ডা. আব্দুল্লাহ আল মামুন খান
প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২১, ০২:৪৭ পিএম | আপডেট: ০৮ জুলাই ২০২১, ০৮:৫৪ এএম
প্রতীকী ছবি
বর্তমান বিশ্বে ক্যান্সার হচ্ছে দ্বিতীয় মারণব্যাধি। বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল বিশ্বে ক্যান্সার আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। প্রতি পাঁচ পুরুষের মধ্যে এক আর প্রতি ছয় নারীর মধ্যে একজন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে।
ক্যান্সারের গায়ে অনেকেই এটে দিয়েছেন আধুনিক আমলের রোগের তকমা। তবে ক্যান্সার রোগের ইতিহাসের বয়সটা হয়তো মানুষের অস্তিত্বের একদম সমানে সমান। প্রাচীন মিসরের মমির হাড়েও পাওয়া গেছে ক্যান্সারের অস্তিত্ব। চিলির আতাকামা মরুভূমিতে মমি হয়ে যাওয়া লাশের হাড়েও পাওয়া গেছে অস্টিওসারকোমার চিহ্ন, সহজভাবে এটিকে হাড়ের ক্যান্সারের সঙ্গেই তুলনা করা যেতে পারে। এমনকি খ্রিস্টের জন্মের ১৬০০ বছর আগের দলিল দস্তাবেজে উল্লিখিত অদ্ভুত কিছু রোগের লক্ষণাদি দেখে গবেষকরা নিশ্চিত হয়েছেন ক্যান্সার সেই আমলেও ছিল। গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরোডটাসের ৪৪০ খ্রিস্টপূর্বের লেখনী থেকে জানা যায়, পারস্যের এক রানী স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিলেন।
আর তাই, মানুষের ইতিহাসের সবেচেয়ে প্রাচীন রোগের একটি হলো এই ক্যান্সার।
দেহের ব্যাহিক কোনো অংশে অনিয়ন্ত্রিত কোষের বৃদ্ধি হলে তা আমাদের চোখে ধরা দেয় টিউমার হিসেবে। ক্যান্সার শব্দটির উৎপত্তির সঙ্গেও তাই জড়িয়ে আছে টিউমারের নাম। ক্যান্সার শব্দের উৎপত্তি যে গ্রিক শব্দ ‘karkinos’ থেকে, তার অর্থ ‘কাকড়া’। মানবদেহ থেকে টিউমার কেটে সরানোর পর তা দেখতে অনেকটা কাকড়ার মতো মনে হয়েছিল বলেই এই নাম দেওয়া হয়েছে। আর মানবদেহে এটি একবার বিস্তার লাভ করলে কাকড়ার মতোই আটকে থেকে নামকে অনেকটাই সার্থকতা দিয়েছে। পরে কালক্রমে ‘কারসিনোমা’ শব্দটি দিয়ে টিউমারকে বোঝানো হতো। আর এই কারসিনোমা শব্দটি থেকেই ‘ক্যান্সার’ শব্দের গোড়াপত্তন।
ক্যান্সারের কারণ
গ) পান, জর্দা, সাদা পাতা, গুল ইত্যাদি দেশের ক্যান্সারের একটি বড় কারণ। সরাসরি ধূমপান না করলেও দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ এসবে অভ্যস্ত। এসব ক্ষতিকর জিনিস ওরাল ক্যান্সার বা জিহ্বার ক্যান্সার করে।
ঘ) বিনাইন টিউমার বা ভালাবোলা টিউমার অনেক দিন পর্যন্ত শরীরে থাকলে যে কোনো সময় ক্যান্সার হতে পারে। বেশির ভাগ কোলন ক্যান্সার এভাবেই হয়ে থাকে।
১. ক্যান্সারের অন্যতম উপায় হচ্ছে ধূমপান। ধূমপানের সঙ্গে ক্যান্সার অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। বিশ্বে যত ধরনের ক্যান্সার আছে, তার মধ্যে ৯০ শতাংশ ক্যান্সারই ধূমপানের কারণে হয়।
৩. স্বাস্থ্যকর খাদ্যগ্রহণের অভ্যাস করতে হবে। শরীরের নানা রোগের পেছনে খাদ্যাভ্যাসের প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। অনিয়মিত খাওয়া শরীরের জন্য ক্ষতিকর। প্রচুর পরিমাণে সবুজ শাকসবজি ও মৌসুমি ফল খান।
৪. অবাঞ্চিত যৌন সম্পর্ক ছড়াতে পারে ক্যান্সার। সুতরাং সুরক্ষিত উপায়ে সহবাস করুন।
৫. ব্যায়াম ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। নিয়মিত ব্যায়ামে শরীরের হরমোন প্রবাহ, কোষ বৃদ্ধির হার, ইনসুলিন সংবেদনশীলতা থাকে স্বাভাবিক। সেই সঙ্গে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ে। সুতরাং প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট শরীর চর্চার পেছনে সময় দিন।
৬. সবসময় কম আঁচে খাবার রান্না করুন। গবেষকরা বলেন, যারা অতিরিক্ত ভাজা-পোড়া জাতীয় খাবারে অভ্যস্ত, তাদের বেশিরভাগেরই অগ্ন্যাশয়, কোলোরেক্টাল ও প্রোস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকি থাকে।
মুখগহ্বরের ক্যান্সার স্ক্রিনিং : সাধারণত তিনটি বিষয় জানা থাকলেই মুখগহ্বরের ক্যান্সার নির্ণয় করা যায়। এক, মুখগহ্বরের ঝিল্লিতে লাল লাল ছোপ পড়েছে কি না। দুই, সাদা খসখসে আস্তরের মতো পড়েছে কি না এবং তিন, ঝিল্লির নিচের দিকে ঘা হয়েছে কি না।
জরায়ুমুখের ক্যান্সার স্ক্রিনিং : এ ক্ষেত্রে পেপটেস্ট পরীক্ষা করা হয়। রোগীকে শুইয়ে স্পেকুলাম দিয়ে জরায়ুর মুখটি একটু দেখা হয়। একটি স্পেকুলা (আইসক্রিমের চামচের মতো এক ধরনের জিনিস) দিয়ে জরায়ুতে ঘুরিয়ে কিছু রস নিয়ে আসা হয়। এই রস মাইক্রোস্কোপের মধ্যে পরীক্ষা করে দেখা হয়, ক্যান্সারকোষ আছে কি না। এটি আদর্শ পদ্ধতি হলেও কিছুটা ব্যয়বহুল।
আরেকটি পদ্ধতি বেশ প্রচলিত, যার নাম ভায়া (ভিজ্যুয়াল ইন্সপেকশন বাই এসিডিক এসিড)। সপস্টিক (কাঠির মাথায় তুলা লাগানো এক ধরনের পরীক্ষণযন্ত্র) দিয়ে পরীক্ষাটি করা হয়। এসিডিক এসিডে সপস্টিক ভেজানো হয়। জরায়ুর মুখ খুলে সপস্টিক স্পর্শ করা হয়। যদি রঙের পরিবর্তন হয়, তাহলে ভায়া পজিটিভ এবং পরিবর্তন না হলে ভায়া নেগেটিভ। ভায়া পজিটিভ মানেই ক্যান্সার রয়েছে, তা-ও নিশ্চিত করে বলা যায় না। ভায়া নেগেটিভ মানেই ক্যান্সারের আশঙ্কা থেকে মুক্ত, সেটিও নয়।
স্তন ক্যান্সার স্ক্রিনিং: নারীরা নিজেই নিজের স্তন ক্যান্সার পরীক্ষা করতে পারেন অথবা স্বাস্থ্যকর্মী বা চিকিৎসককে দিয়েও করানো যায়। এই পরীক্ষাটি গোসলের সময়, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, বিছানায় শুয়ে বা বিভিন্ন সময়ে নিজেই করা যায়।
এ জন্য প্রথমে খেয়াল করতে হবে, স্তনের চারদিকে, বগলের ভেতরে বা আশপাশের কোনো স্থান ফুলে উঠেছে কি না কিংবা আলতো করে ছুঁয়ে দেখলে কোনো শক্ত চাকার মতো অনুভব হয় কি না, কোনো স্থানের বর্ণ পরিবর্তন হয়েছে কি না অথবা কোনো অংশ উষ্ণ লাগে কি না।
দুটি স্তনের মধ্যে আকারে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় কি না। স্তনের কোনো অংশের ত্বক ভেতরের দিকে কুঁচকে আছে কি না কিংবা ঢুকে গিয়েছে কি না। স্তনের বোঁটার কোনো অংশে চুলকানি আছে অথবা র্যাশ উঠেছে কি না। বোঁটার কোনো অংশ ভেতরের দিকে ঢুকে গিয়েছে কি না। বোঁটা থেকে কোনো ধরনের তরল নির্গত হয় কি না। স্তনের কোনো অংশে ব্যথা অনুভূত হয় কি-না, যেটি একই জায়গায় থাকে, কোথাও ছড়িয়ে যায় না।
প্রতি মাসে নিজ স্তনের এই পরীক্ষাগুলো করানোকে একটি অভ্যাস বানিয়ে ফেললে ভালো। এতে অস্বাভাবিক কিছু টের পাওয়া গেলে এরপর চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে মেমোগ্রাম বা আলট্রাসনোগ্রাম করানো যায়। তাতে ক্যান্সার হয়েছে ধারণা করলে এফএনএসি (ফাইন নিডল এসপিরেশন সাইটোলজি) করা যেতে পারে।
মনে রাখা উচিত, শুরুর পর্যায়ে স্ক্রিনিং করে যদি ক্যান্সারের বিষয়টি ধরা পড়ে, তাহলে এই রোগে মৃত্যু এড়ানো সম্ভব হয়।
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল ছাড়াও ঢাকা ও অন্যান্য জেলায় অবস্থিত প্রায় সব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই এখন ক্যান্সার বিভাগে রোগীরা সেবা পাচ্ছেন।
বাংলাদেশে এই মুহূর্তে সার্জারি, রেডিওথেরাপি, কেমোথেরাপি, হরমোন থেরাপি, টার্গেটেড থেরাপিসহ সব আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু রয়েছে।
তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যে পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করা হয়ে থাকে সেগুলো হলো-
রেডিওথেরাপি : রেডিওথেরাপি হলো একধরনের চিকিৎসাকৌশল যা ক্যান্সার এবং টিউমারের মতো রোগের চিকিৎসাতে ব্যবহৃত হয়। এই চিকিৎসাতে সাধারণত উচ্চ শক্তিসম্পন্ন রঞ্জনরশ্মি (এক্স-রে) বা গামা রশ্মি ব্যবহার করে রোগাক্রান্ত কোষ ধ্বংস করা এবং রোগাক্রান্ত কোষের বৃদ্ধি ও বিভাজন ক্ষমতা নষ্ট করে দেওয়া হয়।
কেমোথেরাপি : কেমোথেরাপি হলো এক প্রকার চিকিৎসা ব্যবস্থা যে ব্যবস্থায় ক্যান্সার কোষকে ধ্বংস করতে ক্যান্সাররোধী (অ্যান্টি-ক্যান্সার) এবং কর্কটরোগাক্রান্ত কোষের জন্য বিষাক্ত (সাইটোটক্সিক) ওষুধ ব্যবহার করা হয়। ৫০টিরও বেশি ধরনের রাসায়নিক চিকিৎসামূলক ওষুধ রয়েছে। এগুলোর কোনো কোনোটি ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল হিসেবে খেতে হয়; কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই ওষুধগুলোকে তরল বা স্যালাইনের সঙ্গে বা অন্য কোনোভাবে সরাসরি রক্তে দিয়ে দেওয়া হয়। রক্তের সঙ্গে মিশে এই ওষুধগুলো শরীরের যেখানে যেখানে ক্যান্সার কোষ রয়েছে সেখানে গিয়ে ক্যান্সার কোষগুলোকে ধ্বংস করার চেষ্টা করে।
সার্জারি : সার্জারির মাধ্যমে মূলত শরীরে ক্যান্সারে রূপ নেওয়া টিউমার অপসারণ করা হয়, যেন তা ছড়িয়ে না পড়তে পারে।
হরমোন ও টার্গেটেড থেরাপি : উপরিউক্ত চিকিৎসাসমূহ বাদেও রোগীদের বিভিন্ন হরমোন ও টার্গেটেড থেরাপি দিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয়ে থাকে।
দেশে ক্যান্সার চিকিৎসার অধিকাংশ করা হয় রেডিওথেরাপি (৩৭.৫ শতাংশ) ও কেমোথেরাপির (৩৩.৬ শতাংশ) মাধ্যমে।
এ ছাড়াও রেডিওথেরাপি+কেমোথেরাপি ২১.৮ শতাংশ, সার্জারি শতাংশ, সার্জারি+কেমোথেরাপি ০.৮ শতাংশ, হরমোন থেরাপি ০.৬ শতাংশ এর মাধ্যমে চিকিৎসাসেবা পেয়ে থাকেন।
অসচেতনতা : বাংলাদেশে ক্যান্সার দেরিতে ধরা পড়ার প্রধান কারণ হলো সচেতনতার অভাব। ক্যান্সার এর বিভিন্ন লক্ষণ থাকা সত্ত্বেও সেগুলো সম্পর্কে ধারণা না থাকায় রোগীরা সেগুলো গুরুত্ব না দিয়ে চিকিৎসা করায় না। ফলে ক্যান্সার ছড়িয়ে যাওয়ার পরই ধরা পড়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে।
স্ক্রিনিংয়ের অভাব : প্রত্যেক পুরুষ ও নারীকেই একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর নিয়মিত বিভিন্ন ক্যান্সার নির্ণয়ের সহজ পদ্ধতি স্ক্রিনিং করাতে হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য যে বাংলাদেশে স্ক্রিনিং সম্পর্কে যেমন জনসাধারণ এর ধারণা খুব কম তেমনই কম স্ক্রিনিং এর সুবিধা।
সঠিক রোগ নির্ণয় পদ্ধতির অভাব : দেশে ক্যান্সার চিকিৎসার যথেষ্ট উন্নতি হলেও রোগ নির্ণয় পদ্ধতি এখনো খুব সাধারণ মানেরই রয়ে গেছে। ফলে অনেক সময় ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর রোগ ধরা পড়তে অনেক দেরি হয়ে যায়।
জেলা পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ অভাব : ক্যান্সারের মতো জটিল রোগ নির্ণয় এর জন্য প্রয়োজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের যা দেশের জেলা পর্যায়ে নেই বললেই চলে। ঢাকার বাইরের জেলাসমূহ থেকে তাই রোগীদের ঢাকায় আসতে হয় সঠিক রোগ নির্ণয়ের জন্য।
দরিদ্রতা: দেশের প্রায় বেশিরভাগ মানুষ এখনো দরিদ্রসীমার নিচে অবস্থান করছে। ক্যান্সার চিকিৎসা বেশ ব্যয়বহুল হওয়ায় প্রাথমিক পর্যায়ে অনেক রোগীই চিকিৎসা নিতেই অসামর্থ্য ও অনিচ্ছুক থাকে। এটাও ক্যান্সার দেরিতে ধরা পড়ার একটি বড় কারণ।