কেমন আছে ‘সুন্দরবন'

বিশেষ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ জুন ২০২১, ০৮:০৬ পিএম

সুন্দরবন

সুন্দরবন

গত বুধবার (৯ জুন) জাতীয় সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সুন্দরবনের আয়তন বাড়ছে। তিনি বলেন ‘ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে করা বাঘশুমারি অনুযায়ী, ২০১৫ সালে সুন্দরবনে বাঘ ছিলো ১০৬টি এবং ২০১৮ সালে এর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১১৪টি। 

সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির খবরটিকে দেশের জন্য একটি সুখবর হিসেবেই দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। সাতক্ষীরার সুন্দরবন অঞ্চলে বেসরকারি সংস্থা ‘লীডার্স’-এর পরিচালক মোহন কুমার মন্ডল বলেন, বাঘ রক্ষায় সরকারের উপযুক্ত পদক্ষেপই এর প্রধান কারণ। সরকার বনদস্যু দমনে কঠোর ভূমিকা গ্রহণ করেছে। একই সঙ্গে বিপুল সংখ্যক বনদস্যু বনের ডাকাতি ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে। এসব কারণে সুন্দরবন বাঘ ও অন্যান্য প্রাণিসম্পদের অরণ্য হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।

সুন্দরবন অঞ্চলে বসবাসকারীদের বনের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে পারলে বাঘের জীবনের ঝুঁকি কমবে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক নূরজাহান সরকার। 

তিনি বলেন, বনজীবীদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের ছেলেমেয়েদের সেখানকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় বিনা মূল্যে পড়ালেখার সুযোগ দিতে হবে।

সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির কথা বলা হলেও এর আয়তন বৃদ্ধি নিয়ে মতভেদ রয়েছে। এর আগে একাধিক গবেষণায় জানা গেছে, নানা কারণে সংকুচিত হয়ে পড়েছে সুন্দরবন। ১৭৭৬ সালে বাংলাদেশ অংশে সুন্দরবনের আয়তন ছিলো ১১ হাজার ২৫৮ বর্গকিলোমিটার। 

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ট্রাস্টি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) ২০১৬ সালে করা এক গবেষণায় বলা হয়, সুন্দরবন ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। বাংলাদেশ ও ভারত- দুই দেশের সুন্দরবনেই ভূখণ্ড কমছে আর জলাভূমি বাড়ছে। গত ২৭ বছরে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন ৭৬ বর্গকিলোমিটার কমেছে, আর জলাভূমি অংশে আয়তন বেড়েছে ৩০ বর্গকিলোমিটার। সেই সাথে সুন্দরবনে সুন্দরীসহ সব ধরনের গাছের সংখ্যাও কমছে। মূলত সুন্দরবনে নদীতীরবর্তী এলাকায় ভাঙনের কারণে আয়তন কমেছে বলে গবেষণায় বলা হয়েছে।  

অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক আবদুল আজিজ এবং বন্য প্রাণী গবেষক অসিত রঞ্জন পাল ‘বাংলাদেশ সুন্দরবন: পরিবেশ ও জৈব সম্পদের বর্তমান অবস্থা’ শীর্ষক আরেকটি গবেষণা করেছেন। এতে দেখা গেছে, সুন্দরবনে ১৯৫৯ সালে প্রতি হেক্টরে ২৯৬টি গাছ ছিলো। গাছের সংখ্যা নিয়মিতভাবে কমে ১৯৮৩ সালে হেক্টরপ্রতি গাছের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১৮০-তে। ১৯৯৬ সালে তা আরো কমে হয় ১৪৪। 

১৯৫৯ সালে প্রতি হেক্টরে সুন্দরবনের প্রধান গাছ সুন্দরীর সংখ্যা ছিলো ২১১। কিন্তু তা ১৯৮৩ সালে ১২৫ ও ১৯৯৬ সালে ১০৬-তে নেমে আসে। 

সুন্দরবনে গত দুই দশকে বারবার আগুন লেগেছে। এতে ক্ষতি হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনটির।অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য মাইকিং এবং কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করা ছাড়া বাস্তবে তেমন কোন কাজই হয়নি। দ্রুত আগুন নেভানোর জন্য রিভার ফায়ার স্টেশন নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল। সেক্ষেত্রেও নেই তেমন কোন অগ্রগতি।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী জানান, জলবায়ু পরিবর্তন ও উজান থেকে মিষ্টি পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় সুন্দরবনের নদীগুলোতে বাড়ছে লবণাক্ততা। লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে বিরূপ প্রভাব পড়ছে কুমিরের প্রজননে। অতিরিক্ত লবণাক্ত পানি পান করে রোগাক্রান্ত হচ্ছে বাঘসহ বন্যপ্রাণী। লবণাক্ততা সামান্য বাড়লে সুন্দরবনের নদী-খালে পারশে, দাতিনা, টেংরা ও ভেটকি মাছ কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বন সংশ্লিষ্টরা জানান, সুন্দরবনের গাছে গাছে আগের মতো বানর ও বিভিন্ন প্রজাতির পাখি দেখা যায় না। কমে গেছে মৌচাকও। অবাধে বনের গাছ কাটার কারণে বিপন্ন হতে চলেছে অনেক বন্যপ্রাণী। সুন্দরবনের বিভিন্ন নদী ও খালে দীর্ঘদিনে ধরে বিষ দিয়ে মাছ শিকার করছে একটি চক্র। এর ফলে বিভিন্ন মাছের পোনা, কাঁকড়া ও জলজ প্রাণীও মারা যাচ্ছে।

সুন্দরবন একাডেমির উপদেষ্টা রফিকুল ইসলাম খোকন জানান, বন থেকে ইতিপূর্বে বিলুপ্ত হয়েছে গণ্ডার, বন মহিষ, মিঠা পানির কুমির, এক প্রজাতির হরিণ, চিতা বাঘ ও ৪ প্রজাতির পাখি। বনের নদী-খালে বিষ দিয়ে মাছ ধরার ফলে বিরূপ প্রভাব পড়ছে মাছ ও কাঁকড়ার ওপর। বিলুপ্ত হতে চলেছে ১৯ প্রকার মাছ।

মংলা বন্দর থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে ১৩১ কিলোমিটার নদীপথে দেশি-বিদেশি জাহাজ চলাচল করছে। সুন্দরবনের মধ্যের নদী দিয়ে রায়মঙ্গল ও কয়রার আংটিহারা এলাকা দিয়ে জাহাজ যাওয়া-আসা করছে ভারতে। এসব জাহাজের ইঞ্জিনের শব্দ ও হাইড্রোলিক হর্ন আতঙ্কিত করে তুলছে বন্যপ্রাণীদের। নৌযান থেকে নিঃসৃত তেল ও বর্জ্য ছড়িয়ে পড়ছে বনের মধ্যে। এতে দূষিত হচ্ছে বনের মাটি ও পানি।

২০১২ সালের জানুয়ারিতে সুন্দরবনের ঢাংমারী, চাঁদপাই ও দুধমুখী এলাকাকে ডলফিনের অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। এই তিনটি এলাকার প্রায় ৩১ কিলোমিটার নদীতে রয়েছে ইরাবতি ও শুশুক ডলফিনের বিচরণ। কিন্তু বনের মধ্য দিয়ে চলাচল করা ভারী নৌযানের পাখার আঘাতে মারা পড়ছে ডলফিন। এছাড়া এসব এলাকায় জেলেদের জালে আটকা পড়েও মারা যাচ্ছে শুশুক ও ইরাবতি।

ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির সিনিয়র গবেষক মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, দ্রুতগতির এসব জাহাজের বড় বড় ঢেউয়ের কারণে নদীর তীর ভেঙে যাচ্ছে। সেই মাটি গিয়ে নদীর মোহনার গভীর স্থানগুলো ভরাট করে ফেলছে। ফলে এই মোহনাগুলোতে বিচরণ করা ডলফিন ও শুশুকের আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ ছাড়া ভারি নৌযান চলাচল করা রুটগুলোতে বনের পাশে এখন আর তেমন হরিণ, বানরসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী দেখা যায় না।

বনের আয়তন বাড়ানোর জন্য সরকার কৃত্রিম ম্যানগ্রোভ তৈরি করছে। সুন্দরবনের বিস্তৃতি ঘটলে পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য উপকৃত হবে কিন্তু বনের চারপাশে শিল্প কারখানা স্থাপন বন্ধ করা না গেলে বন ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা করা কঠিন হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, যে কোন কাজে সুন্দরবন রক্ষার বিষয়টি অগ্রগণ্য করতে হবে। বন রক্ষা পেলে এর জীববৈচিত্র্য আপনা থেকেই রক্ষা পাবে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh