মুহাম্মাদ শাখাওয়াত হুসাইন ওয়াদুদ
প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২১, ০২:৫৯ পিএম
প্রতীকী ছবি
পঞ্চাশের দশকে আবির্ভূত আল মাহমুদ বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান পুরুষ। আমাদের আধুনিক কবিতার অন্যান্য প্রধান কবিরা যখন বোদলেয়রীয় নাগরিকতার নৈরাশ্যবাদীতায় যন্ত্রণাদগ্ধ ছিলেন, তখন আল মাহমুদ পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন তাঁর দেশজতা এবং ঐতিহ্যলগ্নতার আকুতি দিয়ে; কিন্তু এই দেশজতা পরিণতিপ্রাপ্তির আগেই তিনি ‘মানবিক নির্মাণের প্রতি’ আস্থা হারিয়ে ফেলে এক ‘মায়াবী পর্দায়’ আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। আর তখন আল মাহমুদের প্রবেশলগ্নের দেশজতা, ঐতিহ্য ও সাম্যবাদের আকুতি হয়ে পড়ে ম্লানতর।
প্রথম কাব্যগ্রন্থ লোক লোকান্তর (১৯৬৩), দ্বিতীয় কালের কলস (১৯৬৬) এবং তৃতীয় সোনালি কাবিন (১৯৭৩) পর্যন্ত আল মাহমুদের কবিতার একচ্ছত্র অনুষঙ্গ হিসেবে ছিল এই দেশজতা। ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত মায়াবী পর্দা দুলে উঠতে তাঁর কাব্যভাবনা বাঁক নেয় খানিকটা ভিন্ন দিকে।
আল মাহমুদের প্রবেশলগ্নের কবিতাগুলো দেশজ উপাদানে সিক্ত হলেও জসীমউদ্দীনের মতো লোকায়ত জীবনের রূপকার তিনি নন। ত্রিশ কাব্যতত্ত্বের নিরিখে আল মাহমুদও আধুনিক কবি। ত্রিশ ধারার আধুনিক কবিতায় লোকজ উপকরণের ব্যবহার সূচিত হয়েছিল ১৯৪০-এর দশকের প্রথম দিকে, আহসান হাবীবের মাধ্যমে। আল মাহমুদ একে দান করেছেন ব্যাপকতা এবং এই বিষয়টিই তার নিজস্বতা অর্জনের অন্যতম প্রধান উপকরণ।
তিরিশি আন্দোলন থেকে উদ্ভূত নাগরিক চেতনা সমৃদ্ধ আধুনিকতার জোয়ারে যখন ভাসছে বাংলাদেশের শিল্পাঙ্গন, তখনো জসীমউদ্দীনের কবিতায় লালিত হচ্ছিল আবহমান লোক ঐতিহ্যের ক্ষীণ ধারাটি। যেটি ছিল এই অগ্রসরমান দরিদ্র এবং শহরমুখী মানুষের জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত; কিন্তু আঙ্গিক এবং জীবন দর্শনে এবং ভাষাগত ভিন্নতার কারণে জসীমউদ্দীন চিহ্নিত হলেন পল্লিকবি হিসেবে।
পঞ্চাশের মাঝামাঝি আধুনিকতার মিছিলে শরিক হন আল মাহমুদ এবং আধুনিক কবিতায় লোকজ উপাদান ব্যাপকভাবে যুক্ত করে হয়ে ওঠেন বহুল আলোচিত; কিন্তু তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ সোনালি কাবিনের পর থেকে তাঁর কবিতায় এই বৈশিষ্ট্যগুলো ম্লান হয়ে পড়ে। প্রথম কাব্যগ্রন্থ লোক লোকান্তরে অরণ্যে ক্লান্তির দিন, তিতাস, নৌকায় ইত্যাদি কবিতায় গ্রামীণ ঐতিহ্যলগ্নতার যে আভাস ঝলকে উঠেছিল দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ কালের কলস এবং তৃতীয় সোনালি কাবিনে এসে তা চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। আল মাহমুদকে শনাক্ত করতে তাঁর লোক ঐতিহ্যলগ্নতা বিশেষভাবে বিবেচ্য, কেননা তাঁর কবি পরিচয়ের সঙ্গেই যুক্ত হয়ে আছে এই বিষয়টি। কালের কলস ও সোনালি কাবিনের বহু কবিতায় বিষয়বস্তু গ্রাম্য জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আক্ষেপ। কালের কলসের জল দেখে ভয় লাগে, ফেরার পিপাসা, প্রত্যাবর্তন ইত্যাদি কবিতায় এই আক্ষেপের শুরু-
আমরা যেখানে যাবো শুনেছি সেখানে নাকি নেই
বাঁচার মতন জল, বর্ষণ হবে না।
জল দেখে ভয় লাগে, কালের কলস
আবার,
বত্রিশ সায়েদাবাদ ঢাকা- এই বিষণ্ণ দালানে
তেমন জানালা কই যাতে বাঁকা নদী দেখা যায়?
ফেরার পিপাসা, কালের কলস
সোনালি কাবিনের প্রকৃতি, দায়ভাগ, প্রত্যাবর্তনের লজ্জা, স্বপ্নের সানুদেশে, পালক ভাঙার প্রতিবাদে, খড়ের গম্বুজ ইত্যাদি কবিতায় এই আক্ষেপের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে নতুন মাত্রা- গ্রামীণ ঐতিহ্যলগ্ন থাকার আকুতি ও সগর্ব স্বীকারোক্তি-
কতদূর এগোলো মানুষ!
কিন্তু আমি ঘোর লাগা বর্ষণের মাঝে আজও উবু হয়ে আছি। ক্ষীরের মতন গাঢ় মাটির নরমে
কোমল ধানের চারা রুয়ে দিতে গিয়ে
ভাবলাম, এ মৃত্তিকা প্রিয়তমা কিষানি আমার।
প্রকৃতি, সোনালি কাবিন
প্রত্যাবর্তনের লজ্জা কবিতায়-
কুয়াশার শাদা পর্দা দোলাতে দোলাতে আবার আমি ঘরে ফিরবো
আর আমি মাকে জড়িয়ে ধরে আমার প্রত্যাবর্তনের লজ্জাকে
ঘষে ঘষে
তুলে ফেলবো
সোনালি কাবিন
আবার,
চিৎকার, কান্না ও হতাশার গোলকধাঁধা ছেড়ে
আমরা বেরিয়ে যাবো।
স্বপ্নের দেশ, সোনালি কাবিন
আল মাহমুদের তখনকার কাব্যভাবনা স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে খড়ের গম্বুজ কবিতায়। এ কবিতায় দেখি- গ্রামের একদল মানুষ, কবির ভাষায় ‘শস্যের শিল্পীরা’ ক্ষেতের আলের ওপর বসে তামাক সাজাচ্ছে। স্বনির্মিত হতাশার দেয়ালঘেরা এক নাগরিক অপসংস্কৃতির প্রতিনিধিত্বকারী শহর প্রত্যাগত বালকের উদ্দেশ্যে একগাদা খড় বিছিয়ে দিতে তারা আহ্বান করে তাদের সঙ্গে বসে যেতে; কিন্তু সে বালকের পরনে ‘নগরের নিভাঁজ পোশাক খামচে ধরেছে হাঁটু’, এমনভাবে যে সে দেশের মাটির বুকে অনায়াসে বসতেই পারছে না। অথচ এই বালকের মৌলিক পরিচয় তার ‘বাপের মারফতি টান শুনে বাতাস বেহুঁশ হয়ে যেতো’।
আল মাহমুদ এই বালকের উদ্দেশে বলেছেন-
তোমাকে বসতে হবে এখানেই
আদরে এগিয়ে দেওয়া হুকোটাতে সুখটান মেরে
তাদের জানাতে হবে কুহেলি পাখির পিছু পিছু
কতদূর গিয়েছিলে পার হয়ে পানের বরজ।
কিন্তু হয়তো আল মাহমুদ নিজেই বসলেন না সেখানে। কুহেলি পাখির পিছে ধাওয়া করতে করতে এক অলিক মায়াবী জগতে প্রবেশ করার প্রয়াস পেলেন পরবর্তী কীর্তিকালে।
সোনালি কাবিনে অভিন্ন শিরোনামের চৌদ্দটি সনেটের বিষয়বস্তু অভিন্ন নয়। কবিতাগুলোতে এক নারীকে উদ্দেশ্য করে উচ্চারিত কবির নিজস্ব প্রেমানুভূতির প্রাধান্য থাকলেও বহু বিচিত্র বিষয়ের অবতারণা রয়েছে। আবহমান বাঙালি সংস্কৃতির নানা অনুষঙ্গ, মিথ, সাহিত্য প্রভৃতি এবং আবহমান বাঙালি সমাজের নানা বিসঙ্গতি থেকে ‘ফসলের সুষম বণ্টন’ অর্থাৎ সাম্যবাদের মতো নানা রাজনৈতিক ভাবনা পর্যন্ত স্থান পেয়েছে সনেটগুলোতে। যদিও ১, ২, ৩, ৫, ৮, ১৩, ১৪ নম্বর কবিতাগুলোতে কেবলই রয়েছে এক নারীর প্রতি কবির ব্যক্তিগত প্রেমানুভূতির প্রকাশ।
রোমান্টিক যুগের কবিদের মতো এই প্রেমানুভূতি নিষ্কলুষ নয়। এখানে প্রেম এসেছে নর-নারীর সংসারজীবনের বাস্তবতার আলোকে, শরীরি প্রেমের এমন খোলামেলা প্রকাশ বাংলা কবিতায় খুব কমই চোখে পড়ে-
বিবসন হও যদি দেখতে পাবে আমাকে সরল
পৌরুষ আবৃত করে জলপাই পাতাও থাকবে না;
তুমি যদি খাও তবে আমাকেও দিও সেই ফল
জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোঁহে হবো চিরচেনা
সোনালি কাবিন-১
আবার,
বাঙালি কৌমের কেলি কল্লোলিত করো কলাবতী
জানে না যা বাৎস্যায়ন আর যতো আর্যের যুবতী
সোনালি কাবিন-২
৪, ৯, ১১ নম্বর সনেটে কবির দয়িতার প্রতি তার প্রেম প্রকাশের ভঙ্গিতেই মিথ ও সাহিত্য ঐতিহ্যের ব্যবহারে কবির দক্ষতা ফুটে ওঠে-
মুকুন্দরামের রক্ত মিশে আছে এ মাটির গায়
ছিন্ন তালপত্র ধরে এসো সেই গ্রন্থ পাঠ করি
কত অশ্রু লেগে আছে এই জীর্ণ তালের পাতায়।
সোনালি কাবিন-৪
কী করে মানবো বলে শ্রীজ্ঞানের জন্মভূমি এ
শীলভদ্র নিয়েছিল নিঃশ্বাসের প্রথম বাতাস
সোনালি কাবিন-১১
কাজী নজরুল ইসলাম এবং সুকান্ত ভট্টাচার্য ব্যতীত যারা বাংলায় সাম্যবাদী কবিতা লিখেছেন তার অধিকাংশ স্লোগান সর্বস্ব; কিন্তু আল মাহমুদের সাম্যবাদ সংক্রান্ত কবিতাগুলো অপেক্ষাকৃত শিল্পিত। এসব কবিতায় নারী ও দেশমাতৃকা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে-
তোমার দুধের বাটি খেয়ে যাবে সোনার মেকুর
না দেখার ভান করে কতকাল দেখবে চঞ্চলা?
সোনালি কাবিন-৯
লালিত সাম্যের ধ্বনি ব্যর্থ হয়ে যায় বারেবার
বর্গিরা লুটেছে ধান, নিম খুনে ভরে জনপদ
তোমার চেয়েও বড় হে শ্যামাঙ্গী শস্যের বিপদ
সোনালি কাবিন-৯
এ ছাড়াও আল মাহমুদের সোনালি কাবিনের বিভিন্ন সনেটে প্রকাশ পেয়েছে আমাদের মধ্যযুগ ও বর্তমানকালের পণ্ডিত সমাজের মেরুদণ্ডহীনতার কথা। নানা সময়ে রাজনৈতিক ও ধারণাগত চাপের মুখে তাদের স্বার্থপরতার চিত্র-
জ্ঞানের প্রকোষ্ঠে দেখো ঝুলে আছে বিষণ্ণ বাদুড়
অতীতে বিশ্বাস রাখা হে সুশীলা কেমন দুরূহ?
সোনালি কাবিন-৬