচিশ মিনিটের ভেতর ইন্সটেন্টলি তৈরি হয়ে যায়, প্রাকৃতিকভাবে পানি নিষ্কাশনের ছড়া-নদী। এসব ছড়া-নদীকে ইংরেজিতে ড্রাই রিভার বেড বলা হলেও, স্থানীয় নেটিভ আমেরিকান বা রেড ইন্ডিয়ানদের ভাষায় এ সব শুখা-নদী ‘অরোয়ো’ নামে পরিচিত। অরোয়ো’তে বাইসাইকেল চালাতে গেলে পায়ের মাসোলে চাপ পড়ে প্রচুর। তবে মাউন্টেন বাইকটিতে আছে নানাবিধ গিয়ার ও রকমারি কলকব্জা। এগুলো এডজাস্ট করে ড্রাই রিভার বেডের বালুকা ও নুড়িপাথরের প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করা কঠিন কিছু না।

অরোয়ো বা ড্রাই রিভার বেডের পাশে কয়েকটি রোদে পোড়া ইটে তৈরি ঘরবাড়ি। এগুলোর বাউন্ডারি ওয়াল বলে কিছু নেই। তবে বাড়িগুলো রড-আয়রনের ফেন্স দিয়ে একটির সঙ্গে আরেকটির আঙিনা আলাদা করা। এ রকম একটি রট-আয়রণের ফেন্সে হলুদ রঙের একটি ওরিওল পাখিকে বসে থাকতে দেখে আমি সাইকেল থামাই। মি. অ্যাংখেলের দেওয়া অভিবাসী পাখিবিষয়ক তথ্য ফিরে আসে মাথায়। আন্দাজ করি, ফেন্সে বসে থাকা সম্পূর্ণ সোনালি পালকের এ খেচরটির সঙ্গী-সাথী অন্য দুই-তিনটি ওরিওলও কাছে পিটে কোথাও আছে। কিছুক্ষণ সাবধানে এদিক-ওদিক তাকিয়েও সহজে তাদের স্পট করতে পারি না। দলছুট এ ওরিওলটিকে উদ্বিগ্ন দেখায়। আমি সেলফোনে তার ছবি তুলতে গেলে আমার আচরণে বিরক্ত হয়ে সে উড়ে পালায়।

মাথা, চোখ ও চঞ্চুর পাশে লোহিত বর্ণের আভা ছড়ানো সম্পূর্ণ সোনালি ওরিওল পাখিটির শট জুত মতো নিতে পারিনি বলে খিন্ন লাগে। আস্তে-ধীরে আবার প্যাডেল মারি। এ দিককার এবড়ো-খেবড়ো টেরেইন রাফ হয়ে আসছে। দূরে-খানিকটা উঁচু এলিভেশনে মনুমেন্টের মতো দুর্দান্ত এক রক ফর্মেশন ভেসে ওঠে দৃষ্টিপথে। দেখি, অন্য এক বাইকার তার মাউন্টেন বাইক বেহদ মেহনতে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ওই দিকে। আমার মাউন্টেন বাইকের কন্ডিশন খারাপ না; কিন্তু ট্রেইল উজিয়ে রক ফর্মেশনের দিকে যেতে ভেতর থেকে কোনো মটিভেশন আসে না। সেলফোন পিং করে ওঠলে- আমি সাইকেল থামিয়ে ম্যাসেজ ওপেন করি। রোজ জানতে চেয়েছে, আমি তার সঙ্গে ব্রাঞ্চ করতে চাই কি-না? সে ফ্রেশ ব্রেড বেক করছে। আমি তার বাড়িতে যেতে রাজি হলে স্প্যানিশ ওমলেট চড়াবে ফ্রাইপ্যানে এবং বাইক চালিয়ে আমি তৃষ্ণার্থ হলে- চাই কী খানিকটা ব্লাডিমেরিও পান করা যেতে পারে। 

ম্যাসেজ পড়া মাত্র আমার ভেতর চাগিয়ে ওঠে গনগনে ক্ষুধা। ভালো ভাবে ব্রেকফাস্ট করে আমি বেরোইনি। ভেবেছিলাম, রোজের সঙ্গে বাইসাইকেলিং করে মেক্সিকান ক্যাম্পার-ক্যাফেতে তমালে বা তরতিয়া স্যুপ খাবো। বেশ বেলা হয়েছে, রোজ যদি ব্রেকফাস্ট ও লাঞ্চের যোগফলে ব্রাঞ্চ তৈরি করে, তাতে যোগ না দেওয়ার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না। আমি আমার লকেশন বর্ণনা দিয়ে তাকে রিপ্লাই করতেই সে রিংব্যাক করে। বাইক-পাথের এ দিককার পথঘাট ও তাবৎ ট্রেইল সে ভালো করে চেনে। সে খুব সহজভাবে বুঝিয়ে বলে, আরও অল্প সময় সাইকেল চালিয়ে বাসস্টপে পৌঁছার ডিরেকশন।

ডিরেকশন মোতাবেক আমি মোড়ে এসে অরোয়ো বা ড্রাই রিভার বেড থেকে উঠে পড়ে- আরেকটি ঘাস ও পাথরে ভরপুর পায়ে চলার ট্রেইল ধরে মাউন্টেন বাইক চালাই। সামান্য এগিয়ে যেতেই ট্রেইল হয়ে পড়ে শিলাপাথরের টুকরা টাকরায় রীতিমতো বন্ধুর পথ। কোনো কোনো জায়গায় পাথরের কোনা-কানা ভেঙে চুরে এমন শার্প হয়ে আছে যে- তার ওপর পৌরসভা কাঠের প্রশস্ত বাকলা পেতে দিয়েছেন। এগুলোর ওপর দিয়ে সাবধানে প্যাডেল মারতে মারতে চোখের কোণ দিয়ে দেখি- কাউবয়ের বারান্দাওয়ালা হ্যাট ও স্কিনটাইট জিন্সের সঙ্গে চামড়ার হাইবুট পরে এক লোক দুলকিচালে ঘোড়া ছোটাচ্ছে। তার কোমরে গাঁথা রিভলবারে সূর্যালোক পড়ে ঝলাচ্ছে রুপালি ধাতুতে তৈরি বাট। 

এসে পড়ি, আরেকটি প্রশস্ত অরোয়ো বা ড্রাই রিভার বেডের কাছে। এখানে পায়ে চলা ট্রেইলটি পিনিওন গাছের অনেকগুলো কাটা তক্তা দিয়ে তৈরি ব্রিজ উজিয়ে চলে গেছে ওপারে। ব্রিজটি ঘোরানো, অনেকটা স্প্যাইরাল আকৃতির। দেখি- একজন মাউন্টেন বাইক আরোহী দারুণ দক্ষতায় অতিক্রম করে যাচ্ছে স্প্যাইরাল পুলটি। সাইকেল চালিয়ে কাঠের এ ঘুরানো সাঁকোটি অতিক্রম করতে আমি ঠিক কনফিডেন্স পাই না। তাই নেমে মাউন্টেন বাইকটি ব্রিজের তলা দিয়ে ঠেলে ওপারে নিয়ে আসি। ঠিক তখনই ঘোড়া ছুটিয়ে খুরে বালুকা উড়িয়ে অরোয়োতে এসে বল্গা টেনে থামে কাউবয়। অত্যন্ত প্রশস্ত এ অরোয়োর কিনার জুড়ে জন্মেছে অজস্র টাম্বোল উইডের ঝোপ। তাদের আশপাশে ক্যাকটাসের কুঞ্জে কুঞ্জে ঝেপে এসেছে সোনালি, পার্পোল ও কমলালেবু রঙের ফুল। অশ্বারোহি কাউবয় ঘোড়ার পিটে বসে আইপ্যাডে তুলে নিচ্ছে ফোটা ফুলে ভরপুর কণ্টকময় কুঞ্জের আলোকচিত্র। আমি তার দিকে হাত নেড়ে মাউন্টেন বাইকখানা সামলে পুলের নিচ থেকে উঠে পড়ি ফুটট্রেইলে। ঘোড়া হাঁকিয়ে মরু-পাহাড়ের দিকে ফিরে যেতে যেতে কাউবয় ফের ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়।

আরও খানিকটা প্যাডেল মারতেই এসে পড়ি রাজপথে। বাসস্টপ খুঁজে বের করা কোনো সমস্যাই হয় না। দেখি লোহিত বর্ণের ঝাঁ ঝকঝকে একখানা বাস দাঁড়িয়ে আছে ওখানে। বিশাল এ বাসটির পেছনে পথচারিদের বাইসাইকেল রাখার জন্য স্টিলের র্যাক লাগানো আছে। আমি ড্রাইভারের দিকে হাতে ইশারা করতেই র্যাকখানা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নেমে আসে। মাউন্টেন বাইকখানা ওখানে রেখে হুক লাগিয়ে আমি বাসে উঠে পড়ি। ড্রাইভারের সিটের পাশেই টিকিট ডিসপেন্সার। আমি সিটি সেন্টারের কাছাকাছি আমার গন্তব্যের উল্লেখ করলে, ড্রাইভার নিরাসক্তভাবে ডিসপেন্সারে দুটি কোয়ার্টার বা ফিফটি সেন্টস্ ঢুকাতে বলেন। ভাঙতি না থাকাতে আমি তাকে দশ ডলারের একটি নোট দেই; কিন্তু তিনি নোটখানা গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করেন। তার বক্তব্য পরিষ্কার- বাসে চড়তে চাইলে তোমার হাতে অবশ্যই থাকতে হবে ভাঙতি কয়েনের সঠিক চেঞ্জ। 

ফ্যাঁকড়ায় পড়ে বিরক্ত হয়ে এদিক-ওদিকে তাকাই। খানিক দূরে বেতের বাস্কেটে তুলতুলে কম্বলে শিশুকে মুড়ে বসেছেন বেজায় ভারভারিক্কি পৃথুলা এক মহিলা। চোখাচুখি হতেই তিনি মিষ্টি করে হেসে তার পার্সে কিছু খুলিবিলি করেন। তার পাশে দাঁড়িয়ে মাথায় গোলাপি টোপর পরা একটি পাঁচ-ছয় বছর বয়সের ছোট্ট মেয়ে ললিপপ চুষছে। টিকিট কেনার কোনো বুদ্ধি বের করতে না পেরে ভাবছি- তবে কী বাস থেকে নেমে যেতে হবে? কিন্তু রোজের বাড়ি সিটি সেন্টার পেরিয়ে বেশ দূরে। অতদূর প্যাডেল মেরে যাওয়ার মতো এনার্জিও আমার নেই। ঠিক তখনই স্রেফ কপাল জোরে সমস্যাটির সমাধান হয়ে যায়। ললিপপ চোষা ছোট্ট মেয়েটি এগিয়ে এসে আমার হাতে তুলে দেয়, দুই কোয়ার্টারের দুটি ঝকঝকে রুপালি কয়েন। আমি টিকিট ডিসপেন্সারের ছিদ্রে কোয়ার্টার দুটি ফেলতেই ড্রাইভার ‘হিয়ার ইউ গো, উই আর অল সেট’ বলে বাস স্টার্ট দেন।

আমি ছাদের ঝুলন্ত আংটা ধরে ব্যালেন্স রক্ষা করে বসে পড়ি শিশুসহ পৃথুলা রলিপলি গোছের নারীর উল্টা দিকে। বসেই তাঁকে থ্যাংকয়্যু বলতে গেলে মহিলা তাঁর ফোলা-ফোলা করতলে মাছি তাড়ানোর ভঙি করে মৃদু হেসে মন্তব্য করেন,‘ তোমার মাথার ঝাকড়া চুল তো দেখি বেশ ঢেউ খেলানো। তা আসা হচ্ছে কোথা থেকে?’ আমি জবাবে ‘বাংলাদেশ’ বললে তিনি বিব্রত হয়ে বলেন, ‘আই হোপ বাংলাদেশ ইজ নট ইন আফ্রিকা।’ বলেই লজ্জা পেয়ে জানান, ‘লিসেন, স্কুলে আমি জিওগ্রাফি পরীক্ষায় কখনো পাস করতে পারিনি। বাংলাদেশ কোথায় এ সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই নেই, স্যারি অ্যাবাউট দিস।’ কথা বলতে বলতে একটু হাঁপিয়ে ওঠে মহিলা তাঁর পার্স থেকে অ্যাজমা রোগের প্রতিশেধক ছোট্ট নেবুলাইজার বের করে মুখে শট্ নিয়ে হাঁসফাস করেন। এ সুযোগে আমি তাঁকে নজর করে দেখি। পূর্ণিমার চাঁদের মতো বেজায় গোলাগাল মুখমণ্ডল ও কালচে-বাদামি গাত্রবর্ণের জন্য তিনি যে নেটিভ আমেরিকান বা রেড ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়ের মানুষ এ নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকে না। ওজনের দিক থেকে ভীষণ ভারী দেহের অধিকারি এ নারীর ঝাঁকার মতো ছড়ানো চুলে গাঁথা তিনটি ঝলমলে ফড়িং। তাঁর গলায় ঝুলানো নেকলেসটিও অভিনব। মনে হয়, কোনো গাছের সরু নরোম ডাল বাঁকিয়ে হৃৎপিণ্ডের আকৃতিতে তা তৈরি করা হয়েছে। ডালের ফ্রেমের ভেতর এক ধরনের ক্যাকটাসের পাতা থেকে আহরণ করা সুতলি দিয়ে বোনা মাকড়শার জাল। মহিলা শ্বাস-প্রশ্বাসের তোড় সামলিয়ে আবার হাসি মুখে তাকালে আমি জানতে চাই, ‘আপনার ফিফটি সেন্টস্ কীভাবে রিপে করব, ম্যাম?’ রহস্যময় হাসি হেসে তিনি জবাব দেন, ‘আমি বাংলাদেশে বেড়াতে গেলে তুমি আমাকে ডেজার্ট বা মিষ্টি কোনো খাবার কিনে দিলেই হবে। আমি মিষ্টি খেতে কী যে ভালোবাসি, রিয়েলি লাভ ইটিং সামথিং সুপার সুইট’। তারপর তিনি আলটপকা জিজ্ঞেস করে বসেন, ‘আর ইউ ম্যারিড বাই এনি চান্স?’ আমি অস্ফুটে ‘ইয়াপ’ আওয়াজ দিয়ে সম্মতিসূচকভাবে মাথা নাড়লে, তিনি ‘টু ব্যাড, সাচ অ্যা হ্যান্ডসাম গাই উইথ ব্ল্যাকি হেয়ার অলরেডি টেকেন বাই এনাদার ওয়োম্যান, স্যাড,’ বলে কপট হতাশা প্রকাশ করেন। তখন বেতের বাস্কেটে কম্বল মুড়ি দিয়ে শোয়া শিশুটি জোরেসোরে কেঁদে ওঠে। মহিলা তাঁর পার্স থেকে বের করেন ছোট্ট একটি রিমোট। তা টিপতেই তাঁর চুলের বিশাল স্তূপ ছেড়ে ফ্লাই করে তিনটি রঙিন ফড়িং। বুঝতে পারি, পতঙ্গ তিনটি সূক্ষ্ম সুতলি দিয়ে তাঁর চুলের ক্লিপের সঙ্গে আটকানো। ফড়িংগুলো বাচ্চার বাস্কেটের ওপর উড়ে উড়ে মৃদু গুঞ্জন ছড়ায়। আর তিফিল শিশুটি কম্বলের ভেতর নড়ে-চড়ে, পা ছুড়ে, হাত বাড়িয়ে হুলুস্থুল বাঁধিয়ে দেয়।

বাস একটি স্টপে থামে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে মনে হয়, গাড়িটি সমতল ছেড়ে ওঠে এসেছে পাহাড়ি এক টিলা-টক্করের ওপর। মেক্সিকোর মারিয়াচি সিঙ্গারদের স্টাইলে তৈরি একটি ঢোলাঢালা শার্ট পরে গাড়িতে ওঠে আসেন হ্যাট পরা এক প্রৌঢ়। বাস এ স্টপে বেশ খানিকটা সময় স্রেফ দাঁড়িয়ে থাকে। বিশাল জানালা থেকে পাশাপাশি একটি পাহাড়ের ঢালে গড়ে ওঠা আবাসিক এলাকার দিকে তাকিয়ে কেন জানি মনে হয়, এ শহরে বছর খানেক সময় বাস করতে পারলে দারুণ হয়। ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারি- বাস এখানে আরও মিনিট পাঁচেক দাঁড়াবে। তো আমি বাইরে বেরিয়ে আসি খোলা হাওয়ায়। সড়কের কিনার থেকে পাহাড়ের আবাসিক এলাকার পারফেক্ট ভিউ পাওয়া যায়। আমি সেলফোনে স্ন্যাপশট নিতে নিতে মুগ্ধ হয়ে দেখি- হাল্কা হলুদাভ-গোলাপি রঙের কাদামাটিতে লেপাপুছা অ্যাডোবি হাউস বলে পরিচিত দালানকোঠার সরণিতে বেশ কিছু গাছপালা, তাতে ঝলসে যাচ্ছে হাই-ডেজার্টের তীব্র সূর্যালোক।

মাউন্টেন বাইকে রক-ফর্মেশনের দিকে


আমি বাসে ফের উঠে বসতেই গাড়িটি স্টার্ট নেয়। পথের দু’পাশে নানাবিধ শিল্পসম্ভারে সজ্জিত একের পর এক আর্ট গ্যালারি। গাড়ি ট্র্যাফিক সিগনালে লালবাতির সামনে দাঁড়ালে দেখি, রোদচশমা পরা এক পর্যটক তরুণী একটি আর্ট গ্যালারির সামনে বোঝা বওয়া গাঁধার ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে তার বয়ফ্রেন্ডের ক্যামেরায় পোজ দিচ্ছে। সবুজ বাতি জ্বলতেই বাস ফের চালু হয়, আর খেয়াল করি, ললিপপ চোষা ছোট্ট মেয়েটি একটি সিটের আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে ইশারায় আমাকে কী যেন বলে। আন্দাজ করি, সে আমাকে লুকোচুরি খেলায় শরিক হতে বলছে। তাঁর মা হাত তুলে- আমাকে বিরক্ত না করার জন্য তাকে নির্দেশ দেন। তাঁর ভাষার সঙ্গে ইংরেজি বা এসপানিওলের কোনো মিল নেই। তো আমি মহিলাকে ‘এক্সিউজ মি’ বলে জানতে চাই, ‘আপনি কী নেটিভ আমেরিকানদের আনাসাজি গোত্রের মানুষ?’ তিনি জবাব দেন,‘লেট মি এক্সপ্লেইন টু ইউ...। আমাদের ভাষায় আনাসাজি শব্দের অর্থ হচ্ছে এনসিয়েন্ট পিপুল, এ এলাকার তাবৎ নেটিভ আমেরিকানদের পূর্বপুরুষরা আনাসাজি বলে পরিচিত।’ আমি এবার জানতে চাই, ‘আপনি যে ভাষায় কথা বললেন, তা কী হোপি ইন্ডিয়ান, ম্যাম?’ তিনি ‘ইউ আর অ্যা ভেরি কিউরিয়াস গাই’ মন্তব্য করে ফের বলেন, ‘আই অ্যাম নট অ্যা হোপি, আমার গোত্রের নাম নাভাহো। নেটিভ আমেরিকানদের মধ্যে আমরাই হচ্ছি সবচেয়ে বড় সম্প্রদায়।’ আমি আলোচনাকে আরেকটু দীর্ঘায়িত করার উদ্দেশ্যে বলি, ‘স্যারি, আপনাকে আরেকটু বিরক্ত করবো, নাভাহো ভাষায় থ্যাংকয়ু বলে কীভাবে?’ তিনি জবাব দেন,‘ থ্যাংকয়ু শব্দটি শেখার আগে তোমার শেখা উচিত- হাউ টু সে হ্যালো। লিসেন, ইয়াটেহ হচ্ছে নাভাহো ভাষায় হ্যালো আর থ্যাংকয়ু হচ্ছে আহিহি।’ 

গাধার ভাস্কর্যের সামনে পোজ দেয়া তরুণী


আমি আলোচনার সূত্র ধরে মন্তব্য করি, ‘নাভাহো কালচার সম্পর্কে জানতে আমার দারুণ আগ্রহ।’ তিনি প্রতিক্রিয়ায় জানান, ‘টেল মি হোয়াট আসপেক্ট অব আওয়ার কালচার ইন্টারেস্ট ইউ।’ আমি জবাব দেই, ‘ঠিক জানি না, তবে নাভাহো গোত্রের কোনো আচার-অনুষ্ঠান বা রিচ্যুয়েলে হাজির হয়ে তা পর্যবেক্ষণ করতে চাই। অনুমতি নিয়ে কোনো রিচ্যুয়েলে উপস্থিত হওয়া যাবে কী?’ একটু সময় নিয়ে মহিলা কী যেন ভেবে অতঃপর বলেন, ‘একটি পার্সোনাল রিচ্যুয়েল অনুষ্ঠিত হবে আগামী সপ্তাহের শেষ দিকে। আমি চেষ্টা করে দেখবো আমাদের ট্রাইভাল চিফের অনুমতি পাওয়া যায় কি না, তুমি আসতে চাও কী?’ আমি তুমুল উৎসাহের সঙ্গে বলি, ‘ওয়ান্ডারফুল, দ্যাট উড বি সাচ অ্যা কুল এক্সপিরিয়েন্স, ম্যাম; কিন্তু রিচ্যুয়েলটা কিসের সে সম্পর্কে কাইন্ডলি যদি একটু আগাম ধারণা দেন।’ মহিলা লজ্জায় রক্তিম হয়ে বলেন,‘আচারটা হতে যাচ্ছে আমার শিশু দুটির বাবার একটি আচরণ নিয়ে। মাস সাতেক আগে সে আমাকে ছেড়ে সান্তা-ফে শহরে এক হোয়াইট উয়োম্যানের সঙ্গে বসবাস করতে শুরু করে; কিছু দিন আগে দ্যাট সোকল্ড হোয়াইট উয়োম্যান তাকে দাগা দিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার দিকে চলে গেছে। এখন আমার হাসবেন্ড ফিরে আসতে চাচ্ছে আমার কাছে; কিন্তু চাইলেই তো আর হুট ফিরে আসা যায় না, আমাদের গোত্রে সংসার করতে হলে কিছু স্ট্রিক্ট নিয়ম-কানুন মানতে হয়। তাকে একটি আচারের ভেতর দিয়ে পরিশুদ্ধ হয়ে ফিরে আসতে হবে নাভাহো সম্প্রদায়ে। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করবেন আমাদের গ্রামের শ্যামান বা পুরহিত।’ 

আমি এবার খুব পোলাইটলি মাথা ঝুঁকিয়ে তাঁকে বাও করে বলি, ‘আমাকে এ আচারানুষ্ঠানে স্রেফ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার অনুমতি দিলে সত্যিই খুব সম্মানিত বোধ করব।’ তিনি তাঁর সেলফোনে আমার নাম্বারটি নিয়ে মিসকল দিতে দিতে বলেন, ‘এখনই ডেফিনেটিভলি কোনো কথা দিতে পারছি না, আমি ট্র্রাইভাল চিফ ও আমাদের শ্যামানের সঙ্গে কথা বলবো, যদি অনুমতি পাই তোমাকে রিং করে জানাব।’ বাস এসে থামে রেল ইয়ার্ড বলে একটি পুরানো রেলওয়ে স্টেশনের কাছে। ওখানকার প্ল্যাটফর্মের কাছে অনেক বছর আগে তৈরি একটি পানির ট্যাংকিকে খুব পিকচারাস্ক দেখায়। আমি জানালা দিয়ে তার ছবি তুলতে গেলে দেখি- মহিলা বাচ্চা দুটিকে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। আমি নাভাহো ভাষায় ‘আহিহি’ বা থ্যাংকু বললে তিনি হেসে ‘তোমার দেশে গেলে মিষ্টি কিনে খাওয়াতে হবে কিন্তু’, বলেই বাস থেকে নেমে যান।

সুরমা রঙের দুটি বিশাল মনুষ্যমূতি


বাস আরও একটু সময় থামে। আমি জানালা দিয়ে ওয়াটার ট্যাংকির তলা দিয়ে দুটি শিশু-সন্তান নিয়ে হেঁটে যাওয়া মহিলাকে দেখি। তাঁর আচার-আচরণে এমন একটি কোয়ালিটি আছে যে, অতি সহজেই তিনি অচেনা মানুষকে আপন করে নিতে পারেন। আমন্ত্রিত হয়ে নাভাহো পল্লীতে যেতে পারলে জানা যাবে, কীভাবে গৃহত্যাগী স্বামীকে নাভাহোরা আবার তার আদি সংসারে ফিরিয়ে নেয়। বাস আবার চলতে শুরু করে সুগন্ধী সেইজ বুশে সমাচ্ছন্ন বাদামিতে ধুসর মেশা একটি প্রান্তরের ভেতর দিয়ে। ঘাড় বাঁকাতেই দেখি, মেক্সিকান কেতার হ্যাট পরা মানুষটি পত্রিকা সরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। চোখাচুখি হতেই তিনি হাসিমুখে এসপানিয়লে বলেন, ‘ওলা সিনিওর, কে তাল? বা কেমন চলছে মিস্টার।’ আমি জবাব দিতে গিয়ে হাত বাড়িয়ে করমর্দন করে তাঁর সঙ্গে পরিচিত হই। প্রৌঢ় এ ভদ্রলোকের ঘড়ির স্টেনলেস স্টিল ও আংগুলের একাধিক আংটিতে বসানো নীল বর্ণের ফিরোজা পাথর। একটি কান থেকে ঝুলছে একই ধরনের পাথরের ঝুমকো পাশা। ইনি মেক্সিকো থেকে আগত অভিবাসী। প্লাজা ব্লাংকা বলে একটি আবাসিক এলাকায় ইনি প্রতিদিন ভোরে সরবরাহ করেন দৈনিক সংবাদপত্র। কথা-বার্তায় জানতে পারি যে- প্লাজা ব্লাংকায় বিত্তশালী আমেরিকানরা রিটায়ার করে অবসর জীবন কাটাচ্ছে। এদের অনেকেই কম্পিউটার স্ক্রিনে অনলাইন নিউজপেপার পড়াটা পছন্দ করেন না। আমি রোজ নিউমি’র কটেজের এডরেস দেখিয়ে জানতে চাই, তিনি ওই এলাকাটি চিনেন কী না, ঠিক কোথায় বাস থেকে নামতে হবে? আরও মিনিট দশেক অপেক্ষা করতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন, ‘যে এলাকায় তুমি যাচ্ছ ওসব তো খুব এক্সপেনসিভ রেসিডেনসিয়াল এরিয়া, নো সে পোয়েডে এনকনটরর ভিভিয়েনডা বারাতা, বা ওখানে তো সস্তায় তুমি বাসা ভাড়া করতে পারবে না।’ আমি এবার জানতে চাই,‘ কোথায় সস্তা ঘর ভাড়া পাওয়া যায় সিনিওর।’ তিনি জবাব দেন,‘শহরের দরিদ্র মেক্সিকান ইমিগ্র্যান্টসরা বাস করে এয়ারপোর্টের কাছাকাছি। ওদিকে আছে অনেক মোবাইল হোম। চাইলে তুমি ওখানে সহজেই এক কামরা ভাড়া করতে পারবে।’ 

বাস এখন সিটি সেন্টারের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। স্ট্রিটকর্নারে দাঁড় করানো চমৎকার একটি ঘড়ি, তাতে আমি সময় দেখি-দশটা পনেরোর মতো বাজে। বাস সান্তা-ফে জাদুঘরের স্টপেজে থামে। লালচে কাদামাটিতে তৈরি মিউজিয়ামের দালানটিকে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালির রাজধানী বামাকো শহরের সাবেক শাসক আফ্রিকান এক চিফের বাসভবনের মতো দেখায়। প্রৌঢ় সিনিওর বিজনেস কার্ড হোল্ডারের সিলভারে তৈরি কৌটা থেকে বের করে আমার দিকে একটি কার্ড বাড়িয়ে দিতে দিতে বলেন,‘তোমার চুল কাটার দরকার হলে আমার সেলুনে চলে এসো। সকাল এগারোটা থেকে বিকেল ৩টা অবধি আমি চুল কাটি। পরিচিত হিসেবে তোমাকে পঁচিশ পার্সেন্ট ডিসকাউন্ট দেবো।’ আমি নরসুন্দরের সেলুনের কার্ডটি পকেটে পুরে তাঁকে বলি, ‘গ্রাসিয়াস বা ধন্যবাদ।’

কাঠের স্প্যাইরাল ব্রিজে মাউন্টেন বাইক


বাস এসে থামে পরবর্তী স্টপে। জানালা থেকে সান্তা-ফে শহরের চকমিলান ক্যাথিড্রালটি পরিষ্কার দেখা যায়। প্রৌঢ় সিনিওর আমাকে পরের স্টপে নেমে যাওয়ার উপদেশ দিয়ে নেমে যেতে যেতে ঘাড় ঘুরিয়ে সহমর্মীতার সুরে বলেন, ‘সি উস্তেদ এসতা বুসকানদো উন ট্রাবাহো, ভায়া আ এসতো ইগলেসিয়া, বা তোমার যদি চাকরি খোঁজার দরকার হয় মিস্টার, তাহলে এই ক্যাথিড্রালে যেতে পারো। এখানে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা দরিদ্র বেকারদের চাকরি-বাকরি পেতে সাহায্য করে থাকে।’ সিনিওর নেমে যাওয়ার খানিক পর বাস আবার স্টার্ট দেয়। আমি জানালা দিয়ে ফের সুদর্শন ক্যাথিড্রালটির দিকে তাকাই। দেখি, উপাসনালয়ের চত্বরে ঢুকে জননী মরিওমের একটি আইকনের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে, সিনিওর গলা থেকে ক্রুুশ ঝুলানো লকেটটি খুলে নিয়ে, তা তাঁর মাথায় রেখে চোখ মুদে প্রার্থনা করছেন। বাস আরেকটু এগিয়ে গেলে তাঁর প্রার্থনারত ইমেজটি অপসৃত হয় দ্রুত।

বাস এবার শহর ছাড়িয়ে একটি জল ঝরঝর ছড়া-নদীর পাশ দিয়ে আগুয়ান হচ্ছে। এখান থেকে দূরের গাছপালাহীন পাহাড়ের পরিষ্কার ভিউ পাওয়া যায়। প্যাসেনজার নামাতে বাসটি থামলে, জানালা দিয়ে দেখি, দূর পাহাড়ের প্রেক্ষাপটে বসানো সুরমা রঙের দুটি বিশাল মনুষ্যমূর্তি। এ ভাস্কর্যে ফুটিয়ে তোলা মানুষ দু’জনের চেহারা-সুরত ও আলোয়ানের মতো জড়িয়ে পরা লেবাসাদি দেখে ধারণা করি, এরা কোনো নেটিভ আমেরিকান গ্রোত্রের সমাজপতি। তাদের মুখের চিন্তা ও বিষাদ মেশানো অভিব্যক্তি নিয়ে আমি ভাবি। আর বাসটি ধীরগতিতে মূর্তির বাঁধানো প্ল্যাটফর্ম অর্ধচক্রাকারে ঘুরে অগ্রসর হয় সামনের দিকে।   

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh