মেধার শীর্ষে ওঠা ‘সরদার'

বিশেষ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ জুন ২০২১, ১১:৩৪ এএম | আপডেট: ১৫ জুন ২০২১, ০১:২৫ পিএম

সরদার ফজলুল করিম। ফাইল ছবি

সরদার ফজলুল করিম। ফাইল ছবি

দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক সরদার ফজলুল করিমের আজ (১৫ জুন)  মৃত্যুদিন। ২০১৪ সালের এইদিনে ৮৯ বছর বয়সে তিনি ঢাকার শমরিতা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।   

সরদার ফজলুল করিমের জন্ম বরিশালের আটিপাড়া গ্রামে এক দরিদ্র পরিবারে। তার পিতা খবিরউদ্দিন সরদার ছিলেন কৃষক। মা সফুরা বেগম ছিলেন গৃহিনী। প্রতিদিন সকালে পান্তা খেয়ে বাবাকে ফসলের মাঠে সাহায্য করতে লাঙ্গল নিয়ে ছুটতে হতো তাকে। তিনি নিজেই লিখেছিলেন, ‘কৃষকের সন্তানের কোনো ভবিষ্যৎ নেই!’ 

অথচ সেই দরিদ্র  কৃষক পরিবার থেকে উঠে এসে সরদার ফজলুল করিম হয়েছিলেন কালের মনীষী, প্রবাদপ্রতিম শিক্ষক, দেশের সেরা দার্শনিক। তিনি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক, হয়েছিলেন পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সদস্য। 

সরদার ফজলুল করিম গ্রামের এক স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে বরিশাল কলেজ থেকে মাধ্যমিক পাস করেন মেধা তালিকায় স্থান পেয়ে। ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন শাস্ত্রে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান লাভ করেন।

তিনি লিখেছেন, আমার মা-বাবা নিরক্ষর ও একেবারে মাটির মানুষ ছিলেন। তাদের মতো লোকের কথা ছিল না আমাকে স্কুলে পাঠানোর। কিন্তু তারা আমাকে স্কুলে পাঠিয়েছেন। সেজন্য আমি এ মাটির মানুষগুলোর কাছে ঋণী এবং এই দেশের মাটির প্রতি আমার মনের মধ্যে একটা ভক্তি জেগে আছে। 

ছাত্র জীবনেই তিনি সাম্যচিন্তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। পার্টির কাজে সময় দেয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে এক অনিশ্চিত জীবন বেছে নিতে এতটুকু দ্বিধা করেননি। বিদেশে উচ্চ শিক্ষার জন্য বৃত্তি পেয়েও তিনি যাননি পার্টির নির্দেশেই। 

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর কমিউনিস্টদের জন্য তৈরি হয় এক বৈরি সময়। জেল-আত্মগোপন তখন ছিল কমিউনিস্টদের নিত্য সঙ্গী। সরদার ফজলুল করিমও সেই বৃত্তের বাইরে ছিলেন না। গ্রেফতার হয়ে টানা সোয়া পাঁচ বছর কারাগারে থেকে ১৯৫৫ সালের মার্চ মাসে মুক্তি পান। তিনি ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানে সামরিক শাসন জারির আগ পর্যন্ত পাকিস্তান গণ পরিষদের সদস্যও ছিলেন। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসনের সময় গ্রেফতার হয়ে ১৯৬২ সালের ডিসেম্বর মাসে মুক্তি পান। ১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলা একাডেমির সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যক্ষ ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালে কয়েকমাস তাকে কারাগারে থাকতে হয়েছে।

১৯৭২ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়ে ১৯৮৫ সালে অবসরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত অধ্যাপনা করেছেন। তিনি ‘দর্শন কোষ’সহ অনেক বই লিখেছেন। দর্শন বিষয়ক একাধিক বিশ্বমানের গ্রন্থ তিনি অনুবাদ করেছেন। ‘চল্লিশের দশকের ঢাকা'সহ কয়েকটি অসামান্য স্মৃতিকথা লিখেছেন। তিনি বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে বিভিন্ন সমসাময়িক বিষয় নিয়েও নিয়মিত লিখতেন। 

মে দিবসে জন্ম নিয়ে ( জন্ম ১ মে, ১৯২৫) শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির সংগ্রামেই নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। তার পুরোটা জীবন ছিল ত্যাগের। আজীবন শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। একদিকে ব্রত ছিল জ্ঞানের আলো ছড়ানোর, অন্যদিকে সাধারণ শ্রমজীবী, খেটে খাওয়া মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার অবিরাম চেষ্টা। 

ছোটখাটো চেহারার সাধারণ বেশভূষায় তিনি ছিলেন অসাধারণ চিন্তাশীল ও দৃঢ়চেতা একজন মানুষ। যারা তার সান্নিধ্যে এসেছেন তারাই জানেন সরদার ফজলুল করিম লোভ-লালসামুক্ত অথচ চিন্তার জগতে সম্পূর্ণ ঋদ্ধ এক ব্যতিক্রমী মানুষ। ব্যক্তিগত সুখভোগের যেকোনো প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার সাহস তার ছিল।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh