বাংলা ভাষা আন্দোলন এবং তার পূর্বাপর

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশ: ১৮ জুলাই ২০২১, ০৩:৪৪ পিএম | আপডেট: ১৮ জুলাই ২০২১, ০৩:৪৬ পিএম

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

পূর্বকথা 
বাংলা ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে ভিন্ন একটি যোগাযোগ বা সম্পর্ক খুঁজে পাবার জন্য আজকের এ প্রবন্ধ উপস্থাপন। রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্ক শুধু পাকিস্তানে নয়, অখণ্ড ভারতবর্ষে প্রথম শুরু হয়েছিল। বিশেষ করে রাষ্ট্রভাষা বা জাতীয় ভাষা হিসেবে ‘বাংলা ভাষা’, ‘হিন্দি ভাষা’ এবং ‘উর্দু ভাষা’ নিয়ে বিতর্ক ভারতে বহুদিনের। ১৯১১ সালে রংপুরে অনুষ্ঠিত এক প্রাদেশিক সম্মেলনে সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী ভারতের অন্যতম ভাষা হিসেবে ‘বাংলা ভাষা’র গুরুত্ব তুলে ধরেন এবং জাতীয় পর্যায়ে বাংলাকে স্বীকৃতিদানের কথা বলেন। ব্রিটিশ ভারতে উনিশশো আঠারো সালে মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলা ভাষাকে অবিভক্ত ভারতের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদানের দাবি জানিয়েছিলেন। তিন বছর পর উনিশশো একুশ সালে সৈয়দ নবাব আলী চৌধুরী বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য ব্রিটিশ সরকারের কাছে লিখিত প্রস্তাব পর্যন্ত পাঠিয়েছিলেন। ফলে বাংলা ভাষার মর্যাদা নিয়ে বাঙালিদের মধ্যে আগে থেকেই উৎসাহ এবং উদ্দীপনা ছিল। যখন নওয়াব আলী ব্রিটিশ সরকারের কাছে বাংলা ভাষাকে ‘রাষ্ট্রভাষা’ করার দাবি জানান, তখন জিন্নাহ কংগ্রেস ছেড়ে চলে এসেছেন। জিন্নাহ-পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিশেষ একজন খলনায়ক। ভারত ভাগের ক্ষেত্রেও তাঁকে অনেকেই খলনায়ক বলেছেন। বলা হয় জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্ব দ্বারা ভারত ভাগ হয়েছে। কথাটা সত্য নয়। জিন্নাহ নিজে দ্বিজাতি তত্ত্বের উদ্ভাবক নন। দ্বিজাতি তত্ত্বের উদ্ভাবক হিন্দু মহাসভার নেতারা। স্মরণ রাখতে হবে, সত্যিকার অর্থে জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্ব দ্বারা ভারত ভাগ হয়নি। ভারত ভাগ হয়েছে ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া ‘মন্ত্রী মিশন পরিকল্পনা’ কংগ্রেস না মেনে নেওয়ার কারণে। বাংলা ভাষা আন্দোলনকে গভীরভাবে বুঝতে হলে ভারত ভাগ আর ভারতবর্ষে গান্ধীর ভূমিকাটি বুঝতে হবে। 

ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নে ব্রিটিশ মন্ত্রী মিশন চূড়ান্ত একটি প্রস্তাব রেখেছিল। মন্ত্রী মিশন পরিকল্পনা অনুযায়ী মাদ্রাজ, বোম্বাই, সংযুক্ত প্রদেশ, বিহার, মধ্য প্রদেশ ও উড়িষ্যা নিয়ে গঠিত হবে ভারতের ক বর্গ। ঠিক একইভাবে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পাঞ্জাব, সিন্ধু ও বালুচিস্তান নিয়ে গঠিত হবে খ বর্গ। পাশাপাশি বঙ্গ এবং আসাম নিয়ে গঠিত হবে গ বর্গ। স্বায়ত্তশাসিত এই তিনটি অঞ্চল নিয়ে গঠিত হবে সর্বভারতীয় ইউনিয়ন। সর্বভারতীয় ইউনিয়নের গঠিত কেন্দ্র শুধু বৈদেশিক সম্পর্ক, প্রতিরক্ষা ও আন্তঃপ্রাদেশিক যোগাযোগ ব্যবস্থা দেখার দায়িত্ব পাবে। বাকি সব ক্ষমতা থাকবে তিনটি অঞ্চলের প্রদেশগুলোর ওপরে, সব প্রদেশ হবে স্বায়ত্তশাসিত। জিন্নাহর প্রস্তাবের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মন্ত্রী মিশন এই প্রস্তাব দিয়েছিল। জিন্নাহর সব দাবি সেখানে মানা হয়নি; কিন্তু জিন্নাহ মন্ত্রী মিশনের এই প্রস্তাব সার্বিকভাবে মেনে নিয়েছিলেন। চূড়ান্ত বিচারে এই প্রস্তাব মেনে নিতে রাজি হয়নি কংগ্রেস। প্রদেশগুলোর স্বায়ত্তশাসনের অধিকার তাদের পছন্দ ছিল না। কংগ্রেস চাইছিল, ভারত ইউনিয়নের সকল ক্ষমতা থাকবে কেন্দ্রের হাতে আর কেন্দ্র চাইলে প্রদেশের সংবিধান স্থগিত করে দিতে পারবে। কংগ্রেস মন্ত্রী মিশন পরিকল্পনা মেনে না নিলে ভারত দ্বিখণ্ডিত হয় বা ভারত ভাগ অনিবার্য হয়ে ওঠে। ফলে দ্বিজাতি তত্ত্বের কারণে ভারত ভাগ হয়নি।

যদি ভারত ভাগ না হতো আর মন্ত্রী মিশন পরিকল্পনা মেনে নেওয়া হতো, তাহলে বাংলা ভাগ হতো না। বাংলা আর আসাম মিলে হতো একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ যেখানে বাংলা ভাষাভাষী মানুষ হতেন সংখ্যাগরিষ্ঠ। কংগ্রেস আর কংগ্রেসের গান্ধী এ প্রস্তাব মেনে নিতে রাজি হননি, কারণ তাহলে বঙ্গ-আসাম প্রদেশে মুসলিমরা হতো সংখ্যাগরিষ্ঠ। বাংলা এবং আসামের কংগ্রেস নেতারাসহ অনেক বর্ণহিন্দু নেতা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের প্রদেশ কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। বাংলা ভাগ আর ভারত ভাগ তাই অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। জিন্নাহ নিজে কখনো বাংলা ভাগ চাননি, তিনি সর্বদাই বাংলা আর পাঞ্জাব ভাগের বিরুদ্ধে ছিলেন। দুর্ভাগ্য, বাংলা আর পাঞ্জাবে মুসলমানরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ; এই সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন বর্ণহিন্দুরা মানতে চাননি। ফলে বাংলা আর পাঞ্জাব ভাগ করার মধ্য দিয়েই ভারত ভাগ হয়ে গেল; কিন্তু দায় চাপানো হলো জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্বকে, যা মোটেই সত্যি নয়। বাংলার বর্ণহিন্দুরা সবসময় মনে করতেন এবং বলতেন, বাংলার মুসলমানদের হাতে বাংলা ভাষার সর্বনাশ ঘটবে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরাই বাংলা ভাষার সম্মান রক্ষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন, যা পশ্চিম বাংলার হিন্দুরা পারেননি। হিন্দু-মুসলমান বিষয়টিকে এভাবে আলাদা করে দেখাটা মনে হতে পারে অন্যায় বা সাম্প্রদায়িকতা; কিন্তু বিশেষ বাস্তবতার কারণে এ প্রশ্নটি উত্থাপন করা হচ্ছে। বহুকাল এমন গেছে, যখন বাঙালি মুসলমানকে বাঙালি মনে করা হতো না; কিন্তু তারাও বাংলায় কথা বলতেন। হিন্দু বাঙালিকে বলা হতো ‘বাঙালি’, মুসলমান বাঙালিকে বলা হতো ‘মুসলমান’। বহু নামিদামি সংস্কৃতিবান ব্যক্তি না ভেবেচিন্তে এসব বলেছেন বা লিখে রেখে গেছেন। চল্লিশ সালেও শিক্ষা নিয়ে সংসদের বিতর্কে শেরেবাংলা ফজলুল হককে বলা হয়েছিল, মুসলমানদের হাতে শিক্ষার দায়িত্ব থাকলে বাংলা ভাষা ধ্বংস হয়ে যাবে। কারা কারা এরকম বক্তব্যে স্বাক্ষর করেছেন তাঁদের নাম বলাটা সঙ্গত হবে না। কারণ মহান এক বাঙালিও তাতে স্বাক্ষর করেছিলেন; কিন্তু পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষ সবকিছুর পর প্রমাণ করেছে তারা বাঙালি। পূর্ব বাংলার মানুষ যখন উর্দুভাষার একাধিপত্য মেনে নিতে চায়নি তখন পশ্চিমবঙ্গের মানুষ হিন্দি ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নিয়েছিল। 

জিন্নাহ যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু করতে চেয়েছিলেন, তার সঙ্গে গান্ধীর একটি যোগসূত্র আছে। বিষয়টি খুবই গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হওয়া দরকার, যা এতদিন আলোচিত হয়নি। খুব বিস্ময়ের ব্যাপার জিন্নাহ যে কংগ্রেসের বড় মাপের একজন নেতা ছিলেন সেটি এখন আর অনেকেই জানেন না। জিন্নাহ কংগ্রেসে গান্ধীর চেয়ে প্রায় পনেরো বছরের জ্যেষ্ঠ সদস্য। ১৯২০ সালে গান্ধী সুনির্দিষ্টভাবে কংগ্রেসে যোগদানের সঙ্গে সঙ্গেই জিন্নাহ কংগ্রেস ছাড়লেন। জিন্নাহ ১৯০৫ সালে কংগ্রেসে যোগদান করেন। ১৯১৫ সালে জিন্নাহ ছিলেন কংগ্রেসের জনপ্রিয় নেতা। তিনি ১৯১৬ সালে মুসলিম লীগ আর কংগ্রেসের মধ্যে লক্ষৌ চুক্তির ব্যাপারে ভূমিকা রাখেন। ১৯১৫ সাল পর্যন্ত গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকায় ছিলেন। ১৯১৫ সালে প্রথম মহাযুদ্ধ চলাকালীন গান্ধী ভারতে ফিরে আসার পর কংগ্রেস নেতা গোখলে তাঁকে কংগ্রেসে যোগদান না করতে বলে, বললেন আগে ভারতবর্ষ ঘুরে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে। প্রথম মহাযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে তখন ভারতবর্ষে মুসলমানদের খিলাফত আন্দোলন চলছিল। মুসলমানদের ধর্মীয় এ আন্দোলনকে গান্ধী সমর্থন দেওয়ার কথা ভাবেন, মুসলমানদের মধ্যে নিজের জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে তুলবার জন্য। তিনি ভিন্নদিকে মুসলমান নেতাদের বললেন, হিন্দুরা খিলাফত আন্দোলনকে পূর্ণ সমর্থন দেবে যদি মুসলমানরা ভারতবর্ষে গরু জবাই বন্ধ করে দেয়। খিলাফত আন্দোলনের বৃহত্তর স্বার্থে মুসলমানরা রাজি হলেন যে গরু তাঁরা জবাই করবেন না। গান্ধী এবার কংগ্রেসকে বললেন, খিলাফত আন্দোলনকে সমর্থন জোগাতে। জিন্নাহসহ কংগ্রেসের সকল প্রধান নেতারা এর বিরোধিতা করলেন। জিন্নাহ বললেন, খিলাফতের মতো ধর্মীয় আন্দোলনকে কংগ্রেসের রাজনীতির মধ্যে টেনে আনলে ভবিষ্যতে বিপদ বাড়বে। রাজনীতির ভিতরে ধর্মীয় বিষয়গুলো মাথাচাড়া দেবে। 

গান্ধী সেটি মানলেন না। খিলাফতকে সমর্থন দিলে মুসলমানরা গরু জবাই বন্ধ করে দেবে এই শর্তে হিন্দু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো খিলাফতকে সমর্থন দিতে রাজি হলো। গান্ধী এভাবে ধর্মীয়ভাবে কট্টর হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে নিজের প্রভাব বিস্তার করলেন। গান্ধী-পরবর্তী সময়ে গোরক্ষা কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। হিন্দু-মুসলমান ধর্মীয় সম্প্রদায়কে সঙ্গে নিয়ে গান্ধী কংগ্রেসের ওপর বিরাট চাপ সৃষ্টি করলেন যাতে মুসলমানদের খিলাফত আন্দোলনকে কংগ্রেস সমর্থন দিতে বাধ্য হয়। গান্ধীর চাপের কাছে নতি স্বীকার করলেন জিন্নাহ ছাড়া কংগ্রেসের আর সব বড় নেতারা। জিন্নাহ কিছুতেই কংগ্রেস দলের ভিতরে গান্ধীর অগণতান্ত্রিক ভূমিকা মেনে নিতে রাজি হননি। তিনি কিছুতেই চাননি কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্যে ধর্মীয় নেতারা প্রভাব বিস্তার করুক; কিন্তু গান্ধীর পক্ষের ধর্মান্ধ জনসমর্থনের কাছে জিন্নাহ হেরে গেলেন। ১৯২০ সালের ডিসেম্বর মাসে নাগপুরের কংগ্রেস অধিবেশনে ধর্মান্ধদের চাপের কাছে কংগ্রেস নেতাদের নতি স্বীকার করতে দেখে তিনি কংগ্রেস ছেড়ে চলে এলেন। গান্ধী কংগ্রেসে প্রবেশ করলেন আর জিন্নাহ কংগ্রেস ছাড়লেন ধর্মীয় উগ্রতা মেনে নেবেন না বলে। জিন্নাহ কংগ্রেস ছেড়ে চলে আসার পর কংগ্রেসে গান্ধীর একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলো। সমস্ত গণতান্ত্রিক রীতিনীতি বাদ দিয়ে এরপর থেকে গান্ধীর একার নির্দেশে কংগ্রেস পরিচালিত হতো। গান্ধী কংগ্রেসে নিজের আধিপত্য বিস্তারের পর ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে হিন্দিকে প্রতিষ্ঠা দিতে চাইলেন। কারণ ভারতের শিল্পপতি আর ব্যবসায়ীরা ভারতজুড়ে হিন্দি ভাষাকে প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেছিল। 

হিন্দি নামটি ফার্সি থেকে এসেছে। পারস্যের অধিবাসীরা একদা ভারতীয় লোকদের হিন্দু আর পরে তাদের বিশেষ একটি ভাষাকে হিন্দি বলতো। হিন্দু আসলে কোনো ধর্ম নয়, হিন্দু বলতে বোঝাতো পুরো ভারতের জনগণকে। মূলত ভারতের সিন্ধু নদী বা সিন্ধু উপত্যকা থেকে হিন্দু শব্দটির উৎপত্তি। কারণ গ্রিকরা ‘স’কে ‘হ’ উচ্চারণ করতো। ফলে সিন্ধু হয়ে যায় হিন্দু। সিন্ধু নদীর পারে যেসব ভারতীয়রা বাস করতো, প্রাচীনকাল থেকে তাদের বলা হতো হিন্দু। মুঘল শাসকরা তাই ভারতকে বলতো হিন্দুস্তান। হিন্দুধর্ম বলে আসলে কোনো ধর্ম ছিল না, পরে এই নামকরণ হয়। বর্তমান হিন্দুধর্ম আসলে বৈদিক ধর্ম বা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম যা চার বেদের ওপর প্রতিষ্ঠিত। ভারতের সকল জনগণকে বোঝাতে একদা ‘হিন্দু’ শব্দটি ব্যবহার করা হতো, আর পরে সেটি হয়ে গেল বিশেষ সম্প্রদায়ের ধর্ম। বিশেষ করে ইংরেজ শাসনে হিন্দু জনগোষ্ঠী থেকে হয়ে গেল হিন্দুধর্ম। ভাষা হিসেবে ‘হিন্দি ভাষা’ আরব, তুর্কী আর পারস্যদের দান আর ‘হিন্দি’ শব্দটি পারস্যদের কাছ থেকে পাওয়া। মধ্য এশিয়া থেকে আসা তুর্কি, পাঠান, মুঘল প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে স্থানীয় মানুষদের সংযোগ থেকে জন্ম হয়েছিল উর্দু ভাষার। ফারসির তুলনায় উর্দু তখন নিতান্তই অর্বাচীন। বিবর্তন হতে হতে ঠিক কোন পর্যায়ে ওই সম্পর্ক-ভাষা উর্দু নাম ধারণ করলো, এ বিষয়ে নানা জনের নানা মত। সত্যিকার অর্থে উর্দু শব্দটি তুর্কি শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘শিবির’ বা ‘সেনা ছাউনি’ বা ‘ক্যাম্প’। মুঘল বা তুর্কি শাসনে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের সেনাবাহিনীর লোকরা নিজেদের মধ্যে এই ভাষায় ভাব বিনিময় করতো। পরে সেই ভাষা আরও উন্নত হয়ে রাজ দরবারে ঢুকে পড়ে সাহিত্য বা সংগীত চর্চার ভাষা হিসেবে। 

যদিও মুঘল আমলে সেনাছাউনিতে উর্দু ভাষার বিস্তার ঘটে কিন্তু জহুর-উদ-দিন নামক এক পণ্ডিত মনে করেন, আরবরা যখন সিন্ধুদেশ দখল করে তখন থেকেই উর্দুর যাত্রা। বহুজন মনে করে আরও আগে যখন আরবিয়রা বাণিজ্য করতে ভারতে আসতে আরম্ভ করে তখন থেকেই এই ভাষার জন্ম। সম্ভবত তখন এই ভাষাকে বলা হিন্দবী। বহুজন মনে করেন, মুসলিম শাসনের সময় উত্তর ভারতের খারি-বোলি কথ্য ভাষা থেকে হিন্দির উৎপত্তি ঘটে। বহিরাগত মুসলিম ব্যবসায়ী বা মুসলিম শাসকরা সাধারণত জনগণের সঙ্গে এই ভাষায় কথা বলতেন, যাতে তা স্থানীয়দের কাছে বোধগম্য হয়। কারণ স্থানীয়দের পক্ষে ফারসি বা তুর্কি ভাষা বোঝা সম্ভব ছিল না। এই খাড়ি বোলি ভাষার একটি রূপ ধীরে ধীরে ফারসি এবং আরবি ভাষা থেকে প্রচুর শব্দ ধার করে। ফলে জন্ম নেয় আবার নতুন ভাষা ‘উর্দু’। হিন্দবী বা হিন্দি ভাষার জন্মের আগে আর প্রথম আরবি অক্ষরেই হিন্দি ভাষা লেখা হতো। পরে যখন হিন্দবী বা হিন্দি ভাষা সেনা ছাউনির ভাষা হিসাবে অধিক ব্যবহৃত হতে থাকে তখন তা উর্দু ভাষা নামে পরিচিত হয়। মুসলিম শাসকরা দাক্ষিণাত্য দখলের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ ভারতে উর্দু ভাষার ব্যবহার আরম্ভ হয় নানাভাবে; কিন্তু সেখানে আবার উর্দুর ভিতরে দক্ষিণ ভারতীয় ভাষার শব্দ ঢুকে পড়ে, সেজন্য সেখানকার উর্দু ‘দকনী’ নামেও পরিচিত। সত্যি বলতে আধুনিক উর্দুর সঙ্গে দকনির অনেক তফাত, বরং মিল বেশি হিন্দির সঙ্গে। দকনীকে উচ্চারণ বিভ্রাট আছে, সেজন্য সেটি উপভাষা হিসেবেই রয়ে যায়। দাক্ষিণাত্যের মুসলিম শাসকরা কিন্তু ফারসীর পাশাপাশি উর্দুই বলতেন।

ভারতে উর্দু নামের এই সাহিত্যিক ভাষাটির উদ্ভব নিয়ে নানা কথা থাকলেও, তা শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। মির্জা গালিব তাঁর কবিতাগুলো ফারসি বা উর্দু ভাষায় লিখতেন। তিনি উর্দু ভাষায় লেখা কবিতার জন্যই বিখ্যাত হয়েছিলেন। ভারতের শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ নিজেও ফার্সির সঙ্গে সঙ্গে উর্দু ভাষায় অনেক কবিতা লেখেন। দিল্লির সঙ্গে সঙ্গে উর্দু ভাষা সবচেয়ে বেশি সাফল্য আর জনপ্রিয়তা লাভ করে লখনৌয়ে। ভারতের সাধারণ মানুষের ভাষায় কিন্তু আরবি বা ফারসি ভাষার তেমন প্রভাব পড়েনি। বরং তারা স্থানীয় ভাষাতেই কথা বলতেন। হিন্দি ভাষার সাহিত্য রচনায় সংস্কৃত ভাষার প্রভাব রয়েছে, সেখানে উর্দু ভাষার বিশেষত্ব এই যে, সংস্কৃত সাহিত্যচর্চার বলয়ের সম্পূর্ণ বাইরে থেকে উর্দু সম্পূর্ণ নতুন ভঙ্গিতে সাহিত্যচর্চা আরম্ভ করে এবং খুব সহজেই তা সর্বমহলে জনপ্রিয়তা লাভ করে। হিন্দি এবং উর্দুর একটি সাধারণ কথ্য রূপ আছে, যার নাম হিন্দুস্তানি ভাষা; কিন্তু হিন্দুস্তানি ভাষা সাহিত্যিক ভাষার মর্যাদা পায়নি। যদিও গান্ধী ইংরেজবিরোধী আন্দোলনে একতা প্রদর্শনের জন্য হিন্দুস্তানি ভাষায় কথা বলতেন; কিন্তু হিন্দুস্তানিকে তা সত্ত্বেও জনপ্রিয়তা করা যায়নি। সত্যিকার অর্থে হিন্দি ও উর্দু ‘খাড়ি-বোলি’ বা ‘খাড়িবুলি’ ভাষার দুটি রূপ। খাড়িবুলি ভাষার ফার্র্সি প্রভাবিত রূপ উর্দু বলে পরিচিত। দিল্লি সালতানাত এবং মুঘল সাম্রাজ্যের সমকালে উপমহাদেশে উর্দু ভাষা গড়ে ওঠে। উর্দু লেখা হয় ফার্সি হরফে। হিন্দি প্রথমে আরবি অক্ষরে লেখা হলে অনেক পরে লেখা হয় দেবনাগরী হরফে। ব্রিটিশ শাসনের শেষদিকে ভারতে দেবনাগরী অক্ষরে লেখা হিন্দিকে প্রাধান্য দেওয়ার জন্য হিন্দু মহাসভার নেতারা বা ধার্মিক হিন্দুরা প্রথম আন্দোলন শুরু করেন। মদন মোহন মালব্য ছিলেন তাঁদের অগ্রণী। মুসলমানদের অনেকে পাল্টা হিসেবে উর্দুকে টিকিয়ে রাখবার জন্য তখন অগ্রসর হন।

সর্বত্রগামী লড়াই
যখন ভারতের জন্য ১৯২৮ সালে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক সর্বজনগ্রাহ্য একটি সংবিধান রচনার প্রস্তাব এলো, গান্ধী সে দায়িত্ব প্রদান করলেন মতিলাল নেহরুকে। জিন্নাহ তখন মুসলিম লীগের সভাপতি হিসেবে কংগ্রেসকে বলেছিলেন, সংবিধান যেন এমনভাবে রচিত হয় যাতে মূল ক্ষমতা থাকবে প্রদেশগুলোর হাতে; কেন্দ্রের হাতে নয়। জিন্নাহর রাজনীতির প্রধান একটি লক্ষ্য ছিল প্রদেশগুলোর স্বায়ত্তশাসন; কিন্তু জিন্নাহর সে পরামর্শ মানা হলো না। কংগ্রেস সকল ক্ষমতা রাখল কেন্দ্রের হাতে, প্রদেশগুলোকে কেন্দ্রের পুতুল হিসেবে রাখা হয়েছিল। প্রদেশগুলোর হাতে বলতে গেলে তেমন ক্ষমতাই থাকল না। জিন্নাহসহ অন্যান্য দলগুলো সে সংবিধান মেনে নিতে রাজি হননি। সেকারণেই কংগ্রেস দলের মতিলাল নেহরুর দেওয়া প্রস্তাব ভারতের সংবিধান হতে পারলো না, বর্তমানে তা নেহরু প্রতিবেদন নামেই পরিচিত। ১৯২৯ সালে রচিত মতিলাল নেহরুর প্রতিবেদনে হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলা হয়েছিল। গান্ধীসহ এরপর কংগ্রেস নেতারা অনেকেই হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে কাজ করতে থাকেন। ফলে তখন থেকেই হিন্দি আর উর্দুর মধ্যে এক ধরনের বিরোধ তৈরি হয়। গান্ধী বা কংগ্রেসই হিন্দি ভাষা সকলের ওপর চাপিয়ে দিতে গিয়ে এ বিরোধ উস্কে দিয়েছিলেন। হিন্দি তখন লেখা হতো দেবনাগরী লিপিতে আর উর্দু আরবি অক্ষরে। বর্ণহিন্দু ব্যবসায়ীদের দাবি ছিল দেবনাগরী হরফে লেখা হিন্দিকেই ভারতের একমাত্র ভাষা হিসেবে চালু করা হোক। বিড়লার মতো ধনীকদের টাকায় চলতো কংগ্রেস দল এবং গান্ধীর আশ্রমগুলো। সেজন্য কংগ্রেস বা গান্ধী বিড়লার মতো শিল্পপতিদের ইচ্ছার বাইরে যেতে পারেননি। গান্ধী যখন গুলোবিদ্ধ হয়ে মারা যান তখন তিনি বিড়লার অতিথিশালায় ছিলেন। তিনি নিয়মিত দিল্লিতে বিড়লাদের অতিথিশালায় থাকতেন। গান্ধী এবং কংগ্রেস হিন্দি ভাষাকে ভারতের সকল প্রদেশে চাপিয়ে দেওয়ার জন্য কী ধরনের ভূমিকা নিয়েছিলেন, তা কিছুটা আলোচিত হতে পারে।

ভারতে উনিশশো সাঁইত্রিশ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস যখন সাতটি প্রদেশে জয়লাভ করে, ক্ষমতায় বসেই তখন তারা হিন্দিকে জোর করে কংগ্রেস শাসিত প্রদেশগুলোতে চাপিয়ে দিতে চায়। কারণ কংগ্রেসকে যারা টাকা দিতো সেই ব্যবসায়ীরা হিন্দি ভাষার প্রসারের জন্য নানারকমভাবে চাপ সৃষ্টি করে। খুব সচেতনভাবেই কিছু কিছু ব্যবসায়ী এবং কংগ্রেসের নেতা উর্দুভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র আরম্ভ করেন। ভারতে তখন হিন্দুত্ব বা সনাতন ধর্মের পুনরুত্থানবাদী আন্দোলনের জয়জয়কার, রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন গান্ধী। পুনরুত্থানবাদী বর্ণহিন্দুদের কাছে আরবি হরফে লেখা উর্দু আর গ্রহণযোগ্য ছিল না। হিন্দু, জৈন, পার্সি ধর্মাবলম্বী ব্যবসায়ীরা হিন্দি ভাষাকে সর্বস্তরে চালু করার জন্য পৃষ্ঠপোষকতা করতেন বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়ে। ফলে ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস বিজয় লাভ করার পর বিভিন্ন ভাষাভাষী প্রদেশে হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়। জিন্নাহসহ স্থানীয় অনেক নেতা এর প্রতিবাদ করেন। যখন কংগ্রেস হিন্দির পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে জোর করে তাদের শাসিত প্রদেশগুলোতে চাপিয়ে দেয় তখন কিছু মানুষ উর্দুর পক্ষেও প্রচারণা চালায়। বাংলার অনেকে তখন হিন্দি বা উর্দু বাদ দিয়ে বাংলার পক্ষে প্রচার চালায়। সেই সূত্রে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় উনিশশো সাঁইত্রিশ সালের তেইশে এপ্রিল ‘ভারতের রাষ্ট্রভাষা’ শীর্ষক এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানানো হয়। এই রচনার মধ্য দিয়ে হিন্দি ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো হয়েছিল। মাদ্রাজ প্রদেশের বিভিন্ন বিদ্যালয়ে হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দিতে গেলে ১৯৩৭ সালেই এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়। প্রতিবাদ করতে গিয়ে দুজন মানুষ মারা যায়, হাজারের উপরে মানুষকে বন্দী করা হয়। রাজা গোপালাচারীর সরকার তখন মাদ্রাজের শাসন ক্ষমতায় ছিলেন। 

সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৩৮ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি হরিপুরায় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে সভাপতির দীর্ঘ ভাষণে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে বলেন, জাতীয় একতা যাতে বৃদ্ধি পায় সেই উদ্দেশ্যে আমাদের সর্বজনগ্রাহ্য একটি ভাষা ও একটি লিপি গড়ে তুলতে হবে। তিনি বলেন জাতীয় প্রসঙ্গে আমার মনে হয়, হিন্দি ও উর্দুর মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে তা নেহাতই কৃত্রিম। আমাদের পক্ষে সব থেকে স্বাভাবিক ভাষা হবে এই দুই ভাষার মিশ্রণ। বাস্তবিক পক্ষে দেশের ব্যাপক অঞ্চলে দৈনন্দিন জীবনযাত্রা সেই ভাষায় চলে এবং সাধারণ ব্যবহারের জন্য ভাষানাগরী বা উর্দু যে কোনো লিপিতে তা লেখা যেতে পারে। আমি জানি ভারতবর্ষে এমন অনেকে আছেন যারা এই লিপি দুটির একটিকে বাদ দিয়ে অপরটি গ্রহণের পক্ষে উগ্র মত প্রকাশ করবেন। আমাদের নীতি কিন্তু বর্জনের নীতি হবে না। দুই লিপির যে কোনো একটি লিপি ব্যবহার করতে আমরা পুরোপুরি সায় দেবো। একইসঙ্গে আমার এ কথা মনে হচ্ছে, এই সম্পর্কে শেষ সমাধান এবং শ্রেষ্ঠ সমাধান হলো এমন এক প্রকার লিপি গ্রহণ করা, যা আমাদের বাকি দুনিয়ার সঙ্গে একই সূত্রে গ্রথিত করবে। হতে পারে আমাদের কোনো কোনো দেশবাসী আতঙ্কে শিউরে উঠবেন যখন তাঁরা আমার মুখ থেকে ‘রোমান লিপি’ গ্রহণের কথা শুনবেন; কিন্তু তাঁদের আমি অত্যন্ত বিনীতভাবে আবেদন জানাবো, তাঁরা যেন সমস্যাটিকে বৈজ্ঞানিক এবং ঐতিহাসিক দিক থেকে বিচার করে দেখেন। 

তিনি আরও বলেন, যদি আমরা তা করি, তখনই বুঝতে পারবো যে, কোনো লিপিকেই পরম পবিত্র বলে আগলে রাখার মতো কিছু নেই। যে নাগরী লিপিকে আমরা দেখছি তা বিবর্তনের বেশ কয়েকটি পর্যায়ে অতিক্রম করে আজ এই জায়গায় পৌঁছেছে। তা ছাড়া ভারতবর্ষের প্রধান প্রদেশগুলোর অধিকাংশেরই নিজস্ব লিপি আছে। উর্দু লিপি ব্যবহার করে থাকেন ভারতবর্ষের উর্দুভাষী জনসাধারণ এবং পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশের হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোক। এত রকম বিভিন্নতা আছে বলেই সারা ভারতবর্ষের জন্য একই রকম লিপি স্থির করতে হলে তা করা উচিত পুরোপুরি বৈজ্ঞানিক ও নিরপেক্ষ মনোভাব নিয়ে, যাতে কোনোরকম পক্ষপাত না থাকে। আমি স্বীকার করছি, এক সময়ে আমি ভাবতাম বিদেশি লিপি গ্রহণ করা হবে জাতীয়তা বিরোধী; কিন্তু উনিশশো চৌত্রিশ সালে তুরস্কে যাবার পরে আমার মত বদলে যায়। তখনই আমি বুঝতে পারলাম বাকি দুনিয়া যে লিপি নিয়েছে তা গ্রহণ করলে কী দারুণ সুবিধা। আমাদের দেশের জনসাধারণের দিক থেকে ভেবে দেখলে যেহেতু দেশের শতকরা নব্বই ভাগের বেশি নিরক্ষর এবং কোনো লিপির সঙ্গেই তাঁদের পরিচয় নেই, সে ক্ষেত্রে যে লিপিই গ্রহণ করা হোক তাতে তাদের কিছু যায় আসে না। এ ছাড়া রোমান লিপি জানা থাকলে ইউরোপীয় ভাষা শেখা তাদের পক্ষে সহজ হবে। আমাদের দেশে রোমান লিপি এখনই চালাতে গেলে জনমত যে কী পরিমাণ বিক্ষুব্ধ হবে সে বিষয়ে আমি যথেষ্ট সচেতন। তা সত্ত্বেও দেশবাসীর কাছে নিবেদন, তাঁরা যেন বিচার করে দেখেন শেষ পর্যন্ত কোন সমাধান সব দিক থেকে বিজ্ঞানসম্মত হবে। 

ইংরেজি শিক্ষিত দেশপ্রেমিক সুভাষচন্দ্র আসলে তথাকথিত ইংরেজ ছিলেন। বক্তৃতা দিতেন ইংরেজিতে, লিখতেন ইংরেজিতেই; কিন্তু কথাটা সত্য যে, তিনি কাউকে আহত না করার জন্য নিরপেক্ষ মনোভাব নিয়ে ভারতের জন্য নতুনভাবে লিখিত ভাষা চালু করার ক্ষেত্রে রোমান লিপি ব্যবহার করার কথা বলেছিলেন। সে-সময়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে গান্ধী ছাড়া আর প্রায় সবাই ইংরেজিতে বক্তৃতা দিতেন। গান্ধী সাধারণত যা কিছু লিখতেন, লিখতেন ইংরেজিতে। গান্ধী যদিও ভীষণ রকম ইংরেজি শিক্ষা এবং ইংরেজি ভাষাবিদ্বেষী ছিলেন, কিন্তু সারাজীবন ইংরেজিতে লিখে গেছেন। গান্ধী অবশ্য বহু ব্যাপারেই স্ববিরোধী ছিলেন। তিনি ছিলেন ইংরেজ শাসনের ভক্ত। ইংরেজদের শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচনা করলেও, নিজে ব্যারিস্টার হয়েছিলেন। তিনি অবশ্য ব্যারিস্টারি পড়তে যান, তাঁর নানান মতবাদ তৈরি হবার আগেই; কিন্তু নিজের ছেলেদের ইংরেজদের প্রবর্তিত শিক্ষা দিতে চাননি, সে কারণে তাঁর বড় ছেলে হরিলাল বাবার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। হরিলাল পরবর্তীতে লেখাপড়া শিখতে না পারার কারণে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হন। বাবার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে তিনি কিছুদিনের জন্য ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। গান্ধী হরিলালকে বলতেন, ইংরেজদের এইসব শিক্ষা তোমাকে মানুষ বানাবে না, মানুষ হবার চেষ্টা করো। তিনি হরিলাল বা তাঁর অন্য ছেলেদের বলতেন, মানুষের সেবা করা সবচেয়ে বড় শিক্ষা। গান্ধী তাঁর সন্তানদের বলতেন, গান্ধী আশ্রমে তাঁর দেওয়া সত্যাগ্রহ মতবাদই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ শিক্ষা।

হরিলাল যখন কিশোর বয়সে বাবার সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকায় সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যোগ দেন এবং কারাগারে যান, গান্ধী হরিলালকে বলেছিলেন, সবচেয়ে বড় শিক্ষাটা তুমি এখান থেকেই পাবে। পিতার বক্তব্যে হরিলাল, কস্তুরবা বা অন্য ছেলেরা একমত হননি। গান্ধী-পরবর্তী জীবনে ইংরেজি শিক্ষিত আমলাদের সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করে বলেছেন, এরা জনবিচ্ছিন্ন। ভারতের কোনোই উপকার সাধন এদের দ্বারা হবে না; কিন্তু ইংরেজি জানা ভারতীয় ভদ্রলোকরা যাতে তাঁর চিন্তার সঙ্গে পরিচিত হতে পারে, আর ইংরেজ শাসকদের কাছে যাতে তাঁর বাণী পৌঁছে যায় সেজন্য তিনি ইংরেজিতে লিখতেন। গান্ধী সন্তানদের ইংরেজদের প্রবর্তিত শিক্ষার বিরুদ্ধে বললেও, সবসময় ইংরেজদের সুসভ্য জাতি বলে জ্ঞান করেছেন। মনে করেছেন, ইংরেজদের সাম্রাজ্য টিকে থাকা উচিত। তিনি নিজে যে রাজভক্ত সে কথা প্রমাণ করার জন্য, দক্ষিণ আফ্রিকায় ‘বুয়ার যুদ্ধ’ এবং ‘জুলু বিদ্রোহে’ ইংরেজ শাসকদের পক্ষ নেন। দক্ষিণ আফ্রিকার স্থানীয়দের ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে তিনি রীতিমতো ইংরেজ সেনাবাহিনীর সঙ্গে কাজ করেন। অহিংস গান্ধী তখন ইংরেজদের পক্ষে রক্তাক্ত লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করাটা ন্যায়সঙ্গত মনে করেছেন। অহিংসার পূজারি গান্ধী এমনকি প্রথম মহাযুদ্ধে ভারত থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে ইংরেজদের পক্ষে যুদ্ধ করতে পাঠিয়েছেন; কিন্তু শিক্ষার বাহন হিসেবে ইংরেজি নয়, গান্ধী সর্বদা বলেছেন মাতৃভাষার কথা। গান্ধী মাতৃভাষা বলতে মূলত দেবনাগরী অক্ষরের হিন্দি ভাষাকেই বুঝতেন। তিনি চূড়ান্ত বিচারে সে ভাষাকেই ভারতের সকলের জন্য শিক্ষার বাহন করে তুলতে চেয়েছিলেন। 

হিন্দিকে ভারতের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছিল অনেকদিন ধরেই। গান্ধী এই সম্পর্কে বলেছেন- হিন্দি, হিন্দুস্তানি এবং উর্দু এই কথাগুলো হচ্ছে একটিমাত্র ভাষারই বিভিন্ন নাম, যা উত্তরের হিন্দু বা মুসলমানরা ব্যবহার করে থাকেন এবং একে দেবনাগরী বা পার্শিয়ান যে কোনো লিপিতেই লেখা যায়। উর্দু কথাটি প্রচলিত হবার আগে হিন্দু-মুসলমান উভয়ের ব্যবহৃত এই ভাষার নাম ছিল হিন্দি। এই একই ভাষাকে পরে হিন্দুস্তানি নামে অভিহিত করা হয়। গান্ধীর উপরের বক্তব্য সম্পূর্ণ সঠিক নয়। গান্ধী এরপরে লিখেছেন, উত্তরের এক বিরাট জনগোষ্ঠী যে ভাষা বুঝতে পারে, হিন্দু ও মুসলমানদের সেই ভাষায় কথা বলতে শেখা উচিত। বিরাট ভারতের নানা ভাষাভাষী মানুষের ওপর গান্ধী কেন শুধু উত্তর ভারতের ভাষা চাপিয়ে দিতে চাইছেন? বাংলার হিন্দু মুসলমানকে কেন উত্তরের হিন্দি ভাষা বলতে হবে? গান্ধী আরও লিখছেন, নির্বিচারে বহু হিন্দু ও মুসলমান যথাক্রমে সংস্কৃত এবং পার্শিয়ান বা আরবি শব্দ ব্যবহার করতে চাইবেন। যতদিন পর্যন্ত পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং পৃথক থাকার ভাব থাকবে ততদিন এসব আমাদের বরদাস্ত করতে হবে। যখন অভিন্ন হৃদয় হয়ে প্রাদেশিকতা বর্জন করে ভারতকে নিজদেশ মনে করে গর্ব অনুভব করবো, প্রদেশের কাজের জন্য তখন প্রাদেশিক ভাষা বজায় রেখেও আমরা একই লিপি সম্বলিত একটি মাত্র রাষ্ট্রভাষা ব্যবহার করবো। কোনো প্রদেশ, জেলা বা কোনো একদল লোকের ওপর কোনো এক বিশেষ ধরনের হিন্দি ভাষা বা লিপি জোর করে চাপিয়ে দেওয়া দেশের স্বার্থের পরিপন্থী হবে।

গান্ধী এরপর লিখছেন, সাধারণ ভাষার ব্যাপারটিকে ধর্মের পার্থক্য থেকে আলাদা করে দেখতে হবে। তিনি সুভাষচন্দ্রের বক্তব্যের বিরোধিতা করে বলেন, রোমান লিপি ভারতের সাধারণ লিপি হতে পারে না বা হওয়া উচিত নয়। প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুধু পার্শিয়ান এবং দেবনাগরী লিপির মধ্যে হতে পারে। দেবনাগরীর নিজস্ব স্বাভাবিক যোগ্যতার কথা ছেড়ে দিলেও সারা ভারতের জন্য এইটিকেই সাধারণ লিপির মর্যাদা দেওয়া উচিত। কারণ বেশিরভাগ প্রাদেশিক লিপিই সৃষ্টি হয়েছে দেবনাগরী থেকে। সঙ্গে সঙ্গে মুসলমান বা অন্য যারা জানে না, তাদের মধ্যে জোর করে এই লিপি চালানোর কোনো রকম প্রচেষ্টাই হওয়া উচিত নয়। বর্তমান অবস্থায় মুসলমানরা যে দেবনাগরীর ওপর জোর দেবে একথা মনে আনা যায় না। দেবনাগরী বা পার্শিয়ান যে কোনো লিপিতেই লিখিত হোক না কেন, উত্তরের হিন্দু এবং মুসলমানরা সাধারণত যে ভাষা ব্যবহার করে থাকেন, তাকেই আমি হিন্দি বা হিন্দুস্তানির সংজ্ঞা হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তাব করছি। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হলেও আমি সেই সংজ্ঞাই মেনে চলি। নিঃসন্দেহেই দেবনাগরী আন্দোলনের সঙ্গে আমি সর্বান্তঃকরণে জড়িত। সংস্কৃত থেকে উদ্ভুত বা এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত ভাষাগুলোর জন্য একটি সাধারণ লিপি থাকা উচিত, আর দেবনাগরীই হওয়া উচিত সে লিপি। কোনো এক প্রদেশবাসীর অন্য প্রদেশের ভাষা শেখার পক্ষে বিভিন্ন লিপিগুলো এক অহেতুক বাধাস্বরূপ। ভারত এক-জাতিত্বের দাবি করা সত্ত্বেও এবং বস্তুত এক জাতি হওয়া সত্ত্বেও ভারতে কেন একটি মাত্র লিপি প্রবর্তিত হবে না? তাই দেবনাগরী বা উর্দু লিপির যে কোনো একটিকে বেছে নেবার অধিকার দেওয়া হয়েছে। মনে রাখতে হবে যে দেশের জনসাধারণের অধিকাংশই নিরক্ষর। শুধু বাজে ভাবপ্রবণতার জন্য বা চিন্তাশক্তির দুর্বলতার জন্য তাদের ওপর নানারকম লিপি চাপিয়ে দিলে সে হবে আত্মঘাতী নীতি। দেবনাগরীই একমাত্র লিপি বা ভারতে সর্বজনগ্রাহ্য হওয়া সম্ভব। স্বেচ্ছায় মুসলমানরা শুধু বৈজ্ঞানিক কারণে বা জাতীয় প্রয়োজনের খাতিরে দেবনাগরীর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার না করা পর্যন্ত উর্দু বা পার্শিয়ান যুগপৎ এর সঙ্গে চলতে থাকবে। 

গান্ধী তাঁর বক্তব্যের শেষে আসলে হিন্দি আর দেবনাগরী লিপির পক্ষেই কথা বলছেন। তবে মুসলমানরা যদি মেনে না নেয়, তবে আপাতত পাশাপাশি উর্দু চলতে পারে; কিন্তু তাঁর মতে চূড়ান্তভাবে হিন্দিই হচ্ছে ভারতের গ্রহণযোগ্য ভাষা। তিনি ভারতের সকল মানুষের মধ্যে একতার বন্ধন সৃষ্টি করতে ভারতের সব ভাষাকে বর্জন করে শুধুমাত্র দেবনাগরী লিপিতে হিন্দি ভাষা চালু করার পক্ষে শক্ত মত ব্যক্ত করেন। ভারতবর্ষে গান্ধীর কল্পিত রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠাকল্পে সব মানুষকে একটি জাতিতে পরিণত করার জন্য সেটিই হবে একমাত্র ভাষা। গান্ধী নিজে কিন্তু একজন গুজরাটি। ব্রিটিশ শাসনে গান্ধী যখন এসব কথা বলছেন তখন কংগ্রেস ভারতের এগারোটি প্রদেশের আটটিতে নিজেদের সরকার গঠন করে বসে আছে। আর সেইসব জায়গায় একরকম জোর করে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার ফলে, বিভিন্ন প্রদেশ থেকে বিরোধিতা আসে। বিরোধিতা করেন জিন্নাহ নিজেও। জিন্নাহর উনিশশো আটত্রিশ-ঊনচল্লিশ সালের বক্তৃতায় এবং বিভিন্ন ভাষ্যে তা পাওয়া যাবে। কংগ্রেসের চাপিয়ে দেওয়া হিন্দি ভাষা এবং বন্দে মাতরম গান দুটিরই তীব্র নিন্দা করেন জিন্নাহ। তবে সাঁইত্রিশ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের বহু আগে থেকেই হিন্দু মহাসভা আর কংগ্রেস দলে হিন্দির পক্ষে প্রচার চলছিল। সে প্রচার এতটাই ব্যাপক ছিল যে, জিন্নাহ সে কারণেই উনিশশো সাঁইত্রিশ সালের নির্বাচনী ঘোষণায় তাদের চৌদ্দটি দফার এক দফায় বলেছিলেন, মুসলিম লীগ ক্ষমতায় এলে উর্দু ভাষার বিকাশে সহযোগিতা করবে। জিন্নাহ এ কথা বলেছিলেন এ কারণেই যে, তিনি জানতেন ব্যবসায়ীরা হিন্দি ভাষাকে ভারতের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে আর একই কারণে তারা উর্দু ভাষাকে গুরুত্বহীন করে তুলছে। 

সন্দেহ নেই, উর্দু ছিল তখন শিল্প সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যথেষ্ট এগিয়ে থাকা ভাষা। দিল্লি এবং লক্ষৌয়ে উর্দু ভাষার তখন যথেষ্ট সমাদর। সারা ভারতের কথা যদি বিবেচনা করা যায়, তাহলে হিন্দির চেয়ে তখন উর্দু এবং বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা অনেক বেশি হচ্ছিল। তার আগের ভারতীয় সাহিত্যে অবদান রেখেছে প্রাচীন যুগে সংস্কৃত আর পালি ভাষা, মধ্যযুগে ফার্সি ভাষা। কারণ পালি ছাড়া বাকি দুটই ছিল তখন সরকারি ভাষা। মধ্যযুগের শেষেও এবং আধুনিক যুগেও ভারতের সাহিত্য-সংগীত-কবিতা রচনায় উর্দুভাষা যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে চলেছিল। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ততটা নয়, যতোটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে। মুসলমানরাই যে শুধু উর্দু ভাষায় লিখতেন তা নয়, প্রচুর হিন্দু বংশদ্ভুতরাও লিখতেন। কৃষণ চন্দর, মুন্সিপ্রেম চাঁদের মতো লেখকরা ছিলেন, যাদের শক্তিশালী রচনা এখানকার অনেক পাঠকরাই পড়েছেন। উর্দু শুধু মুসলমানদের ভাষাও ছিল না; কিন্তু রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্ক যখন চলছিল ভারতবর্ষে তখন সাহিত্য আর সংগীতের অঙ্গনে বাংলা ভাষা অনেক এগিয়ে ছিল। ভারত ভাগ বা ভারতের স্বাধীনতার পর ভারতবর্ষ হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করে, জিন্নাহ বেছে নেন উর্দুকে। দুটির মধ্যে কি যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়? নিশ্চয় একটি যোগসূত্র ছিল। হিন্দি ভাষার দৌরাত্ম্যে মনে করা হয়েছিল উর্দু ভাষা হারিয়ে যাবে। ফলে হিন্দি ভাষার বিপরীতে উর্দুকে টিকিয়ে রাখার প্রশ্নটা অনেকের মাথায় থেকে গিয়েছিল।

ভারতের স্বাধীনতার পরের ইতিহাসে দেখা যায়, স্বাধীন ভারত পুনরায় সকল প্রদেশে হিন্দিভাষা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে এবং হিন্দিভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দেয়। ভারতের স্বাধীনতার পর তামিলনাড়ুতে আবার আন্দোলন হয়েছিল হিন্দির বিরুদ্ধে। স্বাধীনতার পরপরই আন্দোলন হয়েছিল অন্ধ্র প্রদেশে। হিন্দি ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিটা ছিল বহুদিন ধরেই ভারতের বড় বড় ব্যবসায়ীদের, তাদের সে উদ্যোগ সফল হলো। উনিশশো আটচল্লিশ সালেই ভাষাভিত্তিক প্রদেশ কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হলো, যতদিন পর্যন্ত না ভারত একটি জাতিতে পরিণত হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত ভাষাভিত্তিক প্রদেশগুলোর সংকীর্ণ ঝোঁকগুলোকে অবদমিত রাখতে হবে। বহুজন হিন্দির আধিপত্য মেনে নিতে চায়নি। নিজেদের জাতিসত্ত্বা হারিয়ে ভারতীয় হয়ে যেতে চায়নি। উনিশশো বায়ান্ন সালের বিশে অক্টোবর তেলেগুভাষী গান্ধীবাদী নেতা পট্টি শ্রীরামালু মাদ্রাজের তেলেগুভাষী এগারোটি জেলা নিয়ে পৃথক অন্ধ্রপ্রদেশ গঠনের দাবিতে অনশন শুরু করেন। দুর্ভাগ্যজনক যে, শ্রীরামালুর এই অনশন নেহরুকে বিচলিত করেনি। ছাপ্পান্ন দিন অনশন করার পর উনিশশো বায়ান্ন সালের পনেরো ডিসেম্বর অনশনরত পট্টি শ্রীরামালু মারা যান। শ্রীরামালুর মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে তেলেগুভাষী জেলাগুলোতে দাঙ্গা শুরু হয়। তেলেগু ভাষার পক্ষে বিরাট হিন্দিবিরোধী আন্দোলন আর দাঙ্গার প্রেক্ষিতে উনিশশো বায়ান্ন সালের আঠারোই ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা অন্ধ্রপ্রদেশ নামক পৃথক রাজ্য গঠন করতে বাধ্য হয়। 

হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ এখানেই থেমে থাকে না। পরের ঘটনাটি ঘটে ১৯৬৪ সালে তামিলনাড়ুতে। হিন্দিভাষার আগ্রাসনের প্রশ্নে এবং তামিল ভাষার পক্ষে একজন মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করে নিজের গায়ে পেট্রোল ঢেলে দিয়ে রেলস্টেশনের কাছে আত্মহত্যা করেন। মানুষটির নাম চিন্নাস্বামী, মৃত্যুর আগে সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করেন তিনি নিজের ভাষায় বলেন, ‘তামিল টিকে থাক, হিন্দি নিপাত যাক’। চিন্নাস্বামীর পর আরও কয়েকটি আত্মাহুতি ঘটে তামিলনাড়ুতে। পরবর্তীতে হিন্দি বিরোধী তামিলদের আন্দোলন সেখানে ভয়াবহ রূপ নেয়। তামিল রাজনৈতিক নেতা আন্নদুরাই বলেছিলেন, ‘একটি অঞ্চলের ভাষাকে গোটা দেশের ওপর চাপিয়ে দেওয়া সম্পূর্ণ স্বৈরাচারী আচরণ। এটি একটি অঞ্চলের মানুষের ওপর আধিপত্য সৃষ্টি করবে। এর ফলে হিন্দি ভাষাভাষীরা আমাদের ওপর কর্তৃত্ব করবে।’ পরবর্তীতে আন্দোলন সংহিস রূপ নেয়। সরকারি নির্যতনের প্রতিবাদে আন্দোলনকারীরা দুজন পুলিশকে পুড়িয়ে মারে। চলতে থাকে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে তামিল জনসাধারণের সংঘর্ষ। সংবাদপত্রের খবরে জানা যায় এ সংঘর্ষে নিহত হয় তেশট্টিজন তামিল নাগরিক। স্বাধীনতার পর ভারতের আসাম রাজ্যে বাংলা ভাষার পক্ষে বরাক উপত্যকায় যে আন্দোলন হয় তার প্রেক্ষাপট কিছুটা ভিন্ন ছিল। সরকারি প্রশাসনের হাতে সেখানেও এগারো জন মানুষ প্রাণ দেন। পরবর্তীতে পশ্চিমবঙ্গসহ আরও অনেক প্রদেশেই হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে ক্ষোভ ধ্বনিত হয়, কিন্তু সবক্ষেত্রে হিন্দির বিরুদ্ধে আন্দোলনে সমান সাফল্য পাওয়া যায়নি।

লক্ষ্যহীন লক্ষ্য
যথেষ্ট গঠনমূলক প্রশ্নটা হলো, ভারত যদি ভাগ না হতো কিংবা বাংলা যদি ভাগ না হতো, তাহলে তো বাংলাদেশের মানুষকে উর্দু না হোক হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নিতে হতো। উর্দুর বিরুদ্ধে যেভাবে আন্দালন করা গেছে, ইতিহাস বলে স্বাধীন ভারতে হিন্দির বিরুদ্ধে সে রকম আন্দোলন করা যেতো না। আর ভারতে বাংলা ভাষা কখনোই রাষ্ট্রভাষা হতো না। বাংলা ভাগের ভিতর দিয়ে অন্তত বাংলাকে একটি দেশের রাষ্ট্রভাষা করা গেছে। জিন্নাহ কেন পাকিস্তানের জন্য যা বিশেষ কোনো প্রদেশের ভাষা নয়, সেই উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করতে চেয়েছিলেন তার কিছুটা অনুসন্ধান এখানে মিলবে। স্মরণ রাখতে হবে, সুভাষচন্দ্র বসু যা ভারতের কোনো প্রদেশের লিপি নয় সেই নিরপেক্ষ রোমান লিপিকে সারা ভারতের লিপি হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। জিন্নাহ ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ ছিলেন, সেজন্য এখানে আর একটি কথা বলে রাখা দরকার, পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত হিসেবে এখন যে গানটি গাওয়া হয়, জিন্নাহ কিন্তু এই গানটি বাছাই করেননি। জিন্নাহ উর্দু ভাষার একজন হিন্দু কবি জগন্নাথ আজাদকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন পাকিস্তানের প্রথম জাতীয় সংগীতটি রচনা করার। প্রচুর মুসলমান কবি থাকা সত্ত্বেও তিনি জগন্নাথ আজাদকে এই দায়িত্ব দেন আস্থার সঙ্গে। জিন্নাহ চেয়েছিলেন সংখ্যালঘু নাগরিকদের একজন প্রতিনিধি পাকিস্তানের জাতীয় সংগীতটি রচনা করবেন। জিন্নার মৃত্যুর পর কট্টোর মুসলমানদের চাপে জগন্নাথ আজাদের লেখা সে গানটি বাতিল করা হয়, পাকিস্তানে এখন আর কেউ প্রথম জাতীয় সংগীতটির কথা মুখেও আনেন না। জগন্নাথ আজাদের জন্ম ১৯১৮ সালে, মারা যান দুই হাজার চার সালে। জিন্নাহর মৃত্যুর পর তিনি পাকিস্তানে থাকতে পারেননি, ভারতে চলে আসেন। জগন্নাথ আজাদ ছিলেন কবি ইকবালের ওপর বড় একজন বিশেষজ্ঞ, নিজেও একজন কবি ছিলেন। 

ঘটনা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, জিন্নাহর উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পেছনে রয়েছে ভিন্ন এক ইতিহাস। কংগ্রেস সারা ভারতে হিন্দি চাপিয়ে দিতে চাইলে উর্দু ভাষা ধ্বংস হয়ে যাবার ভয় ছিল। প্রশ্ন জাগে জিন্নাহ কি তার একটি সমাধান করতে চেয়েছিলেন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে চেয়ে? কারণ ১৯৩৭ সালে মুসলিম লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে হিন্দি ভাষার দাপট থেকে উর্দুভাষাকে রক্ষার জন্য বলা হয়েছিল, উর্দু ভাষা বিকাশে মুসলিম লীগ ভূমিকা রাখবে। পাকিস্তান বা দেশভাগের কথা তখন পর্যন্ত সামনে আসেনি। জিন্নাহ ভেবেছিলেন, স্বাধীন ভারতে হিন্দির দাপটে যদি উর্দু ভাষা টিকতে না পারে, সেক্ষেত্রে উর্দু ভাষা যাতে সম্পূর্ণ হারিয়ে না যায় মুসলিম লীগ সে দায়িত্বটি পালন করবে। নিঃসন্দেহে এটি ছিল তখনকার ভারতবর্ষে কংগ্রেসের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে একটি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি নিজে বলতে গেলে উর্দু জানতেন না; কিন্তু ভাষাটি যেন হারিয়ে না যায় সে ব্যাপারে তাঁর মনে সহানুভূতিশীল একটি স্থান তৈরি হয়েছিল। স্বভাবতই তখন উর্দু ছিল কবিতা-শিল্প-সংগীতের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভাষা। জিন্নাহ পরবর্তী সময়ে যে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করতে চেয়েছিলেন সেজন্য তাঁকে দোষারোপ করা যেতে পারে, কিন্তু এর মধ্যে কোনো পক্ষপাতিত্ব ছিল না। জিন্নাহ নিজের মাতৃভাষাকে কিংবা পাকিস্তানের কোনো প্রদেশের ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার কথা ভাবেননি। গুজরাটবাসী গান্ধী বহু আগেই হিন্দিকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করতে চেয়েছিলেন আর এক গুজরাটবাসী জিন্নাহ চাইলেন উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করতে। পাকিস্তানের সকল প্রদেশের জন্যই সেটি তখন নিরপেক্ষ ভাষা। ইসলাম ধর্মের সঙ্গে বা মুসলমানদের সঙ্গে এ ভাষার কোনো সম্পর্ক ছিল না। হিন্দি বা উর্দু ছিল একদা সারা ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের মানুষের মিলনের ভাষা। প্রশ্ন আসতে পারে, গান্ধী যে লক্ষ্য নিয়ে হিন্দিকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করতে চেয়েছিলেন, জিন্নাহ কি একই লক্ষ্য নিয়ে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করতে চেয়েছিলেন? সম্ভবত এর উত্তর হবে, না। কারণ জিন্নাহ কখনোই গান্ধীর মতো ধার্মিক ছিলেন না। 

বাংলার মানুষ যখন বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন করেন তাঁরাও উর্দু ভাষাকে বাতিল করে দিতে চাননি। ভাষা আন্দোলনের দলিলপত্র দেখলে এ কথা স্পষ্ট হয় যে, সেখানে বলা হয়েছিল উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা করা হোক। বাঙালির বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার এ দাবিটি ছিল খুবই যৌক্তিক। কারণ তখন পাকিস্তানের চুয়ান্ন শতাংশ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলতো। পাঞ্জাবের ভাষায় কথা বলতেন সাড়ে আটাশ শতাংশ মানুষ, পশতু বলতেন সাত শতাংশের কিছু বেশি মানুষ আর সিন্ধি বলতেন ছয় শতাংশ মানুষ। ফলে বাঙালির দিক থেকে সেদিন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিটি সুচিন্তিত মত ছিল। বাংলা ভাষা আন্দোলনের উদারতার দিক এই যে, বাঙালিরা যথেষ্ট নমনীয় ছিলেন উর্দুর ব্যাপারে। বাঙালিরা সংকীর্ণতার পরিচয় দেননি, উর্দু ভাষাকে সঙ্গে রেখেই পাশাপাশি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করতে চেয়েছিলেন; কিন্তু পাকিস্তানের শাসক মহল বাঙালির সেই উদারতা আর যুক্তির মূল্য দেয়নি। বাংলা ভাষাকে দাবিয়ে রাখার জন্য তারা রক্তপাত ঘটিয়ে ছিল। মানুষের ওপর নির্যাতন চাপিয়ে দিয়েছিল, ঠিক ভারতে যা হয়েছিল হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে; কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে, ভাষা আন্দোলনের প্রায় সত্তর বছর পার হয়ে যাবার পরেও বাংলা ভাষাকে সর্বস্তরে চালু করা যায়নি। বরং ইংরেজি বাংলা ভাষার জায়গা আরও গ্রাস করে নিচ্ছে। কথাটা কী প্রমাণ করে?

জিন্নাহ এ কথা বলেছিলেন ঠিকই, উর্দু হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা; কিন্তু তাঁর আমলে ভাষা আন্দোলনের প্রশ্নে তিনি রক্তপাত ঘটাননি। দমন নিপীড়ন চালাননি। পাকিস্তান সৃষ্টির পর জিন্নাহ খুব শিগগিরই মৃত্যুবরণ করেন, মাত্র আর এক বছর বেঁচে ছিলেন। যক্ষ্মা আর কর্কট রোগে তিনি ভুগছিলেন বহুদিন ধরে। মূল ভাষা আন্দোলন যখন শুরু হয় জিন্নাহ তখন বেঁচে নেই, প্রধানমন্ত্রী নাজিমউদ্দীন তখন ক্ষমতায়। জিন্নাহ পাকিস্তানকে রাষ্ট্র ভাষা করার ঘোষণা দেওয়ার পরেই যে বাংলা ভাষা আন্দোলন আরম্ভ হয়েছিল তা নয়। বাংলা ভাষার পক্ষে ইতিমধ্যেই ১৯১১ সালে এবং ১৯৩৭ সালে কথা বলতে দেখা গিয়েছিল। ১৯৪৩ সালে আবুল মনসুর আহমদ মোহাম্মদী পত্রিকায় ‘পূর্ব পাকিস্তানের জবান’ নামক এক প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তিনি সেখানে বলেন, উর্দু নিয়ে ধস্তাধস্তি না করে আমরা সোজাসুজি বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ও জাতীয় ভাষারূপে গ্রহণ করতে পারি। তিনি সে প্রবন্ধে বাংলা ভাষার পক্ষে আরও বহু কথা লিখেছিলেন। ১৯৪৬ সালে কবি ফররুখ আহমদ ‘পাকিস্তান: রাষ্ট্রভাষা ও সাহিত্য’ নামে এক প্রবন্ধ লেখেন মাসিক সওগাত পত্রিকায়। সেখানে তিনি জোরালোভাবে বাংলা ভাষার পক্ষে কথা বলেন। মুসলমানদের মধ্যে তখন কয়েকজন বলেছিলেন, বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করলে ইসলামী ঐতিহ্যের সর্বনাশ হবে। কবি ফররুখ আহমদ তাঁদের সমালোচনা করে বলেন, এ ধরনের চিন্তা লজ্জাজনক। 

বাংলা ভাষাকে গুরুত্ব দেওয়ার ব্যাপারটি তখন বিভিন্ন জনের লেখায় পাওয়া যায়। ১৯৪৭ সালের জুন মাসে ‘বাংলা ভাষা বিষয়ক প্রস্তাব’ শিরোনামে আবদুল হক বাংলা ভাষার পক্ষে দাবি তুলে ধরেন। দেশ ভাগের স্বল্পকাল পূর্বে সেকেন্দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জিয়াউদ্দিন আহমদ প্রস্তাবিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার পক্ষে মত দেন। তিনি বলতে চান ভারত যদি তাদের রাষ্ট্রভাষা হিন্দি করতে পারে, ঠিক তেমনিভাবে প্রস্তাবিত পাকিস্তানের সংহতি রক্ষার জন্য উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করা অপরিহার্য। জিয়াউদ্দিনের এই বক্তব্যে সামান্যতম যুক্তি ছিল না। জোর করে ভাষা চাপিয়ে দিয়ে সংহতি রক্ষা করা যায় না, সর্বস্তরে তা চালু করাও যায় না। জিয়াউদ্দিনের এই বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। প্রতিবাদ হিসেবে উনিশশো সাতচল্লিশ সালের ঊনত্রিশে জুলাই কলকাতার দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ভাষাবিদ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর ‘পাকিস্তানের ভাষা সমস্যা’ নামক নিবন্ধ ছাপা হয়। তিনি সেখানে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে অগ্রগণ্য মনে করেন। তিনি আরওবলেন, তারপরেও যদি অন্য কোনো ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দানের কথা উঠে, শুধু তাহলেই উর্দুর কথা চিন্তা করা যেতে পারে। 

পাকিস্তান স্বাধীন হবার পরে রাষ্ট্রভাষা কী হবে তা নিয়ে বহু বিতর্ক আরম্ভ হয়। স্বাধীনতা লাভের পরের মাসে পূর্ব পাকিস্তানের তমদ্দুন মজলিস ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা বাংলা না উর্দু’ শিরোনামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে। সেখানে সর্বপ্রথম বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপিত হয়। সেই সময়ে সরকারি কাজকর্ম ছাড়াও সকল ডাকটিকেট, পোস্টকার্ড, ট্রেনের টিকেটে সবকিছু কেবল ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় লেখা থাকত। খেয়াল করতে হবে, ‘তমদ্দুন মজলিস’ যারা বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করছে, তারা নিজেরাই নিজেদের সংগঠনের নামটি বাংলায় রাখেনি। প্রতিষ্ঠানটির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক আবুল কাশেম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হওয়া উচিৎ সে ব্যাপারে একটি সভা আহ্বান করেন। সভায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে পাকিস্তান সরকারের কাছে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় দাবি করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ঠিক এর মাস দুই পরে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের সভায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপিত হয়। 

ডিসেম্বরের শেষের দিকে গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। পরের বছর ফেব্রুয়ারি মাসে গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সংসদে প্রথমবারের মতো বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। আবদুল হামিদ খান ভাসানীসহ বাঙালি গণপরিষদ সদস্যরা এই প্রস্তাবকে সমর্থন দিলেও মুসলিম লীগ সমর্থিত সাংসদরা এর বিরোধিতা করেন। খাজা নাজিমুদ্দিন ছিলেন এই বিরোধিতার শীর্ষে। খুব স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে জিন্নাহ ঢাকা সফরে আসার আগেই বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে নানারকম আলোচনা চলছিল। পাশাপাশি বিপরীত দিকে পূর্ব বাংলার বহু মুসলমান ‘উর্দু’কে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছিলেন এবং তা জিন্নাহকে পাঠিয়েছিলেন। সুতরাং জিন্নাহর বক্তব্যটিও আকস্মিক কিছু ছিল না। তিনি আসলে বাঙালি শিক্ষিত জনতার মনোভাব জানার পরেও, ভিন্ন এক অংশের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে কথা বলেন। ঢাকায় বিভিন্ন জনমতের সঙ্গে কথা বলার পর, বাস্তব পরিপ্রেক্ষিতে তিনি সে ব্যাপারে কিছুটা নমনীয় হয়েছিলেন। তিনি তার বিদায়ী ভাষণে নরম সুরেই বলেছিলেন যে, তিনি মনে করেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হওয়া দরকার। হতেই হবে তা আর বলেননি। শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে জিন্নাহর এ রকম নমনীয়তার কথাই বলা হয়েছে।

জিন্নাহ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে চাইলে, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠেছিল। নিঃসন্দেহে বাঙালির এই প্রতিবাদ ছিল যুক্তিসঙ্গত; কিন্তু শিক্ষিত বাঙালির প্রতিবাদেরই বা মূল কারণটি কী ছিল তা স্পষ্ট নয়। কারণ বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন করেও শিক্ষিত সমাজ বাংলাকে সর্বস্তরে চালু করতে চায়নি। বরং বাংলা ভাষার পরিবর্তে ইংরেজি ভাষাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। ধরা যাক, যদি জিন্নাহ সেদিন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা না করে ভারতের মতো ইংরেজিকে রাষ্ট্রভাষা করতে চাইতেন, শিক্ষিত সুবিধাভোগী বাঙালির ভূমিকা কী হতো? সকলেই তাঁরা কি প্রতিবাদ করতেন? বর্তমান বাস্তবতা প্রমাণ করে, তা করতেন না হয়তো। জিন্নাহ তাহলে খলনায়ক না হয়ে হয়তো ইংরেজি শিক্ষিত সুবিধাভোগী বাঙালির প্রাণের নায়ক হতেন। 

কথাটা বলার পিছনের যুক্তিটা দেওয়া যাক। বাংলা ভাষা আন্দোলনের পিছনের কারণটা সত্যিকার অর্থে কী ছিল, মনে হচ্ছে সেটি নিয়ে নতুন করে ভাবনা-চিন্তা করবার রয়েছে। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য কি শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা সত্যিই এই লড়াই করেছিলেন? জিন্নাহ যখন ইংরেজিতে বলেছিলেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা, সভায় তখন নাকি প্রথম প্রতিবাদ ধ্বনিত হয় ‘নো নো’ বলে। মানে না না। ইংরেজি শিক্ষিত শ্রেণির মুখ থেকে প্রতিবাদের ‘না’ টা ধ্বনিত হয়েছিল ইংরেজি ‘নো’ শব্দ দিয়ে। খুব স্বাভাবিক যে, পূর্ব বাংলার ইংরেজি জানা ভদ্রলোকরা জিন্নাহর ইংরেজি ভাষায় দেওয়া বক্তৃতার বাক্যাংশের প্রতিবাদ করেছিলেন ইংরেজিতে; কিন্তু পরেও তাঁরা বাংলা ভাষার স্বার্থে কখনো ইংরেজিকে বিসর্জন দিতে চাননি। 

স্মরণ রাখা দরকার, উনিশশো আটচল্লিশ সালে প্রথম ভাষা আন্দোলন শুরু এবং বায়ান্নতে গিয়ে শেষ হয়; কিন্তু বাংলা ভাষা আন্দোলনের পর বাঙালিরা ‘মুসলিম লীগ’-এর বিরুদ্ধে বিকল্প যে জাতীয়তাবাদী দলগুলো গঠন করে তার নাম হয় ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’, পরে ‘আওয়ামী লীগ’ আরও পরে বিভক্ত ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’। নামগুলোর কোনটাই বাংলা নয়। ব্যাপারটা এমন হলো কেন? ভদ্রলোকদের কোন মানসিকতার কারণে? বাংলা ভাষা আন্দোলনের পর বলা হয় ‘শহীদ মিনার’। শহীদ শব্দটা আরবি আর মিনার শব্দটা ফারসি। বাংলা প্রতিশব্দ হবে ‘স্মৃতিস্তম্ভ’। বহুল ব্যবহৃত পুষ্প অর্পণের ‘পুষ্প’ কথাটা সংস্কৃত। বাংলা ভাষার প্রতি তাহলে সত্যিকারের মর্যাদার জায়গাটা কোথায়? ভাষা আন্দোলন দিবস ৮ই ফাল্গুন না হয়ে হলো একুশে ফেব্রুয়ারি। কী দাঁড়ায় তাহলে? ভাষা আন্দোলনের স্মৃতির বহু কিছুই বিদেশি শব্দের ওপর দাঁড়িয়ে আছে! রাজনৈতিক দলগুলোর মূল নামটা ইংরেজি আর উর্দুতেই রাখা, ভাষা আন্দোলনের লড়াইটা তবে কীসের জন্য ছিল? ঘটনাটা খুব ছোট, কিন্তু এর থেকে কি প্রমাণিত হয় না, ইংরেজি শিক্ষিত ভদ্রলোকরা যারা এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন বাংলা ভাষার পক্ষে লড়াইয়ে তাদের চিন্তার জায়গাটা স্বচ্ছ ছিল না। কথাটা হলো বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠা দান বা সর্বস্তরে তা চালু করার বাসনা তাদের মনে কি আদৌ ছিল? থাকলে বাংলা ভাষার বর্তমান হাল কি এইরকম হতো? বাংলা ভাষার পক্ষে লড়তে গিয়ে প্রতিবাদের ধ্বনিটা যেমন বাংলা ছিল না, জাতীয়তাবাদী প্রধান রাজনৈতিক দলের নামগুলো বাংলায় রাখা হলো না। বাংলা ভাষা আন্দোলনের পূর্বাপর ঘটনার ভিতর দিয়ে কী শিক্ষা লাভ করছে বাংলাদেশের মানুষ?

শেষের আগে
সারা হিন্দুস্তানের ভাষা ছিল উর্দু, যা হিন্দুস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করেছিল। পরে সে ভাষা নিয়ে আরম্ভ হলো রাজনীতি। ভারতের একদল মানুষ আরবি বা ফারসি হরফে লেখা এ ভাষাকে বাতিল করে দিতে চাইলেন। পাশাপাশি দেবনাগরী অক্ষরে হিন্দি ভাষাকে তার বিকল্প করে তুলতে চাইলেন। ১৯৫০ সালে ভারতের দাফতরিক ভাষা করার ব্যাপারে ভোটাভুটিতে হিন্দি ভাষা একটি ভোট বেশি পেয়ে ভারতের দাপ্তরিক ভাষার মর্যাদা পায়। ১৯৫০ সালে দেবনাগরী ভাষায় হিন্দি লেখার পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়; কিন্তু ঘটনাগুলো সবসময় কংগ্রেস নেতাদের ইচ্ছেমতো চলতে দেওয়া হয়নি। হিন্দির বিরুদ্ধে নানারকম আন্দোলনের ফলে পরে অবশ্য ভারতে হিন্দি ইংরেজির পাশাপাশি সরকারি ভাষা হিসেবে উর্দুকে প্রতিস্থাপিত করা হয়। বর্তমানে উর্দু ভারতেরও একটি সরকারি ভাষা। যেমন অন্ধ্র প্রদেশ, দিল্লি, জম্মু ও কাশ্মীর এবং উত্তর প্রদেশে এটির সরকারি মর্যাদা আছে। এই রাজ্যগুলোতে উর্দু সরকারি প্রশাসন ও প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ভারতের বহু অঞ্চলের মুসলমান উর্দু ভাষা ব্যবহার করেন। ঠিক যেমন হিন্দুরা হিন্দি ব্যবহার করেন অনেক প্রদেশে। ভারতে হাজার খানেক উর্দু সংবাদপত্র রয়েছে। নিজস্বপাঠ্য পরিকল্পনা বিশিষ্ট উর্দু বিদ্যালয় রয়েছে ভারতে।

বর্তমানে ভারতে উর্দু ভারতীয় সংবিধানের তফশিলভুক্ত ভাষা। ভারতে হিন্দি ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যাই বেশি। তারপর আসে বাংলা, তেলেগু, মারাঠি, তামিল এবং উর্দুর নাম। সংখ্যার বিচারে উর্দু ষষ্ঠ। ভারতের যে তিনটি ভাষা বিভিন্ন প্রতিবেশী রাষ্ট্রের জাতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে সেগুলো হলো, পাকিস্তানে উর্দু, বাংলাদেশে বাংলা এবং নেপালে নেপালি। যদিও পাকিস্তানে মোট জনসংখ্যার দশ শতাংশের কম উর্দুভাষী, তবুও উর্দু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। পাকিস্তানে যাঁরা উর্দু ভাষায় কথা বলেন তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই মোহাজির বা ভারতের উদ্বাস্তু। উর্দু বর্তমানে ইংরেজির সঙ্গে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। যেসব পাকিস্তানির মাতৃভাষা উর্দু নয়, তাদের জন্য এটি দ্বিতীয় বা তৃতীয় ভাষা। পাকিস্তানের সমস্ত সরকারি, ব্যবসায়িক, গণমাধ্যমমূলক ও শিক্ষায়তনের কাজ উর্দুতে সম্পন্ন হয়। বিভিন্ন প্রদেশগুলো নিজেদের স্থানীয় ভাষা ব্যবহার করে। উর্দুর বেশ কিছু উপভাষা বিদ্যমান রয়েছে। এর অধিকাংশই ভারতে। পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে উর্দুর বেশ কিছু উপজাত লক্ষ্য করা যায়। এক সময় ঢাকাইয়া উর্দু নামে ঢাকায় উর্দুর একটি উপভাষা প্রচলিত ছিল; কিন্তু স্বাধীনতার পরে বাংলার প্রভাবে সেটি প্রায় হারিয়ে যায়।

দুই হাজার এক সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ভারতে উর্দু ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা পাঁচ কোটির বেশি। যা সে দেশের মোট জনসংখ্যার পাঁচ শতাংশের বেশি ছিল। প্রতি কুড়িজন ভারতীয়র একজনের মাতৃভাষা উর্দু। উত্তর প্রদেশ, বিহার, মহারাষ্ট্র, অন্ধ্র্রপ্রদেশ, কর্নাটক এবং ঝাড়খন্ড রাজ্যে মোট উর্দু ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা পঁচাশি শতাংশ। বাকিদের বাস পশ্চিমবঙ্গ, মধ্যপ্রদেশ, তামিল নাড়ু এবং রাজস্থানে। কাশ্মীরের আঞ্চলিক ভাষা কাশ্মীরি হলেও সেখানকার প্রধান সরকারি ভাষা উর্দু। অন্ধ্রপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ. উত্তরাখন্ড, দিল্লি ও বিহারের কিছু কিছু অংশেও উর্দু দ্বিতীয় সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃত। পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার সেখানকার বিশেষ কিছু অঞ্চলে উর্দুকে দ্বিতীয় সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করার ব্যাপারে ইতিবাচক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। 

ভারতের অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষার মতো উর্দু কোনো প্রাদেশিকতায় আবদ্ধ থাকেনি। ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষরাও অনেকে উর্দু শেখেন সখ করে। ভারতে উর্দু ভাষা শেখানোর জন্য সরকারিভাবে এক বছরের একটি সনদপত্র দানের কার্যক্রম রয়েছে। বিভিন্ন রাজ্যের উর্দু প্রতিষ্ঠানগুলো এ পাঠ্যক্রম পরিচালনা করে। পশ্চিমবঙ্গেই দেখা গেছে এরকম প্রতিষ্ঠানে উর্দু ভাষা শেখার ব্যাপারে মুসলমান শিক্ষার্থীর চেয়ে অমুসলমান শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বেশি। ভারতে উর্দু ভাষার এরকম লেখক আছেন যাঁরা মাতৃভাষা ছেড়ে উর্দুকেই বেছে নিয়েছেন সাহিত্যসৃষ্টির উপায় হিসেবে। হিন্দি এবং ইংরেজির মতো বর্তমানেও উর্দু এক সর্বভারতীয় ভাষা। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা উর্দু ভাষাভাষী মানুষ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার ফলে কোনো বিশেষ রাজ্যে তাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ নন। দুই হাজার দশ সালে সমাজবাদী পার্টির নেতা মুলায়ম সিংহ যাদব উর্দুর দুরবস্থার কথা তুলে ধরেন সংসদের অধিবেশনে। সেসময়ে দলমত নির্বিশেষে বিজেপিসহ বিভিন্ন দলের নেতানেত্রীরা তাঁকে সমর্থন করেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি তোলেন পশ্চিমবঙ্গে একটি উর্দু বিশ্ববিদ্যালয় খোলার। মুলায়ম সিংহ যাদবের রাজ্য উত্তর প্রদেশ উর্দুর বড় কেন্দ্র হয়েও সেখানে উর্দু-মাধ্যমে বিদ্যালয়ের অভাব। উর্দু ভাষার প্রতি এই অবহেলা দেখে চলচ্চিত্র পরিচালক মহেশ ভাট, যাঁর মা ছিলেন উর্দুভাষী শিয়া মুসলমান, তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন উর্দুভাষী সকল শিশুর মৌলিক অধিকার আছে মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভ করার।

বহু মানুষের ভুল ধারণা থাকতে পারে যে উর্দু শুধু মুসলমানদের ভাষা বা মুসলমান মাত্রই উর্দুভাষী। দুই হাজার এক সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ভারতে মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় চৌদ্দ কোটি, তার সাঁইত্রিশ শতাংশ উর্দুভাষী। ভারতের অমুসলিম কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে লালা লাজপত রাই, গঙ্গাধর তিলক, তেজবাহাদুর সপ্রু এবং জওহারলাল নেহরু উর্দুপ্রেমী ছিলেন। পরবর্তী সময়ের দুই প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাও এবং অটলবিহারী বাজপেয়ী ছিলেন উর্দু জানা মানুষ। উর্দুর দুই বিখ্যাত অধ্যাপক ছিলেন জগন্নাথ আজাদ এবং হুকুমচাঁদ নাইয়ার। স্যার তেজবাহাদুর সপ্রু সেই যুগেই বলেছিলেন, উর্দু হিন্দু ও মুসলমান উভেয়রই যৌথ ঐতিহ্য, যা অবিভাজনীয়। ভারতের বৌদ্ধ, শিখ আর খ্রিস্টানরাও এ ঐতিহ্যের সঙ্গে কমবেশি যুক্ত। ভাষা কখনোই কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের সম্পত্তি হতে পারে না। ভাষা গড়ে তোলে একটি জনগোষ্ঠী। ভাষাকে তাই সেভাবেই মূল্যায়ন করা দরকার। ঠিক একইভাবে বিশেষ কোনো ভাষাকে অন্য কোনো জনগোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া যায় না। 

সর্বশেষ কথা 
বাংলাদেশের বিরাটসংখ্যক মানুষের ভাষা বাংলা, দেশটির নাম বাংলাদেশ। ভাষার নামে দেশটির নাম। দুর্ভাগ্য এই যে, সেখানে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করা যাচ্ছে না। সত্তর বছরেও সর্বস্তরে বাংলা চালু করা গেল না-তারপরেও কি মনে করতে হবে এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল বাংলা ভাষার মর্যাদা দান? বাংলা ভাষাকে সম্মানদানের নমুনা কি এই যে, বাংলাদেশের শিক্ষার বাহন বাংলা নয়, বরং অধিক ক্ষেত্রেই ইংরেজির আধিপত্য। বাংলাদেশের বহু স্বচ্ছল পরিবারের সন্তানরা শিশুকাল থেকেই ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশুনা করে, বহুজনের সন্তানরা বাংলা বলতে পারলেও বাংলায় লিখতে এবং পড়তে পারে না। বাংলার প্রতি প্রেমের এতই পরকাষ্ঠা তারা যে, সুযোগ থাকলে প্রায় সকলেই সন্তানকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াতো। হতেই পারে এটি তাদের ব্যক্তিগত অধিকার যে সন্তানকে তারা ইংরেজি পড়াবে, নিজেরা ইংরেজি চর্চা করবে; কিন্তু তাহলে এতো ঘটা করে বাংলা ভাষার নামে কেন প্রতিবছর তারা একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করছে? যারা বাংলায় কথা বলে, বাংলা সংস্কৃতিকে ধারণ করে গ্রামের সেইসব কৃষকরা ঘটা করে একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করে না। বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতিকে তারাই জীবন্ত রেখেছে, কোন আনুষ্ঠানিকতা ভণ্ডামী না করেই। রাষ্ট্রভাষা যদি উর্দু হতো তাহলেও তারা বাংলাই বলতো।

রাষ্ট্রভাষা বাংলা করা হলো নাকি উর্দু করা হলো, না কি ইংরেজি করা হলো তাতে সাধারণ জনগণের কী যায় আসে? তারা সবসময় নিজের মাতৃভাষাতেই কথা বলবে। ইংরেজরা যখন শিক্ষার বাহন ইংরেজি করেছে, সাধারণ মানুষ কিন্তু সেই সময়ও নিজের মাতৃভাষায় কথা বলেছে। স্বাধীন ভারত যখন দাপ্তরিক ভাষা ইংরেজি আর হিন্দি করেছে, সাধারণ মানুষ মাতৃভাষায় কথা বলেছে, মাতৃভাষায় গান গেয়েছে। উপরে বসে শাসকরা কোন ভাষা প্রতিষ্ঠা করলো, সেটি নিয়ে সাধারণ মানুষ মাথা না ঘামিয়ে নিজের মাতৃভাষায় তারা সবরকম যোগাযোগ রক্ষা করেছে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে কথাটা সমানভাবে সত্য। পাশাপাশি দেশের তথাকথিত শিক্ষিতরা কী করেছে? ভাষা আন্দোলনে মানুষ প্রাণ দেওয়ার পরেও, সর্বস্তরে বাংলা ভাষাকে চালু করতে দেয়নি। ঘরে বাইরে তারা ইংরেজি বলতে পছন্দ করছে। একদল কারণে-অকারণে ‘আরবি’ বলতে পছন্দ করে। অন্যদল অকারণে ইংরেজি বলতে পছন্দ করে। কট্টর একদল ধার্মিক যেখানে আরবি বলতে পছন্দ করে, নিজ আভিজাত্য রক্ষায় ভদ্রলোকদের সেখানে পছন্দ ইংরেজি। বাংলা ভাষাকে ‘হীন’ করে দেখার ব্যাপারে দু’পক্ষের চরিত্র একই রকম। দু’পক্ষই দুই রকম ‘বিদেশি ভাষা’ ব্যবহার করার মধ্যে দিয়ে এক ধরনের জোশ অনুভব করে। তবে যারা আরবি বলে, তারা ভদ্রলোকদের মতো গড়গড় করে আরবি বলে না। দু’চার লাইন আরবি বললেও, বাংলাই বলে বেশি। ভদ্রলোকরা কিন্তু অনেক অনুষ্ঠানে শুধু ইংরেজিই বলে। যদিও সেসব অনুষ্ঠানে কেবলমাত্র বাঙালিরাই উপস্থিত থাকে। বাংলা ভাষাকে সেসব অনুষ্ঠান থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দেওয়া হয়েছে। কারণ সেটিই তাদের আভিজাত্য। ইংরেজি ভাষার সেখানে ভয়াবহ প্রভুত্ব। 

যারা ক্ষমতার কাছাকাছি তাদের মধ্যে খুব কম মানুষ আছে, যারা বাংলা ভাষাকে সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে ভদ্রলোকদের মধ্যে আবেগ আছে, কিন্তু বাংলা ভাষার প্রতি সত্যিকারের সম্মান নেই। ভদ্রলোকরা বলতে চায়, ইংরেজি না জানলে দেশের উন্নতি হবে না। ইংরেজি ভাষার পক্ষে যারা- তারা মনে করেন, চর্চা ছেড়ে দিলে, বা শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি রাখা না হলে দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। তাদের যুক্তি হলো, বাংলাদেশের মানুষ এমনিতেই ইংরেজি জানে কম- সেখানে ইংরেজি বাদ দিয়ে বাংলায় শিক্ষা দিলে দেশ নিশ্চিত ধ্বংস হবে। সকল উন্নয়ন কাজ বাধাগ্রস্ত হবে, দেশটা পিছিয়ে পড়বে। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের উন্নয়নে কাদের ভূমিকা বেশি? ইংরেজি জানা ভদ্রলোকেদের নাকি ইংরেজি না জানা কম শিক্ষিতদের। ইংরেজি জানা শিক্ষিতরা যখন লুটপাট করছে, তখন ইংরেজি না জানা মানুষরাই দেশের উন্নয়নের ভিত গড়ে দিচ্ছে। ইংরেজি না জানা মানুষগুলো হাত গুটিয়ে ফেলুক, দেখা যাবে ইংরেজি শিক্ষিতরা কী উন্নয়ন বয়ে আনতে পারে! বিশ্বের সকল উন্নত দেশের শিক্ষার বাহন নিজেদের মাতৃভাষা।

রশিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নরওয়ে, ডেনমার্ক প্রভৃতি প্রত্যেকটি দেশ মাতৃভাষায় লেখাপড়া করছে। তাদের উন্নতি করার জন্য ইংরেজি ভাষায় লেখাপড়া করতে হয়নি। ইউরোপীয় রেঁনেসা বা ইউরোপের নবজাগৃতির একটি বিষয় হলো, ল্যাটিন বাদ দিয়ে মাতৃভাষায় ফিরে যাওয়া, মাতৃভাষায় জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা করা। যখন থেকে ইউরোপ মাতৃভাষায় জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা শুরু করেছে, তখন থেকেই তারা উন্নতি করতে শুরু করেছে। ইউরোপীয় নবজাগরণের পূর্বে মুসলমানরা জ্ঞানবিজ্ঞানে ইউরোপের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিল। পৃথিবীতে সত্যিকারের জ্ঞানবিজ্ঞানে একটি উন্নত দেশ দেখতে পাওয়া যাবে না, যারা মাতৃভাষায় লেখাপড়া করেনি। জাপান প্রথম ইংরেজিতে লেখাপড়ার দিকে মন দিয়ে খুব শিগগিরই মাতৃভাষায় ফিরে আসে। প্রথম মাতৃভাষায় বইপত্র জাপানের ছিল না, বিদেশের সব বিজ্ঞানের বই তারা দ্রুত জাপানি ভাষায় অনুবাদ করে নিয়েছিল। মাতৃভাষায় জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার ভিতর দিয়ে জাপান দ্রুত এগিয়ে যায়। বিজ্ঞানী প্রফুল্ল রায় লিখেছেন, জাপান যা পেরেছে, মাতৃভাষায় জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা করলে বাঙালিরাও সেরকম উন্নতি করতে পারতো। ভিয়েতনাম পর্যন্ত মাতৃভাষায় লেখাপড়া করছে। নিজেদের ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা করছে। যারা মাতৃভাষায় লেখাপড়া করেছে, সকলেই তারা সেজন্যই দ্রুত অনেক এগিয়ে গেছে। প্রফুল্ল রায় ছাড়াও বাংলার সেরা বিজ্ঞানী জগদীশ বসু, মেঘনাদ সাহা, সত্যেন বসু সকলেই বলে গেছেন, ‘মাতৃভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা না করলে আমরা আগাতে পারবো না।’ বাংলার চার সেরা বিজ্ঞানীদের ভাষ্য এটি। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, বাংলাভাষায় উচ্চশিক্ষা দেবার জন্য। তিনি বহু চেষ্টা করেও এ ব্যাপারে ইংরেজ সরকারের অনুমোদন লাভ করতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথের লেখা পাঠ করলে দেখা যায়, তিনি কীভাবে মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের পক্ষে শক্ত হাতে কলম ধরেছিলেন। মধুসূদন, বঙ্কিম সকলেই ছিলেন মাতৃভাষার পক্ষে। বঙ্কিমচন্দ্র তো দাসত্ব করার জন্য বাবুদের ইংরেজি শেখার আগ্রহকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করেছেন। 

সকল ইংরেজরা এদেশে ইংরেজি ভাষাকে শিক্ষার বাহন করতে চাননি। শিক্ষা পর্ষদের দশজন ইংরেজ সদস্যর পাঁচ জন মাতৃভাষায় আর পাঁচজন ইংরেজি ভাষার পক্ষে ছিলেন। খুবই উন্নাসিক প্রকৃতির মেকলে যখন ইংরেজি ভাষায় শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেন, তিনি স্পষ্টই বলে দিয়েছিলেন এর মধ্যে দিয়ে ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠীকে শাসকদের দালাল হিসেবে তৈরি করা সম্ভব হবে, যারা সর্বদাই ইংরেজদের গুণগান করবে। তিনি বলেছিলেন, রক্তে মাংসে দেখতেই শুধু ভারতীয় হবে, কিন্তু নিজ দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে শাসকদের পক্ষ নেবে। শিক্ষার মাধ্যমরূপে ইংরেজিকে গ্রহণ করে তিনি ভারতীয় ভাষাসমূহের উন্নতির পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিলেন। স্যার জন ম্যালকম তার পূর্বে আঠারশো আটাশ সালে লিখেছিলেন, একদল ইংরেজি শিক্ষিত ভারতীয়দের আমাদের শাসনতন্ত্রের বিভিন্ন শাখায় নিযুক্ত করা দরকার। তিনি স্পষ্টই বলেন, সরকারের অধিক সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তার জন্য ভারতীয়দের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করা একান্তই জরুরি। যখন অন্যরা ভারতে ইংরেজি চালু করার ব্যাপারে উদগ্রীব, জেমস মিল তখন মাতৃভাষার প্রশ্নটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেন। তাঁর মতে, ভারতের মতো জনবহুল দেশে বেশির ভাগ মানুষকে ইংরেজি শেখানো অসম্ভব। আর এই অসম্ভবকে নীতি হিসেবে গ্রহণ করলে অনেক প্রয়োজনীয় কর্তব্যই অবহেলিত থাকবে। বরঞ্চ ইউয়োপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের বইয়ের অনুবাদ করে দেশীয় ভাষায় শিক্ষা দিলে অনেক তাড়াতাড়ি অনেক বেশি লোককে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত করা সহজ হবে। 

রবীন্দ্রনাথ এবং গান্ধী ইংরেজি শিক্ষার কুফল নিয়ে বহু কথা বলেছেন। গান্ধী লিখছেন, ‘শত শত যুবকের বিশ্বাস যে, ইংরেজির জ্ঞান ছাড়া ভারতের মুক্তি অসম্ভব। সমাজে এমনভাবে ঘুণ ধরেছে যে, বহুস্থলে ইংরেজিতে জ্ঞান থাকাই হচ্ছে শিক্ষার একমাত্র অর্থ। আমার কাছে এসব হীনতা এবং দাসত্বের লক্ষণ’। তিনি অন্যত্র ইংরেজিতে শিক্ষিত ভারতবাসীদের সম্পর্কে লিখেছেন, বিদেশি ভাষায় এই সম্প্রদায় এমন শিক্ষা পেয়েছে যে, জনসাধারণের মধ্যে তারা কোনো প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয় না। সকলে তারা জানসাধারণের প্রতিনিধিত্ব করতে চায় কিন্তু পারে না। নিজেদের তারা ইংরেজ রাজকর্মচারীদের মতোই ভাবে। কারো কাছেই তারা হৃদয়ের দুয়ার খোলে না। তাদের চিন্তা জনসাধারণের মধ্যে কোনো আশা আকাঙ্ক্ষা জাগায় না। যারা মনে করছেন, ইংরেজি না হলে উন্নয়ন হবে না, গান্ধীর বিভিন্ন লেখায় বরং রাষ্ট্রীয় উন্নয়নে ইংরেজি শিক্ষার কুফলই ধরা পড়ছে। সত্যি বলতে ইংরেজি শিক্ষা বাংলাদেশের জনগণকে তার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে। জ্ঞানবিজ্ঞানে সেজন্য বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে আর প্রতিদিন পিছিয়ে যাচ্ছে। মাতৃভাষা চর্চার ভিতর দিয়ে এবার তাদের এগিয়ে যাবার দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করা দরকার।  


লেখক : শিক্ষক, গণ বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh