থামছে না মানবপাচার

বিশেষ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ জুন ২০২১, ১২:১৫ পিএম

মানবপাচারের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ রুট হচ্ছে ভূমধ্যসাগর। ফাইল ছবি

মানবপাচারের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ রুট হচ্ছে ভূমধ্যসাগর। ফাইল ছবি

ভূমধ্যসাগর হয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাতে যাওয়া ৫২৯ বাংলাদেশিকে গত এক মাসে উদ্ধার করা হয়েছে। এদের মধ্যে তিউনিশিয়া থেকে ৪৪৩ জন ও লিবিয়া থেকে ৭৬ জনকে উদ্ধার করা হয়। 

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার সময় গত ১৮ মে ৩৬ জন, ২৭ ও ২৮ মে দেশটির উপকূল থেকে ২৪৩ জন ও ১০ জুন ১৬৪ জন বাংলাদেশিকে উদ্ধার করেছে তিউনিসিয়ার কোস্টগার্ড। এছাড়া গত মাসে লিবিয়ার অবৈধ অভিবাসন দমন বিভাগের (ডিসিআইএম) কর্মকর্তারা আলজেরিয়ার সীমান্তবর্তী মরু এলাকা দারাসে অপহরণকারীদের কবল থেকে ৮৬ জন বাংলাদেশিকে উদ্ধার করেছেন। তারা বেনগাজি হয়ে মরুভূমি পাড়ি দিয়ে ভূমধ্যসাগরে যাওয়ার পথে অপহরণকারীদের কবলে পড়েছিলেন।

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) তথ্যানুসারে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১২ জুন পর্যন্ত ভূমধ্যসাগরে ৮১৩ জন অভিবাসন প্রত্যাশীর মৃত্যু হয়েছে। এ সংস্থার সহায়তায় গত মে মাসে দেশে ফিরেছেন ১৬০ জন বাংলাদেশি। তাছাড়া ২০১৫ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত ভূধ্যসাগর থেকে উদ্ধার হওয়া ২ হাজার ৯০০ বাংলাদেশি লিবিয়া থেকে দেশে ফিরেছেন আইওএমের সহযোগিতায়।

ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মানবপাচারের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ রুট হচ্ছে ভূমধ্যসাগর। তিউনিসিয়ার উপকূলে বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের ভূমধ্যসাগর থেকে উদ্ধারের ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। এখানে যাওয়ার সময় অনেকেই সাগরে ডুবে প্রাণ হারান, কেউ পুলিশের হাতে ধরা পড়ে নির্যাতনের শিকার হন, আবার কেউ পড়েন অপহরণকারীর খপ্পরে। এরপরও বিপজ্জনক এ পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশিদের ইউরোপ পাড়ি জমানোর প্রবণতা থামছে না।

তিউনিসিয়ার কোস্টগার্ড গত ১৮ মে ভূমধ্যসাগরে ভাসমান একটি কাঠের নৌকা থেকে ৩৬ বাংলাদেশিকে উদ্ধার করে, যাদের মধ্যে একজন আলামিন। তিনি লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার বিপজ্জনক যাত্রায় নিজের চাচাকে সমুদ্রে তলিয়ে যেতে দেখেছেন। নিজেও কোনোরকমে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচেছেন। তবু তিনি দেশে ফিরতে চান না। 

আল আমিন বলেন, ‘ইতালি যাওয়ার টাকা জোগাড় করতে অনেক ঋণ করেছি। অথচ যেতে পারলাম না। যদি যেতে না পারি, ধারের টাকা শোধ করব কী করে!’ 

ইতালি যাওয়ার আশায় লিবিয়ায় দুই বছরের বেশি থাকা সোহেল রানা বলেন, দুই লাখ টাকার চুক্তিতে তিনি ইতালি যাওয়ার জন্য নৌকায় চড়ে বসেছিলেন। এখন তিউনিসিয়ায় রয়েছেন। এখন টুকটাক কাজ করছেন। তবে দেশে ফিরতে চান না। 

ভূমধ্যসাগরের একটি রুট ব্যবহার করেই যে শুধু মানবপাচার হচ্ছে তা নয়। বাংলাদেশ পুলিশ ও জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছরই ভারত, পাকিস্তান, সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান, সৌদি আরব, কুয়েত, ওমান, বাহরাইন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানবপাচার করা হয়। যাদের অধিকাংশই হচ্ছে নারী ও শিশু। 

সম্প্রতি ভারতে বাংলাদেশি এক তরুণীকে নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর একটি আন্তর্জাতিক নারী পাচারকারী চক্রের সন্ধান পায় পুলিশ। ২০১৫ সালে মালয়েশিয়ার উত্তরে থাইল্যান্ডের সীমান্তঘেঁষা পাহাড়ি জঙ্গলে ২৮টি পরিত্যক্ত বন্দী শিবিরসহ ১৩৯টি গণকবরের সন্ধান মেলে। এরপর মালয়েশিয়াতেও পাওয়া যায় গণকবর। পাওয়া গেল নির্যাতন শিবির। সাগরপথে পাচার হওয়া শত শত বাংলাদেশি নাগরিকদের পাশাপাশি মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিকদের মৃতদেহও সেসব গণকবরে মাটিচাপা দেয়া হয়েছে বলে জানা যায়। 

সেই বছর এ দুটি দেশ আর ইন্দোনেশিয়া থেকে মানবপাচারকারীদের নির্যাতনের শিকার ১৭৫ জনকে সরকার দেশে ফিরিয়ে আনে। তারা বিমানবন্দর থানায় তিনটি মামলা করেন। থাইল্যান্ডে বিচারে পাচারকারী চক্রের সাজা হয়েছে। বাংলাদেশে বিচার এখনো ঝুলে আছে। গ্রেফতার হয়েছিলেন মাত্র ছয়জন।

এসব ঘটনায় মামলা যদিও–বা হয়, তদন্ত আর বিচার এগোয় না। পুলিশের উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র বলেছে, ২০১২ সালে মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনটি হওয়ার পর থেকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৬ হাজার মামলায় ৯ হাজার ৬৯২ জন গ্রেফতার হয়েছেন। আর ২০১৪ সাল থেকে এযাবৎ মাত্র ৫৪ জনের সাজা হয়েছে। মামলা নিষ্পত্তির হারই খুব কম।

সংশ্লিষ্টদের অনেকেই বলছেন, মানবপাচার মামলায় মূলত প্রাথমিক পর্যায়ের দালালেরা গ্রেফতার হন, সচরাচর যারা ভুক্তভোগীর পরিচিত বা প্রতিবেশী। তদন্তে ঘাটতি থাকায় অনেক আসামি খালাস পান।

এ ধরনের মামলার আরেকটি বড় সমস্যা, আদালতে সাক্ষী হাজির করতে পুলিশের ব্যর্থতা। ঢাকা মহানগরে সরকারের প্রধান কৌঁসুলি আবদুল্লাহ আবু বলেন, মানবপাচার মামলায় সাক্ষী নিয়মিত পাওয়া যায় না।    

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) মানবপাচার প্রতিরোধে কাজ করে। সিআইডির অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, মানবপাচার চক্রের মূল অংশটি দেশের বাইরে। স্থানীয় পর্যায়ে কিছু দালাল কাজ করে। অনেক ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা তথ্য দেন না।

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক বলছেন, ভুক্তভোগী সহায়তা না করলে এ ধরনের মামলা প্রমাণ করা খুব মুশকিল। তাছাড়া  শাস্তি চড়া হলে প্রমাণের ভার কঠিনতর হয়। শাস্তির দৃষ্টান্ত বাড়াতে হলে আইনের সংস্কার লাগবে।

অভিবাসন নিয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) চেয়ারপারসন তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, পাচারকারীরা অনেককেই টাকার ভাগ দেন। এটা বন্ধ করতে হলে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা লাগবে। 

মানবপাচার দেশের বড় সমস্যাগুলোর একটি। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ব্যাপারে সরকারের যতটা নজর দেয়ার দরকার ততটা নেই। মানবপাচারের বড় কোনো ঘটনা ঘটলে প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। শুরু হয় অভিযান। বিচ্ছিন্ন সেই অভিযান শুরু হতে সময় লাগে না, শেষ হতেও সময় লাগে না। লোক দেখানো অভিযানে কিছু চুনোপুঁটি ধরা পড়লেও রাঘববোয়ালরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থাকে। আইন প্রয়োগের শিথিলতার কারণে মানবপাচার বন্ধ করা যাচ্ছে না। 

উন্নত জীবন বা কর্মসংস্থানের খোঁজে দেশ থেকে প্রতি বছরই উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ বিশ্বের নানা দেশে পাড়ি জমাচ্ছে। লোভনীয় চাকরি ও সুযোগ-সুবিধার প্রলোভন দিয়ে মানব পাচারকারীরা তাদের ফাঁদে ফেলছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। সেইসাথে তিউনিশিয়া ও লিবিয়ায় উদ্ধার হওয়া নাগরিকদের দ্রুত ও নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে।  

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh