ব্যাংকে উপচে পড়ছে টাকা, ঋণ নেয়ার লোক নেই

বিশেষ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২১, ০৮:৪৮ এএম | আপডেট: ১২ জুলাই ২০২১, ০৮:৫২ এএম

এখন ব্যাংকগুলোতে রীতিমতো তারল্যের জোয়ার বইছে। ফাইল ছবি

এখন ব্যাংকগুলোতে রীতিমতো তারল্যের জোয়ার বইছে। ফাইল ছবি

করোনাভাইরাস মহামারির আগে তীব্র তারল্য সংকটে ভুগছিল বেশিরভাগ ব্যাংক। নগদ জমা সংরক্ষণের হার (সিআরআর) ও সহজে বিনিময়যোগ্য সম্পদ (এসএলআর) সংরক্ষণেই হিমশিম খাচ্ছিল বেসরকারি ব্যাংকগুলো। তারল্যের সংস্থান করতে বেশি সুদে অন্য ব্যাংকের আমানত বাগিয়ে নেয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তারা।

তবে মহামারির প্রাদুর্ভাবে পরিস্থিতি বদলে গেছে। এখন ব্যাংকগুলোতে রীতিমতো তারল্যের জোয়ার বইছে।  

বিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। গত বছরের ১ জুলাই থেকে এ বছরের ২৮ জুন পর্যন্ত প্রবাসীরা মোট ২ হাজার ৪৫৮ কোটি ৯০ লাখ মার্কিন ডলার পাঠিয়েছেন। এর আগের ২০১৯-২০ অর্থবছরের একই সময়ে তারা পাঠিয়েছিলেন ১ হাজার ৮০৩ কোটি ১০ লাখ ডলার। 

এতে দেখা যায়, এক বছরে প্রবাসী আয় ৩৬ শতাংশ বেড়েছে। তাদের পাঠানো ডলার ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে কিনে নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর বিপরীতে নগদ টাকা দিচ্ছে। আমানতের সুদহার কম হলেও সব টাকাই বিভিন্ন ব্যাংকে জমা হচ্ছে।  অথচ সরকারি প্রণোদনার বাইরে ব্যাংকগুলোর তেমন ঋণ বিতরণ হচ্ছে না। কারণ ব্যবসায়ীরা নতুন বিনিয়োগে যাচ্ছেন না। তারা অনুকূল সময়ের অপেক্ষায় আছেন। আর তাই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে বাড়ছে অলস টাকার পাহাড়। 

জানা গেছে, গত এপ্রিল শেষে ব্যাংকগুলোতে ২ লাখ ১ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকার অতিরিক্ত তারল্য ছিল। সেই টাকার একটি বড় অংশ তারা সরকারি বন্ড এবং অন্য ব্যাংকের পারপেচুয়াল বন্ডে বিনিয়োগ করেছে। এরপরও তাদের কাছে ৪০-৪৫ হাজার কোটি টাকার তারল্য অলস পড়ে রয়েছে। গত বছরের জুনে ব্যাংক খাতে তারল্যের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩৯ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা। এদিকে চাহিদার বেশি সঞ্চয়পত্র বিক্রি হওয়ায় সরকারও এখন বন্ডের মাধ্যমে বেশি টাকা তুলছে না। 

ব্যাংকগুলো এখন জমতে থাকা টাকা সরকারের বিভিন্ন বন্ড ও অন্যান্য ব্যাংকের বন্ডে বিনিয়োগ করে আমানতের খরচ সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে। তবে সেখানেও চাহিদামতো বিনিয়োগ করতে পারছে না। অতিরিক্ত তারল্যের চাপ সামলাতে ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার সর্বনিম্নে নামিয়ে এনেছে।

এক বছর আগেও যেখানে কোনো কোনো ব্যাংক ৮ শতাংশের বেশি সুদে তিন-ছয় মাস মেয়াদি আমানত সংগ্রহ করেছে, এখন তা ৩-৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। তারপরও অতিরিক্ত তারল্যের রক্ষণাবেক্ষণে ব্যাংকারদের হিমশিম খেতে হচ্ছে বলে একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী জানিয়েছেন। তারা বলেন, ব্যাংক আমানতের গড় সুদহার ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। পরিস্থিতি যা তাতে বিনিয়োগ বা ঋণ প্রবৃদ্ধি বাড়াতে না পারলে অচিরেই ব্যাংক আমানতের সুদহার ১-২ শতাংশে নেমে আসবে।

ব্যাংকাররা বলছেন, করোনার কারণেই ব্যাংক খাতে উপচে পড়া তারল্য পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। অর্থনীতির গতি যে শ্লথ হয়ে পড়েছে, এটা তারই ইঙ্গিত। দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। 

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বলেন, ব্যাংকে অলস টাকার পাহাড় সৃষ্টি হবে- এটাই স্বাভাবিক। কারণ, যে ঋণ দিয়েছি তা ফেরত আসছে না। তাই ব্যাংকাররা ভীষণ চিন্তিত ও সতর্ক। দেশে বিনিয়োগ নেই। আমদানিও অপর্যাপ্ত। নতুন কোনো শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে না। তাই ভালো গ্রাহক ঋণ নিতে চাইছেন না। উল্টো দাগী ঋণখেলাপিরা নতুন করে ঋণ চাইছেন। না দিলে ‘দেখে নেয়ার’ হুমকিও দিচ্ছেন কেউ কেউ। সে কারণে আমরা বড় বেকায়দায় আছি।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আমরা বিনিয়োগ করতে চাই; কিন্তু বিনিয়োগ যে করব, সেই চাহিদা তো থাকতে হবে। করোনার কারণেই সব কিছু ধীর হয়ে গেছে। নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না।’ 

বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের মতে, করোনা সংক্রমণ শুরু হলে অর্থনীতিতে চাহিদা বাড়াতে বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় বাজারে টাকার সরবরাহ বাড়ানো হয়। আবার করোনার মধ্যে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স এসেছে অনেক বেশি। ব্যাংকের আমানত সংগ্রহেও ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। কিন্তু প্রণোদনা ঋণের বাইরে দীর্ঘদিন নতুন ঋণের চাহিদা নেই। সব মিলিয়ে ব্যাংকের হাতে উদ্ধৃত তারল্য ও অলস টাকা বেড়েছে। নতুন করে আবার করোনা ভয়াবহ রূপ ধারণ করায় অলস টাকার পরিমাণ আরও বাড়বে বলে উল্লেখ করেন তারা।  

ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনা বাড়ায় নতুন ঋণ নেয়ার মতো পরিস্থিতি আরও পিছিয়ে গেল। দীর্ঘদিন বিনিয়োগ না হওয়ায় পুঞ্জীভূত এই অর্থ ব্যাংকগুলোকে ভোগান্তিতে ফেলেছে। যারা নিয়মিতভাবে প্রচুর কেনাকাটা ও ঘোরাঘুরি করতেন, তারা খরচের হাত গুটিয়ে রেখেছেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার বিষযটিও করোনা মহামারির ওপর নির্ভর করছে। 

আর আর্থিক খাতের বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনা পরিস্থিতিতে অনেক খাতের পণ্য ও সেবার চাহিদা কমে গেছে। নতুন বিনিয়োগ দূরে থাক, বিদ্যমান উৎপাদনের সক্ষমতারও পুরোপুরি ব্যবহার হচ্ছে না। এটা অর্থনীতির জন্য মোটেও ভালো লক্ষণ না। কারণ অর্থনীতিতে স্বাভাবিক গতি বজায় থাকলে এই অর্থ বিনিয়োগ হতো। এ অবস্থায় বেসরকারি খাতে ব্যাংকের বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি সিএসএমই খাতের ঋণের জন্য কাঠামোগত সংস্কার দরকার বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh