কেন বাড়ছে ছিনতাই

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ জুন ২০২১, ০৯:৪২ পিএম

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

গতকাল বৃহস্পতিবার (১৭ জুন) সন্ধ্যা পৌনে ৭টায় রাজধানীর জিগাতলায় লেকের পাশে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে সাকলাইন আরাফাত (২০) নামে এক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে রাত সাড়ে ৮টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেয়া হয়।

এর আগে গত ৫ মে ভোরে নিজ বাসা থেকে বোনের ছেলের সঙ্গে রিকশায় যাওয়ার সময় মতিঝিল বাস ডিপোর সামনে ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন সুনিতা রাণী দাস।

ছিনতাইকারীরা ছিলেন কারে। তারা কার থেকেই রিকশায় থাকা সুনিতার ভ্যানিটি ব্যাগ ধরে টান দেয়। সুনিতা রিকশা থেকে পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত হন। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

৬ মে সন্ধ্যায় আফতাবনগর এলাকায় ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী আওলাদ হোসেন। তিনি জানান, অফিসে ইফতার শেষে সন্ধ্যা ৭টায় রামপুরা থেকে আফতাবনগরে নিজ বাসায় ফেরার পথে চাপাতি হাতে থাকা ছিনতাইকারীরা তাকে ঘিরে ধরেন। তার কাছ থেকে একটি মোবাইল ফোন এবং ৫ হাজার টাকা নিয়ে পালিয়ে যান ছিনতাইকারীরা।

কেবল সাকলায়েন, সুনিতা রাণী বা আওলাদ হোসেন নন, সম্প্রতি ছিনতাইকারীর কবলে পড়ছেন রাজধানীর বহু মানুষ। দিনে-দুপুরেও যেখানে-সেখানে ছিনতাই হচ্ছে। নগদ অর্থ, গহনাগাটি, মোবাইল ও অন্যান্য জিনিসপত্র অবলীলায় ছিনতাই হয়ে যাচ্ছে। ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য এতটাই বেড়ে গেছে যে, পথে-ঘাটে কেউই নিরাপদ বোধ করছে না। গত ১ জুন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের হাত থেকেও মোবাইল কেড়ে নিয়েছে এক ছিনতাইকারী।

সরকারঘোষিত বিধিনিষেধের কারণে রাজধানীতে মানুষের যাতায়াত কম। ফলে সন্ধ্যার পর রাজধানীর অধিকাংশ এলাকায় রাস্তা ফাঁকা হয়ে যায়। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে এক শ্রেণির উঠতি বয়সের তরুণরা রাস্তায় ওঁত পেতে থাকে। সুযোগ বুঝে মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিচ্ছে তারা।

মূলত যে অপরাধী চক্রগুলো মানুষের বাসা থেকে চুরি-ডাকাতি করত, তারাই এখন ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে রাস্তায় নেমেছে। কেননা বিধিনিষেধের কারণে গত এক মাসে রাজধানীর অধিকাংশ মানুষ বাসায় থেকেছে। ফলে এসব অপরাধী চক্রের বাসা-বাড়িতে চুরি করার সুযোগ কমে গেছে। ফলে বাসা ফাঁকা না পেয়ে ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে পথে নেমেছে তারা।  

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উঠিত বয়সী ছিনতাইকারীদের বেশিরভাগই মাদকসেবী। মাদকের টাকার জন্যই তারা ছিনতাইয়ের মতো অপরাধে জড়াচ্ছে।

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছিনতাইকারীরা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করছে, যার মোকাবেলা করা নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। গত কিছুদিনে বেশ কয়েকটি বড় অঙ্কের টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ছিনতাইকারীরা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেছে, যাতে গুরুতর আহত হয়েছে কয়েকজন। প্রকাশিত এক খবরে জানা গেছে, রাজধানীতে তিন শতাধিক চিহ্নিত স্পট রয়েছে; যেসব স্পটে হর-হামেশা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে।  

রাত নেমে আসলে এ আতঙ্ক বাড়ে কয়েকগুণ। রাজধানীর কিছু এলাকায় অনটেস্ট বা নম্বরপ্লেটবিহীন মোটরসাইকেল বা গাড়ি ব্যবহার হচ্ছে ছিনতাই করে। ছিনতাই হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অফিসের সামনের সড়কেও।

ছিনতাইয়ের শিকার একজন বলেন, এখানে দেখেন একটা পুলিশ বক্স। বিপরীত পাশেই উপ-পুলিশ কমিশনারের কার্যালয়। আর আমি ছিনতাই হয়েছি এখানে। তার মানে তো, পুলিশের বাড়িতেই ছিনতাই হলাম।

এর আগে জানুয়ারি মাসে হাইকোর্টের সামনে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারান হামিদুল ইসলাম নামের এক ব্যবসায়ী। এ ঘটনার পর ডিএমপি রাজধানীতে সাঁড়াশি অভিযান চালানোর ঘোষণা দিয়েছিল। এরপরও ছিনতাই বন্ধ হয়নি।  

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা যায়, গত এক মাসে ৫ শতাধিক ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এর মধ্যে অধিকাংশ ভুক্তভোগী থানায় অভিযোগ করছেন না। ফলে অভিযোগের ভিত্তিতে এসব চক্রের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেয়ার সুযোগ কম পাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো। রাজধানীর মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকা, ভাটারা, কাঁঠালবাগান, কলাবাগান, নিউমার্কেট ও মতিঝিল এলাকাতেও বেশ কয়েকটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই থানায় কোনো মামলা দায়ের করা হয়নি।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ এবং র‍্যাবের সূত্রগুলো বলছে, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় স্পটভিত্তিক ছিনতাইয়ের বেশ কিছু জায়গা তারা চিহ্নিত করে গোয়েন্দা নজরদারি করে থাকেন। সাধারণত যেসব এলাকার সড়ক একটু নিরিবিলি এবং সড়কবাতি থাকে না সেসব এলাকা ছিনতাইয়ের জন্য বেছে নেয় ছিনতাইকারীরা। আর ভোরের দিকে ঢাকার বাইরে থেকে বাস, ট্রেন বা লঞ্চ টার্মিনালগুলোকে টার্গেট করে ছিনতাই করে থাকে। এছাড়া আবাসিক এলাকায় সকালে কেউ বাড়িতে প্রবেশ করার সময় প্রাইভেটকারের মাধ্যমে অস্ত্রধারী ছিনতাইকারী হানা দেয়।

পুলিশের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৮ সালে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় ছিনতাই মামলা হয়েছে ৭৮টি। ২০১৯ সালে ১১৯টি। আর ২০২০ সালে সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭৬টি। তবে ভুক্তভোগীদের মতে, ছিনতাইয়ের প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি। ঢাকার সিএমএম আদালতের জিআর খাতার তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত ১০ বছরে শাহবাগ, রমনা, মতিঝিল, বাড্ডা, যাত্রাবাড়ী, ডেমরাসহ ১৫টি থানা এলাকায় ছিনতাই হয় অপেক্ষাকৃত বেশি।  

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, ছিনতাইয়ের যত ঘটনা ঘটছে, সেই হিসাব পুলিশের হিসাবে আসে না। ছিনতাইয়ের শিকার হয়েও অধিকাংশ লোকে মামলা করে না। ছিনতাইকারীদের হাতে প্রাণহানির সংখ্যা বাড়ছে।

ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের সাধারণ নিবন্ধন খাতার তথ্যে দেখা গেছে, গত আট বছরে  ঢাকা মহানগর এলাকায় ছিনতাইয়ের মামলা হয়েছে ৮৪৬টি। এ সময় ছিনতাইকারীদের হাতে খুন হয়েছেন মোট ৩৬ জন। ২০১৮ সালে ছিনতাইয়ের ঘটনায় ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানায় মামলা হয় ৭৮টি। ২০১৯ সালে তা বেড়ে হয় ১১৯টি।

ছিনতাই বেড়ে যাওয়ার ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নেহাল করিম বলেন, ছিনতাই বাড়ার প্রধান একটি কারণ বেকারত্ব। বেকারত্ব বাড়ছে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে ছিনতাই বাড়ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। ছিনতাইয়ের সঙ্গে খুনের ঘটনা ঘটছে, যা খুবই উদ্বেগের।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh