রাতা মোরগের ঝোল

খোকন দাস

প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২১, ১১:৫৩ এএম | আপডেট: ০৮ জুলাই ২০২১, ০৮:৩২ এএম

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

কয়েক দফা ওষুধ খাওয়ার পর হাঁপানির টান কমতে কমতে ফজরের আজানের সময় হয়ে যায়। ক্লান্তিতে শরীর, বালিশে হেলান দিয়ে চোখ বুজে আজানের জন্য অপেক্ষা করে, আজানের পর রাতা মোরগটা ডেকে উঠবে; রাতা মোরগের ডাক শুনে, মোরগটা যে এখনো আছে তা নিশ্চিত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ার পরিকল্পনা করে বৃদ্ধ ইউনুস আলী।

ইদানীং হাঁপানিটা ইউনুসকে একেবারে কাবু করে দিয়েছে; এক একবার শ্বাসটান উঠলে, বিশেষ করে অমাবশ্যার সময় তিন-চার দিনেও থামতে চায় না। ভাগ্য ভালো ইকবাল মনে করে নারাণ ডাক্তার থেকে আগের দিন ওষুধ এনে রেখেছে। আলো-আঁধারিতে মাথার কাছে নড়বড়ে টেবিলে রাখা ওষুধের শিশি, পানির মগ, হাতলওয়ালা প্লাস্টিকের চেয়ার, বেড়ার সঙ্গে লাগানো কোম্পানির মেডিসিনের ছবিওয়ালা পোস্টার- এসব থেকে চোখ সরিয়ে একটা অন্যরকম দৃশ্য কল্পনা করে। সামনে বড় একটা পাতিলে লাল টকটকে ঝোলের ওপর তেল ভেসে বেড়াচ্ছে; ঝোলের মধ্যে ডুব দিয়ে বড় বড় আলুর টুকরা আর রাতা মোরগের মাংস, ইকবালের বউ বিউটি বেগম মোরগের একটা রান আর দুই টুকরা আলু তার পাতে তুলে দেয়। ধোঁয়া ওঠা গরম গরম ভাত ততধিক গরম লাল ঝোলে ভিজে একাকার, ইউনুস বেতের মতো শক্ত আঙুল দিয়ে নাড়াচাড়া করে- ইদানীং এই দৃশ্যটা কল্পনা করতে খুব ভালো লাগে।

এমন একটা তৃপ্তিদায়ক খাবারের কথা কল্পনায় এলে ইকবালের ওপর রাগ চিড়বিড় করে চটতে থাকে চৈত্রের গরমের মতো। ইকবাল হয়ছে তার মতো, উদয়অন্ত মাটি কচলিয়ে ফসল বের করে; না করে কি করবে শরীরের শক্তি আর সামান্য জমি ছাড়া আর কি আছে? তা না হলে- হোক না নিজের ছেলে- কবে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে ইকবালের মাথা দুই ভাগ করে দিতো।

এর আগে দুই-দুইটা রাতা মোরগ তাকে না জানিয়ে ইকবাল বিক্রি করে দেয়- রাতা মোরগের মাংস দিয়ে ভাত খাবার খায়েশটা বহু দিন ঝুলে আছে। 

এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ দেখে চারদিক ফরশা হয়ে গেছে, তখনই সহসা তার মনে হয় রাতা মোরগটা ডেকে ওঠেনি- যার ডাকের জন্য সে ক্লান্ত শরীরে অপেক্ষা করে আছে। নাকি ডেকেছে, সে তার মাংস খাবার দৃশ্য কল্পনার ঘোরে থাকায় খেয়াল করতে পারেনি। কোনো কোনো দিন মোরগ ডাকার পর ইকবালের মা বিলাপ করে কাঁদে ছোট ছেলে জসিমের জন্য, আজ ইকবালের মার কান্নাও শুনতে পায়নি। ডেকেছে, নাকি ডাকেনি- একটা বিভ্রান্তিতে পড়ে যায়। এক পা-দুইপা করে পাশের ঘরে, যেখানে মরিয়ম ছোট নাতিকে নিয়ে শোয়, সে ঘরে গিয়ে দেখে খাঁচায় রাতা মোরগ নেই। 

এই মোরগও কি ইকবাল বিক্রি করে দিয়েছে? 

সুবে সাদেকের এমন শান্ত পরিবেশে উত্তেজিত হওয়া মোটেও উপযুক্ত নয় বলে ইউনুস আলী রাগ নিয়ন্ত্রণ করে। বিস্ফোরিত হতে না পারলেও ভেতরে ভেতরে ছেলেকে দুষতে থাকে। এক সময় রাগ পরিণত হয় অভিমানে, এই সংসার, বউ-ছেলে-মেয়ের জন্য এই একটা জীবনে কী না করেছে; অথচ সামান্য একটা মোরগের ঝোল তার কপালে জুটছে না, বার বার ফসকে যাচ্ছে।

স্নায়ুবিক উত্তেজনার কারণে হয়তো ইউনুসের আবার শ্বাসকষ্ট শুরু হলে নিজেকে শান্ত করে, সকালটা এরকম বিশ্রিভাবে শুরু হওয়া নিয়ে আপসোস করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে।

সকালে মাঠ থেকে ফিরে পান্তা ভাত খেতে খেতে ইকবাল বাপের শরীরের সর্বশেষ অবস্থার তথ্য নেয় বউ বিউটি বেগমের কাছে; ‘আব্বার শরীর ভালানি এখন?’

‘বুড়া এখন ভালোই আছে, মাঝ রাতে বুড়ার সে কি পরিস্থিতি মনে হচ্ছে যখন-তখন দম বেরিয়ে যাবো। সকাল হতেই দেখি টনটনে, যা ভোগাইতে পারে লোকটা। ’ 

‘সব রোগ-ব্যাধিরাতে বাড়ে, বুঝইলা? তবে হাঁপানি এমন একটা রোগ এইটা রাতে বেশি বাড়ে।’

‘রোগ-ব্যাধি নিয়ে তোমার এত জ্ঞান, তোমার জন্য দেখছি নারাণ ডাক্তার ভাতে মরবে’- বিউটি বেগম এই কথা বলে রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। মাঠে যাওয়ার আগে ঘরের মধ্যে উঁকি দেয় বাপের অবস্থা দেখে ইউনুস। হাড্ডিসার বুকের উঠা-নামা, শীর্ণ দাঁড়ি, দন্তহীন মুখগহ্বর, সবকিছু ছাপিয়ে কোঠরাগত দুই চোখে আগুন দেখতে পায় ইকবাল। বৃদ্ধ পিতার জন্য সত্যি মায়া হয়। এই নিয়ে তিন দিন রাতা মোরগ বিক্রি করে দিয়েছে মুখের গ্রাস কেড়ে নেওয়ার মতো। এভাবে মোরগগুলো বিক্রি করে দেওয়ার জন্য মনে মনে লজ্জিত হয়। হঠাৎ হঠাৎ এমন বিপদ এসে হাজির হয় বিক্রি না কওে উপায় থাকে না।মনে মনে ভাবে হাতে টাকা-পয়সা এলে বাজার থেকে একটা রাতা মোরগ কিনে এনে সামনে বসিয়ে খাওয়াবে। যেভাবে সকাল-বিকাল শরীর খারাপ হচ্ছে আব্বার, কিছু হয়ে গেলে বাকি জীবনটা আপসোস নিয়ে কাটাতে হবে। এই সময় জসিমের কথা মনে পড়ে, তিন বছর হলো সাউথ আফ্রিকা গিয়ে বসে আছে। একটা কানা পয়সা পাঠানোর কোনো নামগন্ধ নেই; অথচ ছোট চাচা বিল্লালের ছেলে নাজমুল এক বছরের মাথায় টাকা পাঠাতে শুরু করেছে, চোখের সামনে তাদের ভিটিতে পাকা বিল্ডিং উঠছে। 

কিছু একটা বলতে চেয়েও নিজেকে সংযত করে; পীড়িত বাপের মুখোমুখি হতে চায় না, অহেতুক রাগ করে শরীরটাকে আরও খারাপ করতে পারে। 

ইদানীং হাঁপানিটা বেশ ভোগাচ্ছে ইউনুসকে। কয়েক বছর আগে হঠাৎ হঠাৎ তাও অমাবশ্যার রাতে শ্বাসটান উঠতো, তাও একদিনের বেশি স্থায়ী হতো না। এখন একনাগাড়ে তিন দিন না ভুগিয়ে ছাড়তে চায় না। নারাণ ডাক্তার বলে, ‘বয়স, সবই বয়স, বয়স যতো বাড়বে, অসুখ-বিসুখ ততো চেপে ধরবে।’

শ্বাসটান ছেড়ে গেলে শরীরটা নারিকেলের পাতার মতো কাঁপতে থাকে। কখনো কখনো এসময় মনে হয় যে, ভূমিকম্পে ঘরদোর নড়ছে। চোখ বুজে আসলেও ঘুম আসে না, কাত-চিৎ যেভাবে শোয় না কেন বুকের ধুক-ধুকানি শব্দটা কানের ভেতর হয়ে মগজে ঢুকে একটা অন্য রকম ভীতির সঞ্চার করতে থাকে। ঘুম-ঘুম চোখে এক-দুই ঘণ্টা নিথর পড়ে থাকার পর ধীরে ধীরে শরীর স্থির হতে থাকে। এমন দুঃসহ কষ্টের পর বাঁধাহীন শ্বাস নিতে পারার মধ্যে কী যে সুখ, বেঁচে থাকা যে দুনিয়াতে কতবড় ঘটনা আগে কখনো বুঝতে পারেনি। আরও কয়টা দিন বেঁচে থাকতে পারলে কি যে ভালো হতো। 

নারাণ ডাক্তার ছেলেটার একটা কথা তাকে আশাবাদী করে তোলে- জ্যাঠা, হাঁপানির রোগী সহজে মারা যায় না।

ছেলেটা তিন বছর আগে সাউথ আফ্রিকা গেল এখনো দেশে ফেরার নাম নেই, কোথায় আছে, কী করছে, বেঁচে আছে, না কালো গুণ্ডারা গুলি করে রাস্তায় ফেলে দিয়েছে কে জানে? ছেলেটার জন্য, তাকে বিদেশ পাঠানোর সময় যে দুই একর জমি লাগিদ দিয়েছে, সে জমি ফিরে পাওয়ার জন্য তাকে আরও কিছু দিন বেঁচে থাকতে হবে। 

চোখের সামনে গ্রামটার কত পরিবর্তন হয়ে গেল- স্কুলের সামনে চারচারটা মনোহারি দোকান, সেলুন সৌদি ফেরত আরিফের স্টুডিও, পাশাপাশি দেশি-বিদেশি বিস্কুট, ফ্রিজে ঠাণ্ডা পানির বোতলের পাশে কোমলপানীয় বোতলে ঠাসা।

ইউনুস একটা বিষয় গভীরভাবে খেয়াল করেছে, জমিজমা, হালের গরু, বউয়ের গয়না, উঁচুউঁচু গাছ বিক্রি, ধার-দেনা করে যারা বুকে পাথর চেপে উঠতি বয়সের ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়েছে, কেবল তাদেরই ভিটিতে ভাঙাচোরা ঘরের টিনের চাল ফুড়ে পাকা ঘর বেরিয়েছে। ঘরে এসেছে টিভি, ফ্রিজ আরও কত কী? 

দারুণ সাজগোজ করে বউ-ঝিরা দামি বোরকায় শরীর ঢেকে মাসে একবার, দুইবার সদরে গিয়ে কেনাকাটা করে। ইকবালের বউ সেদিক থেকে অনেক ভালো। এখন পর্যন্ত একদিনের জন্যও সদরে যাওয়ার আবদার করেনি।

ইউনুস আলু এই অঞ্চলের আলুর বাম্পার ফলনের নায়ক। দুই-দুটি মেডেল ভাঙাচোরা সুটকেসের মধ্যে জমির দলিল-দস্তাবেজের সঙ্গে পড়ে আছে। সেই আলু চাষির ভিটায় এখনো সেই পুরনো টিনের ঘর বিদ্রূপ করছে। বড় ছেলেটা রাত-দিন খেটেও কূলকিনারা করতে পারছে না। 

ঘুম থেকে উঠে কিছুটা ফুরফুরে মন নিয়ে ইউনুস ধীরে ধীরে ঘরের পেছনে তার নিজের হাতে লাগালো আম গাছের সঙ্গে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। রান্না ঘরের পাশে লাউয়ের মাচার নিচে ইকবালের বউ বিউটি বেগম কি যেন করছে? পরীবানুকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। মনে মনে সে পরীবানুকে খোঁজে। হঠাৎবাগানের দিক থেকে একঝাক বাচ্চা নিয়ে খয়েরি রঙের মুরগিটা এসে ছাইয়ের গাদায় ডানা মেলে আরাম করে শুয়ে থাকে। ইউনুসের রাগ আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। গতকালও যে রাতা মোরগটা বউয়ের যুবতী মুরগিটাকে ধাওয়া করে ছাইয়ের গাদায় তার ওপর উঠে মর্দানি দেখালো। সেই রাতা মোরগটা আজ কার পাতে সুস্বাদু খাদ্য হয়ে গেল- ভাবতে গিয়ে রাগে দুর্বল শরীরটা কেঁপে কেঁপে ওঠে। 

ইউনুস শরীরে যতটা শক্তি আছে, তা দিয়ে চিৎকার করে ডাকে, ‘ইকবালের বউ, ওই ইকবালের বউ, ইকবাইল্যা কই? ইকবাল কই গেছে?’

ইউনুস ভেবেছে বিউটি বেগম দৌড়ে সামনে এসে মাথা নিচু করে কথার উত্তর দেবে; নূরি বেগম কাজ করতে করতে নাকি গলায় উত্তর দেয়- আপনার ছেলে কই থাকব? মাঠে, ক্ষেতে আলু লাগাইব, আপনি জানেন না? তারে কি দরকার, বিকেলে আবার কোম্পানির লোক আইবো, আলু চাষ নিয়ে মিটিং আছে।’

হঠাৎ ইউনুস নিজেকে সংযত করে শান্ত গলায় বলে, ‘না দরকার কিছু নেই। আমার আবার কি দরকার? তোমার শাশুড়ি কই, তারে আসতে কও।’

ইউনুস ভাবে, তার ইকবাল জোয়ান ছেলে, সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে, রাত দিন খাটা-খাটি নিয়ে থাকে, কোন দিকে তাকায়ও না। বৃদ্ধ বাপের পক্ষে সংসারের দায়িত্ব নেওয়া জোয়ান ছেলের মুখোমখি দাঁড়ানো যায় না। তবে রাগ যেহেতু সে করে আছে, সেহেতু সেটা কারও না কারও ওপর ঢেলে দিতে হবে। সে রাগটা ঢেলে দেওয়ার একজনই এ বাড়িতে আছে সেটা পরীবানু; এর জন্য একটা ছুতা খুব জরুরি, ছুতা না হইলেও সমস্যা নেই। 

তবে উপলক্ষ পেতে ইউনুসের বেশি সময় লাগে না। এক ঝাকা শুকনো পাতা এনে তার সামনে ঢালতে গেলে একরাশ ধুলা এসে তার চোখে-মুখে ঢোকে। 

‘তোমার কাণ্ড-জ্ঞান বলে কি কিছু নেই?’

লজ্জিত পরী বানু কোন উত্তর না দিয়ে আবার বাগানের দিকে রওয়ানা হবে, এমন সময় ইউনুস গলার রগ ফুলিয়ে ঝাঝালো গলায় বলে, ‘রাতা মোরগটা যে বেচি দিছে তুমি দেখনি? তুমি জানো না রাতার মাংস খাওনের নিয়ত করছি?’

পরীবানু বুড়ার কথায় পাত্তা দেয় না। ইউনুস আলী চিৎকার দিয়ে বলে,‘আমার কথার কি কোনো দাম নাই?’

পরী বানু ঘাড় বাঁকিয়ে পেছনে ফিরে হাতের ঝাড়ু বাতাসে নাড়াতে নাড়াতে বলে, ‘বুড়ার রাতার মাংস খাওনের এত শখ কিসের? যারে সকাল-বিকাল আজরাইলে টানাটানি করছে, তার আবার মাংস খাওনের শখ আসে কোত্থেকে? রাইত ধরি যে পড়ি পড়ি ওষুধ খাইচ ওই ওষুধের টাকা কনতুন আইছে? কয়দিন থেকে যে ওষুধ গিলি আইর ইগাইন না গিললে রাতা এইগা কান দুইগ্য খাইতে পাইরতা।’

প্রতিপক্ষ যে এতটা শাণিত ও এতটা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখাবে ইউনুস অনুমান করতে পারেনি। বুড়া নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে হাতের লাঠিটা বুড়ি পরীবানুর দিকে ছুড়ে মারে। 

সারা দিন দূরে দূরে থাকলেও দুপুরে খাবারের পর ইকবাল ইউনুসের খবরা-খবর নেয় এবং বিকেলে মকবুল চাচার দোকানে অধিক ফলনের জন্য কোম্পানির লোকের সঙ্গে আলু চাষিদের বৈঠকের কথা জানায়। ইকবাল জানে এই একটা খবরে তার বাপ উৎসাহ বোধ করবেন। এই বৃদ্ধই এক দিন এলাকায় উচ্চফলনশীল আলু চাষের উদ্যোগ নিয়েছে; দীর্ঘ দিন আলু চাষিদের নেতার আসনটা তার বৃদ্ধ পিতাই দখলে রেখেছিল; এই নিয়ে লোকটার গর্বেরও শেষ নেই। এই একটা খবরের কাছে রাতা মোরগ বিক্রির মতো খবর কোনো খবরই না। 

মকবুলের দোকান ঘর থেকে তার টেনে পাশের খালি জায়গায় বাঁশের খুঁটির সঙ্গে এলইডি বাল্ব লাগানো হয়েছে। ডজনখানিক প্লাস্টিকের চেয়ার গোল করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। সারাদিনের নানা দলের পর শরীর ক্লান্ত হলেও মন মেজাজ এখন ভালো ইউনুসের। দরমার ওপর রাখা ভাঙা সুটকেস থেকে আলু চাষের সাফল্যের স্মারক দুটি বের করে প্রথমে আঙুল দিয়ে এবং পরে লুঙ্গি দিয়ে মুছে যত্নে আবার রেখে ঘর থেকে বের হয়। গায়ে নতুন গামছাটা জড়িয়ে দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে সে মকবুলের দোকানে এসে একটা হাতলওয়ালা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে। দোকানের ছোকরাকে এক কাপ চা দিতে বলে পা তুলে আরাম করে বসে; তখনো না কোম্পানির লোক, না এলাকার আলু চাষি কেউ হাজির হয়নি। চায়ের কাপটা ধরতে যাবে, এমন সময় একটা মটর সাইকেল এসে থামে। 

আপনার নাম কি কইলেন?

চাচা আমার নাম পরিতোষ, আপনি ইকবাল ভাইয়ের আব্বা না?

বুড়া মাথা নাড়ে, হ্যাঁ, ইকবালের আব্বা। 

আপনার কথা ইকবাল ভাইয়ের কাছ থেকে শুনেছি, এই এলাকায় আপনি প্রথম উচ্চ ফলনশীল আলু চাষি, দুই দুইবার মেডেলও পাইছেন। আপনার দেখা-দেখি সবাই আলু চাষে এগিয়ে আসে। আলু চাষিদের নেতাও ছিলেন। 

নিজের প্রশংসা শুনে ইউনুস কিছুটা লজ্জা পায়। আমাদের কী অবদান, আমাদের আলুচাষি বানাইছে আপনাগো এক কোম্পানির লোক, ভবতোষ দা, লোকটার কথা কি কমু!

আপনার চেহারা খান পরিচিত মনে হইতেছে, গলার স্বরও পরিচিত মনে হচ্ছে, আপনারে কোনখানে দেইখছিনি?

‘ না চাচা, আবার দেখবারও পারেন। 

‘কোন ভবতোষের কথা বলছেন? মন্ডল পাড়ার এক ভবতোষ আছেন আপনার মতো কোম্পানিতে চাকরি করতো, এই এলাকায় আলুচাষের প্রচলন তিনিই করেছেন, সেই ভবতোষ আমার বাবা।

‘আপনি ভবতোষের ছেলে? আপনার বাবা কেমন আছেন?

এর মধ্যে মজিদ, রমেশ, নিজাম, হানিফ, পরিমলের বাপ এরা এসে হাজির হয়।

বুড়া ইউনুস আবার শুরু করে, আপনার বাবার সঙ্গে কত খাতির আছিল। একদিন ক্ষেতের আইলে বসে আছি মাথায় হাত দিয়ে, ক্ষেতের সব আলুগাছ মরে সাফ। উনি এই এলাকায় মাঝে মাঝে আসতেন সাইকেল চালাইয়া। আমাদের সঙ্গে কথা বলতেন নিজে থেকে এটা-ওটা বুঝাতেন। আমরা তেমন একটা পাত্তা দিতাম না। সেই সাইকেল নিয়ে ক্ষেতের মধ্যে গিয়ে আমারে বুঝাইলেন। আপনাকে আমরা বীজ দেব।

বলল, আলুর উৎপাদন দ্বিগুণ হয়ে যাবে। আমি চিন্তা করলাম, লোকটা পাগল হয়ে গেছে। আমি পাত্তা দিলাম না। কয়দিন আমার পিছে ঘুরল, তার কোন কথা মাথায় ঢুকলো না, কি করে ঢুকবে এনজিওর কিস্তি নিয়ে মাথার ঘায়ে কুত্তা পাগল অবস্থা।

একদিন সকাল বেলা দেখি, ওনি বাড়িতে এসে হাজির। হা করে একবার দম নিতে গিয়ে থামে, এর পর কথা শুরু করতে গিয়ে কথার খেই হারিয়ে ফেলে। কি যেন কইছিলাম? তোমার বাপ এখন কি করে?

‘বাবা এখন শয্যাশায়ী। প্যারালাইসিস হয়ে বিগত তিন বছর ধরে বিছানায় পড়ে আছেন।’

ইউনুসের চোখে-মুখে চিন্তার ছাপ। আপনার বাবা প্যারালাইসিস, বিছানায় পড়ে আছে!

‘ও হ্যাঁ, কথা মনে পড়েছে। একদিন সকালে এসে বলল, ইউনুস ভাই একবার চাষ করেই দেখেন, সার বীজ কোম্পানি দিবো। 

কথাটা শেষ না করেই আমার হাতটা শক্ত করে ধরে বলে,‘আমরা কোম্পানির চাকরি করি, কোম্পানির দেওয়া টার্গেট নেকড়ের মতো ধাওয়া করে বেড়ায়। টার্গেট পূরণ করতে না পারলে বউ-বাচ্চা নিয়ে না খেয়ে মরতে হবে।’ 

পরে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করি দেখলাম- এত করি যখন কচ্ছে একবার জমি দিয়া দেখি না। 

মোজাম্মেল, দুলালের বাপ, রফিক মিয়া এসে গেলে পরিতোষ হাতের ইশারায় তাদের বসতে বলে ইউনুসের কথায় মনোযোগ ধরে রাখার চেষ্টা করে। 

‘সে বার যা আলু হইলো, গেরামের সবার মাথা খারাপ অবস্থা। সবাই আসি ধইরল আমারে, কইল- সবাই জমি দিবো, কোম্পানির আলু চাষ কইরবো। আমাগো উঠানে হ্যাজাকলাইট জ্বালাই মিটিং হইল; মিটিংয়ের কথা মনে পড়তেই আবার রাতা মোরগের কথা মনে পড়ে। সেই মিটিংয়ের জন্য পরীবানুকে না জানিয়ে ডিমপাড়া মুরগি বিক্রি করে দেয় ইউনুস।

‘দেশে যে এত এত উন্নয়ন হইতেছে, এইবার বুঝতে পাইরতেছ উন্নয়নটা কোন দিক দিয়ে হইতেছে?’ নেতার মতো এমন একটা দামি কথা কি করে তার মুখ থেকে বেরিয়ে পড়ল তার প্রতিক্রিয়া বুঝার জন্য সবার চোখের দিকে একবার তাকায় উৎসাহ নিয়ে। 

‘উন্নয়নের চোদন বাড়তেছে বইল্যা, আমাগো অবস্থার উন্নতি কি জন্য হইতেছে না- সেই কথা কইলা না কিছু।’ ফ্যাসফ্যাসে গলায় আচমকা দুলালের বাপের এমন প্রশ্নে ইউনুসের কেবল মনোযোগই ছুটে যায় না, মাথায় রক্ত উঠে যায়। 

মনে মনে দুলালের বাপকে গালি দিয়েও রাগ কিছুটা কমে না। দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলে, ‘কিসের মধ্যে কি! আমি কইতেছি কি আর তুমি কইলা কি, দুলালের বাপ তোমার এখনো বুদ্ধি-শুদ্ধি হয়নি দেখছি।’

কিছুক্ষণ থেমে আবার বলে, ‘জোয়ান বয়সে যার বিবি অন্য মরদের সঙ্গে চলি যায়, তার বুদ্ধি-শুদ্ধি থাইকবো কি করে?’

একটা সামান্য কথায় কতো বছর আগের একটা ঘটনাকে তুলে এনেভরা মজলিশে এভাবে বেইজ্জতিতে একেবারে কাবু হয় মোতালেব। নিজেকে সামলে নিয়ে কি করে জুতসই পাল্টা আঘাত করা যায়, তা ভাবতে গিয়ে বেশ খানিকটা সময় পার করে ফেলে মোতালেব।

‘বাজারে দাম নেই, রাস্তায় আলু ফেলে প্রতিবাদ, কোল্ড স্টোরের মালিকের সঙ্গে লাঠালাঠি- কম কেরামতি তো করলাম না’- মনে মনে গুছিয়ে নেওয়া কথাটা বলতে যাবে, তার আগে দেখে ইউনুস সেই পুরনো গল্পে ঢুকে পড়েছে। যে গল্পটা শুনতে তারও ভালো লাগে, কেননা এর সঙ্গে সেও জড়িয়ে আছে। 

‘একবার একটা রোগ হইছিল। আলু গাছ লকলক করে বেড়ে উঠছে। একদিন ভবতোষদা, মানে তোবার বাবা আরকি, আমাদের সবাইকে ক্ষেতে নিয়ে গেল। তোমার মনে আছে মজিদের বাপ? মজিদের বাপ মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। হঠাৎ মোচড় দিয়ে দিয়ে আলুগাছগুলো তুলে ফেলতে লাগলো ভবদা।

আমরা বললাম, করেন কী? করেন কী? আপনি কি পাগল হইয়া গেছেন?

কে শোনে কার কথা, ওনি উঠিয়েই চলছেন। আমাগো মজিদের বাপ আর পরিমলের বাপ উপুড় হই আলুবেড় ধরি সে কি কান্না। 

কি কও দুলালের বাপ? কথা কি ঠিক কইলাম? 

দুলালের বাপের দিকে হাতের ইশারা করে ফোকলা দাঁতে খিকখিক করেহাসতে কাশি উঠে আবার হাঁপানি শুরু হয়। বহু কষ্টে নিজেকে সামলে নেয় ইউনুস । 

দুলালের বাপ মাথা নেড়ে ইউনুসের কথায় সম্মতি জানায়। 

ভরাট দুই গালে হাত বুলিয়ে এবার মফিজ মিস্ত্রি বলে, বুড়ার রস দেইখছনি, হাসে কেমনে। 

হাতের ইশারা দুলালের বাপকে থামিয়ে দিয়ে বলে, ‘আসল কথান কই, ভবদা বললেন, গাছের আর দরকার নেই। মাটির সব রস এখন গাছে খেয়ে ফেলবে এতে আলু আর বড় হবে না। আলু থেকে যে চিকন-টিকন শিকড় বেরিয়েছে, সেগুলো দিয়ে রস টেনে আলু বড় হবে।’

আমাদের সবার চোখ কপালে, গাছ উঠাই ফেরলেও আলু বড় হইবো, এমন আজগুবি কথা কেউ কোনো দিন শুনছেনি। 

‘শুনেন, বাচ্চা বড় হইলে মায়ের দুধ আর লাগে? লাগে না, আপনাগো বড় আলু দরকার না-কি গাছ দরকার?’

আমরা কইলাম. ‘আমাদের বড় আলু দরকার।’

আমাদের নিমাইদা পরদিন রাতে কীর্ত্তন থেকে ফেরার পথে কালভার্টের কাছে আমারে জড়াই ধরি কইল, ‘ইউনুস ভাই, গভীরে গিয়ে তুমি কথাটা চিন্তা করি দেখ, যে মা সন্তানের জন্ম দিল, তাকে অকালে মেরে ফেলতে হবে সন্তানের বড় হওয়ার জন্য!’

আমি কইলাম, ‘নিমাইদা তোমার তত্ত্ব কথা ছাড়, আলুর ফলন বাড়ছে কী না সেই কথা খান কও।’ নিমাইদা মাথা ঝাঁকাই কয়,‘বাড়ছে।’

এর মধ্যে সফিককে সঙ্গে নিয়ে ইকবাল এসে হাজির, এখনই সভা শুরু হবে, আসলে সবাই এতক্ষণ ইকবালের জন্যই অপেক্ষা করে আছে। 

ইকবালকে দেখে ইউনুসের আবার রাতা মোরগের কথা মনে পড়ে যায়, লাল লাল ঝোলে গরম গরম ভাত।

ইউনুসের আবার শরীর খারাপ হয়ে গেছে। তাকে দ্রুত বাড়ি যেতে হবে। উঠে দাঁড়িয়ে পা বাড়াবে- এমন সময় আবার দাঁড়ায়, ‘আপনার বাপের কি অবস্থা কইছিলেন তখন?

‘প্যারালাইসিস, শয্যাগত। তিন বছর থেকে। চলাফেরা করতে পারেন না, কথা বলতে পারেন?’

‘ডাক্তার-কবিরাজ কিছু করাননি?’

‘করাইছি, কাজ হয়নি।’

‘প্যারালাইসিস, প্যারালাইসিস, প্যারালাইসস...। শব্দটা মনে মনে আওড়াতে আওড়াতে ধীরে ধীরে দোকান থেকে বেরিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে। তুমুল হাঁপানিতে মনে হচ্ছে, এক্ষুণি দম বেরিয়ে যাবে। এভাবে হাঁপানিতে ধুকার চাইতে প্যারালাইসিসে পড়ে থাকা ভালো। দম নিয়ে এই টানাটানি নেই, বিছানায় কেবল শুয়ে থাকা। হাঁপানি না প্যারালাইসিস কোনটা ভালো? আহা লোকটার সঙ্গে কতদিন দেখা হয় না। 

সন্ধ্যায় নেমে আসা অন্ধকারের মধ্যে নিজের শরীরটাকে টেনেটুনে বাড়ি নিয়ে যায়; তেলচিটচিটে শক্ত বালিশে হেলান দিয়ে দম নেয়। কিছুক্ষণ স্থির হয়ে থাকায় হাঁপানির তীব্রতা কমে এলে তন্দ্রার মতো এসে যায়। ইউনুস তন্দ্রার মধ্যে দেখে- সদর হাসপাতালের ছোট ছোট রুমের মতো একটা রুমে হালকা আলোয় পাশাপাশি দুটি খাটে দুইজন শুয়ে আছেন। একজন তীব্র হাঁপানিতে ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে, অন্য জন পক্ষাঘাতে প্যারালাইসি বিছানার সঙ্গে সেটে আছে। 

বহু কষ্টে থেমে থেমে ইউনুস বলে, ভবদা আলুর উৎপাদন আরও বাড়াতে হবে না? 

পাশ থেকে ভবতোষ ফোঁকলা গালে হেসেকিছু একটা বলে, কী বলে স্পষ্ট বুঝা যায় না; ইউনুস আলী কান বাড়িয়ে দিয়ে বুঝার চেষ্টা করে, ‘আরও বাড়াতে হবে, আরও বাড়াতে হবে, আমাদের জীবন দিয়ে হলেও উৎপাদন বাড়াই যাইতে হবে।’

দু’জনের মাঝখানে আলুর স্তূপ, এই স্তূপ বাড়তে থাকলে কেউ কাউকে দেখতে পায় না, এই স্তূপ একসময় পাহাড়ে পরিণত হয়, পাহাড়ের নিচে চাপা পড়ে যান তারা।   

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh