ব্রিটেনের আফ্রিকায় প্রত্যাবর্তন?

আহমেদ শরীফ

প্রকাশ: ২৩ জুন ২০২১, ০৩:৫১ পিএম

জেরেমি হান্ট

জেরেমি হান্ট

২৯ এপ্রিল থেকে ৩ মে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেরেমি হান্ট আফ্রিকা সফর করেন। এই সফরে তিনি পাঁচ দিনে পাঁচটি দেশ- সেনেগাল, ঘানা, নাইজেরিয়া, ইথিওপিয়া ও কেনিয়া ভ্রমণ করেছেন। এর মাঝে প্রথম তিনটি দেশ পশ্চিম আফ্রিকায়, আর পরের দুটি পূর্ব আফ্রিকাতে। নাইজেরিয়া, ঘানা ও কেনিয়া একসময় ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল; ইথিওপিয়া ইতালির অধীনে ছিল। তবে সেনেগাল ছিল ফ্রান্সের অধীনে। ফরাসির অধীনে থাকা দেশগুলোর সঙ্গে ব্রিটেনের সম্পর্ক খুব একটা গভীর ছিল না কখনোই। তবে ফরাসি ভাষাভাষী এই অঞ্চলে ব্রিটিশদের সাম্প্রতিক আনাগোনা নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ব্রেক্সিটের প্রেক্ষাপটে ব্রিটেনের এই কর্মকাণ্ডকে ব্রিটিশ সরকার ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ আখ্যা দিচ্ছে। বহুকাল পর ব্রিটেনের আফ্রিকার দিকে দৃষ্টি দেওয়াটা ভূরাজনৈতিক দিক থেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। 

২০১৩ সালে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালিতে ফরাসিদের সহায়তায় ব্রিটিশরা সামরিক শক্তি মোতায়েন করে। ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকা বলেছে, এই মিশনে ব্রিটেনের ‘সি-১৭’ পরিবহন বিমান, ‘সেন্টিনেল’ গোয়েন্দা বিমান, স্পেশাল ফোর্সের সদস্য এবং ‘এমআই-৬’ গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা ছিল। এরপর ২০১৪ সালে মালিতে জঙ্গি দমনের কারণ দেখিয়ে ‘অপারেশন বারখেইন’ নামে দীর্ঘমেয়াদি ফরাসি সামরিক অভিযান শুরু হলে, এর সমর্থনে ২০১৬ সালের মার্চে ব্রিটিশ সরকার বিমান বাহিনীর একটা ‘সি-১৭’ পরিবহন বিমান দিয়ে সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দেয়। 

তৎকালীন ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী মাইকেল ফ্যালন বলেন যে, এই বিমান প্রতি মাসে ইউরোপ ও আফ্রিকার মাঝে উড়বে ফরাসিদের ‘সন্ত্রাস দমন’ অভিযানে সহায়তা দেবার জন্য। ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে ব্রিটেন ঘোষণা দেয় যে, ফরাসি মিশনে সহায়তার জন্য ব্রিটেন ৩টি ‘সিএইচ-৪৭ শিনুক’ পরিবহন হেলিকপ্টার মোতায়েন করছে। সে বছরের জুন মাসেই এই হেলিকপ্টারগুলো ৯০ জন সেনাসহ মালির প্রতিবেশী দেশ নাইজার-এ এসে পৌঁছে। এই মিশনে পরবর্তীতে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ‘ওয়াচকিপার’ ড্রোনও মোতায়েন করা হতে পারে। পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোতে ব্রিটিশ স্পেশাল ফোর্সের সদস্যরা সে সব দেশের সেনাবাহিনীকে ট্রেনিংও দিচ্ছে। তবে ব্রিটেনের এই সহায়তা ছিল সুদূরপ্রসারী চিন্তার শুরু মাত্র। পশ্চিম আফ্রিকা ফরাসি প্রভাবের অধীনে থাকলেও, সেখানে ব্রিটিশরা নতুন করে কর্মকাণ্ড শুরু করেছে। আর এই কাজের মাঝে একটি হলো ইংরেজি ভাষা শিক্ষা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হান্ট সেনেগালে ডাকারের ইউনিভার্সিটিতে ‘ইংলিশ কানেক্টস’ প্রোগ্রামের উদ্বোধন করেন। ফরাসি ভাষাভাষী এই দেশগুলোতে ইংরেজি শিক্ষা দেবার জন্য ব্রিটিশ সরকার ৪ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ করছে বলে ঘোষণা দেন মন্ত্রী। 

২০১৪ সালে পশ্চিম আফ্রিকার পাঁচটি দেশ- মালি, মৌরিতানিয়া, নাইজার, বুরকিনা ফাসো ও শাদ- মিলিয়ে ‘জি-৫ সাহেল’ নামে একটা প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়। এর লক্ষ্য হয় অত্র অঞ্চলে সন্ত্রাস দমন, সীমানা পাহারা দেওয়া এবং মানব পাচার বন্ধ করা। ইউরোপের ওপর থেকে শরণার্থীদের চাপ কমাতেই প্যারিসে এই প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়। এর বাজেট আসে ১২টি সদস্যের কাছ থেকে, যার মাঝে ফ্রান্স, ব্রিটেন, জার্মানিসহ বেশকিছু ইউরোপীয় দেশ এবং আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা রয়েছে। এই অঞ্চলটি ফ্রান্সের অধীন হলেও, ব্রিটেন এখানে প্রভাব তৈরির সুযোগ হাতছাড়া করেনি। এই পুরো অঞ্চলে ফরাসিদের সামরিক কমান্ড সেন্টার রয়েছে শাদের রাজধানী এনজামিনাতে। ২০১৮ সালের মার্চে ব্রিটেন এনজামিনাতে নতুন কূটনৈতিক মিশন চালু করে। এই মিশন ব্রিটেনের পররাষ্ট্র দফতর এবং ব্রিটিশ আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা ‘ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট’ বা ‘ডিএফআইডি’এর কর্মকাণ্ডকে পরিচালনা করবে। 

শাদে মিশন খোলা নিয়ে তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন বলেন, ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’এর মূলে রয়েছে বিশ্বব্যাপী ব্রিটিশ স্বার্থকে তুলে ধরা। ২০১৭ সালে ব্রিটেন শাদ হ্রদের আশপাশের এলাকাতে বোকো হারাম সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য ৫ মিলিয়ন পাউন্ড সহায়তা দেয়। আর ‘ডিএফআইডি’এর মাধ্যমে পশ্চিম আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলে ব্রিটেন ২০১৮-১৯ সালে ৮৩ মিলিয়ন পাউন্ড এবং ২০১৯-২০ সালে ৭৫ মিলিয়ন পাউন্ড সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। 

২০১৮ সালের আগস্টে দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্রমণের সময় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে ঘোষণা দেন যে, পশ্চিম আফ্রিকায় ব্রিটেন তার কর্মকাণ্ডের ব্যপ্তি আরও বাড়াতে চাইছে। 

তিনি বলেন যে, ব্রিটেন এখন থেকে মালিতে তার কর্মকাণ্ডকে প্রসারিত করা ছাড়াও নাইজার-এ দূতাবাস খুলতে যাচ্ছে। থেরেসা মের দিকনির্দেশনা মোতাবেক ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি নাগাদ ‘জয়েন্ট সাহেল ডিপার্টমেন্ট’ নামে এক সংস্থা গঠন করা হয়। এই সংস্থার মাধ্যমে সাহেল অঞ্চলে ব্রিটেনের পররাষ্ট্র দফতর, ‘ডিএফআইডি’এর উন্নয়ন কাজ, বাণিজ্য উন্নয়ন, প্রতিরক্ষা দফতরের কর্মকাণ্ড, এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজগুলোকে এক ছায়াতলে আনা হচ্ছে। আগামী কয়েক বছরে এই সংস্থাকে আরও শক্তিশালী করা হবে বলে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দফতর বলছে। 

মালিসহ পশ্চিম আফ্রিকার বেশিরভাগ দেশ- মৌরিতানিয়া, নাইজার, বুরকিনা ফাসো, সেনেগাল, শাদ, আইভোরি কোস্ট, গিনি- একসময় ফরাসি উপনিবেশ ছিল। ঔপনিবেশিক শক্তি হওয়ায় এই অঞ্চলে ফরাসিরা অর্থনৈতিকভাবে কর্তৃত্ব করা ছাড়াও, বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক এবং সামরিক হস্তক্ষেপ করেছে। বর্তমানে মালি, নিজের, শাদ, বুরকিনা ফাসো ও মৌরিতানিয়াতে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার ফরাসি সেনা মোতায়েন রয়েছে। ফরাসি উপনিবেশ হবার কারণে এই অঞ্চলের অফিসিয়াল ভাষাও ফরাসি। ব্রিটিশরা এখানে পদার্পণ করায় জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে যে, ব্রিটিশরা ফরাসিদের অধীন অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করতে উদ্যত হয়েছে কি-না। 

মার্কিন মিডিয়া ‘ভয়েস অব অমেরিকা’র সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ব্রিটিশ থিংকট্যাঙ্ক ‘চ্যাটহ্যাম হাউস’এর পল মেলি বলেন যে, ব্রিটেন নিঃসন্দেহে আফ্রিকাতে ফ্রান্সকে ব্যালান্স করার চেষ্টা করছে না। ইউরোপের সব দেশই বোঝে যে, অর্থনৈতিকভাবে দ্রুত বর্ধনশীল অঞ্চল হিসেবে আফ্রিকার সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করা দরকার। আবার উদ্বাস্তু সমস্যা নিরসনেও আফ্রিকায় কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির দরকার রয়েছে। তবে মেলির বক্তব্য ছিল মূলত পুরো আফ্রিকায় ব্রিটেনের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে প্রসারের ব্যাপারে। তবে পশ্চিম আফ্রিকার ফরাসি প্রভাবে থাকা সাহেল অঞ্চলে ব্রিটিশ কর্মকাণ্ড যে ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’এর অংশ তা ব্রিটিশ সরকারের কর্মকর্তারাও কিন্তু লুকাচ্ছেন না। ব্রেক্সিট হোক আর না হোক, ব্রেক্সিট-পরবর্তী ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’কে প্রস্তুত করতেই ব্রিটেনের আফ্রিকায় প্রত্যাবর্তন।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh