টিকা সংগ্রহে বড় কোনো অগ্রগতি নেই

হামিম উল কবির

প্রকাশ: ১৯ জুন ২০২১, ০৮:৫৮ এএম | আপডেট: ১৯ জুন ২০২১, ০৯:০১ এএম

করোনাভাইরাসের টিকা। ফাইল ছবি

করোনাভাইরাসের টিকা। ফাইল ছবি

করোনা নিয়ন্ত্রণে টিকাই একমাত্র ভরসা। এই টিকা সংগ্রহে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান বড় ধরনের কোনো অগ্রগতি নেই। উপহারের টিকা আসা ছাড়া ফেব্রুয়ারির পর থেকে বড় অংকের টিকার চালান দেশে আসেনি। টিকা সংগ্রহে একটি দেশের ওপর সরকারের নির্ভরতার কারণে এ অবস্থা হয়েছে। 

এর মধ্যেই চলে এসেছে করোনাভাইরাসের পরিবর্তিত নতুন ধরন- ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট (ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট)। নতুন এই ভ্যারিয়েন্ট ভারতে ভয়াবহ অবস্থা হওয়ার পর ধীরে ধীরে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে ভাইরাসটি। ফলে সরকার সীমান্ত জেলাগুলোতে লকডাউন দিতে বাধ্য হয়েছে। লকডাউনে মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে করোনা সংক্রমণ কিছুটা কমিয়ে রাখা যাচ্ছে; কিন্তু এটাই একমাত্র সমাধান নয় বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা। 

দীর্ঘদিন লকডাউন করে রাখা সম্ভব নয় কোনো অঞ্চলকে। এতে করে সার্বিক অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি শ্রমজীবী মানুষের কষ্ট বেড়ে যায়। এর একমাত্র এবং স্থায়ী সমাধান সবাইকে টিকার আওতায় নিয়ে আসা। যতদিন টিকা না দেওয়া যাচ্ছে, ততোদিন যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যবস্থা করতে হবে। 

টিকা সংগ্রহে বড় কোনো অগ্রগতি নেই  

করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর টিকা সংগ্রহে সরকারের বড় কোনো অগ্রগতি নেই। দরিদ্র কিন্তু বিকাশমান অর্থনীতির একটি দেশ হয়েও ধনী দেশগুলোর নাগরিকদের টিকা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশও তার নাগরিকদের টিকা দেওয়া শুরু করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। তখনো ইউরোপের অনেক দেশ তাদের নাগরিকদের টিকা দেওয়া শুরুই করতে পারেনি; কিন্তু টিকা সংগ্রহে শুধু ভারতের ওপর নির্ভরতায় ভুগতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। এটা সবাই জানে ভারত নিজ স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েই তাদের রাজনীতি অথবা কূটনীতি সাজিয়ে থাকে। সে কারণে করোনা বিপর্যয়ে বড় অবনতি দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভারত আন্তর্জাতিক চুক্তি লঙ্ঘন করে বাংলাদেশসহ বাইরের দেশগুলোতে সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা রফতানি বন্ধ করে দেয়। অগ্রিম অর্থ পরিশোধ করার পরও ভারত বাংলাদেশে টিকা রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে।

এরপর থেকে বাংলাদেশ কিছু উপহার ছাড়া আর কোনো টিকা আনতে পারেনি। ভারত টিকা দেবে না নিশ্চিত হওয়ার পর অবশ্য বাংলাদেশ চীন ও রাশিয়া থেকে টিকা আনার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। চীন থেকে দুই দফায় মোট ১১ লাখ টিকা (প্রথমে মে মাসে ৫ লাখ ও পরে গত ১৩ জুন ৬ লাখ) এসেছে। এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কোভ্যাক্সের (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংগৃহীত এবং বিনামূল্যে পাঠানো) ১ লাখ ৬২০ ডোজ ফাইজারের টিকা এসেছে। হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করতে হলে বাংলাদেশের ১২ থেকে সাড়ে ১৩ কোটি নাগরিককে টিকার আওতায় আনতে হবে। সেজন্য প্রয়োজন প্রায় ২৬ কোটি ডোজ টিকা।

ভারতের টিকা বন্ধের পর চীন ও রাশিয়াই হচ্ছে বাংলাদেশের জন্য টিকা সংগ্রহের উপযুক্ত দেশ। দুটি দেশই আমেরিকা বা ইউরোপের চেয়ে তুলনামূলক কম দামে টিকা দিতে পারে। তবে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের টিকাই সবচেয়ে কম মূল্যে পাওয়া গেছে (কম মূল্যে দরিদ্র দেশগুলোকে সরবরাহ করবে এই শর্তে সেরাম অ্যাস্ট্রাজেনেকার সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিল। এ ছাড়াই বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনসহ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোভ্যাক্স সেরামে বিনিয়োগ করেছিল কম মূল্যে টিকা সরবরাহ করবে এই চুক্তিতে)। ভারত টিকা সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার পর রাশিয়া ও চীনের টিকা ভারতের টিকার চেয়ে কমপক্ষে দ্বিগুণ দামে কিনতে বাধ্য হলেও এই দেশ দুটি থেকেই বাংলাদেশ টিকা সংগ্রহ করতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত টিকা সংগ্রহে কূটনৈতিক তৎপরতা এত জোরালো নয় বলেই মনে হচ্ছে। ফলে জুন মাসের অর্ধেক চলে গেলেও বড় অংকের টিকা আসার সুসংবাদ বাংলাদেশের মানুষ এখনো পায়নি।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ফাইজার, সিনোফার্ম এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকার উদ্ভাবিত ভারতের সেরামে উৎপাদিত মোট ১ কোটি ১৫ লাখ টিকা পেয়েছে। 

রাজশাহী ছাড়া সীমান্ত অঞ্চলের অন্যত্র চিকিৎসা অপ্রতুল

ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ছড়ানো বন্ধের উদ্দেশ্যে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সীমান্ত সংলগ্ন বাংলাদেশের কয়েকটি জেলায় গত কয়েক দিন ধরে চলছে আঞ্চলিক লকডাউন। সংক্রমণ বৃদ্ধি পেলেও কোয়ালিটি চিকিৎসার জন্য ভালো কোনো হাসপাতালের বড় অভাব সীমান্ত জেলাগুলোতে। পুরনো মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বলে রাজশাহীতেই তুলনামূলক ভালো চিকিৎসা পাওয়া যায়। যদিও কয়েক বছরে ওই অঞ্চলে কয়েকটি মেডিকেল কলেজ গড়ে উঠেছে; কিন্তু সেখানে এখনো ভালো চিকিৎসা পাচ্ছে না মানুষ। সে কারণে রোগ একটু জটিল হলেই সীমান্ত অঞ্চলের মানুষ ছুটছে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এর ওপর করোনায় একটু জটিল হলেই অক্সিজেন সাপোর্টসহ আইসিইউ সাপোর্ট লাগে। এ কারণে সামর্থবান পরিবারের হলেই মানুষ স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি না করে চলে আসে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ফলে রাজশাহীতে দেখা যাচ্ছে রোগীতে ঠাসা।

রাজশাহী সীমান্ত জেলা বলে এখানকার সঙ্গে ভারতে যাতায়াত করা যায়। ভারতে যাতায়াত এবং দেশের অন্যান্য সীমান্ত জেলা থেকে করোনা আক্রান্তদের রাজশাহী মেডিকেলে ভর্তি করানোর প্রবণতা থেকেই এখানে করোনা সংক্রমণ বেড়েছে। জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, করোনার চিকিৎসার সূচনাতেই চিকিৎসা আরম্ভ করতে পারলে মানুষের যেমন কষ্ট কমে যায়, তেমনি রোগীরা খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে যায় জটিলতা তৈরি হওয়ার আগেই। সে কারণে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে করোনা ওয়ার্ড করে এটাকে তরল অক্সিজেন, অক্সিজেন মাস্ক, হাইফ্লো নেজাল ক্যানোলা দিয়ে সজ্জিত করার পরামর্শ দিয়েছেন অনেক জনস্বাস্থ্যবিদ।

তারা বলছেন, শুধু ষাটোর্ধ্ব বয়সীদের একটু বেশি ঝুঁকি তৈরি হয়ে থাকে ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হলে। তাদের জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থা সহজ করতে পারলে স্থানীয়ভাবেই তারা সুস্থ হয়ে যেতে পারেন। এমনটি করতে পারলে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগীর ভিড় বাড়বে না। কেবল জটিল রোগীরাই সেখানে যাবেন রেফারাল সিস্টেমে এবং তারা সঠিক চিকিৎসা পেয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি চলে আসতে পারবেন।

এ ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দিয়ে সজ্জিত করতে পারলে, সেখান থেকেই করোনা রোগীদের সুস্থ করে দেওয়া যাবে। তাদের আর টার্শিয়ারি হাসপাতালে যেতে হবে না। করোনার এই সময়টাতে স্বাস্থ্যে বরাদ্দ বাড়িয়ে উপজেলা হাসপাতালকে উন্নত চিকিৎসার জন্য নির্ভরযোগ্য করে তোলা উচিত। 

লকডাউন করোনা নিয়ন্ত্রণে স্থায়ী সমাধান নয় 

লকডাউন করোনা নিয়ন্ত্রণে স্থায়ী সমাধান নয়। এ প্রক্রিয়ায় মানুষের চলাচল বন্ধ করা যায় বলে সংক্রমণ কমে যায়; কিন্তু এটা কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। অর্থনীতির জন্য লকডাউন খুবই ক্ষতিকর, বিশেষ করে দিন আনে দিন খায় এমন শ্রমজীবী মানুষের নাভিশ্বাস উঠে যায়। ফলে দীর্ঘদিন কোথাও লকডাউন করে রাখা সম্ভব নয়।

সংক্রমণ কমিয়ে রাখার এই প্রক্রিয়াটি সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় নয় বরং করোনার টিকা দিয়ে ৭০ শতাংশ মানুষের মধ্যে ভাইরাসটির বিরুদ্ধে হার্ড ইমিউনিটি বা গণপ্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলেই ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বলে সর্ব সম্মত সিদ্ধান্ত রয়েছে। টিকা যেহেতু বাংলাদেশ উৎপাদন করতে পারছে না অথবা সহসাই বাইরে থেকে যথেষ্ট টিকা আমদানি সম্ভব নয়, সে কারণে স্বাস্থ্যবিধি যথাযথ মেনে চলতে পারলে করোনা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে। একটি ভালো মাস্ক ও ঘন ঘন সাবান দিয়ে হাত ধুতে পারলে তা টিকার বিকল্প হিসেবে কাজ করে থাকে। সে কারণে নাগরিকদের স্বাস্থ্যবিধি মানানো সরকারের দায়িত্ব। বাংলাদেশের একটি শ্রেণির মানুষ করোনা সংক্রমণের শুরু থেকেই মাস্ক পরে না। এদের জন্য অন্যরা বিপদে পড়তে পারে।

সংক্রমণ কমিয়ে রাখার জন্য মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানানোর ব্যবস্থা করতে পারলে, টিকা ছাড়াই করোনা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব বলে জনস্বাস্থ্যবিদরা শুরু থেকেই বলে আসছেন।


সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh