ভ্রমণ

কেরালা: যাকে যায় না ভোলা!

সজল জাহিদ

প্রকাশ: ২০ জুন ২০২১, ০৬:৪৯ পিএম | আপডেট: ০৮ জুলাই ২০২১, ০৮:৫২ এএম

সবুজের সমুদ্র!

সবুজের সমুদ্র!

সত্যিই কেরালা, ভারতের এমন একটা রাজ্য- যে একবার এই রাজ্যে গিয়েছে, কয়েক দিন থেকেছে, মনের মতো খাবার খুঁজে পেয়েছে আর প্রকৃতির কাছে নিজেকে সপে দিতে পেরেছে, সে কখনো কেরালাকে কিছুতেই ভুলে যেতে পারবে না। সেটা সম্ভব নয়। বেশ কয়েক বছর কেটে গেছে, আমাদের কেরালা ভ্রমণের। তবু আজও যেন সেইসব স্মৃতি, ছবি, প্রকৃতি আর অনুভূতিগুলো আমাদের কাছে ঠিক তেমনই অমলিন রয়েছে! তাই এবারের গল্প আমাদের কেরালা ভ্রমণের কয়েকটি ছোট্ট ছোট্ট গল্পের সমন্বয় মাত্র! চলুন অল্প করেই ঘুরে আসি কেরালা, আমার আর আমাদের মতো করে। ভালো লাগবে কি-না সেটা না হয় ছেড়ে দিলাম পাঠকের হাতেই!

নারিকেলের অরণ্যে...!! 

কি হাস্যকর নারিকেলের অরণ্য হয় কখনো বা নারিকেল গাছের অরণ্য? অদ্ভূত তো!

আসলেই অদ্ভূত! আমি নিজেই অবাক হয়ে গেছি দেখে, যে নারিকেলের অরণ্য আছে কোথাও তাই দেখে। আপনি যদি গোয়া থেকে ট্রেনে করে কখনো কেরালা যান, তাহলে আপনাকে শত শত বা হাজার হাজার নয়, লাখ লাখ নারিকেল গাছের অরণ্যের মাঝ দিয়ে ছুটে যেতে হবে। হ্যাঁ সত্যি তাই, গোয়া থেকে কেরালা যেতে প্রায় পুরো পথই যেন নারিকেলের অরণ্য দিয়ে সাজানো। আমি অভিভূত হয়েছি এই মুগ্ধতা মাখানো আর হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া নারিকেলের অরণ্য দেখে। 

গোয়া থেকে আমাদের কেরালা যাবার ট্রেন ছিল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায়। যেটা কেরালার ইরনাকুলাম স্টেশনে পৌঁছাবে পরদিন সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে। আমাদের উপায় ছিল না। কারণ শুধু গোয়ার পরিকল্পনা করে টিকিট করে ফেলার পরে কেরালা যুক্ত হয়েছিল হুট করেই। তাই গোয়া থেকে কেরালা যাবার জন্য পছন্দের ট্রেনে টিকিট কাটতে পারিনি। অগত্যা সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিটের টিকিটই কাটতে হয়েছিল।

ট্রেনে যখন গোয়া, কর্নাটক আর কিছুটা তামিলনাড়ু হয়ে কেরালা যাচ্ছিলাম রাতে তো আর কিছু চোখে পড়েনি। এক ব্যাঙ্গালুরু স্টেশন ছাড়া। কারণ সেখানে ট্রেন বেশ খানিকটা সময় দাঁড়িয়েছিল বলে নিচে নেমে গভীর রাতের ব্যাঙ্গালুরু দেখছিলাম আর ভাবছিলাম দূর বাইরের প্রকৃতির কিছুই দেখা হলো না এদিকটার। যে কারণে ঘুমের কাছে আকুল আবেদন ছিল, দেরি করে ঘুমোলেও সে যেন একট রাতারাতি ভেঙে যায়।

ঘুম কখন ভেঙেছিল সেই প্রসঙ্গ না হয় থাক; কিন্তু সূর্যের নানা রকম স্পর্শে চোখ মেলে দেখি আমাদের লাখ্যাদ্বীপ এক্সপ্রেস ছুটে চলেছে স্বচ্ছ টলটলে নদী, সবুজ অরণ্য, আর নারিকেল গাছের এক অপূর্ব জগতের মধ্য দিয়ে। জীবনে নারিকেল গাছ তো অনেক দেখেছি; কিন্তু নারিকেল গাছের যে আলাদা একটা সৌন্দর্য থাকতে পারে কোনো দিন চোখে পড়েনি আর ভেবেও দেখিনি।

এমন চোখ জুড়ানো আর প্রাণ পাগল করা নারিকেল গাছের সারি কোনো দিন দেখিনি। যেদিকে তাকাই শুধু সারি সারি নারিকেল বাগান। এ যেন বাগান নয় নারিকেল গাছের অরণ্য চারদিকে। মাঠে ঘাটে, নদী, পুকুর, জলাশয়, বাড়ির চারপাশ বা খোলা কোনো প্রান্তর যেদিকে তাকাই, শুধু নারিকেল আর নারিকেল গাছ। সবকিছু যেন শুধু নারিকেল গাছ দিয়েই সাজানো। অন্যান্য সবুজের মাঝেও সারি সারি আর উঁচু উঁচু নারিকেলের গাছগুলো আলাদা করে নজর কাড়বে যে কারও।

যখন ট্রেন কোনো নদী পার হবে, সেখানে নদীর দুই ধারে শুধু নারিকেল আর নারিকেল গাছের সারি ঠায় দাঁড়িয়ে, উঁচুতে ঝুঁলে থাকা লম্বা লম্বা সবুজ পাতা নাড়িয়ে স্বাগত জানাবে। আর সেই সব নদীর পানি এতটাই স্বচ্ছ আর টলটলে যে, ট্রেন থেকে নেমে একটা ডুব দিতে ইচ্ছা করবে যে কারও। একই সঙ্গে এমন নদী আর সবুজ অরণ্য পেলে যা হয় আর কি? সেদিক থেকে চোখ ফেরাতে ইচ্ছাই করবে না।

কিন্তু নদী পেরিয়ে ট্রেন যখন খোলা প্রান্তর ধরে ছুটে যাবে, তখনো কাছে দূরে চোখে পরবে সারি সারি নারিকেলের অরণ্য। যেন দুলে দুলে, সবুজ পাতার হাত নেড়ে টা টা জানাচ্ছে আপনার ছুটে যাওয়াকে আর সামনের গাছগুলো জানাচ্ছে স্বাগত। এতোই অপরূপ তাদের একাগ্রতা, একনিষ্ঠতা, আন্তরিকতা আর সবুজের আহ্বান। সেই সকাল থেকে ইরনাকুলার (কেরালার রেল স্টেশন) পৌঁছান পর্যন্ত পুরোটা পথই এমন সবুজ আর অনিন্দ্য সুন্দর নারিকেল গাছের অরণ্যে শোভিত। আর যেসব স্টেশনে মাঝে মাঝে ট্রেন থেমেছে, প্রতিটা স্টেশন এতোটা, এতটাই পরিচ্ছন্ন আর ঝকঝকে যে নিজ থেকেই চমকে উঠেছি দেখে। স্টেশনও যে এতো পরিপাটি আর ঝকঝকে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।

এসব দেখতে দেখতে মনের মাঝে আফসোস আরও বেড়েছে, হায় তাহলে সারারাত যে পথে এলাম সেই পথও না যেন আরও কত সুন্দর ছিল, আরও কত সবুজ ছিল, না যেন আরও কতশত অপরূপ অরণ্য দেখতে পাইনি রাতের আঁধারে। কত শত, পাহাড়, পর্বত, ঢেউ খেলানো সবুজের সমুদ্র রয়ে গেছে রাতের অন্ধকারের মাঝে।

তবে মনে মনে সান্ত্বনা, এমন নারিকেলের অরণ্যের দেখা পাওয়া, প্রাণ ভরে উপভোগ করাও তো কম ভাগ্যের কথা নয়। যা পেয়েছি তাই নিয়েই না হয় আপাতত সুখে থাকি, স্মৃতিতে সুখের ছবি আঁকি, আর ভালোবেসে গল্প লিখি। কিন্তু আমাকে আরও অবাক করে দেওয়ার জন্য সামনেই যে ছুটে আসছিল আজকের বা এই ট্রেনের গন্তব্য ইরনাকুলাম স্টেশন সে কি জানতাম? মোটেই জানতাম না। যে কেরালার শুরুটাই হবে এমন আতিথেয়তা দিয়ে! ইরনাকুলাম, স্টেশনেই আতিথেয়তা...!

যেহেতু আমাদের ট্রেন কেরালা পৌঁছাবে সেই সকাল ১০ টার পরে, তাই এটা নিয়ে কিছুটা চিন্তিত ছিলাম। পরিবার সঙ্গে থাকলে যা হয় আর কি। ট্রেন থেকে নেমে, সারা রাতের জার্নির ক্লান্তি ঝেড়ে একট ফ্রেশ হওয়াটা খুব জরুরি হয়ে পড়েছিল। বিশেষ করে একটা ভালো গোসল দিতে না পারলে তো পরের জার্নি করাটা আরও কঠিন হয়ে পড়বে। আর তার ওপর যদি হয়, জুনের ৩৬-৩৮ ডিগ্রি গরম আর সামনে পাহাড়ি আঁকা-বাঁকা রাস্তায় ৪-৫ ঘণ্টার জার্নি। 

একটা হোটেল কিছু সময়ের জন্য পাওয়া বেশ কঠিন। আবার অল্প সময়ের জন্য পাওয়া গেলেও বেশকিছু টাকা গুনতে হবে। কি করি, কি করি? ট্রেনে বসে বসেই ভাবছিলাম। এই ভাবনায় ডুবে থাকতে থাকতেই ট্রেন কখন যেন ঝড়ের গতিতে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে ৩০ মিনিট আগেই ইরনাকুলাম স্টেশনে এসে থেমে গেল! ট্রেন থেকে নেমে একট ছায়ায় দাঁড়িয়ে চায়ের দোকানে খোঁজ নিয়ে জানলাম এক নাম্বার প্ল্যাটফর্মে এসি রেস্ট রুম আছে। এটা জেনে আর এক নাম্বার প্ল্যাটফর্ম কোন দিকে জেনে নিয়ে, সেদিকে তাড়াতাড়ি হেটে যেতে শুরু করলাম।

চলমান সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে অন্যদিকের এক নাম্বার প্ল্যাটফর্মে গেলাম। এসি ওয়েটিং রুম কোথায় জানতে চাইলে, জিজ্ঞাসা করল, পেইড না আনপেইড কমন ওয়েটিং রুম? দুটোই জেনে নিলাম আর দেখলাম পেইড যেটা, সেটা একদম যেখানে নেমেছি সেখানেই। আগে একট ঢুঁকে খোঁজ নিয়ে নেই আর দেখে নেই কেমন সেই ওয়েটিং রুম। যেখানে পে করে অপেক্ষা করতে হয়? এই ভেবে ওদেরকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেই তো অবাক! 


এ কি? এটা কি কোন ওয়েটিং রুম? এটাতো কোনো বনেদী বাড়ির ড্রইং রুম বা তার চেয়েও বিলাসবহুল ব্যাপার! কত না যেন দাম হবে এর ভাড়ার? 

তবুও সামনে বিশাল টেবিল, একপাশে ছোট্ট লাইব্রেরি, আর দারুণ চেয়ারে বসা ভদ্র মহিলাকে জিজ্ঞাসা করলাম, এখানে অপেক্ষা করার সিস্টেমটা কি রকম আর কি কি সুবিধা আছে? মানে ওয়াশরুম, স্নানের ব্যবস্থা আছে কি-না আর সে জন্য কত পে করতে হবে? এসব; কিন্তু তিনি যেটা বললেন সেটা ঠিক বিশ্বাস হলো না। আমি ঠিক শুনলাম কি-না বুঝতে পারলাম না! তাই আবারও জিজ্ঞাসা করলাম? এরপর তিনি আমাকে ছোট্ট চাট দেখিয়ে দিলেন, যেখানে সব কিছু লেখা আছে। যা দেখে আমার চক্ষু প্রায় চড়ক গাছে! ২৫ রুপির বিনিময়ে এক ঘণ্টার হিমশীতল ঘরের নরম আর বিশাল সোফায় বসা বা ঘুমানো। 

তবে এখানে বিশ্রাম নেবার একমাত্র শর্ত হলো, ট্রেনের টিকিট কনফার্ম থাকতে হবে। হ্যাঁ আমাদের সেটা আছে। কোনটা লাগবে যেটায় এলাম সেটার না কি তিনদিন পরে যেটায় যাবো সেটার? একটা হলেই হবে ব্যাস। এটা জেনে খুশিতে আটখানা নয় শোল খানা হয়ে ঝটপট ওদেরকে বাইরে থেকে ভেতরে নিয়ে এলাম; সঙ্গে আমাদের ব্যাগপত্র। তিনজনের টিকিট দেখিয়ে এক ঘণ্টার জন্য ২৫ রুপি করে জনপ্রতি দিয়ে টোকেন নিলাম। 

হিম ঠাণ্ডা রুমে বসে রেস্ট নিয়েই ছুটলাম ফ্রেস রুমে। মাঝে জেনে নিলাম এর জন্য কোনো পে করতে হবে কি-না আলাদা করে? না করতে হবে না। এমনকি গোসলও করা যাবে সাধ মিটিয়ে। ওয়াও! ফ্রেস হতে গেলাম বাপ-বেটা মিলে। ওরে বাপ কি ওয়াশ রুম। যেমন- বড় তেমনি ঝকঝকে আর আরামদায়ক। সেই সঙ্গে আলাদা শাওয়ার রুম, সঙ্গে ঠাণ্ডা আর গরম পানির ব্যবস্থা। আহ! আর কি চাই? ছেলেকে বসিয়ে ছেলের মাকে ঝটপট খবরটা দিয়ে এলুম! তখন মনে পরে গেল সেই প্রিয় উক্তি ‘অন্ধকারে যারা বাস করে, মৃদু আলোয় তাদের চোখ ঝলসায়’! আমাদেরও তাই হয়েছিল। না হয়েই বা উপায় কি? আমরা তো এমন করে ভাবতেই পারতাম না, যে একটা স্টেশনে এমন রাজকীয় ব্যাপার থাকতে পারে, তাও মাত্র ২৫ রুপির বিনিময়ে! 

যে যার মত করে ফ্রেস ও গোসল করে একদম সব ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে আরাম করে নরম সোফায় গা এলিয়ে দিলাম। কিছু সময় নরম সোফায় এলিয়ে থেকে উঠলাম। কোথায় কি খাবার পাওয়া যায় খুঁজে দেখার জন্য। বাইরে বেরিয়েই বাম পাশে দেখি দারুন এক অভিজাত রেস্তোরাঁ কাছের দেয়ালের ভেতরে। দেখেই কিছুটা কুঁকড়ে গেলাম, এই রেস্তোরাঁ তো আমার জন্য নয়। নিশ্চয়ই অনেক দাম হবে, যে ডেকোরেশন আর ভাবসাব। ভেতরে না ঢুঁকে ফেরত আসবো। তবুও ভাবলাম, না হয় একবার ভেতরটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে মেন্যু কার্ডটা দেখে আসি, কোনটার কত দাম? কিছুটা আড়ষ্ট হয়ে ঢুঁকে পড়লাম। যা হোক, আমার ওপর দিয়েই হোক, ছেলে আর মায়ের কাছে অপদস্থ না হলেই বাঁচি! আর এখানে তো আমাকে আর কেউ চেনে না! 

ভারী কাচের দরজা ঠেলতে গিয়ে দেখি ওপাশের দারোয়ান সেটা খুলে দিয়েছে! কিছুটা ভয়ই পেয়ে গেলাম। এটার জন্য না আবার বিলটিল দেওয়া লাগে! একটু এদিক সেদিক তাকিয়ে একটা মেন্যু কার্ড হাতে নিলাম। মেন্যু কার্ডে চোখ বুলিয়ে তো মাথা খারাপের জোগাড়! আমি কি ঠিক দেখছি না চোখে কোনো গণ্ডগোল হলো? মাছ-ভাত আর কারী মিলে ১২০ রুপি! একটা আণ্ডাকারী আর ভাত ৭০ রুপি (ডাবল ডিমের কারী), একটা খাবারেই দু’জনের আরামে হয়ে যাবে। সঙ্গে দুটি করে রুটি আছে! ঝটপট বেরিয়ে গেলাম, ওদেরকে নিয়ে আসতে।


ব্যাগপত্র নিয়ে ইরনাকুলাম স্টেশনের ওপরেই, লাগোয়া কাছের ঝকঝকে রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়লাম। ছেলের জন্য চিকেন বিরিয়ানি ১৩০, আর আমাদের জন্য আণ্ডাকারী ভাতের প্যাকেজ অর্ডার দিয়ে রেস্তোরাঁটা ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। ইস কি সুন্দর ঝকঝকে, তকতকে, পরিচ্ছন্ন, চারদিকে কাছের দেয়াল, ভেতরের আসবাবপত্রে আধুনিকতা আর আভিজাত্যের ছোঁয়া। দেখে, হেঁটে আর বসেই মন ভালো হয়ে যায়। তার ওপর খাবারের দাম যদি হয় এমন সাধ্যের মধ্যে, তবে তো আর কথাই থাকে না। খুশি আর মন ভালো হওয়ার পরিমাণ বেড়ে যায় কয়েকগুণ। 

কেরালায় এসেই, একটা স্টেশনেই এমন ব্যবস্থা, আর আরাম-আয়েশের সবকিছু হাতের নাগালে পেয়ে, সবাই দারুণ খুশি হয়েছিলাম। যেটা আমাদের কাছে আতিথেয়তার মতই লেগেছে। স্টেশনের আতিথেয়তা। আমাদের কাছেই তো তাই-ই। স্টেশনেই আতিথেয়তা।


মোহময় মুন্নারের পথে...
ইরনাকুলাম স্টেশনে আতিথেয়তায় ফ্রেশ হয়ে, পাশের রেস্টুরেন্টে খাবার খেয়ে, ওদেরকে বসিয়ে রেখে বাইরে গেলাম ট্যাক্সির খোঁজ নিতে। কয়েক জায়গায় খোঁজ নিয়ে দেখলাম যাওয়া-আসা বা শুধু যাওয়া অথবা দুই দিনের জন্য প্যাকেজ ঠিক করে নেওয়া কোনোটাই ৩৫০০-৬০০০ রুপির নিচে সম্ভব না। ইরনাকুলাম থেকে মুন্নারের দূরত্ব ১২৫ থেকে ১৩০ কিলোমিটারের মধ্যে। যার মধ্যে প্রায় অর্ধেকই আঁকা-বাঁকা পাহাড়ি উঁচু-নিচু পথ।

যেখানে ট্যাক্সিতে করে যেতেই অন্তত চার ঘণ্টা লাগবে আর বাসে গেলে পাঁচ ঘণ্টা। ফেসবুক বন্ধু আকাশ এক্ষেত্রে বেশ উপকার করেছে। ওর সঙ্গে যোগাযোগ করে ৩৫০০ রুপির ট্যাক্সি না নিয়ে এক কিলোমিটার দূরের স্টেট বাস স্ট্যান্ডে চলে গেলাম। যদিও ট্যাক্সির ড্রাইভাররা বারবার নিরুৎসাহিত করেছে বাসস্ট্যান্ডে যেতে। সকালের পরে নাকি আর মুন্নারের বাস পাওয়া যায় না বলে। তবুও আকাশের পরামর্শ মতো গেলাম দেখি না পাওয়া গেলে তখন না হয় ট্যাক্সি নেব।

ভাগ্যটা বেশ ভালো ছিল, বাস স্ট্যান্ডে গিয়েই জানলাম ১২টা ৫০ মিনিটে বাস আছে মুন্নার যাওয়ার। যদিও আকাশ বলেছিল একটা ৩০ মিনিটে ২টি বাস পাবো; কিন্তু দেড় ঘণ্টা আগেই বাস পেয়ে যাওয়াতে ভীষণ ভালো লেগেছিল। অনেকটা আগে আগে মুন্নার পৌঁছানো যাবে বলে। বাস আসবে একটু পরেই, সেটা জেনে নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম।

হঠাৎ করে ৩৭ ডিগ্রি গরমে এক পশলা বৃষ্টির স্পর্শ হয়ে কোথা থেকে যেন আজানের সুমধুর ধ্বনি ভেসে এলো! ভুল শুনছি নাতো? এই রকম জিজ্ঞাসা নিয়ে মা- ছেলে আর আমি তিন জনই তিন জনের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। আশপাশে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলাম যে, আসলেই এটা আজানেরই ধ্বনি কি-না? নাহ এটা আজানের শব্দই নিশ্চিত হয়ে আরও একটা অন্য রকম প্রশান্তি যেন ছুঁয়ে গেল। ইস ধর্মের কি আকর্ষণ? কি টান? কি দূর্বলতা? কি আবেগ? আর কি মহিমা? সেটা যেন আযানের প্রতিটি শব্দ, সুর আর ক্ষণে বুঝিয়ে দিচ্ছিল।

নীরব হয়ে আযান শুনে, বাসের খোঁজ নিতে শুরু করলাম। কখন আর কোথায় আসবে মুন্নার যাওয়ার বাস? বেশ কয়েকবার ভাষা সংক্রান্ত জটিলতা এড়িয়ে মুন্নারের বাস কোনটা সেটা জেনে নিয়ে ব্যাগপত্র নিয়ে উঠে পড়লাম। আমাদের সঙ্গে আরও বসেছিল তিন ইতালিয়ান। ওরাও মুন্নার যাবে, ব্যাকপ্যাকার ট্র্যাভেলার তিন জনই। একটি মেয়ে আর দুটি ছেলে। ঠিক ঠিক ১২ টা ৫০ মিনিটে বাসস্ট্যান্ড থেকে মুন্নারের উদ্দেশ্যে বাস ছেড়ে দিয়েছিল। তিনজন মিলে আরাম করে তিন সিট নিয়ে বসে পড়লাম। ভাড়া ছিল ১১৬ বা ১২৬ রুপি করে ফুল আর ৫৭ রুপি হাফ।

বাস এগিয়ে চলেছে কেরালা শহরের নানা রাস্তা পেরিয়ে মুন্নারের দিকে। সেদিন বেশ গরম পড়েছিল। তবুও ক্লান্তি আর বাসের ঝাকুনিতে কে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, তা বুঝতে পারিনি। এক জায়গায় এসে বাস থেকে নামতে হলো। বাসের কোনো একটা সমস্যা হয়েছে, সেটা ঠিক করবে বলে। সেখানে প্রায় ১০-১৫ মিনিট অপেক্ষার পরে আবার বাস ছেড়ে মেইন রাস্তায় উঠতেই চোখে পড়লো নানা রকমের মসজিদ একটু পরপর। দেখেই কেমন যেন একটা ভালো লাগা পেয়ে বসলো। শত হলেও ধর্মের টান বলে কথা।

কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম এরপর ঠিক মনে নেই। ঘুম ভাঙল যখন সমতল ছেড়ে পাহাড়ি পথে চলতে শুরু করেছিলাম। এক পাহাড়ি বাস স্ট্যান্ডে বাস থেমেছিল ১০ মিনিটের বিরতিতে। এত খটমট নাম যে মনে রাখা মুশকিল তাই ওদিকে আর মনোযোগ না দিয়ে সেখানে একটু চা, কেক আর পানি খেয়েছিলাম। ঝিরঝিরে বৃষ্টি ঝড়তে শুরু করতেই আবার বাসে উঠে পড়লাম। বাসও ছেড়ে দিল সঙ্গে সঙ্গে। এর পরেই শুরু হয়েছিল মুন্নার যাবার মনোমুগ্ধকর রাস্তা।

আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে উপরে উঠি আর সবুজের অরণ্য ভেদ করে নানারকম আকর্ষণীয় সবুজের সমারোহ দেখতে দেখতে সামনে এগোতে থাকি। তখন ঝিরঝির বৃষ্টি একটু জোওে পড়তে শুরু করল। যে কারণে সবুজের ঘেরা পাহাড়ি পথের দুই পাশটা আরও বেশি কমনীয় হয়ে উঠেছিল। একপাশে সবুজের সমুদ্র ঢেউ খেলানো চা বাগান, তার একটু উঁচুতে গভীর আর ভেজা অরণ্য, অন্যপাশে উঁচু উঁচু পাহাড়, পাহাড়ের গায়ে গায়ে ছোট বড় নানা রকম রুপালি ঝর্ণা, সাদা মেঘের ভেলা, কাছে দূরে কুয়াশার নিজের মত করে খেলা। এক অপরূপ আবেশ তৈরি করে দিয়েছিল মুহূর্তেই।

আর হুট করেই বেশ ঠাণ্ডা লাগায় মোবাইলের স্কিনের দিকে তাকিয়ে দেখি দুপুরের ৩৭ ডিগ্রি তাপমাত্রা কখন যেন কমে ১৭ তে চলে এসেছে! মানে উত্তপ্ত গরম থেকে তিন ঘণ্টার মধ্যে শীতের দেশে চলে এসেছি! ঊাহ! কি অদ্ভূত একটা ব্যাপার তাই না? যদিও এমন অভিজ্ঞতা আমি দার্জিলিং এ বহুবার পেয়েছি; কিন্তু তাদের এবারই প্রথম ভ্রমণ, তাই তারা আমার চেয়ে অনেক বেশি রোমাঞ্চিত ছিল। গরমে মা-ছেলের গোমড়া মুখে শীতের সুখ সুখ পরশ বুলিয়ে দিয়েছিল মুন্নার যাবার পথের সবুজের সমুদ্র, ঢেউ খেলানো চা বাগান, গভীর আর অচেনা অরণ্য, ঝিরঝির বৃষ্টি, কাছে দূরের ছোট-বড় পাহাড়, পাহাড়ে-পাহাড়ে জমে থাকা মেঘের দল, মাঝে মাঝে বাসের খোলা জানালা দিয়ে আঁকড়ে ধরা শীতের কুয়াশা আর পাহাড়ের গা থেকে ঝড়ে পড়া অসংখ্য রূপালী ঝর্ণাধারা।

আমি দুইপাশের দুই রূপ দেখবো? নাকি সামনে এগিয়ে আসা আর পেছনে ফেলে যাওয়া ঘন অরণ্য দেখবো, ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। আমার বামে ছিল উঁচু-নিচু সবুজ চা বাগানের সারি আর প্রান্তর জুড়ে সবুজের নান্দনিক চা বাগান- যেখানে ঝিরঝির বৃষ্টির পরশে ওরা ওদের সবুজের স্নিগ্ধতা যেন আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল বহুগুণ। চা বাগান যেন নয় এক একটা সবুজ কাঞ্চিবরন পড়ে যেন সেজে উঠেছিল চারপাশ! কারণ একট পরে পরে মোড়ে মোড়ে দেখা মিলেছিল কাঞ্চিভরনের বড় বড় বিল বোর্ড। তাই গুলিয়ে ফেলছিলাম।

মাঝে মাঝে বাস একেবেকে ছুটে চলছিল গভীর অরণ্যের মাঝ দিয়ে। ভেজা অরণ্যের যে কি অপরূপ রূপ ভাষায় লিখে বোঝানো আমার জন্য মুশকিল। অরণ্য নয় যেন, সদ্য স্নান করা কোনো রমণী উঠে এসেছে ঝর্ণাধারা থেকে। যার পুরো শরীরজুড়ে ফোঁটা ফোঁটা জমে আছে আর ঝড়ে পড়ছে একটু একটু করে। কপাল, চোখের পাতা, নাকের ডগা, কানের লতি, থুতনি, গাল, গলা আর... আর সর্বাঙ্গ জুড়ে যেন সুখের বৃষ্টির ফোঁটা জড়িয়ে আছে এখানে-সেখানে আর হালকা আবগি হাওয়ায় সেসব বৃষ্টির ফোঁটা যেন ঝরে ঝরে পড়ছে পাগল করা আকর্ষণে।

মাঝে মাঝে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম সবুজ কাঞ্চিবরন জড়ানো স্নিগ্ধ চা বাগানের দিকে? সদ্য ঝর্ণায় স্নান করে ফেরা আব্রুহীন রমণীবেশি অরণ্যকে, কাছে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বৃষ্টি ভেজা পাহাড়কে? পাহাড়ের গায়ে, পায়ে আর পিঠে জড়িয়ে থাকা ঝর্ণাধারাকে নাকি সামনের আঁকা-বাঁকা অপূর্ব রাস্তার দু’পাশে ফুটে আর ঝুলে থাকা রঙ বেরঙের ফুলকে?

এসব সম্মোহনে সম্মোহিত হয়ে, অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বাঁকরুদ্ধ হয়ে কখন যেন বাস এসে থেমে গেছে মুন্নারের ঝলমলে চত্বরে বুঝতেই পারিনি। বাসের সহকারীর ডাকে চেতনা ফিরে পেয়ে বাস থেকে নামলাম মুন্নার বাস স্ট্যান্ডে।

মুন্নার, চা চকলেট কফি ও মসলার শহরে...।
বাস থেকে যখন মুন্নারে নেমেছি, তখন বিকেল গড়িয়ে গেছে, সন্ধ্যা নামি নামি করছে। তাছাড়া পাহাড়ে তো এমনিতেই সন্ধ্যা একটু আগে আগে নেমে থাকে। বাসস্ট্যান্ডের রেলিং ঘেরা যাত্রী ছাউনিতে ওদের বসিয়ে রেখে হোটেল খুঁজতে গেলাম। ১৫-২০ মিনিটে মনের মতো লোকেশন, বাজেট আর হোটেল একটাও না পেয়ে ফিরে এলাম। 

যাত্রী ছাউনিতে ফিরে একটা অটো নিলাম যে হোটেল খুঁজে দেবে, ভাড়া নেমে ৩০-৫০ রুপি। কাছেই অনেক হোটেল আর কটেজ আছে; কিন্তু অচেনা আর উঁচু-নিচু পাহাড়ি রাস্তা বলে নিজেদের মত করে খুঁজে নেওয়া অসম্ভব। তার ওপর একাধিক ব্যাগ, সুটকেস আর সন্ধ্যা নেমে গাঢ় অন্ধকার হয়ে গেছে বলে। একটু এগিয়ে একটা পাহাড়ি ছোট্ট নদী পেরিয়েই তিনটি হোটেল পেলাম একই জায়গায়। অবশেষে উপায় না দেখে কম পছন্দের হোটেলেই রুম নিতে হয়েছিল। পরদিন সারাদিনে মুন্নার যতটা সম্ভব ঘুরে বিকেলে কোচিনের বাসে করে কেরালা চলে যাবো।

রুমে উঠে, ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে পড়লাম নীরব রাতের মুন্নারের পাহাড়ি পথে। আহা! কি অদ্ভূত যে লাগছিল সেই সন্ধ্যাটা। গরম পানিতে গোসল করে, পা ভাঙা গরম কাপড়, মুজা আর কেডস পরে তিনজন হাতে হাত ধরে পাহাড়ি অন্ধকার কিন্তু শতভাগ নিরাপদ পথে হেঁটে চলেছি রাতের মুন্নার দেখতে। ঝলমলে শপিং মল, চা কফি আর চকলেটের শোরুম দেখে ডিনার করে ফিরবো বলে। রাত ৮টা ৩০ মিনিট থেকে ৯ টা পর্যন্ত সবকিছু খোলা থাকে। এরপর হুট করেই সবকিছু বন্ধ হয়ে অন্ধকার হয়ে যায়, হোটেল থেকে জানিয়ে দেওয়া হলো। তখন সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিট এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় আছে। এর মধ্যে ডিনার শেষ করতে হবে। 

অন্ধকার পাহাড়ি পথে একে অন্যেকে ধরে হাঁটতে হাঁটতে কোথায় যেন ঝমঝম করে গড়িয়ে যাওয়া জলের শব্দ শুনতে পেলাম। একট এগোতেই দেখি সামনে একটা ছোট্ট ব্রিজ। যেটা একটু আগে পেরিয়ে এসেছি। যানবাহন চলছে নিয়মিত। গাড়ির আলো পাহাড়ের ঢালে পড়তেই চোখে পড়লো দুই পাহাড়ের মাঝে ছোট্ট এক খরস্রোতা নদী। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল এই নদীর উৎস যে ঝর্ণা থেকে সেটা খুব বেশি দূরে নয়। একটা পাহাড়ের উল্টো পাশে গেলেই তার দেখা মিলবে এবং সেটা বেশ বড়ই হবে। ইস যদি এই রাতেই একদল রোমাঞ্চ প্রিয় কারো সঙ্গে বেড়িয়ে পরা যেত, ওই ঝর্ণা বা এই নদীর শুরুর কাছে! সেই ইচ্ছা নিজের মাঝে রেখেই ব্রিজ পেরিয়ে গেলাম। 


বাজারের কাছে গিয়েই খোলা ভ্যানে করে নানা রকম খাবার বিক্রি করতে দেখলাম। ওখানেই অর্ডার করলে বানিয়ে দিচ্ছে একদম ফ্রেস। আমরা পরাটা আর ওমলেট অর্ডার করলাম। খাওয়ার শেষ পর্যায়ে এসে জানলাম এখানে বিফ কাবাব পাওয়া যায় কি? শুনেই তো জিভে জল আর ছেলের ইচ্ছামত নিলাম একটা বিফ কাবাব। দারুন ভিন্ন স্বাদের টেস্ট ছিল সেই বিফ কাবাবের। এতোই ভিড় ছিল সেই ভ্যানের চারপাশে যে তিনজন মিলে খাবার দিয়েও কুলিয়ে উঠতে পারছিল না। অন্য পাশে তো একাধিক ভ্যান তো ছিলই একই রকম খাবারের সাপ্লাই দিতে। তিনজন মিলে ১৭০ রুপি খাবারের বিল দিয়ে উঠে পড়লাম যতক্ষণ খোলা থাকে মুন্নার শহর দেখে বেড়াতে। 

কি ঝলমলে এক একটা দোকান, চায়ের ফ্যাক্টরি আউটলেট, কফির বিক্রির দোকান, চকলেটের নানা রকম দোকান আর ভিন্ন রকম চকলেটের বিকিকিনি। এক একটা দোকানে ঢুকি আর চা, কফি, চকলেটের গন্ধে প্রাণ ভরে যায়। এতোই বিশুদ্ধ সেই গন্ধ। মনে হচ্ছিল মুখ হা করে রাখি আর বুক ভরে বিশুদ্ধ খাঁটি কফি আর চকলেটের গন্ধ নিয়ে নেই যতটা পারি। আর চোখে পড়লো অন্য রকম এক সাবানের আয়োজন, পাতা আর কোনো একটা গাছের বাকলের মধ্যে আয়ুর্বেদিক সাবানের সমারোহ। 

চা, কফি, সাবান আর বহু রকমের চকলেটের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল এক একটা বর্ণিল দোকানে নানা রকম বর্ণিল চকলেট দেখাটা। সেটাও চকলেটের প্যাকেট নয়, একেবারে র চকলেট। কেজি ধরে বিক্রি হচ্ছে। সাদা, লাল, কফি, আর রঙ-বেরঙের নানা রকম চকলেট। গামলায় গামলায় সাজিয়ে রাখা হয়েছে। দেখেই মন ভরে গেছে। আর মানুষ কিনেছেও দেদার! 

বেশ অনেকক্ষণ ধরে এসব ঝলমলে দোকানে ঘুরে দেখে যখন দোকানগুলো বন্ধ হবার পথে, তখন আমরাও ফেরার পথ ধরেছিলাম। আবারও সেই পাহাড়ি পথ, রাতের অন্ধকার, নদীর কলরব, অরণ্যে জোনাকি, রাত জাগা পাখির ডাক, জমে থাকা বৃষ্টি ফোঁটার ঝরে পড়ার শব্দ শুনতে শুনতে, যে যার মত করে একে অন্যের হাত ধরে, গান গাইতে গাইতে। 

ছেলে গুনগুন করছিল ওর মত করে, আর আমি ছেলের মায়ের সঙ্গে, পাহাড়ের গায়ে, অরণ্যের আড়ালে, চাঁদের জ্যোৎস্না দেখে হেঁড়ে গলায় সুর ধরেছিলাম, 

এমনি করে যায় যদি দিন যাক না...

মন মাতানো মুন্নারে...
আহা! কি অদ্ভূত একটা সকাল ছিল সেদিন। মুন্নারের পাহাড়ি রুম থেকে ঘুম থেকে উঠেই আমরা বিস্মিত হয়ে তাকিয়েছিলাম চারদিকে। হালকা কুয়াশা ঘেরা পাহাড়ি শহর। শীতল বাতাস ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছিল আমাদের। বাইরে এসে দাঁড়াতেই এক টুকরো ভীষণ আদুরে, মিষ্টি রোদ এসে উষ্ণ পরশ বুলিয়ে দিল আমাদের গায়ে। 

আগের দিন, সন্ধ্যার পরে মুন্নার গিয়ে পৌঁছানোর কারণে তার পাহাড়ি রূপের দেখা পাইনি আগের দিন। তাই তো সকাল হতেই এমন চারপাশ ও চারদিকের বিস্ময় আমাদেরকে দারুণ আপ্লুত করে ফেলেছিল; কিন্তু আমরা জানতাম না যে, আমাদের পাহাড়ি কটেজের চারপাশের মুগ্ধতা ছাড়াও আরও অপার্থিব কিছু অপেক্ষা করছে একট দূরেই।


কটেজের আঙিনায় বসে, শীতের হিমেল হাওয়া গায়ে মেখে, মিঠে রোদের আরাম নিতে নিতে চুমুক দিচ্ছিলাম ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ে। চা শেষ হবার আগেই রাতে ঠিক করে রাখা অটো এসে দাঁড়িয়ে গেল পাশে। একদম ফ্রেস মন নিয়ে, দারুণ আনন্দে উঠে পড়লাম অটোতে।

তখনো জানি না যে অটো আমাদের এমন মোহময় কোনো সবুজের মাঝে নিয়ে যাবে। অটোতে উঠে চলতে শুরু করার কয়েক মিনিটের মধ্যে মিহি আঁকা-বাঁকা পথ পেরিয়েই ঢুকে পরলো আমার প্রিয়, আমাদের প্রিয়, ভীষণ প্রিয় এই সবুজের সমুদ্রে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়লাম যেন মুহূর্তেই। 

অটোকে থামাতে বললাম। অটো থেমে যেতেই নেমে আমরা হারিয়ে গেলাম সবুজের সমুদ্রে। আহা, কি স্নিগ্ধ! কি মায়াময়! কি অপুর্ব! কি অপরূপ! চারদিক। যেদিকেই তাকাই না কেন শুধু সবুজের ঢেউ! ঢেউয়ের মাঝে এতোটা গভীরে আমরা হারিয়ে গিয়েছিলাম যে, আমাদের অটো, মিহি পিচঢালা পথ দেখতে পারছিলাম না। 

ছোট, মাঝারি পাহাড়ের গায়ে গায়ে সবুজের ছড়াছড়ি শুধু। সকালের প্রথম রোদ পেয়ে ওরা সবুজের সঙ্গে মেখেছিল হলুদ আবীর। রাতের ঝরে পড়া শিশিরগুলো সকালে শিশির হয়ে মুক্তোর মতো চিকচিক করছিল রোদের পরশে।


সেই সবুজের সমুদ্র, সেই সবুজের ঢেউ, সেই মুক্তোর মতো ঝিলমিলে সকাল, সেই আলতো রোদের ছুঁয়ে যাওয়া, আমাদের হারিয়ে যাওয়া, আনন্দ আর উচ্ছ্বাসে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকার দিনগুলো মনে পড়ে গেল ল্যাপটপে পুরনো ছবি দেখতে দেখতে, স্মৃতিকাতর করে দিল আমাদের। 

কি মোহময় দিন ছিল সেদিন, আমাদের ছুঁয়ে যাওয়া, আমাদের আবিলুপ্ত করে যাওয়া, আমাদের প্রাণ পাগল করে দেওয়া মন মাতানো মুন্নারে।

তাই পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে, সবুজে ছেয়ে থাকা, সবুজের ঢেউয়ে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করা প্রিয় এই শহরের নাম দিয়েছি আমি, মন মাতানো মুন্নার। ছবি দেখছি আর ভাবছি সবকিছু কবে ঠিক হবে, আদৌ কি ঠিক হবে সবকিছু? আবার কি আমরা যেতে পারবো প্রিয় এই সবুজ শহরে?

সময় যেথায় থমকে দাঁড়ায়!

‘যখন সময় থমকে দাঁড়ায়’ নচিকেতার এই গান কষ্টের, দুঃখের, হতাশার আর ক্ষোভের; কিন্তু মুন্নারের এই জায়গায় এসে আমার ও আমাদের সময় থমকে গিয়েছিল। কিন্তু কোনো দুঃখ, কষ্ট, হতাশা বা ক্ষোভে নয়! ঠিক এর উল্টো অনুভূতি নিয়ে। আনন্দে, অবাক বিস্ময়ে আর সুখের আতিশয্যে! 

হ্যাঁ ঠিক তাই, মুন্নারের এই প্রান্তরে এসে আমাদের অনুভূতি এমনই হয়ে গিয়েছিল, যে কারণে নচিকেতার ওই কষ্টের গানের ভাবার্থ সেই সময়ে আমাদের কাছে সুখে পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। অবাক বিস্ময়ে আমাদের সময় সেদিন থমকে গিয়েছিল, সবুজের এমন ঢেউ দেখে, চা বাগানের এই অপরূপ শেভা দেখে, সবুজের ঢেউকে আকাশের সীমানায় পৌঁছে যেতে দেখে, সবুজের মাঝে হলুদের অপরূপ নান্দনিকতা দেখে! 

আমরা ফিরছিলাম মুন্নারের সকালে ছোট ছোট চা বাগান, ছোট-বড় আর মাঝারি পাহাড়ের সারি, জুম চাষ, হাতির অভয়ারণ্য, টলটলে জলের ঝকঝকে লেক, ড্যাম, সবুজের মিহি গালিচা ঘেরা পার্ক, স্বচ্ছ জলে রঙ বেরঙের বোটের ভেসে চলা, রাবার আর পাইনের অরণ্যে, নাম না জানা ফুলের খামার, পাহাড়ের ভ্যালিতে বর্ণীল বাগান, বিস্ময়কর হানি ট্রি! আর পাহাড়ের আঁকা-বাঁকা পথে হেলে-দুলে। 


মাঝে এক জায়গায় থেকে সকাল আর দুপুরের মাঝের খাবার খেয়ে নেবার বিরতি দেওয়া হলো- নুডলস আর বয়েল আণ্ডা। বেশ ভালোই লেগেছে আর সব সময়ই লাগে চলতি পথে সহজে আর অল্প খরচের এই খাবার, বয়েল আণ্ডা আর সবজি দিয়ে সেদ্ধ নুডলস। তিনজন মিলে পেট ঠাণ্ডা করে আবার উঠে পড়লাম। এবার আমাদের ফেরার পালা। দুপুর দুইটা পর্যন্ত যত দূর যাওয়া যায়। পথে দুই একটি ঝর্ণা পড়বে রাস্তার সঙ্গে লাগোয়া। পাহাড় থেকে ঝর্ণা ধারা সোজা রাস্তায় এসে পড়েছে, পথচারীদের একট প্রশান্তি দিতে। 

বেশ কিছুটা উঁচু-নিচু পথে পেরিয়ে, মুন্নারের ছোট্ট কিন্তু বনেদী শহর পেরিয়ে, গতকাল যে পথে এসেছিলাম সেই পথে চলতে শুরু করেছি। একট পথ যেতেই দোকান, বাড়ি আর কিছুটা জনাকীর্ণ জায়গায় আমাদের অটো দাঁড়িয়ে গেল। অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করতেই জানালো পায়ে হেটে একটু ভেতরে গেলেই অনেক পুরনো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেরও আগের একটি লোহার ঝুলন্ত ব্রিজ আছে। গেলে দেখে ভালো লাগবে বলে জানালেন। বাপ বেটা নেমে পড়লাম; কিন্তু একটু এদিক-ওদিক করে তেমন আকর্ষণীয় কিছু দেখতে না পেয়ে ফিরে এলাম। দেখা হলো কি-না জানতে চাইলো ড্রাইভার, কিছুটা অবাক কণ্ঠে। জানালাম আমরা খুঁজে পাইনি। 

সেটা শুনে আশ্বস্ত হলেন, যাক তাহলে এখনো তার হতাশ হবার তেমন কোনো কারণ নেই। কারণ হলো এই ব্রিজটা এতটাই চমৎকার আর দৃষ্টিনন্দন একটা জায়গায় অবিস্থিত যে, যে কেউ ওটা দেখে, ওটার উপরে উঠে, হেটে আর দোল খেয়ে বার বার বলতে বাধ্য হবে ওয়াও, ওয়াও! আমার মত ওয়াও শব্দ অপছন্দ করা সেকেলে আমিও বার বার ওয়াও ওয়াও করে উঠেছি! 

ড্রাইভার আবারও পথ দেখিয়ে দিলেন। এবার আমরা একটা দোকানের পাশের ছোট গলি দিয়ে সামনে এগিয়ে গেলাম। গলি পেড়িয়ে সামনে এগিয়ে ফাঁকা জায়গায় গিয়েই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া খরস্রোতা পাহাড়ি নদীর উপরে দুই প্রান্তকে এক করেছে অনেক পুরনো লোহা আর কাঠের পাটাতনের এক ঝুলন্ত ব্রিজ। যেটা মৃদু বাতাসেই রীতিমত দুলছে! দেখেই অজান্তেই মুখ দিয়ে বেড়িয়ে গেল ওয়াও! অসাধারণ তো! ছেলেকে বললাম চল বাবা যাই? 

কিন্তু কোথায় সে? তাকিয়ে দেখি কখন যেন সে এক দৌড়ে গিয়ে উঠে পড়েছে সেই দারুণ ঝুলন্ত ব্রিজে। আমিও উঠে পড়লাম আর দেরি না করে। সঙ্গে ছেলের মাকেও ডেকে নিলাম। ব্যাস তিনজন মিলে সেই ঝুলন্ত ব্রিজে উঠে চারপাশের অপরূপ প্রকৃতি উপভোগ করতে লাগলাম। যার দুই পাশে পাহাড়, যত দূর চোখ যায় পাহাড় আর পাহাড়, মাঝ দিয়ে বয়ে চলেছে বহমান এক পাহাড়ি নদী। যে নদীর একপাশে শহর, অন্যপাশে যেন এক নিখাদ গ্রাম। ছোট ছোট কুড়ে ঘর, একটু সমতল মাঠ, মাঠে গরু, ছাগল আর কুকুরদের বিচরণ। 

নদীর ধারে অনেকটা জঙলি প্রকৃতি, ঝুলে পড়া ঘাস লতা পাতা আর ওদের ছুঁয়ে ছুঁয়ে নিজের পথে ছুটে চলা পাহাড়ি নদীর জল। নানা রঙের জঙলি ফুলের বর্ণিলতা। ওপাশের ছোট্ট নিখাদ গ্রাম থেকে ঝুলন্ত ব্রিজ পেরিয়ে হেটে আসা ছেলে, মেয়ে আর বড়দের কয়েকজন। কেউ ব্যাগ কাঁধে স্কুল বা কলেজের পথ ধরেছে, কেউ ছাতা হাতে গঞ্জের কোনো দোকানে নিত্য দিনের প্রয়োজনে। 

ঝুলন্ত ব্রিজে দাঁড়িয়ে দোল খেতে খেতে এসব দেখছিলাম আর মোহাচ্ছন্ন হয়ে চারদিকের রূপ অবলোকন করছিলাম। দূরের পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে মেঘেদের আনাগোনা, জেকে বসা, ছুটে চলা, একে অন্যকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাওয়া। শুনছিলাম আরও উঁচু পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে ছুটে আসে পাহাড়ি নদীর জলের কলতান, ব্রিজের নিচ থেকে ছুটে চলা খরস্রোতা নদীর অনবদ্য রূপ আর সেই সঙ্গে আমাদের ক্যামেরা আর মোবাইলে ক্লিক ক্লিক করা। 

বেশ অনেকটা সময় সেখানে কাটিয়ে, পাহাড় দেখে, আধুনিক শহরের ছোট্ট পাহাড়ি নদীর ওপাশে গ্রামের স্পর্শ নিয়ে, পাহাড়ি নদীর জল ছুঁয়ে, ফুল দেখে, ভেসে যাওয়া মেঘ নিয়ে খেলা করে, আর নিজেদের এমন অনবদ্য প্রকৃতির মাঝের নানা রকম স্মৃতি আগলে রেখে। আবারও অটোতে করে সামনের পাহাড়ের দিকে চলতে শুরু করা। এবার এক পাশে বিশাল পাহাড়ের পিঠ কেটে বানানো মসৃণ রাস্তা আর অন্যপাশে গভীর খাঁদ। তবে রাস্তাজুড়ে বেশ ভালো নিরাপত্তা বেষ্টনি নিশ্চিত করছিল পথ চলতে। 

তাই পাহাড়ি পথে এঁকে-বেঁকে আবারও ছুটে চলা। তবে এবার ধীর লয়ে, খুব ধীরে ধীরে আমাদের অটো পাহাড়ের পিঠ বেয়ে চলেছে সামনের দিকে। সামনে যত দূর চোখে যায় আকাশের সঙ্গে পাহাড়ের আলিঙ্গন! নীল আকাশে সঙ্গে মিশে আছে সবুজ আর বিশাল বিশাল পাহাড়ের সিঁড়ি। একটা জায়গায় থামলাম। আসলে বাধ্য হলাম অটোকে থামিয়ে নেমে যেতে। নীল আকাশ, সবুজ পাহাড়, স্বচ্ছ রাস্তা আর পাহাড়ি ঝর্ণা দিয়ে খরস্রোতা পাহাড়ি নদীতে-পাথরে ঝরে পড়া জলের ঝড় দেখে। 

আর তারপরেই সেই ‘যখন সময় থমকে দাড়ায়’ মুহূর্ত! আহা সে যে কি সবুজ, সবুজ প্রান্তর, সবুজের সমুদ্রে যেন সবুজের অবিরাম ঢেউ! সবুজ আর হলুদের ঢেউ যেন পাহাড় থেকে আকাশের কাছাকাছি ছুটে যেতে চাইছে। সবুজের ঢেউ যেন ওই নীল আকাশকে ছুতে চাইছে! এতই সবুজ, এতই সবুজ আর এতই সবুজ! সবুজ চা বাগান তো অনেক দেখেছি; কিন্তু এমন প্রান্তর জুড়ে, মাটি থেকে আকাশ আর আকাশ থেকে মাটি পর্যন্ত সবুজের ঢেউয়ের দেখা আগে পাইনি কখনো, শুধু সিনেমা আর গুগলের ছবি ছাড়া। 

আর সেই সবুজের ঢেউ, সবুজের সমুদ্র আর মাটি থেকে আকাশ ছোঁয়া সবুজ এই প্রথম চোখের সামনে, হাত ছোঁয়া দুরত্বে, মন প্রাণ আর মননের স্পর্শের অনুভুতিতে। যেখানে যেদিকে তাকাই শুধু সবুজ সবুজ আর সবুজ। সবুজের মাঝে ছোট ছোট বর্ণীল বাড়ি, লাল-হলুদ আর বেগুনী-গোলাপির ছড়াছড়ি, মাথার সিঁথির মত মিহি রাস্তা সবুজের বুক চিড়ে ছুটে চলেছে আরও সবুজের মাঝে, সবুজের প্রান্তরে, সবুজের ঢেউয়ে, সবুজের সমুদ্রে! 

যে সবুজের মাঝে আমাদের সেদিন আমাদের সময় থমকে দাঁড়িয়েছিল! সুখে, আনন্দে, বিস্ময়ে, হতবাক হয়ে চুপচাপ তাকিয়ে ছিলাম অপলক নয়নে, কতক্ষণ জানি না। শুধু জানি আরও কিছুটা সময়, আরও একটা বেলা আরও একটা দিন বা নীরব কোনো রাতে কেন তাকিয়ে থাকতে পারলামনা সেই সবুজের ঢেউয়ে, সবুজের প্রান্তরে, সবুজের সমারোহে। ‘মন মাতানো মুন্নারে’   

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh