ঘাটতি পূরণ হবে কীভাবে?

এম এইচ রশিদ

প্রকাশ: ২০ জুন ২০২১, ০৮:৪৯ এএম | আপডেট: ২০ জুন ২০২১, ০৯:১৩ এএম

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

করোনাভাইরাসের সংকট প্রতিনিয়ত তীব্র হচ্ছে। জীবননাশের পাশাপাশি অর্থনৈতিক ক্ষতিও প্রকট আকার ধারণ করছে। সংকটময় পরিস্থিতির মধ্যে করোনাকালীন দ্বিতীয় বাজেট জাতীয় সংসদে পেশ করা হয়েছে। সংকটকালের মধ্যেও প্রস্তাবিত ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটটি দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাজেট; কিন্তু বড় বাজেটের বড় দুর্বলতা হচ্ছে, ঘাটতি অনেক বেশি। 

দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার ঘাটতি রেখে বাজেট পেশ করা হয়েছে। টাকার অঙ্কের পাশাপাশি জিডিপির অনুপাতেও বাজেটে ঘাটতি অনেক বেড়েছে। বৈশ্বিক মানদণ্ড অনুসরণ করে আগের বছরগুলোতে ঘাটতি রাখা হতো জিডিপির ৫ শতাংশ; কিন্তু সংকটের বছরে ঘাটতি জিডিপির ৬ শতাংশ অতিক্রম করেছে। 

করোনা পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে বা সংক্রমণ আরও তীব্র হলে বছর শেষে ঘাটতি আরও বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। 

গত ৩ জুন জাতীয় সংসদে আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এই ব্যয় বিপরীতে আয় হবে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যয়ের তুলনায় আয় কম হওয়ায় ঘাটতি থাকবে ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। এটি ঘাটতি মোট জিডিপির ৬ দশমিক ২ শতাংশ। বড় অঙ্কের এই ঘাটতি মেটাতে দেশি উৎস থেকে ঋণ এবং বিদেশি উৎস থেকে ঋণ ও অনুদান নিয়ে মেটানোর হিসাব তৈরি করেছে সরকার। দেশি উৎস থেকে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকার ঘাটতি

মেটানো হবে। দেশি উৎসের মধ্যে রয়েছে- ব্যাংক ঋণ ও সঞ্চয়পত্র বিক্রি। আগামী অর্থবছরে ঘাটতি মেটাতে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ করার পরিকল্পনা রয়েছে। সঞ্চয়পত্র ও নন-ব্যাংকিং উৎস থেকে আরও ৩৭ হাজার ১ কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। আর বিদেশি উৎস থেকে নেওয়া হবে ১ লাখ ১ হাজার ২২৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে রয়েছে- বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার অনুদান এবং বৈদেশিক মুদ্রার ঋণ। 

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনা পরিস্থিতি মাথায় রেখে নতুন বছরের বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকারের আয়ের বড় ও প্রধান উৎস জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর আহরণ। প্রতি বছর বিভিন্ন খাতে কর হার বাড়িয়ে রাজস্ব আয় বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হয়; কিন্তু করোনার কারণে এ বছর কর হার বাড়ানো হয়নি। উল্টো দেশীয় শিল্পগুলোকে সচল করার স্বার্থে নানা জায়গায় কর ছাড় দেয়া হয়েছে।

ব্যবসা-বাণিজ্য ও মানুষের আয়-রোজগার যেভাবে কমে গেছে, তাতে ব্যক্তি থেকে কর আহরণও কমতে পারে। আয় বৃদ্ধিতে যে ধরনের প্রস্তাব করা হয়েছে, করোনার কারণে সেটি বাস্তবায়ন না হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাজেট বাস্তবায়নের হার কমে যাচ্ছে। করোনার কারণে এই হার বছর শেষে আরও কমতে পারে। সুতরাং অর্থনীতিতে সংকট থাকার কারণে রাজস্ব আয় কমে যাবে এটিই স্বাভাবিক। রাজস্ব আয় কমে গেছে বাজেট ঘাটতি আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। 

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, চলতি অর্থবছর এবং আগামী অর্থবছরে কর থেকে সরকারের আয় কমবে। সেক্ষেত্রে বাজেটের ঘাটতি এমনিতেই বেড়ে যাবে। বাজেটের ঘাটতি আমি মনে করি কোনো সমস্যা না। বর্তমান অবস্থায় সরকারকে বেশি ব্যয় করতেই হবে। মানুষের জীবন ও জীবিকা রক্ষায়, সামাজিক নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বেশি ব্যয় করা জরুরি। তা ঋণ করে হলেও। 

এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, বাজেট ঘাটতির অর্থ কোথা থেকে আসবে সেটা বড় প্রশ্ন। বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৬ দশমিক ২ শতাংশ ধরা হয়েছে। বৈদেশিক উৎস থেকে বাজেট ঘাটতি পূরণের বিষয়টি ইতিবাচক দিক। এটা আকাক্সিক্ষত। তবে ২০২০-২১ অর্থবছরের ১০ মাসের গতিপ্রকৃতি পর্যালোচনা করে পুরো অর্থবছর কেমন হতে যাচ্ছে, সে বিষয়টি মাথায় রেখে ২০২১-২২ অর্থবছরে সামষ্টিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে গতিপ্রকৃতি ঠিক করা হয়নি। আমরা এখানে দুর্বল অবস্থায় রয়েছি। 

তিনি আরও বলেন, রাজস্ব আহরণের বিষয়ে বাজেটে বলা হয়েছে, আগামী অর্থবছরে চলতি সংশোধিত বাজেটের তুলনায় রাজস্ব আহরণ ১০ দশমিক ৭ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। ঘাটতি বাজেটের অর্থায়ন রাজস্ব আদায়ের মাধ্যমে কতটুকু সম্ভব হবে, সে বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ আছে। রাজস্ব আহরণ ৩০ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা অসম্ভব। বাজেটে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৯ দশমিক ৬ শতাংশ। বলা হচ্ছে, রাজস্ব আদায়ের মাধ্যমে ঘাটতি পূরণ করা হবে। ব্যয় ঠিক করে আয়ের চিন্তাধারা থেকে এনবিআরের ওপর রাজস্ব আদায়ের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়। যা আসলে অর্জন করা সম্ভব হয় না। বাজেট ঘাটতি নতুন বিষয় নয়। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি ছিল জিডিপির ৬ শতাংশ। তবে আগের ১০ বছর ধরে বাজেট ঘাটতি রাখা হচ্ছিল ৫ শতাংশের নিচে।

ঘাটতি বাজেটের বড় সংকট ঋণনির্ভরতা। প্রতি বছর ঘাটতি বাজেট দেওয়া হচ্ছে আর ঘাটতি মেটাতে ঋণ নেয়া হচ্ছে। প্রতিবছর ঋণের সুদ পরিশোধের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। এ জন্য আগামী বছরে সুদ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৬৭ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। করোনার কারণে ব্যাংকগুলোতে প্রচুর অলস তারল্য রয়েছে। কারণ ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করতে চাচ্ছে না। এক্ষেত্রে সরকার সহজেই ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারে। 

ব্যাংক ঋণের সুদহার সঞ্চয়পত্র সুদহারের তুলনায় প্রায় অর্ধেক; কিন্তু সরকার ব্যাংক ঋণের পরিবর্তে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে বেশি নজর দিচ্ছে। সরকারের তৎপরতার কারণে এ বছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে নিট আয় হয়েছে ৩৪ হাজার ৭২৮ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় সাড়ে ৩ গুণ বেশি। গত অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে নিট আয় হয় ১০ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্রগুলোর বিপরীতে সরকারকে গড়ে ১১ থেকে ১২ শতাংশ সুদ পরিশোধ করতে হয়। সঞ্চয়পত্র বিক্রির বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সুদ পরিশোধের চাপ বাড়ছে। বাড়তি ব্যয় বাজেট কাঠামো চাপ সৃষ্টি করছে। 

তবে দেশি উৎসের তুলনায় বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নিলে সুদ অনেক কম। বিদেশি উৎস থেকে ১ শতাংশেরও কম সুদে ঋণ নেওয়া সম্ভব। বিদেশি উৎস থেকে বেশি ঋণ নিলে সুদ ব্যয়ের চাপ কিছুটা কম হবে। এছাড়া বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নিলে অর্থ ব্যয়ে স্বচ্ছতা আনা সম্ভব।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh