জিআই স্বীকৃতি পাওয়া বাংলাদেশের পণ্যের বিশেষত্ব

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ জুন ২০২১, ০৯:৪৭ পিএম | আপডেট: ১৯ জুন ২০২১, ০৯:৪৮ পিএম

জি আই স্বীকৃতি পাওয়া বাংলাদেশের পণ্য

জি আই স্বীকৃতি পাওয়া বাংলাদেশের পণ্য

ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) হচ্ছে কোনো সামগ্ৰীর ব্যবহার করা বিশেষ নাম বা চিহ্ন। এই নাম বা চিহ্ন নিৰ্দিষ্ট সামগ্ৰীর ভৌগোলিক অবস্থিতি বা উৎস যেমন একটি দেশ, অঞ্চল বা শহর অনুসারে নিৰ্ধারণ করা হয়। ভৌগোলিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সামগ্ৰী নিৰ্দিষ্ট গুণগত মানদণ্ড বা নিৰ্দিষ্ট প্ৰস্তুত প্ৰণালী অথবা বিশেষত্ব নিশ্চিত করে।

বাংলাদেশে নতুন করে আরো পাঁচটি পণ্য জিওগ্রাফিক্যাল আডেন্টিফিকেশন (জি-আই) বা ভৌগলিক নির্দেশক হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছে। এ নিয়ে বাংলাদেশে মোট জিআই পণ্যের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো ৯টিতে। নতুন নিবন্ধিত জি-আই পণ্যগুলো হলো- রাজশাহী সিল্ক, রংপুরের শতরঞ্জি, কালিজিরা চাল, দিনাজপুরের কাটারীভোগ চাল এবং নেত্রকোনার সাদামাটি।

এর আগে, বাংলাদেশে প্রথম বারের মতো জি-আই পণ্য হিসাবে ২০১৬ সালে স্বীকৃতি পেয়েছিল জামদানি। এরপর ২০১৭ সালে ইলিশ, ২০১৯ সালে খিরসাপাতি আম, ২০২০ সালে ঢাকাই মসলিন এবং চলতি বছর ওই ৫টি পণ্যকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। এখন থেকে এই পণ্যগুলো বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য হিসাবে বিশ্বে পরিচিতি পাবে।

কোনো একটি দেশের পরিবেশ, আবহাওয়া ও সংস্কৃতি যদি কোনো একটি পণ্য উৎপাদনে ভূমিকা রাখে, তাহলে সেটিকে ওই দেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।

কোন পণ্য জি-আই স্বীকৃতি পেলে পণ্যগুলো বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ডিং করা সহজ হয়। এই পণ্যগুলোর আলাদা কদর থাকে। ওই অঞ্চল বাণিজ্যিকভাবে পণ্যটি উৎপাদন করার অধিকার এবং আইনি সুরক্ষা পায়।

আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব বিষয়ক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল প্রোপার্টি রাইটস অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউআইপিও) নিয়ম মেনে বাংলাদেশের শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে পেটেন্টস, ডিজাইন এবং ট্রেডমার্ক বিভাগ (ডিপিডিটি) এই স্বীকৃতি ও সনদ দিয়ে থাকে।যে ব্যক্তি/ প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা জি-আই এর জন্য আবেদন করেন সেটার মেধাস্বত্ত্ব তাদের দেয়া হয়।

২০১৩ সালে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন হয়। ২০১৫ সালে আইনের বিধিমালা তৈরির পর জি-আই পণ্যের নিবন্ধন নিতে আহ্বান জানায় ডিপিডিটি। ডিপিডিটির ভৌগলিক নির্দেশক পণ্যের জার্নাল থেকে বাংলাদেশের এই ৯টি জি-আই পণ্যের বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়।

জামদানি

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন- বিসিক এর পক্ষ থেকে জামদানিকে জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধনের অনুমোদন চাওয়া হয়। ২০১৬ সালে সেটি স্বীকৃতি পায়। এর আগে, ২০১৩ সালে ইউনেস্কো ঐতিহ্যবাহী জামদানিকে 'ইনট্যানজিবল হেরিটেজ অব বাংলাদেশ' হিসেবে ঘোষণা করেছে।

জামদানি শাড়ি হল কার্পাস তুলা দিয়ে প্রস্তুত এক ধরণের পরিধেয় বস্ত্র। একে মসলিনের উত্তরাধিকারীও বলা হয়। জামদানি বলতে সাধারণত শাড়িকেই বোঝায়। তবে জামদানির দিয়ে ওড়না, কুর্তা, পাঞ্জাবি বানানোও হয়ে থাকে।

জামদানি শাড়ির প্রধান বিশেষত্ব হচ্ছে এটি সম্পূর্ণ হাতে বোনা। শীতলক্ষ্যা নদীর পার্শ্ববর্তী এলাকার জলবায়ু এই জামদানি শাড়ি বোনার উপযোগী। শীতলক্ষ্যা নদীর পানির সাথে রঙ মিশিয়ে সূতা রঙিন করা হয়। যার কারণে রঙের স্থায়িত্ব বেশি হয়। সে হিসেবে ঢাকার নারায়ণগঞ্জ ও সোনারগাঁওয়ে সবচেয়ে বেশি জামদানি তৈরি হয়।

জামদানি শাড়ি রেশম সূতা ও সূতি সূতা দিয়ে তৈরি হয়ে থাকে। আবার এই সূতা রঙ করার পর ভাত মেশানো পানিতে ভেজানো বা ভাতানো হয়। এরপর সেই সূতা রোদে শুকিয়ে চরকা ঘুরিয়ে আলাদা করে, তারপর তাঁতে বোনা হয়। তেরছা, বুটিদার, ঝালর, পান্নাহাজার, ফুলওয়ার, তোরদার এমন বিভিন্ন ডিজাইনের জামদানি হয়ে থাকে।

জামদানি শাড়ির ১৮ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৪ ফুট প্রস্থের হয়। সাধারণত সূতার কাউন্ট ও ডিজাইনের ওপর জামদানির দাম চার হাজার টাকা থেকে শুরু করে দুই লাখ পর্যন্ত হতে পারে। একটি জামদানি শাড়ি তৈরি করতে দুই দিন থেকে ৪ মাস বা তার বেশি সময় লাগতে পারে।

ঢাকা অঞ্চলে জামদানির বয়স প্রায় ৪০০ বছর। ১৭০০ শতাব্দীতে জামদানি দিয়ে নকশাওয়ালা শেরওয়ানি, পাগড়ির প্রচলন ছিলো। এছাড়া মুঘল আমলে নেপালের আঞ্চলিক পোশাক রাঙ্গার জন্য জামদানি কাপড় ব্যবহৃত হতো। উনিশ শতকের মাঝামাঝি দিল্লি, লক্ষ্ণৌ, নেপাল ও মুর্শিদাবাদের নবাবরা জামদানির পোশাক পরতেন। ইবনে বতুতা থেকে শুরু করে ব্রিটেন ও বিভিন্ন দেশের পর্যটক বাংলাদেশ ভ্রমণের সময় এই জামদানির প্রশংসা করেছিলেন।

তবে এই শিল্প সংকুচিত হয়ে পড়ে ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের পর থেকেই। তখন যন্ত্র দিয়ে কম মূল্যের ছাপার শাড়ি বানানো শুরু হয়। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর এই জামদানি টিকিয়ে রাখতে উদ্যোগ নেয়া হয়।

বর্তমানে ঢাকার মিরপুরে জামদানি পল্লি আছে, এছাড়া নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার তারাবো পৌরসভার নোয়াপাড়া গ্রামে ১৯৯৩ সালে গড়ে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধানে ২০ একর জমির ওপর জামদানী নগর তোলা হয়েছে।

ইলিশ

বাংলাদেশ মৎস্য অধিদফতর ইলিশ মাছকে জিআই স্বীকৃতি দেয়ার জন্য নিবন্ধনের আবেদন করেছিল। ২০১৭ সালে সেটা স্বীকৃতি পায়। ইলিশ ১৮২২ সাল থেকে বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও কৃষ্টির সাথে জড়িয়ে আছে। বিশ্বে মোট ইলিশের ৭৫% বাংলাদেশে উৎপাদন হয়ে থাকে। এছাড়া বাংলাদেশে মোট উৎপাদিত মাছের ১০% ইলিশ।

২০১৪-১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী প্রতিবছর ৩.৮৭ লাখ মেট্রিক টন ইলিশ উৎপাদন হয়। যার বাজার মূল্য সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশের জিডিপির ১% আসে ইলিশ থেকেই।

এই মাছ স্বাদে, ঘ্রাণে উৎকৃষ্ট। খাদ্যমানেও সমৃদ্ধ। এতে উচ্চমাত্রার আমিষ, চর্বি ও খনিজ পদার্থ রয়েছে। সেইসাথে আছে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড, অ্যামিনো অ্যাসিড, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, আয়রন, ভিটামিন-এ, ডি, বি।

ইলিশের বৈশিষ্ট্য হলো এটি টর্পেডো আকৃতির রুপালি রঙের মাছ। পিঠে কিছুটা কালচে ভাব আছে। পোনা বা জাটকা অবস্থায় গায়ে সারিবদ্ধ দাগ থাকে। ইলিশ ডিম থেকে ফোটার পর পরিপক্ব হতে আট মাস থেকে এক বছর সময় লাগে। পরিণত ইলিশ সর্বোচ্চ ৬৩ সেন্টিমিটার বা দুই ফুটের বেশি লম্বা এবং ওজনে সর্বোচ্চ তিন/সাড়ে তিন কেজি হতে পারে।

তবে সচরাচর মাছের ওজন ২ কেজি ওজনে পৌঁছানোর আগেই জালে ধরা পড়ে। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় ১০০টি নদীতে ইলিশ পাওয়া যায়। বিশেষ করে পদ্মা ও মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদ-নদী, এর শাখা উপ শাখা, মোহনা ও বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় অঞ্চলে ইলিশের বিচরণ করে।

মেঘনা নদীর নিম্নাঞ্চল কালাবদর, তেঁতুলিয়া, আড়িয়াল খাঁ, এছাড়াও বিষখালী, পায়রা, রূপসা, শিবসা, পশুর, লোহাদিয়া, আন্ধারমানিক নদী, মোহনা ও সাগর উপকূলে সারা বছর ইলিশ ধরা পড়ে।

এছাড়া পদ্মার নিম্নাঞ্চলে ইলিশের অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠা করায় ইলিশ সংরক্ষণে বছরের নির্দিষ্ট কিছু দিন ইলিশ আহরণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় পদ্মায় ইলিশের প্রাপ্যতা অনেক বেড়েছে।

সাধারণত সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে ইলিশ ডিম পাড়ার জন্য সমুদ্র থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে আমাবস্যা ও পূর্ণিমার জোয়ারে নদীতে প্রবেশ করে। মেঘনা নদীর ঢলচর, মনপুরা দ্বীপ, মৌলভির চর, কালির চার এই ৪টি এলাকার সাত হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা ইলিশের প্রধান প্রজনন ক্ষেত্র।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের খিরসাপাত আম

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট এই পণ্যটিকে জিআই স্বীকৃতি দেয়ার জন্য নিবন্ধনের আবেদন করেছিল। সেটা স্বীকৃতি পায় ২০১৯ সালে। ডিমের মতো দেখতে মাঝারি আকারের এই আমটির মূল বৈশিষ্ট্য হল এর শাঁস আশবিহীন, রসালো, গন্ধ বেশ আকর্ষণীয় এবং স্বাদে খুব মিষ্টি। বলা হয় এর গড় মিষ্টতা ২৩%। ফলের খোসা সামান্য মোটা তবে আঁটি পাতলা। এ কারণে আমটির গড়ে ৬৭ ভাগ খাওয়া যায়।

বাংলাদেশে যতো জাতের আম হয়, তারমধ্যে খিরসাপাত আমটিকে সবচেয়ে উন্নত জাত বলা হয়ে থাকে। মধ্যম মৌসুমি এই ফলটি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন হয়। সাধারণত জ্যৈষ্ঠ মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে অর্থাৎ জুন মাসের শুরু থেকে আম পাকা শুরু করে। ফলন ভালো তবে অনিয়মিত। ফল পাড়ার পর পাকতে ৫-৭ দিন সময় লাগে। ফুল আসা থেকে ফল পরিপক্ব হতে চার মাস সময় লাগে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ, ভোলারহাট ও গোমস্তাপুর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি খিরসাপাত আমের চাষ হয়ে থাকে।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, আজ থেকে দুইশ বছর আগে শিবগঞ্জ উপজেলার দুইশ বিঘার ওপর আমের বাগান ছিলো। এছাড়া ৩৫ বিঘার ওপর দেড়শ বছরের পুরনো আরেকটি বাগান আছে। দুটো বাগানেই খিরসাপাত আমের চাষাবাদ হতো বলে জানা গেছে।

ঢাকাই মসলিন

বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড (বাতাঁবো) ঢাকাই মসলিনকে জি-আই পণ্য হিসেবে নিবন্ধন করার জন্য ডিপিডিটির কাছে আবেদন করলে সেটি ২০২০ সালে স্বীকৃতি পায়। বাতাঁবো তাদের আবেদন জানিয়েছে যে, তারা ছাড়া প্রকৃত মসলিন কাপড় বর্তমানে অন্য কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তৈরি করছে না। এখন থেকে কেউ ঢাকাই মসলিন উৎপাদন করতে গেলে বাংলাদেশের তাঁত বোর্ডের সুপারিশক্রমে ডিপিডিটির থেকে নিবন্ধন নিতে হবে।

ঢাকাই মসলিন হচ্ছে ফুটি কার্পাস তুলায় তৈরি এক ধরণের সূক্ষ্ম ও পাতলা কাপড়। ১০০% সূতি এই কাপড়ের সূতা চরকার মাধ্যমে তৈরি করে গর্ত/পিট তাঁতে বুনন করা হয়। চরকায় কাটা বলে এই কাপড় অসমান, খুব মসৃণ, পাতলা, স্বচ্ছ, ওজনে হালকা এবং পরিধানে বেশ আরামদায়ক।

ভালো মানের এই ফুটি কার্পাসটি মেঘনা নদীর পশ্চিম তীরে ঢাকা জেলার আশেপাশে সোনারগাঁ, ধামরাই, কাপাসিয়া, কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ি, বাজিতপুরসহ কয়েকটি স্থানে জন্মাত। গাজীপুরের কাপাসিয়া নামটি এই কার্পাস থেকেই এসেছে বলে মনে করা হয়।

মসলিনের ইতিহাস হাজার বছরের। মসলিন শব্দটি ইরাকের প্রাচীন ব্যবসাকেন্দ্র মসুল থেকে উদ্ভূত বলে ধারণা করা হয়। এক সময় বলা হতো, মসলিন শাড়ির বুনন এতোটাই সূক্ষ্ম ছিল যে পুরো একটি শাড়ি আংটির ভেতর দিয়ে এপার-ওপার করা যতো।এই কাপড়ের উৎপাদন ১৭ শতকে মোঘল আমলে ব্যাপক বিকাশ লাভ করে। একে বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আভিজাত্যের সাক্ষী হিসেবেও বর্ণনা করা হয়েছে।

তবে ব্রিটিশ শাসনামলে মসলিন কারিগররা মসলিন তৈরি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। এখন আবার নতুন করে মসলিন তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের এক দল গবেষক গত ছয় বছরের গবেষণায় সফলতা পেয়েছে।

১৯৬৫ সালে রচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. আব্দুল করিম 'ঢাকাই মসলিন' গ্রন্থে ১৮ প্রকার মসলিনের বর্ণনা করেছিলেন। তারমধ্য রয়েছে মলমল খাস, বদন খাস, ঝুনা, খাসসা, শবনম ইত্যাদি। একেকটি ঢাকাই মসলিনের স্পেসিফিকেশন একেক রকম। মূলত সুতার সূক্ষ্মতা, বুনন শৈলী আর নকশার বিচারে এই পার্থক্য হয়ে থাকে।

রাজশাহী সিল্ক

রাজশাহী সিল্ক পণ্যটিকে জি-আই হিসেবে নিবন্ধনের জন্য ২০১৭ সালে আবেদন করে রাজশাহী জেলার বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ড। যা এ বছর স্বীকৃতি পেয়েছে। রেশম কাপড়ের একটি ব্র্যান্ডের নাম রাজশাহী সিল্ক। এর মূল বৈশিষ্ট্য হল এটি মালবেরি সিল্ক যা প্রাণীজ তন্তু ও প্রোটিনাস ফাইবার দিয়ে তৈরি।

মালবেরির বাংলা হল তুঁত গাছ। এই গাছের পাতা রেশম পোকা ২০-২২ দিন খাওয়ার পর পোকার মুখ থেকে লালা নিঃসৃত হয়। সেই লালা থেকে তৈরি হয় রেশম গুটি। এই রেশম গুটি থেকে রিলিং মেশিনের মাধ্যমে সুতা বা কাঁচা রেশম উত্তোলন করা হয়।সেই কাঁচা রেশমকে বিভিন্ন উপায়ে প্রক্রিয়া করে তাঁত মেশিনে বুনে তৈরি করা হয় রাজশাহী সিল্কের কাপড়।

কাপড় বোনার পর বিভিন্ন রং দিয়ে ডাইয়িং ও প্রিন্টিং করা হয়। অনেক সময় কাপড় বোনার আগে সূতা রং করা হয়ে থাকে। এ কারণে রাজশাহী সিল্ক দেখতে বেশ উজ্জ্বল ও চকচকে সেইসঙ্গে কোমল ও আরামদায়ক।

স্বাভাবিক অবস্থায় রাজশাহী সিল্কে ১১% জলীয় অংশ থাকে। এ কারণে শীত, গ্রীষ্ম সব ঋতুতে রাজশাহী সিল্ক পরিধান করা আরামদায়ক। পেটেন্টস, ডিজাইন এবং ট্রেডমার্ক বিভাগের ভৌগলিক নির্দেশক পণ্যের জার্নাল-৮ এ এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

মো. আব্দুর রশীদ খানের লেখা, 'বাংলাদেশের ঐতিহ্য রাজশাহী সিল্ক'- বই অনুযায়ী ১৭৫৯ সাল বা তার আগে থেকেই রাজশাহীতে রেশম পোকার উৎপাদন ও এর কাপড় ব্যবহার হয়ে আসছে।

রাজশাহীর বোয়ালিয়া বন্দরে এই রেশমের চাষ হতো সবচেয়ে বেশি। অষ্টাদশ শতকে ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে রাজশাহী সিল্ক রপ্তানি হতো। এখন নতুন করে রপ্তানি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

রংপুরের শতরঞ্জি

জিআই স্বীকৃতি দেয়ার জন্য নিবন্ধনের আবেদন থেকে বাদ পড়েনি রংপুরের শতরঞ্জিও। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) ২০১৯ সালে ডিটিডিটি-এর কাছে এই আবেদন করেছিল। যা ২০২১ সালে এসে স্বীকৃতি পায়।

রংপুরের ঘাঘট নদীর তীরে নিসবেতগঞ্জ গ্রামে শতরঞ্জি শিল্প গড়ে উঠেছে। ব্রিটিশ নাগরিক নিসবেট ১৮৪০ শতাব্দীর দিকে তৎকালীন রংপুর জেলার কালেক্টর ছিলেন। সেই সময়ে নিসবেতগঞ্জের নাম ছিল পীরপুর।

পীরপুর গ্রামে সে সময়ে রং-বেরংয়ের সুতার গালিচা বা শতরঞ্জি তৈরি হত। নিসবেট এসব শতরঞ্জি দেখে মুগ্ধ হন এবং এ শিল্পের প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে সহায়তা দেন এবং বিপণনের ব্যবস্থা করেন। তার এই ভূমিকার জন্যই নিসবেটের নামানুসারে পীরপুরের নামকরণ হয় নিসবেতগঞ্জ। রংপুরের সরকারি বেগম রোকেয়া কলেজের সহকারী অধ্যাপক মো. আজহারুল ইসলাম তার এক প্রবন্ধে এসব তথ্য দিয়েছেন।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, এয়োদশ শতাব্দীতেও এ এলাকায় শতরঞ্জির প্রচলন ছিলো। মোঘল সম্রাট আকবরের দরবারে শতরঞ্জি ব্যবহার করা হত বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়। এছাড়া জমিদার জোতদারদের ভোজের আসন হিসেবে শতরঞ্জির ব্যবহার হতো। সে সময়ে শতরঞ্জি রাজা-বাদশাহ, বিত্তবানদের বাড়িতে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হত।

ব্রিটিশ শাসনামলে শতরঞ্জি এত বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করে যে এখানকার তৈরি শতরঞ্জি সমগ্র ভারতবর্ষ, বার্মা, সিংহল, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হত। মজার ব্যাপার হলো, এ পণ্য উৎপাদনে কোন যন্ত্র লাগে না। কেবলমাত্র বাঁশ এবং রশি দিয়ে মাটির উপর সুতো টানা দিয়ে হাতে নকশা করে শতরঞ্জি তৈরি করা হয়।

১৯৭৬ সালে সরকারিভাবে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) নিসবেতগঞ্জ গ্রামে শতরঞ্জি তৈরির একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। কিন্তু বাজার সৃষ্টি না হওয়ায় প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়ার অবস্থা হয়েছিল। 

পরে, ১৯৯৪ সালে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা উন্নত প্রশিক্ষণ দিয়ে ওই এলাকার মানুষদের শতরঞ্জি উৎপাদনে উদ্বুদ্ধ করে। সেই থেকে রংপুরের শতরঞ্জি ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও এশিয়ার প্রায় ৩৬টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে বলে জানা গেছে। এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে রপ্তানি বাণিজ্যে হস্তশিল্পের ৬০ শতাংশই রপ্তানি হয়ে থাকে রংপুরের শতরঞ্জি। বিগত তিন বছরে গড়ে প্রতিবছর প্রায় ৪০ লাখ ডলার দেশে আনা সম্ভব হয়েছে এই রংপুরের উৎপাদিত শতরঞ্জির মাধ্যমে।

বাংলাদেশ কালিজিরা

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট এই পণ্যটিকে জিআই হিসেবে নিবন্ধনের জন্যে আবেদন জানিয়েছিল। যা স্বীকৃতি পেয়েছে ২০২১ সালে। সাধারণত কালিজিরা ধানের খোসা কালো হয়ে থাকে। তবে খোসা ছাড়ালে সাদা রঙের চাল বেরিয়ে আসে। এই জাতের ধানের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এটি খুব ছোট এবং সুগন্ধযুক্ত।

দানার আকৃতি ছোট আবার খোসা কালো হওয়ার কারণে একে দেখতে অনেকটা কালিজিরা মশলার মতো মনে হয়। তাই এমন নামকরণ করা হয়েছে। এই চাল দিয়ে মূলত ভাত, পোলাও, পায়েস বা ফিরনি তৈরি করা হয়। এই ধানের উৎপত্তিস্থল ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে বাংলাদেশের ময়মনসিংহ অঞ্চলে।

তবে অতুলনীয় স্বাদ, গন্ধ ও গুনাগুণের জন্য এই ধান সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। সাধারণত শ্রাবণ থেকে ভাদ্র মাস অর্থাৎ আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়ে কালিজিরার চারা রোপণ করতে হয়। অগ্রহায়ণের শেষের দিকে অর্থাৎ ১০ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে ফসল কাটা হয়। অর্থাৎ রোপা আমনের মৌসুম হল কালিজিরা ধান উৎপাদনের সময়।

দিনাজপুর কাটারীভোগ

এই পণ্যটিকেও জিআই হিসেবে নিবন্ধনের জন্যে আবেদন জানিয়েছিল বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট। এই ধানের বৈশিষ্ট্য হল এ থেকে উৎপাদিত চাল সরু ও সুগন্ধি। এটি সারা বাংলাদেশে উৎপাদন হলেও সবচেয়ে বেশি চাষ করা হয় ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, মাগুরা ও সিলেট জেলায়।

তবে এই ধানটির মূল উৎপত্তিস্থল দিনাজপুরে। দিনাজপুর ছাড়া অন্য এলাকায় চাষ হলে এর সুগন্ধি কমে যায়। দিনাজপুরে উৎপাদিত আমন ধানের মধ্যে কাটারীভোগ অন্যতম। এ কারণে দিনাজপুরের কাটারীভোগ পণ্যটিকেই এই স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, দিনাজপুর জেলার চিরিবন্দর উপজেলাতে কাটারীভোগ সবচেয়ে বেশি পরিমাণে চাষ হয়ে থাকে। চাষাবাদের অনুকূল পরিবেশ থাকায় দিনাজপুরে প্রাচীনকাল থেকেই কাটারীভোগ চাষাবাদ হয়ে আসছে। কাটারীভোগ ধানটিও রোপা আমনের মৌসুমের ফসল। সে হিসেবে শ্রাবণ থেকে ভাদ্র মাস অর্থাৎ আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়ে চারা রোপণ করতে হয়। অগ্রহায়ণের শেষের দিকে অর্থাৎ ১০ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে ফসল কাটা হয়।

বিজয়পুরের সাদামাটি

নেত্রকোনার এই প্রাকৃতিক সম্পদটিকে জিআই স্বীকৃতি দিতে নিবন্ধনের আবেদন করেছিল নেত্রকোনা জেলা প্রশাসনের কার্যালয়। যা ২০২১ সালে এসে স্বীকৃতি পায়। সিরামিকের তৈজসপত্র, টাইলস, গ্লাসসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহার হচ্ছে এই উৎকৃষ্ট মানের সাদামাটি।

নেত্রকোনা জেলার বিজয়পুরে সাদামাটির বিপুল মজুদ আছে। এই মাটির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল এটি প্রাকৃতিক-ভাবেই কেওলিন বা অ্যালুমিনিয়াম সমৃদ্ধ। সেইসঙ্গে সিলিকা বালিসহ আরও অনেক খনিজ পদার্থ রয়েছে। স্থান ভেদে মাটি বৈশিষ্ট্য ও মান ভিন্ন ভিন্ন হয়। কালো, ধূসর ও লাল রঙের এই মাটি শুকনো অবস্থায় মধ্যম মাত্রার শক্ত ও ভঙ্গুর হয়। কিন্তু ভেজা অবস্থায় এই মাটি বেশ মসৃণ, নরম ও আঠালো।

বাংলাদেশ ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতর ১৯৫৭ সালে তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার দুর্গাপুর থানায় ভেদিকুরা নামক স্থানে প্রথম সাদামাটির সন্ধান পাওয়া যায়। দুর্গাপুর বর্তমানে নেত্রকোনার একটি উপজেলা। উপজেলার সমেশ্বরী নদীর ওপারেই সাদামাটির পাহাড়ের অবস্থান। এখনো ১৬৩টি সাদামাটির টিলা রয়েছে।

এই বিজয়পুরে ১৯৬৪-৬৫ সালের দিকে ১৩টি কূপ খনন করা হয়। ১৯৬৮ সাল থেকে শুরু হয় মাটি উত্তোলন। তবে এখন ৯টি কূপ থেকে মাটি তোলার কাজ করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত ৫ লাখ মেট্রিকটন মাটি উত্তোলন করা হয়েছে। মজুদ আছে ১৩.৭৭ লাখ মেট্রিক টন।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh