হজ ও কোরবানির শিক্ষা

মাওলানা লিয়াকত আলী

প্রকাশ: ১৮ জুলাই ২০২১, ০১:৪৭ পিএম

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

সারাবিশ্বে করোনাভাইরাসজনিত মহামারি ও দুর্যোগের মাঝে গত বছরের মতো এবারও মুসলিম উম্মাহ উদযাপন করবে পবিত্র হজ ও ঈদুল আজহা। করোনাভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কায় এ বছরও সৌদি আরব কর্তৃপক্ষ হজযাত্রীর সংখ্যা সীমিত রাখার ব্যবস্থা নিয়েছে। তেমনি আমাদের দেশসহ মুসলিম-অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের সরকার পবিত্র ঈদুল আজহার নামাজ আদায় এবং কোরবানির পশু সংগ্রহ ও কোরবানির সময় স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের নির্দেশনা জারি করেছে। সব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সারাবিশ্বের মুসলমানেরা হজরত ইবরাহিমের (আ.) সুন্নাহ হিসেবে ঈদুল আজহা পালন করবে।

আল্লাহপ্রেমের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনের উপলক্ষ বায়তুল্লাহর হজ। তেমনি আল্লাহর রাহে নিজের সবচেয়ে প্রিয় বস্তু বিলিয়ে দেওয়ার বিধান কোরবানি। উভয় বিধান মুমিন জীবনের অন্যতম প্রধান অধ্যায়। কালেমা, নামাজ, যাকাত ও সিয়ামের মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি বান্দার আনুগত্য ও অনুরাগের যে ক্রমোন্নতি অর্জিত হয়, তার চরম অভিব্যক্তি ঘটে হজের মাধ্যমে। পৃথিবীর প্রত্যন্ত এলাকা থেকে মুমিন বান্দারা সমবেত হয় আরব মরুর প্রাচীনতম নগরী মক্কা মুকাররমায়। বায়তুল্লাহর হজ একদিকে যেমন ইবাদত ও আধ্যাত্মিক সাধনার উচ্চ মাকাম, তেমনি মানব সাম্য ও সৌভ্রাতৃত্বের উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত। ইসলাম নামের আসমানি জীবনাদর্শ ছাড়া এমন কোনো সার্বজনীন দর্শন কি এ পর্যন্ত উদ্ভাবিত হতে পেরেছে, যা বিশ্বের সমগ্র মানবগোষ্ঠীকে সাম্য ও সমানাধিকারের ভিত্তিতে সহাবস্থানের ব্যবস্থাপত্র দেয়?

আরাফাতের ময়দানেই মহানবীর (সা.) পবিত্র জবানে উচ্চারিত হয়েছিল মানবাধিকারের প্রথম ঘোষণা। মানুষের জীবন, সম্পদ ও সম্মান পবিত্র বলে ঘোষণা করা হয়। আধুনিক সভ্যতার উন্নততম অবস্থানে প্রতিষ্ঠানের দাবিদাররা এখন থেকে মাত্র ছয় দশক আগে মানবাধিকার সনদ নামে এক অসম্পূর্ণ দলিলে স্বাক্ষর করতে সক্ষম হয়; কিন্তু ইসলামের নবী মরুভূমির এক খোলা ময়দানে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মানবাধিকার ঘোষণা করে গিয়েছেন আজ থেকে চৌদ্দশ বছর আগে। 

জিলহজ মাসে রয়েছে আরেক ইবাদত। তা হলো কোরবানি। ৯ তারিখে উকুফে আরাফা আর ১০ তারিখে তাওয়াফে জিয়ারত হজের দুটি প্রধান স্তম্ভ বা অপরিহার্য পালনীয় কর্তব্য। ১০ তারিখে হাজিদের জন্য একটি অতি জরুরি কাজ কোরবানি করা। আর যারা হজের উদ্দেশ্যে যায়নি, নিজেদের বাড়ি বা বাসস্থানে অবস্থানকারী সেইসব ব্যক্তির জন্যও হাজিদের মতোই জিলহজের ১০ তারিখে কোরবানি করতে হয়। ঈদুল ফিতরের মতোই দু’রাকাত ঈদুল আজহার নামাজ আদায়ের পর পশু কোরবানির হুকুম পালন করতে হয় সামর্থ্যবান মুসলমানদের।

কোরবানির তাৎপর্য প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, এটি তোমাদের পিতা হজরত ইবরাহীম (আ.) এর সুন্নত। প্রতিদান সম্পর্কে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকি। রাসূলুল্লাহ (সা.) আরও ইরশাদ করেন, কোরবানির দিনে আল্লাহ তাআলার নিকট কোরবানির চেয়ে বেশি প্রিয় কোনো নেক কাজ নেই। কোরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই আল্লাহর নিকট কবুল হয়ে যায়। কেয়ামতের দিন উক্ত পশু তার খুর, পশম সবকিছু নিয়ে উপস্থিত হবে। সুতরাং তোমরা সন্তুষ্টচিত্তে কোরবানি করবে।

বস্তুত হযরত ইবরাহীম (আ.) এর অনুসরণে নিজের প্রিয় বস্তু আল্লাহর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করার আহ্বান নিয়ে আগমন করে ঈদুল আজহা। তিনি যেসব কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন তার একটি ছিল প্রিয়তম সন্তান হজরত ইসমাঈল (আ.) কে আল্লাহর উদ্দেশ্যে কোরবানি করা। তিনি তাতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়েছিলেন এবং আল্লাহর নির্দেশ পালনের সব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন; কিন্তু আল্লাহ পাক চাইছিলেন হযরত ইবরাহীম (আ.) এর আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার পরীক্ষা নিতে। হযরত ইবরাহীম (আ.) তাতে সফল হলেন। বাস্তবিক পুত্র কোরবানি তাঁকে করতে হলো না। আসমান থেকে ঘোষণা করা হলো- আপনি স্বপ্ন বাস্তবায়িত করেছেন।

হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর আদর্শ চিরস্মরণীয় করে রাখার ব্যবস্থা করেছেন আল্লাহ তাআলা উম্মতে মুহাম্মদির জন্য পশু কোরবানির মাধ্যমে; কিন্তু তাতে নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা কামনা করা হয়েছে। কোরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে- ‘এসবের (পশু) গোশত কিংবা রক্ত আল্লাহর নিকট পৌঁছে না। বরং তাঁর নিকট পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।’ অর্থাৎ পশু কোরবানি করা হলেও এমন মনোবৃত্তি থাকতে হবে যে, সবচেয়ে প্রিয় বস্তু এমনকি প্রিয়জনকে আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদন করতে প্রস্তুত থাকব। তাইলেই পশু কোরবানি সার্থক হবে। আমরাও আল্লাহ তায়ালার দরবারে নিজেদের সামান্য কোরবানি পেশ করার সাহস করি। 

এ কথা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, নিছক প্রথা হিসেবে হজরত ইবরাহীমের (আ.) সুন্নত অনুসরণ করা এবং তার স্মরণে শরিক হয়ে প্রতি বছর ঈদুল আজহার সময়ে একটি পশু কোরবানি করা যথেষ্ট নয়। বর্তমানে বস্তুবাদ ও জড়বাদের সামনে বিশ্ব এমন নতশির এবং উপায় উপকরণের আরাধনায় এমন আচ্ছন্ন- যেমনটি ছিল হজরত ইবরাহীম আ. এর সময়ে। কোরবানির প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে এসব স্রোতের প্রতিরোধে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলে এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে ও পর্যায়ে নিজের প্রাপ্য, বক্তব্য, অভিমত ও প্রস্তাবের প্রাধান্য ও অগ্রগতির দাবি পরিহার করলেই হযরত ইবরাহীমের (আ.) প্রকৃত অনুসরণ হয়।

মহানবী (সা.) উম্মতকে শিক্ষা দিয়ে গেছেন নিখুঁত পশু কোরবানি করতে। বাহ্যিকভাবে তা যেমন ত্রুটিমুক্ত হতে হয়, তেমনি অন্তরেও পোষণ করতে হয় একাগ্রতা ও আল্লাহ প্রেমের ব্যাকুলতা। আমরা যেন নিজেদের পার্থিব জীবনের সহায়ক উপকরণাদির প্রতি মোহ ও আকাক্সক্ষা ত্যাগ করে নিজেদের সহায় সম্পদ মহান প্রভুর ইচ্ছা ও আদেশ মোতাবেক প্রত্যর্পণের প্রতিজ্ঞা করতে পারি, হজ ও ঈদুল আজহা সে আহ্বান নিয়ে আগমন করে।

লেখক : ইসলামি চিন্তাবিদ

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh