কোভিড ১৯ : প্রয়োজন ভ্যাকসিন

হাসান মাহমুদ রেজা ও আনিকা তাবাসসুম বৃষ্টি

প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২১, ০৯:৩৬ এএম | আপডেট: ০৪ জুলাই ২০২১, ০৮:৪৫ পিএম

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

যত সম্ভাবনা ও আশা নিয়ে ২০২০ সাল শুরু হয়েছিল, তা আমূল পাল্টে গিয়ে করোনা মহামারিতে প্রায় দেড় বছর ধরে সারাবিশ্ব এক ভয়াবহ সময় অতিবাহিত করছে। ভাইরাস সংক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর হারও উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে কয়েক দফায়। উন্নত, উন্নয়নশীল কিংবা অনুন্নত- কোনো দেশই এর থেকে ছাড় পেল না। সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশও এই বিধ্বংসী ভাইরাসে বিপর্যস্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব এ জাতীয় সংকট দেখেনি আর। 

আমাদের দেশেও এই করোনাভাইরাস সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে। দরিদ্র মানুষের সংখ্যা লাফিয়ে ওঠার পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে। সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং ক্যাম্পাসসমূহ বছরখানেকের বেশি বন্ধ হয়ে রয়েছে। ভয়, অনিশ্চয়তা, মানসিক চাপ এবং আর্থিক কষ্ট সমাজকে গ্রাস করছে ধীরে ধীরে। জনজীবনকে দ্রুত স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টায় নন ফার্মাকোলজিক্যাল ইন্টারভেনশন যেমন মাস্ক পরা, হাত স্যানিটাইজ করা, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার মতো বিধিনিষেধগুলো মেনে চলার পাশাপাশি এর প্রতিরোধের জন্য ভ্যাকসিনেশনের বিকল্প নেই। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, অন্তত ৭০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনার আগ পর্যন্ত চলমান করোনা মহামারি শেষ হবে না। 

একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। বিআইডিএস এর তথ্য উপাত্ত অনুযায়ী, করোনায় এক কোটি ৬৪ লাখ লোকের আয় কমেছে আর বেকারত্ব বেড়েছে দশ গুণ। ফলে তাদের কর্মসংস্থান, আয় ও জীবনযাত্রার মানের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে। চাকরির বাজারও হয়ে গিয়েছে অনেকাংশে সংকুচিত। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় (জুলাই ২০২০) প্রকাশিত প্রতিবেদনে বাংলাদেশে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহ (এসডিজি) অর্জনে করোনভাইরাসের প্রভাব সুস্পষ্ট। করোনা মহামারির আগে, গত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশ দারিদ্র্য হ্রাসে সুদৃঢ় পদক্ষেপ নিয়েছে যার ফলশ্রুতিতে ১৯৯০ সাল থেকে দারিদ্র্য ৫০.৪% থেকে কমিয়ে ২০১৯ সালে ২০.৫% হয়েছিল। তবে করোনা এবং লকডাউন দেশের দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক স্থায়িত্বকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করেছে, মানুষের জীবন-জীবিকা ব্যাহত করেছে এবং ২০২০ সালে দারিদ্র্যকে ৪০.৯% এ উন্নীত করেছে। বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করলেও মহামারিজনিত কারণে অনেক খাদ্যপণ্যের সরবরাহ চেইন ব্যাহত হয়েছে; যার ফলস্বরূপ বিভিন্ন পণ্যের দাম বৃদ্ধি পায়। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে অবশ্যম্ভাবী ফলাফল হয়তো হবে প্রকট খাদ্য সংকট।

দেশের মূল চালিকাশক্তির অন্যতম হচ্ছে পোশাক রফতানি ও বহির্বিশ্বে কর্মরত বাঙালি শ্রমিকদের প্রেরিত অর্থ। বলার অপেক্ষা রাখে না যে এই দুই ক্ষেত্রেই বেশ বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে। আসন্ন দিনগুলোতে সবকিছু আবার ট্র্যাকে ফিরিয়ে আনতে এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহকে নিশ্চিত করতে সরকারকে প্রথমেই ভ্যাকসিনেশন নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্বের অনেকগুলো দেশ ভ্যাকসিন উৎপাদনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, অভূতপূর্ব গতিতে একের পর এক কোম্পানি প্রতিষেধক আবিষ্কার করে করোনা মহামারির এই সংকট থেকে উদ্ধারের পথ সুগম করছে। তবে অনুমোদন, উৎপাদন, রফতানি ও স্বত্ব নিয়ে জটিলতায় এখনো যথেষ্টসংখ্যক মানুষ করোনা ভ্যাকসিন পায়নি। নাগরিক জনজীবনকে আগের পর্যায়ে ফিরিয়ে নিতে এবং ভ্যাকসিনের সুফল পেতে হলে বিশ্বের প্রায় সব মানুষকেই ভ্যাকসিন গ্রহণের আওতায় আনতে হবে।

যেখানে ভ্যাকসিনেশনের হার সর্বাধিক, দেখা গিয়েছে কোভিড সংক্রমণের হারও সেখানে হ্রাস পাচ্ছে। তবে বর্তমানে সারাবিশ্বে যে পরিমাণ ভ্যাকসিনের চাহিদা রয়েছে, উৎপাদনকারী সংস্থাগুলো তা উৎপাদন করে কুলাতে পারছে না। বাংলাদেশ চুক্তি থাকা এবং অগ্রিম অর্থ প্রদানের পরও পরিমাণমতো টিকা পাচ্ছে না। তাই বাংলাদেশে ভ্যাকসিন উৎপাদনের বিষয়টি এখন সময়ের দাবি হিসেবে সামনে চলে এসেছে।

দেশজুড়ে শুরু হওয়া ভ্যাকসিন প্রদান কর্মকাণ্ড এখন প্রায় স্তিমিত হয়ে আসছে পর্যাপ্ত ভ্যাকসিন না থাকার কারণে। ভ্যাকসিনের অভাবে প্রথম ডোজ আপাতত স্থগিত আছে এবং দ্বিতীয় ডোজ নিয়েও অনিশ্চয়তায় ব্যাপক উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছিল। সেই অপ্রতুলতা মেটাতে বাংলাদেশ সরকার বিকল্প হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়াসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। 

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ অল্পবয়সী (১০-২৪ বছর)। এ জনগোষ্ঠীকে ভ্যাকসিনের আওতার বাইরে রেখে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করাও অসম্ভব। উন্নত দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পূর্বে সর্বস্তরের ছাত্রছাত্রীদের ভ্যাকসিনেশন নিশ্চিত করা জরুরি। 

সিরাম ইনস্টিউটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার তথ্যমতে, তারা চাহিদার সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য অন্যান্য দেশেও ভ্যাকসিন উৎপাদন শুরুর পরিকল্পনা করছেন। স্থানীয় ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে রাশিয়ার স্পুটনিক টিকা বাংলাদেশেই উৎপাদনের প্রস্তাব দিয়েছে মস্কো। তাদের প্রস্তাব অনুযায়ী, রাশিয়া টিকা উৎপাদন সংক্রান্ত প্রযুক্তি সরবরাহ করবে এবং তার সহায়তায় বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো এদেশেই টিকা উৎপাদন করবে। 

বাংলাদেশের ওষুধ প্রযুক্তিবিষয়ক বিশেষজ্ঞগণের মতে, সহায়তা পেলে রাশিয়ার আবিষ্কৃত ভ্যাকসিন স্পুটনিক ভি বাংলাদেশেই উৎপাদন করা সম্ভব।

বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো এখন আর আগের অবস্থায় নেই, ওষুধশিল্পে বাংলাদেশের অগ্রগতি অনেক। বেশ কয়েকটি বিশ্বমানের কোম্পানিও রয়েছে বাংলাদেশে, ২০১৯-২০ সালে বিশ্বের প্রায় ১৩২টি দেশে ওষুধ রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত কিছু ওষুধ যেমন রেমডেসিভির বাংলাদেশ থেকে অন্য দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। তবে বিপরীত ঘটনাই লক্ষ্য করা গেছে ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে। সাতটি ভ্যাকসিন তৈরির অভিজ্ঞতা থাকলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো প্রতিষ্ঠান এখন কোনো ভ্যাকসিন তৈরি করে না। ১০ বছর আগে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট সর্বশেষ জলাতঙ্ক রোগের টিকা উৎপাদন করেছিল। তারপর থেকে বিদেশে উৎপাদিত ভ্যাকসিম এনে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচিতে (ইপিআই) ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি গুলোর প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এবং দক্ষ জনবল রয়েছে, শুধু উচ্চমানসম্পন্ন প্রযুক্তি এবং ভ্যাকসিনের কাঁচামাল পাওয়া গেলেই মানসম্মত ভ্যাকসিন উৎপাদন শুরু করা সম্ভব। প্রযুক্তিগতভাবে আমাদের পিছিয়ে থাকাটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ প্রযুক্তির উন্নয়নের জন্য যে গবেষণা ও তহবিল দরকার তা বাংলাদেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে নেই। ভ্যাকসিন গবেষণায় বায়োসেফটি লেভেল থ্রি ল্যাবরেটরির অপ্রতুলতাও উল্লেখ্য। ভ্যাকসিন উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মূলত এই বিষয়গুলোতেই সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

ভ্যাকসিন তৈরির কাঁচামাল বাংলাদেশে কিংবা ভারতে উৎপাদিত হয় না। এই কাঁচামালগুলো আমাদের আন্তর্জাতিক বাজার থেকে সংগ্রহ করতে হবে। রাশিয়া যদি এই প্রযুক্তি এবং কাঁচামাল সরবরাহ করতে রাজি থাকে এবং আমাদের জনদক্ষতা বৃদ্ধি করা যদি সম্ভব হয়, তাহলে ভ্যাকসিন উৎপাদনে তেমন কোনো বাধা থাকবে না। স্থানীয়ভাবে বাংলাদেশে ভ্যাকসিন উৎপাদনের জন্য বড় আকারের বিনিয়োগেরও প্রয়োজন হবে। বিশ্বের প্রায় ১৫টি দেশে ২০টিরও অধিক সরবরাহ অংশীদার, ২০টিরও বেশি পরীক্ষাগার এবং যুক্তরাজ্যে তিনটি ও ইউরোপের বাকি দেশগুলোতে পাঁচটিরও বেশি উৎপাদন কেন্দ্র রয়েছে অ্যাস্ট্রাজেনেকার। দক্ষিণ এশিয়াতে সিরাম হচ্ছে তাদের একমাত্র উৎপাদন অংশীদার।

আমাদের দেশে স্থানীয়ভাবে করোনার ভ্যাকসিন উৎপাদনের জন্য স্পুটনিক-ভি উৎপাদনের অবকাঠামো ও প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার ভিত্তিতে প্রাথমিকভাবে ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস, পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালস ও হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির সক্ষমতা যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। করোনাভাইরাস প্রতিরোধী ভ্যাকসিন সংগ্রহ ও বিতরণবিষয়ক আন্তঃমন্ত্রণালয়সংক্রান্ত পরামর্শক কমিটির এই তিনটি কোম্পানির উৎপাদন সক্ষমতার ভিত্তিতে স্কোরিংয়ের মাধ্যমে মূল্যায়ন করে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরকে চূড়ান্ত সুপারিশ জানিয়েছে। টিকা উৎপাদনের সক্ষমতা নির্ধারণের জন্য কোম্পানির দক্ষতা, মান, জনবল ও সামর্থ্য, অভিজ্ঞতা এবং কত দ্রুত উৎপাদনে যেতে পারবে- এসব বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়। বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর, ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর ও ভ্যাকসিন কমিটি যেভাবে যৌথভাবে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তাতে খুব দ্রুত বাংলাদেশেই ভ্যাকসিন উৎপাদন সম্ভব বলে আশা করা যাচ্ছে। দেশের ১২-১৩ কোটি জনসংখ্যাকে ভ্যাকসিন কার্যক্রমের আওতায় আনা গেলেই হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করা সম্ভব হবে। সক্ষমতা বাড়লে আশা করা যায়, ভ্যাকসিন বিদেশেও রপ্তানি করা খুব একটা কঠিন হবে না। 

করোনা মহামারি সত্যিকার অর্থেই একটি বৈশ্বিক সংকট -তার ব্যাপ্তিতে এবং গভীরতায়। মাত্র দেড় বছরের মধ্যে এটা জীবন ও জগতের চিত্র বদলে সারাপৃথিবীকে দিশেহারা করে ফেলেছে। জন্ম দিয়েছে এক ‘নতুন বাস্তবতা’র। বর্তমান ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার লক্ষ্যে এ মুহূর্তে একমাত্র উপায় দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে ভ্যাকসিনেশনের আওতায় আনা। পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা।

লেখক : নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসিউটিক্যাল সায়েন্স বিভাগের শিক্ষক

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh