হামিম কবির
প্রকাশ: ০৭ জুলাই ২০২১, ০১:১৩ পিএম
ড. হাসান মাহমুদ রেজা
ড. হাসান মাহমুদ রেজা, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক। পিএইচডি করেছেন জাপানের নারা ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে। সেখানেই কিছু দিন শিক্ষকতা করেন। এখন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির স্কুল অব হেলথ অ্যান্ড লাইফ সায়েন্স অনুষদের ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স ও বাংলাদেশে ভাইরাসটির গবেষণা নিয়ে দেশকাল পত্রিকার সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হামিম কবির...
করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স করে একটি বিরল স্ট্রেইন আবিষ্কার করেছে আপনার নেতৃত্বে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির গবেষক দল। এ স্ট্রেইনটির সঙ্গে অন্য কোনো স্ট্রেইনের কি কোনো মিল পাওয়া গেছে?
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জিনোম রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এনজিআরআই) নিজস্ব গবেষণাগারে সার্সকভ-২ (সিওভি-২, এটি করোনাভাইরাস হিসেবে বহুল পরিচিত)-এর জিনোম সিকোয়েন্স করে দেশের প্রথম এবং একমাত্র বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিরল কৃতিত্ব অর্জন করে।
নর্থ সাউথের স্কুল অব হেলথ অ্যান্ড লাইফ সায়েন্সের ডিন হিসেবে আমার নেতৃত্বে এনজিআইআরআইর পরিচালক ড. মুহাম্মদ মাকসুদ হোসেন ইলিউমিনা মাই সেক প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ৫৮টি করোনাভাইরাসের নমুনার সিকোয়েন্সিং করা হয়েছে। সার্সকভ-২ ভাইরাসটি ২৯টি প্রোটিন নিয়ে গঠিত। এর মধ্যে চারটি প্রোটিন নিয়ে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে সবচেয়ে বেশি গবেষণা করা হয়েছে। কারণ এই চারটি প্রোটিন দিয়ে ওষুধ তৈরি করতে পারলে কোভিড-১৯ সংক্রমিত রোগীদের সুস্থ করে তোলা সম্ভব।
এর মধ্যে স্পাইক প্রোটিন (করোনাভাইরাসের কাটাগুলো) নিয়ে সবচেয়ে বেশি গবেষণা করা হয়েছে। এই প্রোটিনগুলো ভাইরাল মেমব্রেন থেকে বেরিয়ে আসে এবং মানবদেহে অবস্থিত রিসেপ্টর এসিই-২-এর সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে কোষগুলোতে প্রবেশ করে। স্পাইক প্রোটিনগুলোর মিউটেশনযুক্ত ভাইরাস মানুষের কোষগুলোকে সংক্রমিত করার ক্ষমতার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। এনজিআরআই এই চারটি স্ট্রাকচারাল প্রোটিনে এমন কিছু বিরল মিউটেশন খুঁজে পেয়েছে, যা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্পাইক প্রোটিনে একটি মিউটেশন প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে আমরা খুঁজে পেয়েছি। স্পাইক প্রোটিনের ২০৪তম অবস্থানে অ্যামিনো এসিডের নাম টাইরোসিন। আমরা দেখেছি, এই টাইরোসিনটি পরিবর্তন হয়ে ফিনাইল অ্যালানিন হয়েছে। যে জিনোমে এই রূপান্তরটি সংঘটিত হয়েছে, তা বিওয়ানথ্রিসিক্স লিনিয়েজের (বংশানুক্রম) অন্তর্ভুক্ত। এটি একটি বড় ক্লাস্টার। এই মিউটেশনটি সার্সকভ-২ স্পাইক প্রোটিনের কাঠামো এবং কার্যক্রমের পাশাপাশি ভাইরাস সংক্রমণের ক্ষমতার ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। ফলে এটি নিয়ে নতুন করে গবেষণার সুযোগও সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বে এ পর্যন্ত দেড় থেকে দুই লাখ জিনোম সিকোয়েন্স হয়েছে, বাংলাদেশে হয়েছে সাতশ’র বেশি বার। এই জিনোম সিকোয়েন্স থেকে জানা গেছে যে, বাংলাদেশে দেড় হাজারেরও বেশি মিউটেশন হয়েছে। অ্যামিনো এসিডে যে মিউটেশন হয়েছে এটি আমরাই প্রথম আবিষ্কার করতে পেরেছি। আমরা যে মিউটেশনটা পেয়েছি, এটি কতটা শক্তিশালী তা এখনো জানি না। মানুষের দেহে প্রবেশের ক্ষেত্রে এর ক্ষমতা কমও হতে পারে আবার বেশিও হতে পারে। নতুন স্ট্রেইনটির কারণে মানুষের মৃত্যু দ্রুতও হতে পারে, ধীরেও হতে পারে। আবার মৃত্যু কম-বেশিও হতে পারে। এটি নির্ভর করবে ভাইরাসটির ক্ষমতার ওপর। এ নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করতে পারলে আরও অনেক অজানা তথ্য বেরিয়ে আসতে পারে।
করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন আবিষ্কারে প্রাণীর ওপর গবেষণার পদ্ধতিটি কেমন?
প্রথমে গবেষণাগারে ভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হয় এমন কিছু ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে হয়। এই ভ্যাকসিন মেশিনের মাধ্যমে পরীক্ষার পর প্রথমে ইঁদুরের ওপর প্রয়োগ করে দেখা হয় অ্যান্টিবডি সৃষ্টি হয়েছে কি-না। যে কোনো ভাইরাসের বিরুদ্ধে একটি ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে হলে অনেক ধাপ অতিক্রম করতে হয়। কারণ মানুষ ও প্রাণীর মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। একটি কার্যকর ভ্যাকসিন মানুষের মধ্যে প্রয়োগের আগে এর সেফটি, এফিক্যাসি নিশ্চিত করতে হবে। ইঁদুরে পরীক্ষা সফল হলে খরগোসে যেতে হবে। খরগোসের ওপর পরীক্ষা সফল হলে চাইনিজ হ্যামস্ট্রিংয়ের ওপর পরীক্ষা চালাতে হবে। এখানে সফল হলে বানরের ওপর পরীক্ষা করতে হবে। বানরের ওপর পরীক্ষা সফল হলেই কেবল এর পরের ধাপে মানুষের ওপর পরীক্ষার অনুমতি পাওয়া যাবে। অ্যান্টিবডি কার্যকর হয়েছে কি-না দেখাতে হবে এই স্টাডিতে। এ পর্যন্ত যত ভ্যাকসিন এসেছে, তাদের সবাইকে এই চ্যালেঞ্জ স্টাডিতে উত্তীর্ণ হতে হয়েছে। এরপর আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত কোনো একটি সাময়িকীতে তাদের গবেষণার ফল প্রকাশ করতে হবে। সাময়িকীতে যারা কাজ করেন, মানে যারা সাময়িকী সম্পাদনার দায়িত্বে আছেন, তাদের মধ্যে অনেক প্রশ্নের উদয় হবে। তাদের জিজ্ঞাসার যথাযথ জবাব দিতে হবে। সবগুলোর সঠিক জবাব দিতে না পারলে ধরে নেওয়া হবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়নি যথাযথভাবে।
ভাইরাস নিজের মধ্যে মিউটেশন করে কেন? এ প্রসঙ্গে অন্যান্য কী তথ্য রয়েছে?
কমিউনিটিতে বা পরিবেশে আরও ভালোভাবে টিকে থাকার জন্য ভাইরাস নিজের মধ্যে এই পরিবর্তন এনে থাকে। এর লিনিয়েজটিকে অত্যন্ত ক্ষতিকর একটি ভাইরাস হিসেবে আমরা চিহ্নিত করতে পেরেছি। ভারত এবং সৌদি আরবে কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে যাদের মৃত্যু হয়েছিল, তাদের শরীর থেকে যে নমুনা সংগ্রহ করা হয় সেগুলোর সিকোয়েন্স করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে জিআইএসএআইডিতে যে সিকোয়েন্সগুলোর ফল সংরক্ষিত রয়েছে, সেখানে বাংলাদেশে পাওয়া ভাইরাসগুলোর লিনিয়েজ পাওয়া গেছে। গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা ড্যাটা (জিআইএসএআইডি) হলো ইনফ্লুয়েঞ্জা ধরনের সব তথ্যের একটি আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম। এখানে অন্যান্য জিনোম সিকোয়েন্সের তথ্যও দেওয়া হয়। যারা এখানে তথ্য জমা দেন, তারা অন্যদের তথ্যও এখান থেকে নিয়ে গবেষণা করতে পারেন। প্ল্যাটফর্মে সংরক্ষিত সিকোয়েন্স অনুসারে ভারতে মৃত্যু হওয়া ৫২ রোগীর নমুনা থেকে প্রাপ্ত ভাইরাসের ১০টি এই লিনিয়েজের অন্তর্গত। সৌদি আরবের ১২১টি জিনোমের প্রায় অর্ধেকের সঙ্গেই এই লিনিয়েজের মিল পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও ব্রিটেনের ৪৫ শতাংশ, ডেনমার্কের ৯ শতাংশ এবং কানাডার একটি নির্দিষ্টসংখ্যক নমুনায় এই লিনিয়েজ পাওয়া গেছে। আমরা নর্থ সাউথে ১০০টি ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স শেষ করব। এ পর্যন্ত আমরা ৫৮টি শেষ করেছি। সামনে হয়তো আরও মিউটেশন পেতে পারি। এই ভাইরাসটি ক্রমাগত নিজেকে রূপান্তর করছে। এতে শক্তিশালী হচ্ছে আবার দুর্বলও হয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে তো সংক্রমণ তুলনামূলক কম দেখা যাচ্ছে। এখানে যে রূপান্তর বা মিউটেশনটি পাওয়া গেছে, তা কিরকম সংক্রমণ ঘটাতে পারে?
বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত পরিষ্কার করে এর প্রকৃতি বলতে পারছেন না। আরও গবেষণার মাধ্যমে এর ব্যাখ্যা পাওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশ ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোতে করোনাভাইরাস সংক্রমণ অনেকটা কম। বাংলাদেশের মানুষের জেনেটিক্যাল যে ধারা, তাতে মনে হতে পারে এখানকার মানুষের মধ্যে শক্তিশালী ইমিউনিটি (রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা) রয়েছে। এ জন্য প্রচুর গবেষণা করতে হবে বিষয়টি পরিষ্কার করে বলার জন্য। অনেক বেশি জিনোম সিকোয়েন্স করতে পারলে হয়তো বলতে পারব, ঠিক কোন মিউটেশনটির জন্য অথবা কোন কারণে এখানে সংক্রমণ কম। বাংলাদেশে যে দেড় হাজার মিউটেশন হয়েছে এর কোনোটিই এখানে হুবহু মিলে যায়নি। প্রথম দিকে যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্রেইনটির সঙ্গে ৯৯ শতাংশ মিল পাওয়া গিয়েছিল। ভাইরাসের ন্যাচারাল ট্রেন্ড এবং কিছু হোস্টের ওপর নির্ভর করে মিউটেশন হয়ে থাকে। আবার মিউটেশনের জন্য পরিবেশগত ফ্যাক্টরও একটা বড় ভূমিকা রাখে। গবেষণা অব্যাহত রাখলে, এসব বিষয়ে আমরা ডিটেইলস জানতে পারব। যে কোনো ভাইরাস অথবা এখনকার করোনাভাইরাসের কথাই যদি ধরি তাহলে বলতে পারি, এই জিনোম সিকোয়েন্স ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর ভ্যাকসিন আবিষ্কারে কাজে লাগবে। ভ্যাকসিন তৈরির জন্য সিনোম সিকোয়েন্সের তথ্যগুলো থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আবার নতুন ওষুধ তৈরিতেও এর ফলাফল কাজে লাগতে পারে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর একটি নতুন ওষুধ নিয়ে কাজ হচ্ছে। এই ওষুধ আক্রান্ত রোগীর ওপর প্রয়োগ করা হলে রোগী হয়তো একটু ভুগতে পারেন। ওষুধ প্রয়োগের পর সঙ্গে সঙ্গে রোগী সুস্থ হয়ে যাবেন না হয়তো; কিন্তু তাকে আইসিইউতে ট্রান্সফার করার প্রয়োজন হবে না।
বাংলাদেশে গ্লোব বায়োটেক করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কারের চেষ্টা করছে। এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে তাদের ভ্যাকসিন আবিষ্কার সম্বন্ধে কী জানা যাচ্ছে?
গ্লোব বায়োটেক এ পর্যন্ত যা করেছে তাতে আমার কাছে মনে হয়েছে তারা এনিমেল স্টাডির সবটুকু কমপ্লিট করতে পারেনি অথবা করেনি। তবে ভ্যাকসিন তৈরির জন্য তারা একটি ইনিশিয়েটিভ নিয়েছে। এ জন্য তারা প্রশংসার দাবিদার, প্রশংসা তারা পেতেই পারেন। আমি বলতে চাই, ভালো কিছু করতে হলে গবেষণা চালিয়ে যেতে হবে। মানুষের জীবন অত্যন্ত মূল্যবান। এটি মেনে নিয়ে নৈতিকতার সঙ্গে সব ধাপ অতিক্রম করে যেতে হবে।
ভ্যাকসিন তৈরি করতে হলে ভাইরাস নিয়ে কাজ করার সামর্থ্য থাকতে হবে। বাংলাদেশে কি ভাইরাস নিয়ে কাজ করার সামর্থ্য আছে?
বাংলাদেশে জীবিত ভাইরাস নিয়ে কাজ হয় না। জীবিত ভাইরাস নিয়ে কাজ করতে হলে বায়ো সেফটি লেভেল-থ্রি ধরনের গবেষণাগার প্রয়োজন। বাংলাদেশে এ মাপের কোনো গবেষণাগার নেই। ভ্যাকসিন তৈরি অথবা জীবাণুর বিরুদ্ধে ওষুধ তৈরির জন্য এ ধরনের গবেষণাগার প্রয়োজন। তা না হলে এখানে ভাইরাস নিয়ে উন্নত গবেষণা হবে না। ভ্যাকসিন বা ওষুধ তৈরি করাও সম্ভব হবে না নিজেদের উদ্যোগে।
আমরা কি এখানে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরি করতে পারি না?
ভবিষ্যতে করোনাভাইরাসের চেয়েও অনেক দুর্বোধ্য ও জটিল জীবাণু চলে আসতে পারে। এসব বিষয় মাথায় রেখে বড় পরিসরে বাংলাদেশে একটি ভ্যাকসিন তৈরির অবকাঠামো স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। সঙ্গে ভ্যাকসিন গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোও স্থাপন করতে হবে। একটি দেশীয় কোম্পানি ভ্যাকসিন তৈরিতে এগিয়ে এলেও এখানে ভ্যাকসিন তৈরির সমন্বিত সুযোগ-সুবিধা না থাকার কারণে এখনো এটি যৌক্তিক গতিতে এগোতে পারছে না। তা ছাড়া ওই কোম্পানিটির এ ধরনের কাজ করার মতো সক্ষমতা ও অভিজ্ঞতা কোনোটিই নেই। এ ছাড়া গত এক বছরে দেশের শীর্ষ ওষুধ কোম্পানিগুলোর কোনোটিই কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন তৈরির কোনো আগ্রহই প্রকাশ করেনি। সরকারি পর্যায়েও তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অথচ অ্যাস্ট্রাজেনেকা নতুন প্ল্যান্ট স্থাপন করে ভ্যাকসিন উৎপাদন করছে। চীনের সিনোভ্যাক তাদের উৎপাদন ক্ষমতা আরও কয়েক গুণ বৃদ্ধি করেছে। ভারতে ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সিরাম ইনস্টিটিউট থাকা সত্ত্বেও আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এ কাজে এগিয়ে এসেছে। এটি বলা যাবে না যে, করোনাভাইরাসই শেষ মহামারি। আরও অনেক অজানা রোগ ভবিষ্যতে আসতে পারে। এসব কিছু মাথায় রেখে বড় পরিসরে ভ্যাকসিন তৈরির অবকাঠামো স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া দরকার। সঙ্গে সঙ্গে ভ্যাকসিন গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো স্থাপন করা উচিত।
সরকার চেষ্টা করলে কি বাংলাদেশে কোভিড-১৯ বা অন্য কোনো ভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে পারে?
সমস্যা থেকেই উত্তরণের পথ খুঁজে পাওয়া সম্ভব। এখন কোভিড-১৯ নিয়ে জাতি সমস্যায় আছে। আমি মনে করি, এখান থেকেই চেষ্টা করলে একটা কিছু করা সম্ভব। প্রাইভেট-পাবলিক (সরকারি-বেসরকারি) সমন্বয়ে বাংলাদেশে ভ্যাকসিন তৈরির একটি মহৎ উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারতো। যথেষ্ট অবকাঠামো থাকলে অন্তত অন্য দেশ থেকে প্রযুক্তি নিয়ে এসে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন উৎপাদনে আমরা অংশ নিতে পারতাম। এটি করতে পারলে দেশীয় প্রয়োজন মিটিয়ে অন্য দেশে রফতানির সুযোগও সৃষ্টি হতো। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মডার্না ও জার্মানির বায়োএনটেক কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন উৎপাদনের মধ্য দিয়েই তাদের সক্ষমতা এবং ব্যবসাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প ইতিমধ্যে বিশ্ববাসীর আস্থা অর্জন করেছে। দেশের প্রথম সারির কোম্পানিগুলো একটু ঝুঁকি নিয়ে হলেও ভ্যাকসিন তৈরির চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করে ওষুধ শিল্পে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ বাংলাদেশে অথবা পৃথিবীর অন্যান্য দেশে মহামারির এখানেই শেষ হচ্ছে না। বাংলাদেশে হাতে গোনা দু’একটি কোম্পানি সীমিত আকারে কিছু ভ্যাকসিন উৎপাদন করতে পারলেও ভ্যাকসিন তৈরির পূর্ণ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নেই বাংলাদেশে। সরকারি উদ্যোগে এটি করা যেতে পারে, অথবা বেসরকারি উদ্যোক্তাদের এ ব্যাপারে উৎসাহিত করতে হবে।
ওষুধ শিল্পে আমরা প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি; কিন্তু এত অর্জনের পরও আমরা কেন ভ্যাকসিন আবিষ্কারের দিকে মনোযোগী হতে পারছি না?
বাংলাদেশে যেসব ওষুধ তৈরি হচ্ছে, এর কোনোটাই গবেষণা প্রোডাক্ট নয়। বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো জেনেরিক ওষুধ তৈরি করে। আমরা জানি, অন্তত ওষুধ শিল্পে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত (এলডিসি) দেশগুলোর লিডার। এলডিসিভুক্ত আর কোনো দেশ এত বেশি পরিমাণ ওষুধ তৈরি করে না। বাংলাদেশের মানুষের প্রয়োজনের ৯৮ শতাংশ ওষুধ বাংলাদেশ তৈরি করে; কিন্তু তারপরও আমরা এখনো প্রয়োজনের সব এপিআই (ওষুধ তৈরির কাঁচামাল) তৈরি করতে পারি না। চীন অথবা ভারত থেকে এপিআইর বিশাল অংশ আনে আমাদের ওষুধ কোম্পানিগুলো। আবার কিছু অংশ আসে ইউরোপ থেকে। আমরা বিশ্বের দেড়শ’টি দেশে ওষুধ রফতানি করে থাকি; কিন্তু আমাদের এই বাজার নষ্ট করার জন্য কিছু কোম্পানির নিম্নমানের ওষুধ তৈরি করছে। এ ব্যাপারটিতে নজরদারি দরকার।
এ ছাড়া আমাদের ওষুধ শিল্পকে প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে রাখতে হলে এবং আরো বেশি ওষুধ বিদেশে রফতানি করতে হলে, আমাদের নিজেদেরই এপিআই তৈরিতে যেতে হবে। ওষুধ তৈরিতে প্রোটিন ও পেপটাইটস ব্যবহার করছি। এসব তৈরির প্রক্রিয়া একটু আলাদা ধরনের। আমাদের ওষুধ কোম্পানিগুলোকে ধীরে ধীরে এদিকেই যেতে হবে। এ জন্য সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। গবেষণা করার জন্য সরকারের উচিত সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রণোদনা দেওয়া। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা থেকে আমরা ওষুধ আবিষ্কারে মনোযোগ দিতে পারব।
দেশকাল পত্রিকাকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আপনাদেরও ধন্যবাদ।