বড় চ্যালেঞ্জ রাজস্বে লক্ষ্যমাত্রা আদায়

এ আর সুমন

প্রকাশ: ১৫ জুন ২০২১, ০৯:৩৫ এএম

বাজেট ঘাটতি, রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে

বাজেট ঘাটতি, রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে

প্রতিবারের মতো এবারো ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে বিভিন্ন খাতে কোথাও দাম বাড়ানো-কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে এবারের বাজেটে সবচেয়ে বেশি যেসব বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে, তার মধ্যে রয়েছে বাজেট ঘাটতি, রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা। 

বাজেট ঘোষণার পরই দেশের বিভিন্ন অর্থনৈতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়ী সংগঠন এসব বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। যে প্রতিক্রিয়া আসন্ন বাজেটের চ্যালেঞ্জ ও দুর্বল দিকগুলো উপস্থাপনা করেছে। 

প্রতিবারের মতো এবারো বাজেট-পরবর্তী প্রতিক্রিয়া সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। তারা বলছে- প্রস্তাবিত ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে অনুদান বাদ দিলে ঘাটতির পরিমাণ ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৬ দশমিক ২ শতাংশ। বিশাল এ ঘাটতির অর্থ সংস্থান নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে গবেষণা এ প্রতিষ্ঠানটি। 

গত ৩ জুন প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণার পরদিনই অর্থাৎ ৪ জুন রাজধানীর একটি হোটেলে প্রস্তাবিত ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট নিয়ে সিপিডির পর্যালোচনায় এই আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। যেখানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। 

তিনি বলেন, বাজেট ঘাটতির অর্থ কোথা থেকে আসবে সেটা বড় প্রশ্ন। বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৬ দশমিক ২ শতাংশ ধরা হয়েছে। বৈদেশিক উৎস থেকে বাজেট ঘাটতি পূরণের বিষয়টি ইতিবাচক দিক। এটা আকাক্ষিত। তবে ২০২০-২১ অর্থবছরের ১০ মাসের গতি-প্রকৃতি পর্যালোচনা করে পুরো অর্থবছর কেমন হতে যাচ্ছে, সে বিষয়টি পর্যালোচনা করে সামষ্টিক অর্থনীতির ক্ষেত্র ঠিক করা হয়নি। আমরা এখানে দুর্বল অবস্থায় রয়েছি। 

তিনি আরও উল্লেখ করেন, রাজস্ব আহরণের বিষয়ে বাজেটে বলা হয়েছে, আগামী অর্থবছরে চলতি সংশোধিত বাজেটের তুলনায় রাজস্ব আহরণ ১০ দশমিক ৭ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। ঘাটতি বাজেটের অর্থায়ন রাজস্ব আদায়ের মাধ্যমে কতটুকু সম্ভব হবে, সে বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ আছে। তবে সিপিডি বাজেট পর্যালোচনায় দেখতে পায় রাজস্ব আহরণ ৩০ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা সম্ভব। বাজেটে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৯ দশমিক ৬ শতাংশ। বলা হচ্ছে, রাজস্ব আদায়ের মাধ্যমে ঘাটতি পূরণ করা হবে। ব্যয় ঠিক করে আয়ের চিন্তাধারা থেকে এনবিআরের ওপর রাজস্ব আদায়ের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়, যা আসলে অর্জন করা সম্ভব হয় না।

বাজেট ঘোষণার দিনই ৩ জুন বিকেলে প্রতিষ্ঠানটির ফেসবুক পেজে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় সিপিডি জানায়, প্রস্তাবিত এ বাজেট দুর্বল এবং এটি বাস্তবায়নে সামনে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে।

ফাহমিদা খাতুন বলেন, জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২০ শতাংশের কথা বলা হয়েছে। এখানে বলা হচ্ছে ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির দেখানো হয়েছে ৬ দশমিক ১০ শতাংশ। আমরা বলছি- অর্থনীতির অন্যান্য যেসব সূচক দেখা যাচ্ছে, সেই সূচকের পরিপ্রেক্ষিতে এটা একটু বেশি। এটা বাস্তবায়নের সম্ভাবনা খুব কম। লো বেঞ্চমার্ক থেকে এই যে ৭ শতাংশের ওপরে প্রবৃদ্ধি হবে, এটা আসলে বাস্তবোচিত না এবং পূরণ হবে না। 

সিপিডি তাদের বাজেট প্রতিক্রিয়ায় আরও বলেছে, প্রস্তাবিত বাজেটে আয়করের সীমা ওপরের দিকে বাড়ানো হয়নি। একইভাবে নিচের দিকের সীমা অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। ফলে কর ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। নিচের দিকে আয়করের সীমা আর একটু বাড়ালে ভোগ ব্যয় বাড়ত। তা বিনিয়োগে সহায়তা করতে পারতো। অর্থাৎ পুনরুদ্ধারে সহায়তা করতে পারতো। সরকারি ব্যয়ের বর্ধিত যে বরাদ্দ, এখানে দেখা যাচ্ছে, প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জনপ্রশাসনে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। পাবলিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও একটা বর্ধিত বরাদ্দ দেখা যাচ্ছে। খাতওয়ারি বিষয়ের মধ্যে সবার আগে আসে স্বাস্থ্য খাত। স্বাস্থ্য খাতের মূল বিষয় এখন টিকাদান। করোনা কতদিন থাকবে কেউ জানে না। করোনা থেকে মুক্তি না পেলে অর্থনীতিতে চাঞ্চল্য ফিরে আসবে না। সেজন্য টিকাদান কর্মসূচি সবার জন্য, যারা যোগ্য সবাইকে টিকা দিতে হবে।

এদিকে বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছে ডিসিসিআই। নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটকে জীবন-জীবিকার ভারসাম্য রক্ষায় অন্তর্ভুক্তিমূলক বাজেট বলেছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)। তবে বিশাল বাজেট বাস্তবায়ন অনেকটা চ্যালেঞ্জিং হবে উল্লেখ করে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পুনর্বিবেচনার অনুরোধ করেছে। 

বাজেট ঘোষণার পর ডিসিসিআই এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, ‘এটি একটি ব্যয়বহুল বাজেট, এর মাধ্যমে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, ব্যবসায়ীদের আর্থিক প্রণোদনা, সামাজিক নিরাপত্তা ব্যয় বৃদ্ধি ও জনগণকে করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতি থেকে রক্ষায় বরাদ্দের উদ্যোগ থাকার কারণে জীবন-জীবিকার ভারসাম্য রক্ষায় একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক বাজেট হয়েছে।’ 

এই কঠিন সময়ে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে ঘোষিত জাতীয় বাজেট ২০২১-২২ এ প্রবৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে যথাক্রমে- ৭.২ ও ৫.৩ শতাংশ। এই সময়ে অগ্রগতিমূলক ও অর্জনযোগ্য প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা আশার সঞ্চার করছে বলেও উল্লেখ করেছে ডিসিসিআই। তারা বলছে, ‘যেখানে সারাবিশ্বে জিডিপির প্রবৃদ্ধি নেগেটিভ। তাই এ ধরনের উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে অর্থনীতির সব ক্ষেত্রে উত্তরণ ঘটাতে হবে, যা অনেকাংশে চ্যালেঞ্জিং।’ 

আয়কর ও ভ্যাট হার হ্রাস, গ্রস রিসিট, গবেষণা এবং আমদানি কাঁচামালের ওপর অগ্রিম কর হ্রাস করা, স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বৃদ্ধি ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির সুপারিশ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করায় স্বাগত জানিয়েছে ডিসিসিআই। তবে প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ঘোষিত সরকারি সহায়তা সহজতর উপায়ে ব্যবসায়ীদের দেওয়া গেলে বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় ঘোষিত বাজেট সহায়ক হবে বলে ডিসিসিআই মনে করছে। 

এ অর্থবছরে লিস্টেড ও নন-লিস্টেড কোম্পানির ২.৫ শতাংশ করপোরেট কর কমানোকেও সাধুবাদ জানিয়েছে সংগঠনটি। সিএমএসএমই খাতে আরও বড় আকারের প্রনোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা উচিত বলে মনে করে তারা। ব্যক্তি, শ্রেণি উদ্যোক্তাদের সুবিধা দেওয়ার জন্য টার্নওভার কর হার দশমিক ৫ শতাংশ থেকে দশমিক ২৫ শতাংশ করায় উদ্যোক্তা সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রসংশনীয় উদ্যোগ বলেও মনে করছে ডিসিসিআই।

অন্যদিকে বরাবরের মতো এবারও বাজেট নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি)। অর্থনীতির ওপর করোনা মহামারির অব্যাহত নেতিবাচক প্রভাবের কারণে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা আদায় করা কঠিন হবে বলে মনে করছে আইসিএবি। সেইসঙ্গে ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা চ্যালেঞ্জ হবে বলেও মনে করছে সংস্থাটি। 

আইসিএবির সভাপতি মাহমুদউল হাসান খসরু বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি যে, ডকুমেন্ট ভেরিফিকেশন সিস্টেম (ডিভিএস) বাস্তবায়নে এনবিআর এবং আইসিএবির যৌথ উদ্যোগ লক্ষ্য অনুযায়ী আয় অর্জনে সহায়তা করবে। আমরা আরও বিশ্বাস করি যে, এই উদ্যোগ আর্থিক ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি আনবে।’ 

বাজেটে দক্ষতা বিকাশ, হালকা প্রকৌশল খাতে ছাড়, কৃষিভিত্তিক শিল্পকে ছাড় এবং মেড ইন বাংলাদেশের নতুন ধারণাকে আলোকিত করার মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টির দিকে দৃষ্টি দেওয়ায় সাধুবাদ জানান মাহমুদউল হাসান। তবে চলমান কোভিড-১৯-এর কারণে দারিদ্র্য স্তরের নিচে নেমে আসা মানুষের কথা বিবেচনা করে সামাজিক সুরক্ষা নেটের জন্য বাজেট বরাদ্দ অপ্রতুল বলে মনে করেন তিনি। 

বাজেটে করপোরেট করের হার ২.৫ শতাংশ হ্রাস এবং ওয়ান পারসন কোম্পানির (ওপিসি) ওপর ২৫ শতাংশ কর নির্ধারণ, স্থানীয় শিল্পায়নের জন্য অর্থাৎ বাংলাদেশে তৈরি, মোটর গাড়ি (২০ বছর), গৃহ সরঞ্জাম (১০ বছর), হালকা প্রকৌশলের (১০ বছর) জন্য কর ছাড়ের প্রস্তাব, কমপক্ষে তৃতীয় লিঙ্গের ১০০ মানুষের নিয়োগের ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ করের ছাড়কে সাধুবাদ জানিয়েছে আইসিএবি। 

তবে ফিন্যান্স অ্যাক্টে বিদ্যমান মহামারি পরিস্থিতি বিবেচনা করে স্বতন্ত্র করদাতার বোঝা হ্রাস করা উচিত ছিল বলে মনে করছে তারা। তারা বলছে, বাজেটে উৎসে কর ছাড়ের প্রস্তাবিত বৃদ্ধি পণ্য সরবরাহকারী এবং অবকাঠামো সংস্থার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে।

তবে নতুন বাজেট নিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান, শিল্প সংগঠনের পাশাপাশি মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিভিন্ন অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ। মহামারির বাস্তবতার পাশাপাশি দক্ষতার সংকটের বিষয়গুলো তুলে ধরে নতুন অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়ন নিয়ে বিভিন্ন মহল সংশয় প্রকাশ করলেও অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আশাবাদী। 

তিনি বলেছেন, ‘অতীতের ধারাবাহিকতায় অর্থনীতির শক্তিশালী সূচকগুলোতে ভর করে এবারও বাজেট ‘সফলভাবেই’ বাস্তবায়িত হবে বলে তার বিশ্বাস।’

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh