হুমকিতে পড়তে পারে খাদ্য নিরাপত্তা

বাজেটে উপেক্ষিত কৃষি ও মৎস্য খাত

এম এইচ রশিদ

প্রকাশ: ১৪ জুন ২০২১, ০৮:৫৮ এএম | আপডেট: ১৪ জুন ২০২১, ০৯:০৫ এএম

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

দেশে আনুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে কৃষি ও মৎস্য খাতের অবদান কম। হিসাব-নিকাশের এই অর্থনীতি বাদ দিলে দেশের সিংহভাগ মানুষের কর্মসংস্থান কৃষি ও মৎস্যখাতেই। করোনাভাইরাসের সংক্রমণে মূলধারার অর্থনীতি বেকায়দায় পড়লেও গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা ছিল। 

কৃষি উৎপাদন স্বাভাবিক থাকায় এখনো বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েনি বাংলাদেশ; কিন্তু জিডিপির হিসাবে কৃষি ও মৎস্য অংশ কম থাকায় বরাবরই নীতিনির্ধারকদের কাছে এই দুই খাত অবহেলিত থেকেছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মধ্যে বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা, অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির চাকা সচল করা এবং খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে কৃষি খাতকে গতানুগতিক বাজেটের তুলনায় বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে এমনটি প্রত্যাশা করা হয়েছিল; কিন্তু বাজেটে তার প্রতিফলন ঘটেনি। বরাবরের মতো শুধু শিল্প খাতকেই প্রাধান্য দিয়ে বাজেটে নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। 

প্রস্তাবিত ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ এবং খাদ্যনিরাপত্তা খাতে ২৪ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ২৪ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা। অর্থাৎ দেশের কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বেড়েছে মাত্র ১ দশমিক শূন্য শতাংশ।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে নানা ধরনের সংকট সৃষ্টি হয়েছে; কিন্তু বাজেটে বহুমুখী সংকটকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। করোনার ছোবলে বিপুলসংখ্যক মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন, তাদের বিষয়ে কোনো আলোচনাই নেই বাজেটে। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মের জন্য প্রচলিত কৃষি ও মৎস্য খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এবং এই খাতের আরও আধুনিকীকরণ করে গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা সম্ভব; কিন্তু বাজেটে গতানুগতিকভাবে কম বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কৃষি ও মৎস্য খাতের কারণে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে; কিন্তু এই খাতের প্রতি ধারাবাহিক অবহেলার কারণে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে। কৃষি ও মৎস্য খাতের উন্নয়নে এবং বাজার ব্যবস্থা কৃষকবান্ধব করতে বাজেটে বরাদ্দ রাখার প্রয়োজন ছিল। 

করোনায় কৃষি খাতের ক্ষতি 

করোনাভাইরাসের সংক্রমণে কৃষিখাতে ক্ষতির বিষয়ে ব্র্যাকের গত বছরের জুনভিত্তিক এক জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, দেড় মাসেই কৃষকের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৫৬ হাজার কোটি টাকারও বেশি। লকডাউনকালীন পণ্য বিপণন ব্যবস্থা ভেঙে পড়া, ন্যায্যমূল্য না পাওয়াসহ নানা সংকটে পড়ে দেশের কৃষি খাত। যে কোনো দুর্যোগ কিংবা সংকটে খাদ্য চাহিদা পূরণে মানুষের পাশে ছিল কৃষক। 

করোনা সংক্রমণেও মাঠে ফসল ফলাতে ব্যস্ত ছিলেন তারা। তবে করোনার ধাক্কা লেগেছে এই খাতেও। মাঠভর্তি ফসল থাকলেও লকডাউনে বিপণন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় ন্যায্য মূল্য বঞ্চিত হয়েছেন কৃষক; কিছু কিছু ক্ষেত্রে মাঠেই নষ্ট হয়েছে উৎপাদিত পণ্য।

করোনায় মৎস্য খাতের ক্ষতি 

বিজনেস কনসালট্যান্ট প্রতিষ্ঠান লারিভ ইন্টারন্যাশনাল ও লাইটক্যাসল পার্টনার্সের যৌথ সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে মৎস্য চাষে ব্যাপক সাফল্য সত্ত্বেও চলমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে মাছের খাবারের বাড়তি মূল্য মারাত্মক সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে। কারণ করোনা পরিস্থিতিতে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা আগের চেয়ে কমে গেছে। ফলে চাষিরা কম দামে মাছ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। আর এর প্রভাবে মাছ চাষিদের লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে।

৬৪ শতাংশ কৃষক জানিয়েছেন, করোনা পরিস্থিতিতে যান চলাচল স্বাভাবিক না থাকায় দূরত্বের স্থানগুলোতে খামারীদের মাঝে মাছের খাবার, মৎস্যজাত দ্রব্য ও পোনা সরবরাহে জটিলতা দেখা দিয়েছে। এর ফলে ব্যাহত হচ্ছে মৎস্য উৎপাদন। আবার মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় তা বাজারে কমমূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। তদুপরি এই পরিস্থিতিতে মাছের খাবারের দাম মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়ে গেছে। এতে উৎপাদন খরচ আগের চেয়ে বহুগুণ বেড়েছে।

কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. এম এ সাত্তার ম-ল বলেন, ভেঙেপড়া কৃষিখাত শক্তিশালী করতে কৃষির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত সার, বীজ ও পরিবহন খাতের দিকেও নজর প্রয়োজন। এই ব্যাপারে যে ধরনের আনুষ্ঠানিকতা রয়েছে; বরাদ্দের প্রয়োজন রয়েছে- সেক্ষেত্রে সহায়তা দেওয়া উচিত।

প্রস্তাবিত বাজেটে যা আছে  

আগামী অর্থবছরে ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাড়িয়ে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রয়েছে ৮ হাজার ৫৯৯ কোটি টাকা। যদিও চলতি অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ভর্তুকি ও প্রণোদনার পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ৫০১ কোটি টাকা। বাজেটের আকার যেভাবে বেড়েছে প্রণোদনা ও ভর্তুকি সেই হারে বাড়ানো হয়নি। 

এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বলেন, কৃষি খামার যান্ত্রিকীকরণে ৩ হাজার ১৯৮ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। একইসঙ্গে কৃষিতে ভর্তুকি বাবদ সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। কৃষি ও কৃষিসংশ্লিষ্ট উৎপাদন ও সেবা, ক্ষুদ্র ব্যবসা, ক্ষুদ ও কুটির শিল্প ইত্যাদি খাতে গ্রামের দরিদ্র কৃষক, বিদেশফেরত প্রবাসী শ্রমিক এবং প্রশিক্ষিত তরুণ ও বেকার যুবাদের গ্রামীণ এলাকায় ব্যবসা ও আত্মকর্মসংস্থানমূলক কাজে ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকার স্বল্প সুদে ঋণ বিতরণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রাম প্রধান বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির একমাত্র অবলম্বন কৃষি ও মৎস্য খাত। বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবন ও জীবিকা রক্ষার এই খাত চিহ্নিত কিছু সমস্যায় ধুঁকছে বহুদিন ধরে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষিখাতের যে সংকট সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছিলেন স্বাধীনতার ৫০ বছরের সেই সংকটেই ভুগছেন কৃষকরা। কৃষি বা শস্য বীমা নিয়ে কোনো সমাধান আজ পর্যন্ত হয়নি। মাঝে মধ্যে বাজেটে বক্তৃতায় এই নিয়ে দুয়েকবার কথা হলেও নতুন প্রস্তাবিত বাজেটে এ প্রসঙ্গে কোনো আলোচনা করা হয়নি। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কৃষক ও মৎস্যজীবীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। এ খাতে তাদের জন্য কোনো বরাদ্দ নেই। বাজার ব্যবস্থা মধ্যস্বত্বভোগীদের দখলে। কৃষকরা উৎপাদন খরচের তুলনায় কম দামে ব্যবসায়ীদের কাছে পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হন। অথচ সারাদেশের মানুষ বাজার থেকে বেশি দামে কৃষি পণ্য কিনছেন। বাজার ব্যবস্থা শক্তিশালী করার কথা বহু বছর ধরে বলা হলেও এ বছরেরর বাজেটেও কোনো প্রস্তাবনা নেই।

কৃষকদের জন্য প্রতি বছর সামান্য ঋণের ব্যবস্থা করা হয়; কিন্তু ব্যাংকিং ব্যবস্থার জটিলতার কারণে প্রকৃত কৃষক ও জেলেরা এই ঋণ সুবিধা পান না। প্রস্তাবিত বাজেটে খাদ্যশস্যের বাজারদর নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সিটি করপোরেশন, জেলা সদর ও পৌরসভাসহ প্রায় ২২৭টি স্থানে ওএমএস কার্যক্রমের মাধ্যমে চাল ও আটা বিতরণের কথা বলা হয়েছে। বোরো ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য অতিরিক্ত প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো হাইব্রিড ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ২০ লাখ ৫৫ হাজার টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এসব গতানুগতিক লক্ষ্যমাত্রা প্রতিবছরই থাকে; কিন্তু কৃষক পর্যায়ে তা অর্জিত হয় না। 

দেশে সরকারি পর্যায়ে খাদ্যশস্য সংরক্ষণের বিদ্যমান ধারণ ক্ষমতা প্রায় ২১ লাখ ৮০ হাজার টনে উন্নীত হয়েছে। বর্তমানে আরও প্রায় ছয় লাখ টন ধারণক্ষমতার আধুনিক খাদ্যগুদাম নির্মাণের লক্ষ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে বলে বাজেট বক্তৃতায় উল্লেখ করা হয়েছে। 

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এর নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে দেশে জীবন ও জীবিকার বাস্তব চিত্রের প্রতিফলন ঘটেনি। করোনায় সব মানুষের কর্মসংস্থান ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য কৃষকদের জন্য শুধু ঋণ দেওয়াই যথেষ্ট নয়। আরও কিছু উদ্যোগ নিতে হবে। কৃষি উপকরণের অভ্যন্তরীণ বাজার ও সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। সেক্ষেত্রে শুধু ঋণ দিয়ে সংকট সমাধান করা যাবে না। এজন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে কৃষি উপকরণের সরবরাহ ব্যবস্থাটা সচল রাখার উদ্যোগ নিতে হবে। কৃষকরা দেখা যাবে টাকা পাবে; কিন্তু সেটা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারবে না। যেহেতু ফসল নির্দিষ্ট সময়ের ওপর নির্ভরশীল তাই ভেঙে পড়া সরবরাহ ব্যবস্থাকে দ্রুত স্বাভাবিক করতে হবে। 

ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিক্সের উদ্যোক্তা অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মুহম্মদ মাহবুব আলী বলেন, কৃষিকে বাদ দিয়ে অর্থনৈতিক কোন পরিকল্পনা সফল হবে না। বিপুল মানুষের কর্মসংস্থান ও জনবহুল দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য কৃষিখাতকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলার জন্য গ্রামের উদ্যোক্তা সৃষ্টি করতে হবে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh