স্বর্ণা চৌধুরী
প্রকাশ: ২২ জুন ২০২১, ০২:২০ পিএম | আপডেট: ২২ জুন ২০২১, ০২:৩২ পিএম
ইস্তাম্বুলে উইঘুর নারীদের বিক্ষোভ
চীনের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত কথিত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল শিনজিয়াং। বেশ কয়েক বছর ধরেই সেখানে উইঘুর ও অন্যান্য সংখ্যালঘু জাতিসত্তা রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে আসছে। এটিকে জাতিগত নিধনযজ্ঞ হিসেবে উল্লেখ করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা। সম্প্রতি বিশ্বের সাত বড় অর্থনীতির জোট জি-৭ থেকেও চীনের প্রতি এ সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানানো হয়েছে। কারণ ভূরাজনৈতিক কৌশলগত কারণে এ প্রদেশটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
শিনজিয়াংয়ের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে- মঙ্গোলিয়া, রাশিয়া, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও ভারতের। তাই বিশ্বব্যাপী তীব্র সমালোচনার মুখে পড়লেও, চীন এ প্রশ্নে রাষ্ট্রবাদকে জাতীয়তাবাদের মোড়ক দিয়ে নিজের অবস্থানকে সঠিক বলে তুলে ধরছে।
শিনজিয়াংয়ে চীন সরকারের দমন-পীড়নের কারণে উইঘুর এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর জনসংখ্যার ওপর প্রভাব বিশ্লেষণ করেছেন জার্মানির গবেষক অ্যাডরিন জেনজ। সম্প্রতি এ গবেষক ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানান, সরকারের নতুন কাঠামোগত নিপীড়নে আগামী ২০ বছরে এ অঞ্চলে উইঘুরদের জনসংখ্যা হতে পারে ৮৬ লাখ থেকে এক কোটি পাঁচ লাখ। এখন তাদের জনসংখ্যা প্রায় এক কোটি ২০ লাখ।
জেনজ আরও বলেন, উইঘুরদের বিষয়ে চীন সরকারের যে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা রয়েছে, সেটি উঠে এসেছে এই গবেষণায়। সেখানকার নারীরাই চীন সরকারের মূল লক্ষ্য। ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ সালের মধ্যে শিনজিয়াং কর্তৃপক্ষ সেখানকার চারটি সংখ্যালঘু জাতিসত্তার ওপর জবরদস্তিমূলক জন্মনিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এ জন্য সন্তান জন্মদানে সক্ষম ৮০ শতাংশ নারীকে জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য নানা ধরনের সার্জারি এবং বন্ধ্যত্বকরণ কর্মসূচি নেওয়া হয়।
অপরদিকে, অন্য অঞ্চল থেকে হান জাতিসত্তার মানুষদের এনে এখানে সেটেলার বসতি নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে উইঘুর ও অন্যান্য জাতিসত্তাকে সংখ্যাগত পরিমাপে আরও ছোট করে ফেলা হবে। জেনজের বিশ্লেষণে বলা হয়, চীন সরকারের নতুন নীতির কারণে শিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুরদের জনসংখ্যা কমলেও হান জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়বে। কারণ চীন সম্প্রতি এক সন্তান নীতি থেকে তিন সন্তান নীতি গ্রহণ করেছে।
চীনের ফাঁস হওয়া সরকারি নথিতে দেখা যায়, ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে শিনজিয়াং প্রদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে জন্মহার প্রায় ৪৯ শতাংশ কমেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিনজিয়াং প্রদেশে সংশোধনাগারের নামে চীন প্রায় ১০ লাখ উইঘুর এবং অন্যান্য জাতিগত সংখ্যালঘুদের আটকে রেখেছে। এর উদ্দেশ্য- তাদের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ এবং উগ্রজাতীয়তাবাদের বিস্তার।
চীন কর্তৃক জাতিগত নিপীড়নের বিষয়টি সম্প্রতি সামনে এনেছে লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। তারা বলেছে, ‘ভয়ংকর দুর্ভোগের’ মধ্যে বসবাস করছে, সেখানকার বাসিন্দারা। অ্যামনেস্টি ২০১৯ সালের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত গবেষণা করেছে। তারা ১২৮ জনের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। তার মধ্যে ৫৫ জন চীনের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ছিলেন। আর ৬৮ জন সেসব পরিবারের সদস্য, যে পরিবার থেকে কেউ হারিয়ে গেছেন বা তাদের আটক করা হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। রিপোর্ট বলছে, শিনজিয়াংয়ে ১০ লাখের বেশি মানুষকে বন্দিশিবিরে পাঠানো হয়েছে। অন্যদের ভয় দেখানোর জন্য চীন তাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সাইটগুলোও বন্ধ করে দিয়েছে। গত ১০ জুন এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে সেখানকার পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘকে তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মহাসচিব অ্যাগনেস ক্যালামার্ড মনে করেন, চীন সরকার সেখানে একটি ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। রাষ্ট্রীয় উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সেখানকার জনসাধারণের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে, ভুল বোঝাচ্ছে। এ ছাড়া তাদের বিভিন্ন অস্থায়ী শিবিরে নিয়ে ভয়ংকর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। এ ছাড়া লাখ লাখ মানুষের ওপর নজরদারি করছে চীন। ফলে তারা ভয়ের মধ্যে রয়েছেন।
তবে চীন এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলছে, উইঘুরদের টার্গেট করে সেখানে কিছু করা হচ্ছে না। সার্বিকভাবে দেশে জন্মনিয়ন্ত্রণের যে নীতি গ্রহণ করা হয়েছে, তার প্রভাব শিনজিয়াংয়ের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপরও পড়েছে। এ ছাড়া সে অঞ্চলে মানুষের আয় বৃদ্ধি এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ সহজলভ্য হওয়ায় জন্মহার কমেছে বলে চীন দাবি করছে।
এক বিবৃতিতে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রয়টার্সকে বলেছে, সেখানে ‘কাঠামোগত গণহত্যা’র যে কথা বলা হচ্ছে, সেটি ‘পুরোপুরি ননসেন্স’। আমেরিকা এবং পশ্চিমা দেশগুলোতে যে চীন-বিরোধীরা রয়েছে, এটি তাদের উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণা। তারা সবসময় চীনভীতিতে ভোগে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
এদিকে, চীনের উইঘুরদের রক্ষায় পর্যাপ্ত পদক্ষেপ না নেওয়ায় জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসেরও সমালোচনা করেছেন ক্যালামার্ড। তিনি বলেন, ‘গুতেরেস তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি সেখানকার পরিস্থিতির জন্য চীনের নিন্দা জানাননি। এ ছাড়া সেখানকার পরিস্থিতি জানতে আন্তর্জাতিক তদন্তেরও কোনো আহ্বান জানাননি।’
উইঘুরদের পরিস্থিতি নিয়ে এর আগেও বিভিন্ন সংগঠন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। গত এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়ার্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তারা জানায়, মানবতার বিরুদ্ধে যে অপরাধ সেখানে সংঘটিত হচ্ছে তার জন্য দায়ী চীন সরকার।
বন্দিশিবিরে নারীরা পরিকল্পিতভাবে ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন ও অত্যাচারের শিকার হচ্ছেন বলে, সেখান থেকে মুক্ত হয়ে বিদেশে আশ্রয় নেওয়া নারীরা জানিয়েছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে উঠে আসে কথিত সংশোধনাগারে কাটানো তুরসুনে জিয়াউদুনের লোমহর্ষক বর্ণনা। তুরসুনে বলেন, ‘তারা স্যুট পরত, পুলিশের পোশাক নয়। কখনো কখনো তারা আসত মধ্যরাতের পরে। সেলের মধ্যে এসে তারা কোনো একজন নারীকে বেছে নিত। তাদের নিয়ে যাওয়া হতো করিডোরের আরেক মাথায় ‘কালো ঘর’ বলে একটি রুমে। সেখানে নজরদারির জন্য কোনো ক্যামেরা ছিল না।’
তিনি আরও বলেন, ‘ওই সেলগুলো থেকে প্রতিরাতে নারীদের তুলে নিয়ে যাওয়া হতো, তার পর মুখোশ পরা এক বা একাধিক চীনা পুরুষ তাদের ধর্ষণ করত।’ শিনজিয়াং প্রদেশে চীনের শতশত গোপন বন্দিশিবিরের একটিতে তুরসুনে জিয়াউদুন কাটিয়েছেন প্রায় ৯ মাস। এ সময়ে তিনি তিনবার সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।
ফাঁস হওয়া চীনা নথি থেকে আরও জানা যায়, ২০১৭ সালে বিশেষ স্থানীয় নির্দেশাবলি নিয়ে শিনজিয়াংয়ে ‘স্পেশাল ক্যাম্পেইন টু বার্থ কন্ট্রোল ভায়োলেশন’ নামের অভিযান চালানো হয়। ২০১৯ সালের মধ্যে প্রদেশটির দক্ষিণাঞ্চলে সন্তান জন্মদানে সক্ষম ৮০ শতাংশের বেশি নারীকে জোরপূর্বক বন্ধ্যা করে দেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। এ জন্য নারীদের জরায়ুতে ইনট্রাইউটেরিন ডিভাইস (আইইউডি) স্থাপন বা স্টেরিলাইজেশন সার্জারি করতে বাধ্য করা হয়। আইইউডি সাধারণত ৫ থেকে ১০ বছর নারীদের গর্ভধারণ করা থেকে বিরত রাখে। চীনা সরকারি নথির তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ ও ২০২০ সালে গণহারে নারীদের বন্ধ্যত্বকরণের খরচ দেওয়া হচ্ছে রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে। বর্তমান নারী বন্ধ্যত্বকরণের এই হার ইতিমধ্যে ছাড়িয়ে গেছে অতীতের এক সন্তান নীতির আওতায় করা বন্ধ্যত্বকরণের হারকেও।
পরিসংখ্যান বলছে, এসব পদক্ষেপ নিয়ে উইঘুর জনসংখ্যা কমাতে সফল হয়েছে চীন সরকার। ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে শিংজিয়াংয়ে উইঘুর জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমেছে ৮৪ শতাংশ। আর এসব অঞ্চলে নির্যাতনের তথ্য গোপন করতে বার্ষিক প্রতিবেদনে জন্মহার সম্পর্কিত তথ্য আর দেওয়া হচ্ছে না।