মাসুদুর রহমান
প্রকাশ: ২৩ জুন ২০২১, ০৮:৪৬ এএম | আপডেট: ২৩ জুন ২০২১, ০৮:৫০ এএম
নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি। ছবি : নেপাল টাইমস
নেপালে রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আবার অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। টানাপড়েনে পার্লামেন্ট বিলুপ্ত হচ্ছে বারবার। প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলির সরকারের ভবিষ্যৎ নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা জল্পনা। চলতি বছরের নভেম্বরে সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে।
তার আগে ঘটনা প্রবাহ কোন দিকে অগ্রসর হয়, সেটা দেখার বিষয়। শুধু নেপালের অভ্যন্তরীণ ঘটনাই নয়; ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি নেপালে বেশ প্রভাব ফেলছে।
নেপালে ২০১৫ সালে নতুন সংবিধান প্রণীত হয়। তার আওতায় ২০১৭ সালে অনুষ্ঠিত হয় সাধারণ নির্বাচন। মাওবাদী নেতা পুস্প কমল দহল প্রচন্ড এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলির নেতৃত্বাধীন নেপালি কমিউনিস্ট পার্টির দুই অংশ একত্রে নির্বাচনে অংশ নেয়। তারা দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে। ওই সময় থেকে নেপালের রাজনীতির কিছু বিষয়ে প্রতিবেশী ভারতের উদ্বেগ দেখা দেয়। দেশটির রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব সৃষ্টির প্রচেষ্টা নিয়ে আবার নেপালে রয়েছে প্রচ- অসন্তোষ। ফলে নেপাল একটি হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র হলেও, দেশটির জনগণের মধ্যে ব্যাপকভাবে ভারত বিরোধিতা রয়েছে।
নেপালের নতুন সংবিধানে দেশটিকে ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রে অন্তর্ভুক্তি নিয়ে ভারত বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ে। ভারতের প্রভাবশালী মহল কয়েক দফায় নেপাল সফর করে হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে অন্তর্ভুক্তি ঘটাতে ব্যর্থ হলেও, অন্তত ধর্মনিরপক্ষতার ধারণা সংবিধান থেকে বাদ দেওয়ার প্রয়াস চালায়।
ভারতের ক্ষোভের আরেক কারণ হলো, দেশটির মানচিত্রে বিতর্কিত কালাপানি ও লিপুলেখ অঞ্চলের অন্তর্ভুক্তি। এই দুটি ভূখ-কে ভারত নিজেদের বলে দাবি করে আসছে। নেপালের মানচিত্রে এই পরিবর্তনের ফলে ভারত অনেক বেশি প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। তারপর থেকে নেপালি সরকার অভিযোগ করে আসছে যে, কাঠমান্ডুতে ভারতীয় দূতাবাস ও দিল্লিতে বসে সরকার হঠানোর ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। ভারতের মিডিয়াগুলো প্রচার চালাচ্ছে যে, দক্ষিণ এশিয়ায় অন্য কোনো দেশের ব্যাপারে মোদির সরকার নীতিগত পরিবর্তন না ঘটালেও, নেপালের ব্যাপারে দিল্লিতে পরিবর্তন হচ্ছে। কে পি শর্মা অলিকে পক্ষে আনার লক্ষ্যে ভারতের গোয়েন্দা কর্মকর্তা থেকে শুরু করে নিরাপত্তা কর্মকর্তা এবং কূটনীতিকরা বারবার দেশটি সফর করেছেন।
নেপালে বিচার ব্যবস্থা এবং মিডিয়াকে অনেকটা স্বাধীন বলে মনে করা হয়। আদালত রাজনীতি নিয়ে তাদের বিবেচনামাফিক রায় দিচ্ছে। আবার কাঠমান্ডু পোস্ট কিংবা হিমালয়ান টাইমসের মতো পত্রিকাগুলো সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে বাঁধাহীনভাবে লেখালেখি করছে। নেপালের আদালত দুই কমিউনিস্ট পার্টির একীভূতকরণ সঠিক হয়নি বলে রায় দিয়েছিল। তারপর প্রচন্ডের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে দুই কমিউনিস্টের মিলিত সিদ্ধান্তে ২০১৭ সালের নির্বাচনে যেখানে দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থন পেয়েছিল কে পি শর্মা অলির সরকার; সেখানে প্রচন্ডের সমর্থন প্রত্যাহারের পর পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতাই প্রমাণ করতে পারেনি। নেপালের ২৭৫ আসনের পার্লামেন্টে ক্ষমতায় যেতে ১৩৬ আসন প্রয়োজন। ফলে গত ডিসেম্বরে আস্থা ভোটে হেরে গিয়ে কে পি শর্মা অলির সরকারের পতন হয়। নেপালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আছে। সেখানে সরকারের পতন হলেও প্রধানমন্ত্রী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে থেকে যান। পরবর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত তিনিই দায়িত্বে থাকেন। এ হিসেবে কে পি শর্মা অলির সরকার আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচনের পূর্ব পর্যন্ত দায়িত্বে থাকবেন। ইতিমধ্যে আরেকটি নাটকীয় ঘটনা ঘটেছে। নেপালের আদালত বিলুপ্ত পার্লামেন্ট পুনর্বহাল করেছে। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণে ছোট দলগুলোর ওপর নির্ভরশীলতা বেড়েছে। জেএসপিএন নামের একটি ছোট দল যার আসনসংখ্যা মাত্র ৩৪টি; ওই দল গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এখন আবার জেএসপিএন বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এখান থেকে অলির পক্ষের বেশি নেতাকে তার মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত জেএসপিএন থেকে নয়জনকে কে পি শর্মা অলির মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এসব নানা কারণে নেপালের রাজনীতি ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নেপালে অনিশ্চয়তা দানা বাঁধলেও কোনো অস্থিতিশীলতা নেই। সেখানে কোনো রাজনৈতিক সংঘাত কিংবা সহিংসতা নেই। বরং সার্বিক পরিবেশ শান্ত। ভেতরে ভেতরে যদিও অস্বস্তিকর ব্যাপারগুলো রয়েছে। বিশেষ করে দিল্লির চাপে কে পি শর্মা অলির সরকার ক্রমেই ভারতের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। অলির সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারতের মতো ভয়াবহ আকার ধারণা না করলেও মহামারি পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। এটা নিয়েও সরকার বিরুদ্ধে সমালোচনা হচ্ছে।
ভারতের বিভিন্ন অঙ্গের একটা বৈপরীত্য হলো, কে পি শর্মা অলি নিজের কৃতকর্মের কারণে নিজেকে অসার প্রমাণ করার পূর্ব পর্যন্ত তাকে মসনদে বহাল রাখতে চেয়েছিল। ডানপন্থী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ চায় অলি যেন রাম মন্দির স্থাপন করেন। নেপালকে একটি হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করেন। নেপালে কমিউনিস্ট পার্টির বামপন্থী চরিত্রকে বিনাশ ঘটাতে অলিকে কাজে লাগানোর এই চেষ্টা এখনও অব্যাহত আছে। অলি নিজে এই চক্রে আবদ্ধ হয়েছেন। এখান থেকে তার বেরিয়ে যাওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
মাওবাদের বিপক্ষের লোকেরা কে পি শর্মা অলিকে নিজেদের লোক বলে ভাবতে শুরু করেছে। প্রতিটি সংকটকালে তিনি নাটকীয়ভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। আস্থাভোটে হেরে যাওয়ার পর পার্লামেন্ট বিলুপ্ত হয়। সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বিভাগের ওপর পরিস্থিতির ভারসাম্য ঝুলে থাকে। তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি ফাইন্যান্স অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে বাজেট প্রণয়ন করেছেন। মন্ত্রিসভার রদবদল করেছেন। নতুন মন্ত্রিসভায় সাতটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় তিনি নিজের অধীনে রেখেছেন। ক্ষমতাসীন দলের চেয়ারপারসন হিসেবে পুরনোদের বিভিন্ন পদে পুনর্বহালের টোপ দিয়ে রেখেছেন। সার্বিক বিবেচনায় এই মুহূর্তে পুরো পরিস্থিতি প্রধানমন্ত্রী অলির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। পার্লামেন্টের অনুপস্থিতিতে ফাইন্যান্স অর্ডিন্যান্সের অধীনে বাজেট করা স্বাভাবিক ঘটনা। তবে তার বাস্তবায়ন সহজ হবে না অনেকে মনে করেন। যদিও অর্থমন্ত্রী বিষ্ণু পাওদেলকে খুবই বিচক্ষণ বলে মনে করা হয়।
প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালার সময়েও অলি ক্ষমতাসীন দলের বিরোধ নিস্পত্তিতে বেশি সময় কাটিয়েছেন। অলি সুশাসন প্রতিষ্ঠায় পদে পদে ব্যর্থ হয়েছেন। তার আমলে দুর্নীতির ধারণা নেপালের অবস্থা সর্বকালের মধ্যে সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছেছে। অর্থনীতির অবস্থা ভালো না। মহামারি মোকাবেলায় তার ব্যবস্থাপনা খুব খারাপ। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে আস্থার সংকট বেড়েছে। হিন্দুত্ববাদের সঙ্গে বেশি মেলামেশায় এই অবস্থা হয়েছে বলে অনেকের ধারণা । মিলিনিয়াম চ্যালেঞ্জ অ্যাকাউন্ট (এমসিসি) এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) বাস্তবায়ন বিলম্বিত হচ্ছে। টিকার কূটনীতিতে ব্যর্থ হওয়ার দায়ে পররাষ্ট্র ও স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে; কিন্তু ব্যর্থতা অলির নিজের নেতৃত্বের; তার মন্ত্রিসভার সহকর্মীদের নয়।
অলি ক্ষমতায় থাকা পাকাপোক্ত করে রাজনৈতিক ও আইনগত পরিকল্পনা নিয়ে ব্যস্ত। জনগণের জরুরি প্রয়োজনের দিকে মনযোগী হওয়ার সময় তার কম। এসব কারণে তিনি জনগণের মধ্যে বেশ সমালোচিত। নেপালে রাষ্ট্রপতি অনেকটা বাংলাদেশের মতো অলঙ্কারিক। পার্লামেন্ট রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করে। সংসদীয় গণতন্ত্রের নেপালে মূলত প্রধানমন্ত্রীকে ঘিরে ক্ষমতা আবর্তিত হয়। অলি বাস্তবতা বিবেচনা করে চলা একজন রাজনীতিবিদ। কোনো আদর্শ দ্বারা পথচলা থেকে তিনি বেশ মুক্ত। পররাষ্ট্র মন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী থাকাকালে তিনি দলের বাইরেও অনেক সমর্থন লাভ করেছেন। বিশেষ করে সিভিল সোসাইটিতে মাওবাদ বিরোধীরা শর্মা, অলিকে একজন সত্যিকার অর্থে তাদের লোক বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তারা তাকে সংবিধানের ধারক ও বাহক বলে বিবেচনা করেন।