স্থবির চাকরির বাজারে বাড়ছে বেকারত্ব

হামিদ সরকার

প্রকাশ: ১৯ জুলাই ২০২১, ১১:৪৮ এএম | আপডেট: ১৯ জুলাই ২০২১, ১১:৫৫ এএম

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

বিশ্বজুড়ে করোনার কারণে বিপর্যস্ত অর্থনীতি। বন্ধ অনেক শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। চাকরি হারিয়ে নতুন করে বেড়েছে বেকারত্ব। থমকে গেছে শ্রমবাজার। অন্যদিকে সরকারি-বেসরকারি খাতে দীর্ঘসময় ধরে নতুন করে কোনো নিয়োগ নেই। ফলে নতুন করে বেকারত্ব বেড়েছে। বয়স তো থেমে থাকছে না। হতাশায় ভুগছে শ্রমবাজারে আসা যুব সমাজ। দেশের শ্রমবাজারে বছরে প্রায় ১০ লাখের মতো নতুন শ্রমশক্তির অন্তর্ভুক্তি হচ্ছে। 

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করতে ২৫/২৬ বছর পার হয়ে যায়। ৪/৫ বছর চাকরির জন্য যুদ্ধ করতে হয়। তার মধ্যে করোনা প্রায় দেড় বছর কেড়ে নিয়েছে। আর দেশে যে পরিমাণ চাকরির সুযোগ আছে, তাতে প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা ৪৭ শতাংশ গ্র্যাজুয়েটের চাকরি পাওয়ার সুযোগ নেই বলে শ্রমবাজারে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের মতে, এখন প্রয়োজন ও উচিত হবে ধাপে ধাপে অনলাইনে চাকরির পরীক্ষার ব্যবস্থা করা। 

৩০ জানুয়ারি প্রকাশিত ২০২০ সালের এইচএসসি ও সমমানের মূল্যায়নে সারাদেশে ১১টি শিক্ষা বোর্ড থেকে ১৩ লাখ ৬৫ হাজার ৭৮৯ জন শিক্ষার্থী পাস করেছে। এর আগের বছর ২০১৯ সালে মোট ১৩ লাখ ৩৬ হাজার ৬২৯ জন শিক্ষার্থী এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে এবং তাদের মধ্যে নয় লাখ ৮৮ হাজার ১৭২ জন পাস করেছে। অর্থাৎ দেশের শ্রমবাজারে প্রতি বছর প্রায় ১০ লাখের মতো নতুন করে যুক্ত হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭-এর হিসাব বলছে, দেশে কর্মক্ষম বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৭ লাখ। বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, দেশে শ্রমশক্তির মোট পরিমাণ ৫ কোটি ৬৭ লাখ। এর মধ্যে কাজ করছে মাত্র ৫ কোটি ৫১ লাখ ৮০ হাজার জন। এর অর্থ বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৮০ হাজার।

আর করোনাকালে বেকারত্বের একটা হিসাব দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠীভুক্ত সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি)। সংস্থাটি এক সমীক্ষায় বলছে, বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এর কারণে অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে (এমএসএমই) কর্মরত ৩৭ শতাংশ মানুষ বেকার হয়েছেন। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বলছে, করোনা মহামারির কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম। করোনা মহামারিতে তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার দ্বিগুণ হয়েছে। আইএলওর হিসাবে, এই তরুণদের সবাই পূর্ণকালীন কাজে নিয়োজিত থাকলে বাংলাদেশে করোনাকালে বেকারের সংখ্যা হতো অন্তত ১৬ লাখ ৭৫ হাজার। 

অন্য এক পরিসংখ্যানের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর কর্মবাজারে প্রবেশ করছে প্রায় ২৭ লাখ লোক। আর চাকরি পাচ্ছে মাত্র এক লাখ ৮৯ হাজার জন। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এর মতে, বর্তমানে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ বেকার। দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বেকারত্বের হার বাংলাদেশেই বেশি। ২০১০ সালের পর থেকে প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কা ও ভুটান এই হার কমিয়ে এনেছে। আর ভারতে স্থিতিশীল রয়েছে। তবে বেড়েছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও নেপালে।

বেসরকারি শিক্ষকদের নিয়োগ দেয় বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ-এনটিআরসিএ। সর্বশেষ ৫৪ হাজার শিক্ষক নিয়োগের জন্য আবেদন গ্রহণ করেছে। এতে আশার আলো দেখেছিল প্রায় ৮০ লাখের মতো আবেদনকারী; কিন্তু উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক সেই নিয়োগও আটকে আছে। তাদের মাঝেও বিরাজ করছে হতাশা। আবার করোনার কারণে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অনলাইনে ক্লাস হলেও পরীক্ষা নেওয়ার জটিলতায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা দেড় বছরের বেশি সময়ের জটে পড়েছেন। ফলে তাদের মধ্যেও একটা চরম হতাশা কাজ করছে। 

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, গত ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে ১৮ লাখ ৮৫ হাজার ৮৬৮টি অনুমোদিত পদ রয়েছে। এসবের বিপরীতে ১৫ লাখ ৪ হাজার ৯১৩ জন বর্তমানে কর্মরত। তবে শূন্য আছে ৩ লাখ ৮৭ হাজার ৩৩৮টি পদ। এ ছাড়া প্রতি মাসেই অবসরে যাচ্ছে প্রজাতন্ত্রের জনবল। বর্তমানে শূন্য পদের মধ্যে ৪৬ হাজার ৬০৩টি প্রথম শ্রেণির, ৩৯ হাজার ২৮টি দ্বিতীয় শ্রেণির, এক লাখ ৯৫ হাজার ৯০২টি তৃতীয় শ্রেণির এবং ৯৯ হাজার ৪২২টি চতুর্থ শ্রেণির। মহামারির মধ্যে সেসব পদ পূরণের কাজটি থমকে গেছে। গত বছর মার্চ থেকে মে পর্যন্ত সাধারণ ছুটির সময় সব ধরনের নিয়োগ বন্ধ ছিল। পরে কিছু প্রক্রিয়া শুরু হলেও সংখ্যায় তা সামান্য। অতি মহামারির কারণে সংকুচিত হয়ে পড়েছে চাকরির বাজার। নতুন নিয়োগ নেই অধিকাংশ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। গত দেড় বছরে একটি মাত্র বিসিএস প্রিলিমিনারি ছাড়া আর কোনো চাকরির পরীক্ষার সুযোগ আসেনি। বেসরকারি চাকরিতে নতুন নিয়োগ তো দূরের কথা পুরাতনরাই চাকরি হারাচ্ছে। যারাও আছে, তারাও প্রতিনিয়ত চাকরি হারানোর শঙ্কায় থাকেন। 

পিএসসি করোনা মহামারিতে সবধরনের পরীক্ষা ও নিয়োগ বন্ধ রেখেছে। সর্বশেষ ১২ এপ্রিল সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে নন-ক্যাডার চাকরির আবেদন কার্যক্রমও স্থগিত করেছে সরকারি কর্ম কমিশন। এ ছাড়া ৩১ মার্চ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ১০ গ্রেডের সিনিয়র স্টাফ নার্স ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের ফটো টেকনিশিয়ান পরীক্ষা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। করোনাকালে নতুন করে ব্যাপক বেকারত্ব বৃদ্ধিতে একটা উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি চাকরির নিয়োগ ও নির্বাচনী পরীক্ষা স্থগিত হয়ে থাকায় তরুণ প্রজন্মের জন্য বড় দুশ্চিন্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ দীর্ঘদিন ধরে নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে থাকায় অনেক চাকরি প্রার্থী তরুণ-তরুণীরই বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে।

এদিকে, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হলে গত ৩১ মার্চ পিএসসির অধীন সব পরীক্ষা কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। দুই মাস সেই স্থগিত অবস্থায় আছে সেই কার্যক্রম। যদিও মাঝে সাড়ে চার হাজার চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগের কার্যক্রম সমাপ্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়; কিন্তু পরে তা থেমে গেছে। গত ২৩ মে থেকে ৪২তম (বিশেষ) বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল পিএসসি। লকডাউনের কারণে গত ১৮ মে ৪২তম বিসিএসের ভাইভা পরীক্ষা স্থগিত করতে হয়। মহামারি করোনার কারণে গত ৩১ মার্চ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের সিনিয়র স্টাফ নার্স পদের লিখিত পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। দশম গ্রেডের এ পদের লিখিত পরীক্ষা গত ১০ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু স্থগিত হওয়ার পর পুনরায় ৯ মে এই পরীক্ষা নেওয়ার কথা ছিল; কিন্তু সরকার লকডাউনের মেয়াদ বাড়ানোর কারণে সেটিও স্থগিত করা হয়েছে। তবে লকডাউন শেষ হওয়ার পরপরই পরীক্ষা গ্রহণ শুরু করা হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।

সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের তথ্য বলছে, দেশে এসএসসি থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদের এক-তৃতীয়াংশ বেকার। আর প্রতি বছর চাকরির বাজারে প্রবেশ করেন ২৬ লাখ তরুণ। তাদের মধ্যে আবার সর্বোচ্চ ২০ লাখ তরুণের চাকরির সংস্থান হলেও বাকিরা বেকার থাকেন। দেশের সরকারি খাত সর্বোচ্চ ৪ শতাংশ মানুষের কর্মসংস্থানে সক্ষম। বাকি ৯৬ শতাংশ এখনো বেসরকারি, ব্যক্তিমালিকানা বা আত্মকর্মসংস্থানে জড়িত।

নিয়োগের ব্যাপারে পিএসসির চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন বলেন, পরীক্ষা গ্রহণের ব্যাপারে পিএসসির আন্তরিকতার ঘাটতি নেই; কিন্তু মহামারির কারণে আমাদের কিছুই করার নেই। পরিস্থিতি ভালো না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তিনি আরও বলেন, করোনার দ্বিতীয় দফার ঢেউ সব কিছুকে স্থবির করেছে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh