বাজেটে কর্মসংস্থানে গুরুত্ব দেয়া জরুরি

নীলকণ্ঠ আইচ মজুমদার

প্রকাশ: ১৯ জুন ২০২১, ০৩:৩৪ পিএম | আপডেট: ১৯ জুন ২০২১, ০৪:০০ পিএম

প্রভাষক নীলকণ্ঠ আইচ মজুমদার

প্রভাষক নীলকণ্ঠ আইচ মজুমদার

বাজেট শব্দটি প্রান্তিক মানুষের কাছে খুব একটা পরিচিত নয়। তবে সবাইকে এর ফল ভোগ করতে হয়। জুন মাস এলেই বাজেট নিয়ে শোরগোল শোনা যায়। বিশেষ করে ব্যবসায়ী মহলে এ নিয়ে বেশ আলোচনা হয়। সাধারণত জুনের প্রথম সপ্তাহে সংসদে উপস্থাপন হয় বাজেট। এক পর্যায়ে সরকারি দলের  সদস্যদের সমর্থনে পাসও হয়। বিরোধী দল কখনো কখনো ওয়াক আউট করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সরকারি দল বাজেটকে বলেন জনকল্যাণমুখী আর বিরোধী দল বলেন জনবিরোধী বাজেট।  এসব এখন সবার কাছে অতি পরিচিত শব্দ।

সাধারণ মানুষ বাজেটকে দেখে ভিন্নভাবে। মানুষের ভাবনায় থাকে না রিজার্ভ কিংবা জিডিপি। তারা আমদানি রফতানির নীতিমালাও বোঝে না। জানে না বাজেট ঘাটতি কি এবং কেন? শুধু বোঝে কোন জিনিষের দাম বাড়বে আর কোন জিনিষের দাম কমবে। 

আমাদের দেশে জিনিষের দাম কমার সম্ভাবনা খুবই কম। একবার যেকোনো প্রকারে জিনিষের বেড়ে গেলে তা কমার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবু প্রান্তিক মানুষ একটু ভালো থাকার প্রত্যাশা করে। 

প্রতিবারই বাজেট হয় জনগণের কথা বিবেচনা করে তবে সেখানে প্রান্তিক মানুষের কতটা ভাবা হয় সেটা বিবেচ্য বিষয়। দিন দিন বাজেটের আকার বাড়ছে। এ অর্থ বছর জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল  ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছেন। যার মধ্যে আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা এবং ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। করোনা কালে এ বিপুল অংকের বাজেটের হিসাব মেলানো কষ্টকর।  

‘জীবন- জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ’-শিরোনামের এ বাজেটে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে করোনা মোকাবেলার বিষয়টি। বিশেষ করে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে নিয়ে আসা এ বাজেটের অন্যতম দিক বলে উপস্থাপন করা হয়েছে। উত্থাপিত বাজেটে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ যা অর্থের আকারে ৩৪ লাখ ৭৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। প্রশ্ন হচ্ছে এ জিডিপি এই করোনা মহামারি কালে অর্জন সম্ভব কি না? একটি দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সঠিক মূল্যস্ফীতি বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। গত বাজেটে ৫ দশমিক ৪ শতাংশে মূল্যস্ফীতি ধরে রাখার কথা বলেছিলেন অর্থমন্ত্রী কিন্তু গত এপ্রিলে এটা কিছুটা বেড়ে ৫ দশমিক ৫৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এটা এবছর ধরা হয়েছে ৫.৩ শতাংশ। করোনা কালে এ মূল্যস্ফীতি ধরে রাখা কঠিন বলেই ধরে নেয়া যায়।  

রাজস্ব খাত থেকে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। বাজেটের  রাজস্ব আদায়ের বিষয়টি সবচেয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে এতে কোন সন্দেহ নেই। বাজেটের এইসব বিষয় অর্জন করতে হলে সত্যিকার অর্থেই একটি ব্যাপক চ্যালেঞ্জ নিতে হবে সরকারকে। বাজেটে যে পরিমাণে ঘাটতি দেখানো হয়েছে সে ঘাটতি মোকাবেলায় সরকার বৈদেশিক ঋণ এবং দেশের অভ্যন্তর থেকে ব্যাংক ঋণ নেয়ার প্রস্তাবনা করেছেন।  

দেশের অভ্যন্তর থেকে ঋণ নেয়ার প্রক্রিয়াটা খুব একটা জটিল বিষয় নয়। ব্যাংকিং খাত থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও তারল্য সঙ্কট হবে না আশ্বস্ত করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. ফজলে কবির। যদিও অর্থমন্ত্রী আশার কথা বলেছেন যে, আমরা এখন ঋণ দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি।  কিন্তু ঋণের সঠিক ব্যবহারটা সুন্দর হওয়া বাঞ্ছনীয়। 

বাজেটে সাধারণত যেসব পণ্যের উপর শুল্ক-করহার বাড়ানো হয় সেসব পণ্যের দাম সাধারণত বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। এ বিচারে এবছর মোবাইল ফোন, মাশরুম, শিল্প লবণ, চুইংগাম, বিদেশি রড ও সমজাতীয় পণ, বিদেশি মাংস, বিদেশি গাজর-টমেটো, বিদেশি সাবান, বিদেশি বিস্কুট এর দাম বাড়তে পারে। নতুন করে কর আরোপ না করায় চাল, ডাল, চিনি, লবণ, পাউরুটি, সাবান, বোতলজাত পানি, ফলের জুস, মসলা ও প্রক্রিয়াজাত পণ্যের দাম বাড়ার কথা না। তবে সমস্যাটা হলো বাজেট ঘোষণার সময় কোন নিয়মনীতি না মেনেই ব্যবহার্য জিনিষ পত্রের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়, যা সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। সব দোষ চলে যায় বাজেটের উপর।  

প্রতিবারই বাজেটে কালো টাকা সাদা করার একটা প্রক্রিয়া থাকে। আর এ নিয়ে সবাই নেগেটিভ কথা বললেও  বাজেটে সে প্রক্রিয়াটা সচল থেকেই যায়। যদিও অর্থমন্ত্রী বলেছেন কালো টাকা আর অপ্রদর্শিত আয় এক নয়। অপ্রদর্শিত আয় সিস্টেম লসের কারণে হয়ে থাকে। কালো টাকা বন্ধ করতে হলে এ টাকার উৎস মুখ বন্ধ করতে হবে। 

আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের সামাজিক বেষ্টনীর বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে মানুষকে সরকারি সেবার আওতায় আনা প্রয়োজন। এদিকে নজর দিয়ে সরকার সামাজিক নিরাপত্তায় প্রথমবারের মতো লাখ কোটি বরাদ্দ রেখেছে বাজেটে। তবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি না করা গেলে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের কাজটি জটিল হয়ে পড়বে।  

এ বাজেটে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সুস্পষ্ট কোন দিক নির্দেশনা নেই। এমন কি উদ্যোক্তা তৈরি করার ক্ষেত্রে বাজেটে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়নি। আমাদের দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে বৈদেশিক রেমিটেন্স। করোনার কারণে এ খাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। লাখ লাখ প্রবাসী তাদের কাজ থেকে বিচ্যুতি হয়েছেন। এর ফলে রেমিটেন্সে যেমন প্রভাব পড়বে অন্যদিকে বেকারত্বের পরিমাণও বাড়বে। তাই এ খাতে সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে সঠিক নির্দেশনা প্রয়োজন। করোনাকালে যারা দেশে ফিরে এসেছে তাদেরকে আবার বিদেশে পাঠানো ক্ষেত্রে সরকারের বিশেষ উদ্যোগ প্রয়োজন। 

সরকারি চাকুরেদের বিশেষ করে নিচের স্তরের কর্মচারীদের ক্ষোভ বৃদ্ধি পাচ্ছে । স্কেল পরিবর্তন না করে প্রতিবছর ৫% বৃদ্ধির ফলে জীবনযাত্রায় অর্থনৈতিক বাঁধার মধ্যে পড়তে হচ্ছে। করোনার প্রভাবে শিক্ষাখাত বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যারা শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি দিয়ে চলে। তাদের দিকে বাজেটে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন ছিলো। কৃষি নির্ভর দেশে কৃষির আধুনিকায়নের উপর গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। আর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন কৃষির গুরুত্ব অনুধাবন করা এবং কৃষি পণ্যের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তিতে কৃষককে সহযোগিতা করা। 

বাজেটে কৃষিপণ্য উৎপাদনের ৬ খাতে ১০ বছরের কর অবকাশের কথা বলা হয়েছে। সেই প্রণোদনা প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে সরকারকে যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। প্রান্তিক পর্যায়ের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সরকারি সহযোগিতার নিয়মনীতি গ্রহীতা বান্ধব না হলে এ কাজে সফলতা আসবে না । 

দেশে থেকে প্রতিবছর যে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে তা উদ্ধার করা গেলে বাজেট আরো স্বয়ংসম্পূর্ণ করা যেত। 

সব মিলিয়ে এবারের বাজেট হতাশার নয়। অনেক ভালো বিষয় এখানে সংযুক্ত করা হয়েছে। সমাজের সকল স্তরের মানুষকে অর্থনৈতিক চাকায় সংযুক্ত করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তৃতীয় লিঙ্গের কর্মী নিয়োগে কর ছাড় বিশেষ সুবিধা বঞ্চিত মানুষদের ক্ষেত্রে বেঁচে থাকার আশা যোগাচ্ছে। 

উন্নয়নশীল দেশে বাজেট একটি জটিল বিষয়। এখানে মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি সে তুলনায় প্রাপ্তি কম। প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তির মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করাই হচ্ছে বাজেটের মূল চ্যালেঞ্জ। 

লেখক: প্রভাষক, আলীনগর কারিগরি ও বাণিজ্যিক কলেজ

সভাপতি, ঈশ্বরগঞ্জ প্রেসক্লাব 

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh