‘পারফর্মেন্স’ : প্রতিবাদী ও সচেতনি দৃশ্যায়নের নৃতত্ত্ব

হেলাল মহিউদ্দীন

প্রকাশ: ১৯ জুলাই ২০২১, ০৩:৩৬ পিএম | আপডেট: ১৯ জুলাই ২০২১, ০৩:৪০ পিএম

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

এক

২০১১ সালের সেপ্টেম্বরের ১ তারিখ। স্থান চিলির রাজধানী সান্টিয়াগোর কেন্দ্রীয় ক্যাথেড্রালের বিশাল উন্মুক্ত প্রান্তর। সেখানে জড়ো হয়েছে কয়েকশ’ বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থী। তারা জড়ো হয়েছে প্রতিবাদ জানাতে। উচ্চশিক্ষার মান পড়ে গেছে। চাকরির বাজারও সীমিত। বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। এরই মধ্যে পড়াশোনার খরচ বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। ছাত্ররা শিক্ষাঋণ নিয়ে শোধ করতে পারছিল না। তার মধ্যে সুদের হারও বেড়েছে। নগর কর্তৃপক্ষ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। কোনোরকম উল্টাপাল্টা ও দৃষ্টিকটু প্রতিবাদের ভাষা যেন ব্যবহার না করা হয়। হঠাৎ একজন পুরুষ ও একজন নারী এরকম অসংখ্য জুটি প্রস্তুত হয়ে গেল। তারপর কোনো এক ইঙ্গিত পেয়ে জোড়ায় জোড়ায় ছাত্র-ছাত্রীরা গভীর চুম্বনে রত হলো। উৎসুক পথচারীদের চোখ কপালে উঠল। তাৎক্ষণিক হতবাক অবস্থা কাটলে, তারাও হাত তালি দিয়ে উৎসাহিত করলেন ছাত্র-ছাত্রীদের। 

এই অভিনব প্রতিবাদের দেহভাষাটি কয়েকটি প্ল্যাকার্ডে এভাবে লেখা ছিল- ‘শিক্ষাকে ব্যয়বহুল ও দুষ্প্রাপ্য করে দিয়েছ, অথচ দেখো ভালোবাসাও ব্যয়বহুল বা দুষ্প্রাপ্য নয়’।

আন্দোলন সংগ্রামে ‘আইডিয়া’ বা ‘নবভাবনা’ই প্রাণ। যে কোনো নতুন প্রতিবাদের ভাষাই সহজে নজরে পড়ে। আসলে প্রতিবাদকারীদের উদ্দেশ্যই থাকে নজর কাড়ার। নতুন কিছু দেখানোর। সমাজের মূল্যবোধকে এবং চলতি হাওয়াকে আঘাত করছে এবং অস্বীকার করছে- এমন কিছু দেখানো গেলে নজরে পড়া সহজ হয়। উদ্দেশ্য সিদ্ধি সহজ হয়। যেমন- সেদিনের সেই ঘটনার পর ছাত্রদের বেতন সহনশীল পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়েছিল। ঋণের সুদের হার ৮ হতে নামিয়ে ২ শতাংশ করা হলো। 

সান্টিয়াগোর ওপরে বর্ণিত প্রতিবাদের ভাষাটি সেদিনের আনকোরা নতুন আবিষ্কার ছিল না। সেই বছরেই জুলাই মাসে প্রায় শ’খানেক কলেজ শিক্ষার্থী এই অভিনব প্রতিবাদটি করেছিল। স্বাভাবিকভাবেই সমাজে প্রতিক্রিয়া হয়েছিল দুই রকম। রক্ষণশীলরা এই কৌশলকে বাড়াবাড়ি ও অগ্রহণযোগ্য বললেও সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল, যাতে সরকার শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো আমলে নেয়। যাতে এরকম দৃশ্যের আর সূচনা না হয়। ছাত্ররা এই প্রতিবাদের ভাষাকে খানিকটা হলেও ফলপ্রসূ হতে দেখল। তারা ঠিকই বুঝতে পারল দ্বিতীয় দফায় একই কা-ের প্রচার ও জনসংযোগ আরও বেশি হবে। সারাদেশের মানুষ জানবে। জুলাই মাসের কাণ্ডটিকেও যৌক্তিকতা দেওয়া হবে। তারা যে রক্ষণশীল মহলের সমালোচনায় হতোদ্যম হয়ে পড়েনি, সেটিও প্রমাণ করা যাবে। 

সেই বছর একই সময়ে শিক্ষা ধ্বংসের প্রতিবাদে সড়কে সড়কে আরেকটি রঙিন ও নজরকাড়া দৃশ্যাভিনয় শুরু হয়। বিক্ষোভটির নাম ছিল- ‘থ্রিলার প্রটেস্ট’। মাইকেল জ্যাকসনের থ্রিলার মিউজিক ভিডিওর প্রেত ও জম্বি চরিত্রগুলো রাস্তায় নেমে আসে। তারপর সোজা চলে যায় প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের সামনে। প্রেসিডেন্ট সেবাস্টিয়ান পিনেরার নিরাপত্তা বহরও শিক্ষার্থীদের নিবৃত্ত করতে পারেনি। থ্রিলার গানটির তালে তালে ভূত-প্রেত সাজা ছাত্রদের নৃত্যের পূর্ণদৃশ্যায়ন উপভোগ করছিল নগরবাসী। ইউটিউবেও ছড়িয়ে পড়ে নৃত্যদৃশ্যটি। সারাদেশে শিক্ষার্থীদের দাবির পক্ষে ব্যাপক জনমতও গড়ে ওঠে। 

থ্রিলার নৃত্যের মূল বক্তব্য ছিল- চিলির শিক্ষাব্যবস্থার অধোগতি দেশের মানুষকে ভূত-প্রেতে পরিণত করছে।

বিক্ষোভে সৃজনশীল প্রদর্শনী নিরস্ত্র আমজনতার প্রয়োজনীয় অস্ত্র হয়ে ওঠে, এমন অসংখ্য ঘটনা রয়েছে। ২০১২ সালের গ্রীষ্মকাল। স্থান কানাডার কুইবেক। এখানেও ছাত্র-ছাত্রীদের খোলামেলা একটি প্রতিবাদ-প্রতিরোধ আন্দোলনের দৃশ্যায়ন মঞ্চস্থ হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকশ’ ছাত্র-ছাত্রী উন্মুক্ত রাস্তায় ঝটপট পরিচ্ছদ খুলে বসল। শুধু অন্তর্বাস পরেই তারা বিক্ষোভে শামিল হলো। তাদেরও বিক্ষোভের কারণ ছাত্রদের বেতন বেড়ে যাওয়া। তার আগের দুই-তিনটি মাস নানারকম অহিংস ও শোভন পদ্ধতিতেই বিক্ষোভরত রয়েছিল শিক্ষার্থীরা; পুরো কানাডাজুড়ে কয়েক লাখ ছাত্র-ছাত্রী তাদের সমর্থনে প্রতিবাদে নেমেছিল; কিন্তু প্রাদেশিক সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সময়ক্ষেপণ করছিল। ঘটনার দিন শুধু কুইবেকেই ছিল প্রায় দুই লাখ ছাত্র-ছাত্রী। শিক্ষার্থীরা বুঝে গিয়েছিল শেষ মরণকামড়টি হতে হবে নজরকাড়া। এমন কিছু দৃশ্যায়ন প্রয়োজন- যা কর্তৃপক্ষকে ছাত্রবেতন বাড়ানো বিষয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে। ফলাফল হাজারখানেক ছাত্র-ছাত্রীর প্রায় বিবস্ত্র বিক্ষোভ। এ রকম বিক্ষোভ হতে পারে জেনে নগর কর্তৃপক্ষ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। পুলিশও ছিল প্রস্তুত; কিন্তু তাতে বিক্ষোভকারীরা মোটেই দমে যায়নি। বিক্ষোভকারীদের জয়ও হয়েছিল। ছাত্রবেতন বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত বাতিল ঘোষিত হয়েছিল।

ফিলিপাইনের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা বিচিত্র, অভিনব ও অপ্রথাগত বিক্ষোভ-কৌশল আবিষ্কারের জন্য বিখ্যাত। ২০০৫ সালে শিক্ষাখাতে ব্যয় বরাদ্দ কমে গেলে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। একদল শিক্ষার্থী সম্পূর্ণ দিগম্বর হয়ে রাস্তায় নেম এসেছিল। সারা শরীরে কিছুই নেই। শুধু মুখটি একটি হলুদ মুখোশসদৃশ টুপিতে মোড়ানো। শুধু চোখ দুটি খোলা। ২০১২ সালে পলিটেকনিক ইউনিভার্সিটি অব দ্য ফিলিপাইন্সের পঁচিশজন শিক্ষার্থীও সম্পূর্ণ দিগম্বর বিক্ষোভে রাস্তায় নেমেছিল। তাদের প্রতিবাদের কারণ ছিল- একটি ইসলামবিদ্বেষী প্রামাণ্যচিত্র। ‘ইনোসেন্স অব ইসলাম’ শিরোনামের প্রপাগান্ডা ডকুমেন্টারিটির বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ফুঁসে ওঠে। চলচ্চিত্রটি ফিলিপাইনের ধর্মীয় বহুত্ববাদ এবং সহাবস্থানের ওপর তীব্র আঘাত হেনেছে, এবং দেশে সাম্প্রদায়িকতা ও ঘৃণা উস্কে দেওয়ার উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছে- এই অভিযোগ তুলে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে নামে। এই আন্দোলনেও ফল মেলে। প্রামাণ্যচিত্রটির প্রদর্শনী চিরতরে নিষিদ্ধ করা হয়। 

২০১৩ সালে আরেকটি দিগম্বর বিক্ষোভ হয়েছিল হাঙ্গেরির ক্যাপোসবার বিশ্ববিদ্যালয়ে। সে বছর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্র-ছাত্রীদের ড্রেস কোড নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করে। প্রজ্ঞাপনটি ছিল সেকেলে, অনাধুনিক, মাত্রাছাড়া রক্ষণশীল এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা-পরিপন্থি। ছাত্র-ছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ওপর কোনো অদেখা, অজানা উগ্র ডান চিন্তার আছর পড়েছে সন্দেহ করেছিল। সেই প্রজ্ঞাপনের একটি আইনি ফাঁকফোঁকর ছিল। সেই সুযোগটি নিয়ে ভরা ক্লাসে একদল ছাত্র-ছাত্রী ‘অত্যধিক গরম পড়েছে’ অজুহাত তুলে বস্ত্র ত্যাগ করে এবং বই দিয়ে দেহের সংবেদনশীল অংশ ঢেকে নেয়। 

একই বছরের মার্চে ইংল্যান্ডের শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি চাকরির মেলা বা জব ফেয়ার চলছিল। পৃথিবীর প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই এই চর্চাটি রয়েছে। নামিদামি চাকরিদাতা কোম্পানি তাদের বুথ খোলে। ছাত্র-ছাত্রীদের চাকরির সিভি রেজিউমি সংগ্রহ করে। অনেককে তাৎক্ষণিকভাবে নিয়োগও দেওয়া হয়। সেই মেলায় একটি যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানও অংশ নেয়। সেই মেলায় হঠাৎই হুড়মুড় করে একদল রক্তাক্ত ও আহত ছাত্র-ছাত্রী ঢুকে পড়ে। তাদের শরীর বেয়ে রক্ত ঝরছিল। পোশাক রক্তে রঙিন। তারা একের পর এক আর্তচিৎকার করতে করতে মারা যাচ্ছে। দেখা গেল, মেঝেতে ছড়ানো-ছিটানো অনেকগুলো লাশ। আসলে সেটিও ছিল অভিনয়। যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে চলমান বিক্ষোভের অংশ হিসেবে, তারা সেই বিক্ষোভ-দৃশ্যটির মঞ্চায়ন ঘটিয়েছিল। শিক্ষার্থীদের এই যুদ্ধবিরোধী দলটি আগে হতেই প্রতিষ্ঠানটিকে মানবহত্যাকারী আখ্যা দিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্টতাকেও ধিক্কার জানিয়ে আসছিল। 

দুই

নন্দনশাস্ত্রে ‘সিম্বলিজম’ নিয়ে আলোচনা আছে। রূপকের নান্দনিক গুরুত্ব সীমাহীন। চিন্তাজড়তা আমজনতার চোখে যেসব দৃশ্যায়নকে উদ্ভট ও অপ্রথাগত মনে হতে পারে, চিন্তাশীলদের নজরে সেগুলোই হয়ে উঠতে পারে ভাবনার আকর। এ জন্য শিল্পকলায়ও নন্দনচর্চায় রূপকবাদ বেশ সবল; কিন্তু নৃবিজ্ঞান ‘আর্ট ফর আর্টস সেইক’-এ কম বিশ্বাসী। এই জ্ঞানকাণ্ডটি দেখতে চায় সমাজের আনাচে-কানাচে, গলি-সন্ধিতে মানুষ কেন বিচিত্র ছলাকলার দৃশ্যায়ন ঘটায়। তবে সবচাইতে বেশি বুঝতে চায় মানবজাতি কীভাবে বিচিত্র দৃশ্যায়নকে প্রয়োজনীয় প্রতিবাদের ভাষায় রূপ দেয়। আদতে প্রতিবাদের ভাষাই নির্মাণ করে ফেলে। নৃবিজ্ঞান যেহেতু গ্যালারিনির্ভর নয়, এলিটদের মনোরঞ্জনের কোনো আগ্রহও পোষণ করে না, হাটে-মাঠে-ঘাটে মানুষের বিচিত্র দেখানেওয়ালা কীর্তিকাণ্ডের গূঢ়গভীর অর্থ খোঁজার চেষ্টা করে। এই বিষয়টিকেও তাই তত্ত্বের কাঠামোয় ভারী না করে নৃবিজ্ঞান সোজাসাপ্টা নাম দিয়েছে ‘পারফর্মেন্স’। সহজ একটি বাংলা করেছি- ‘দৃশ্যাভিনয়’। 

নৃবিজ্ঞানীদের আরও দুটি সহজ কথা আছে। একটি ইংরেজিতে ‘ল্যাংগুয়েজ অব রেজিস্ট্যান্স’ বা ‘প্রতিরোধের ভাষা’। আরেকটি ‘ফর্মস অব রেজিস্ট্যান্স’ বা ‘প্রতিরোধের ধরন’। নৃবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হিসেবে বাগাড়ম্বর নয়, বরং সত্যসত্যিই বিশ্বাস করি এবং দাবী করি যে, এই দুটি বাস্তব শর্তকে আমলে না নেবার কারণে গণআন্দোলন হতে শুরু করে অন্যান্য রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের আলোচনা-বিশ্লেষণ প্রায় ক্ষেত্রেই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। 

জেমস স্কট ‘ওয়্যেপন্স অব দ্য ম্যাসেস’ বা ‘আমজনতার অস্ত্র’ নামে একটি তত্ত্ব অবতারণা করেন। জনতার হাতে পাইক-বরকন্দাজ, পুলিশ-মিলিটারি থাকে না। অস্ত্র থাকে না। যাদের হাতে সে সব থাকে, তারা নিরস্ত্র জনতার ন্যায্য দাবীকেও মানতে চায় না। যতই ন্যায়সঙ্গত দাবীই হোক, একেবারেই গান্ধীবাদী শান্তি-শান্তি অহিংস নীতির জনতার আন্দোলনকে আমলেই নিতে চায় না ক্ষমতাধররা। যেমন- রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের ক্ষমতাদর্প ছোট ছোট আকারে সমাজের বিভিন্ন আঞ্চলিক মহলে ভাগবাটোয়ারাও হয়। যেমন- জোতদার, সামন্তপ্রভূ, জমিদার। তাদের স্বার্থরক্ষার জন্য রাষ্ট্র একাট্টা। আইন-পুলিশ বিচারব্যবস্থা সবকিছুই তাদের হাতের নাগালের মধ্যে। তাদেরই সেবায় নিয়োজিত। এমনিতেই তারা নিজেরাও যথেষ্ট ক্ষমতাধর। হাতে লাইসেন্স করা বন্দুক থাকে। ঘাড়ে-গর্দানে পেশিবহুল ভয়ার্তদর্শন পাহারাদার ও নিরাপত্তারক্ষী নিয়োজিত থাকে। 

এতসব বাধা পেরিয়ে কৃষক বা ক্ষেতকামলা বা যোগালি কি পারে ন্যায্য দাবি জানাতে? তাদের প্রতি অমানবিক আচরণ, দমন-পীড়ন, ন্যায্য প্রাপ্য না দেওয়া, অধিকার হতে বঞ্চিত রাখা কোনোটিরই প্রতিবাদ করা তাদের পক্ষে সম্ভব? উত্তর ‘না’। তারা ‘অক্ষম’; কিন্তু অক্ষম থেকেই কিছু একটি না করলেই যে নয়। অন্তত রাগ বা ক্ষোভ মেটানোর জন্য হলেও কিছু তো করতে হবে। তো তারা আবিষ্কার করে অশ্লীল গালি। সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে বানিয়ে চুরিয়ে বাজারে বাজারে তারা মালিকের গিবত করে। খাবারে থুতু মিশিয়ে দেয়। জোতদারের ক্ষেতের ফসলের একাংশ ইচ্ছে করে নষ্ট করে দেয়। স্ত্রী-কন্যার নামে কলঙ্ক ছড়ায়। দড়িতে শুকাতে দেওয়া মালিকপক্ষের কাপড়-চোপড় কেটে দেয়। গরুর দড়ি ছেড়ে দেয় ক্ষেতের ফসল মাড়িয়ে দিয়ে আসার জন্য। জেমস স্কট যেমন এ সব আচরণ দেখেছেন ইন্দোনেশিয়ায়, অন্যান্য নৃবিজ্ঞানীরাও দেখেছেন দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গ জোতদারের জোতে কর্মরত কালোদের মধ্যে, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে ভূস্বামী ও ভূমি শ্রমিকদের মধ্যে, ভারতে বিহারের বর্ণাশ্রমনির্ভর কৃষিশ্রমিক ও ভূমিমালিকদের মাঝে।

এগুলো প্রতিবাদের ধরন। এক সময় এ সব ক্ষুদ্র প্রতিবাদ জমাট বেঁধে প্রতিরোধে রূপ নেয়। সহিংস হবার যখন সুযোগ থাকে না, এর নাম তখন অহিংস পথেই ক্ষমতাধরকে ঝামেলায় ফেলার চেষ্টা চলে। আশির দশকে মালয়েশিয়ায় বর্তমান বাংলাদেশের মতোই গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিনির্ভর জমজমাট অর্থনীতি গড়ে ওঠে। হঠাৎ দেখা গেল, ফ্যাক্টরিগুলোতে নারী শ্রমিকদের ভূতে ধরছে। একজন দু’জন করে অনেককে। তারপর এক কারখানা হতে অন্য কারখানা, অন্য কারখানা হতে অনেক কারখানায় ছড়াতে লাগল এই ব্যাধি। কারখানাগুলোতে কাজকর্ম লাটে উঠতে লাগল। হাসপাতাল-ডাক্তার করে বিশেষ কোনো রোগ নির্ণয় করা যাচ্ছিল না। এক পর্যায়ে চিকিৎসকরা সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন যে, নারী শ্রমজীবীদের অপুষ্টিজনিত কারণে সমস্যাগুলো হচ্ছে। একনাগাড়ে বসে থাকা, ক্লান্তিকর ও বিরক্তিকর কাজ, বাথরুমে যাবার মতো সময়ও না পাওয়া, অস্বাস্থ্যকর অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ সব মিলিয়ে শারীরিক ও মানসিক চাপে দেহ-মনের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলায়- তাদের আচরণ ভূতগ্রস্তের মতো হয়ে উঠেছিল। সে সময়ের মালয়েশিয়ার গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলোকে বাংলাদেশের ফ্যাক্টরিগুলোর বর্তমান অবস্থার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। 

আইওয়া অং নামের একজন নৃবিজ্ঞানী নারী ঘটনার অদেখা গভীরে আলো ফেলতে চাইলেন। দীর্ঘ সময় নারী শ্রমিকদের ওপর গবেষণা করে তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন যে, শারীরিক ক্লান্তিজনিত অবসাদের প্রতিক্রিয়া ধারণাটি আংশিক সত্য বটে। তবে আসল উদ্দেশ্য ছিল ‘রেজিস্ট্যান্স’ বা প্রতিরোধ। ‘ওয়েপন্স অব দ্য উইক’। অনেকগুলোই ঘটনাই ছিল ভূতগ্রস্ততার অভিনয়। ভূতে ধরার অভিনয় সহজ। চোখ-নাক-মুখ উল্টে ফেলে অসংলগ্ন আচরণের অভিনয়ে বেগ পেতে হয় না। মালিকপক্ষ বা ব্যবস্থাপক মহলকে ভীতসন্ত্রস্ত করে রাখা যায়। সবচেয়ে বড় লাভের লাভ এতে কাজের গতি বাধাগ্রস্ত হয়। কোনো কোনো দিন আর কোনো কাজই করা সম্ভব হয় না। ভূতের ভয়ে শ্রমিকরা ঘরে ফিরতে চায়। ভূতের ভয় অজুহাতে পরদিন হতে কাজে না ফেরার সুযোগ নেওয়া যায়। মূল উদ্দেশ্য মালিকপক্ষকে শিক্ষা দেওয়া। তাদের লোকসানের রাস্তা করা। কারণ- বেতন, মূল্যায়ন, শ্রমিক-কল্যাণ কোনো কিছুই শ্রমিকদের ন্যূনতম জীবনামানের নিশ্চয়তা দিতে পারছিল না। শ্রমিক সংগঠন করারও অধিকার নেই। বঞ্চিতের কথা কেইবা শুনতে চায়? শোষণের শিকার হওয়াই যেখানে নিয়তি, সেখানে সামান্য স্খলন, সামান্য অনৈতিকতা দিয়ে হলেও প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ জারি করাই দুর্বলের অস্ত্র- ওয়েপন্স অব দ্য উইক।

তিন

ছাত্র-ছাত্রীরাই, বিশেষত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরাই, আন্দোলন-সংগ্রামে সবচাইতে বেশি কার্যকর তীব্রতা ও মাত্রা যোগ করতে পারে। বিক্ষোভের সৃজনশীল প্রদর্শনীকৌশল উদ্ভাবনেও তারাই সেরা। সে জন্যই শাসক এবং শোষক শ্রেণির যত ভয় ছাত্র-যুবাদের নিয়ে। যদিও বিশ্বময় ছাত্র বিক্ষোভের সাধারণ বৈশিষ্ট্য এই যে, সেগুলোর বেশিরভাগই অ-রাজনৈতিক। রাজনৈতিক দলের প্রভাব থাকলেও, তা নিতান্তই পরোক্ষ বা গৌন হয়ে থাকে। 

মিয়ানমারের জান্তাবিরোধী আন্দোলনের দিকে নজর দিলেই বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মায়ানমারে ২০২১ সালের ফ্রেব্রুয়ারির ১ তারিখ হতে শুরু করে মার্চ- এর প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সেনা-পুলিশের গুলিতে মারা পড়েছে প্রায় ৬০০ জনের মতো বিক্ষোভকারী। তাদের নব্বই ভাগই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রী এবং কিশোর-কিশোরী। যে যে দলেরই কর্মী বা সমর্থক হোক না কেন, সামরিক শাসনের বিরোধিতার বেলায় সবাই একই লক্ষ্যাভীমুখী।

লক্ষ্যণীয় যে, মিয়ানমারের জান্তা জনবিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে শক্তিপ্রয়োগ এবং সশস্ত্র দমনের পথ ধরেছে। জনতার হাতে অস্ত্র নেই। ১৯৬২ সাল হতেই সামরিক বাহিনী কার্যত ক্ষমতায়। সেই সময় হতেই শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে অসংখ্য ছোট-বড় আন্দোলন দমিয়ে চলেছে সেনাশাসকরা। ফলে তাদের আত্মবিশ্বাসের পারদ তুঙে; কিন্তু এবার তাদেরও বোধোদয় ঘটছে। ৬০০টি হত্যাকাণ্ডের মতো শক্তিপ্রয়োগের পরও আন্দোলন স্তিমিত করা যাচ্ছে না। প্রতিদিনই জনগণের আন্দোলন সম্পৃক্ততা বাড়ছেই, তার পেছনের কারণ ‘পারফর্মেন্স’। যুবা-তরুণ ও ছাত্র-ছাত্রীরা অসাধারণ সব প্রদর্শনী প্রকল্প নিয়ে মাঠে নেমেছে। একদল তরুণ সুপারম্যান সেজেছে। অসংখ্য কিশোর-কিশোরী মার্ভেলের সুপারহিরোর সাজে রাস্তায় নামছে। উদ্দেশ্য রূপকের ব্যবহার দিয়ে আমজনতাকে আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করা। জনমনে এই বিশ্বাসবোধ ও উদ্দীপনা বিলানো যে, আমরা সুপারহিরোদের মতোই শক্তির আধার। আমাদের হারায় সেই সাধ্য কার? সেনা-পুলিশ বুঝে উঠতে পারছে না, কোথায় কারা ও কীভাবে প্রতিদিনের হাজার হাজার মুখোশ তৈরি করছে ও জোগান দিচ্ছে। সেসব মুখোশের আড়ালে মঞ্চস্থ হচ্ছে পথনাটক। মানুষও দলে দলে পথনাটক দেখছে। মুখোশের বাইরেও বহু যুবা শরীর ঢেকে নিচ্ছে পাতলা পলিথিনে নির্মিত গাউনে। যাতে সেনাদের রঙের গাড়ি রঙ ছুড়ে চিহ্নিত করতে চাইলেও না পারে। রঙ লাগা মাত্রই ঝটপট খুলে রেখে ফের অন্য কোনো প্রতিবাদের বহরে মিশে যাওয়া যায়। ভীতি কেটে যাচ্ছে তাদের। শরীরে উল্কি এঁকে নিচ্ছে- ‘ভয় পাবার বিষয় নয়, ভয় পাইয়ে দেবার বিষয়’। 

মিয়ানমারের আন্দোলনরত যুবা প্রজন্মটি স্বদেশে কোনোদিন সত্যিকারের গণতন্ত্র দেখেনি; কিন্তু বিশ্বায়ন ও ইন্টারনেটের সুবাদে তাদের জানা হয়েছে সামান্য ছাত্রবেতন বৃদ্ধির প্রতিবাদেও গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক কত দূর যেতে পারে। তাদের সামনে চিলির, ক্যুইবেকের, হাঙ্গেরির, শেফিল্ডের পারফর্মেন্সের চিত্র। সেনা শাসনের প্রতি চীনের অনৈতিক সমর্থনের কারণে তারা চীনের ওপর ক্ষুব্ধ। বিক্ষোভ দমনের জন্য চীন কার্গোভর্তি অস্ত্র পাঠাচ্ছে, গানে-কবিতায় পথনাটকে ফুটিয়ে তুলছে তরুণরা। চীন অস্বীকার করে জানিয়েছিল কার্গোভর্তি অস্ত্র ছিল না, মাছ ছিল। প্রত্ত্যুত্তরে বিক্ষোভকারীরা কৌতুকপ্রদ কাণ্ড করেছে। তারা চীনের দূতাবাসের সামনে বড় ব্যানার ঝুলিয়ে দিয়েছে। তাতে লেখা- মাছের আড়ত। 

পারফর্মেন্স গণআন্দোলনের অনিবার্য অনুষঙ্গ। এ বছরের শুরুর মাস হতে দিল্লি হয়ে উঠেছিল কৃষক বিদ্রোহের মূল মঞ্চ। সারাদেশের কৃষক জড়ো হয়েছিল কেন্দ্রের সংশোধন করা কৃষি আইনের পাঁচটি ধারার বিরুদ্ধে। নতুন আইন কৃষককে আরও গরিব করবে, বড় বড় কৃষিবেনিয়া করপোরেশনকে আরও ধনি করবে- প্রতিবাদ এই সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ-শঙ্কার কারণের বিরূদ্ধে। হাজার হাজার পুলিশকে ব্যবহার করে কৃষকদের দমানোর প্রস্তুতি চলছিল। টের পেয়ে কৃষকও প্রদর্শনীতে নামল। শক্তি প্রদর্শনী। তলোয়ারে-কৃপানে তারা ভারতের শহীদ বীরদের সাজ নিয়েছিল। ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলারের বহর তুলে এনেছিল দিল্লির প্রধান সড়কে। পুলিশ ঘেরাওয়ের মাঝেই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ট্রাকটর চালিয়েছে জমি নিড়ানোর ভঙিতে। পুলিশদের এক জায়গায় জড়ো হতে না দিয়ে ছত্রভঙ্গ করে রাখার জন্যই এই পারফর্মেন্স। 

বাংলাদেশে নব্বইয়ের গণআন্দোলনের সময় শহীদ নূর হোসেন বুকে ও পিঠে সাদা রঙে এঁকেছিলেন- ‘স্বৈরতন্ত্র নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। এ দিকে ঢাকার টিএসসি ছাড়িয়ে সারাদেশেই মঞ্চস্থ হতে থাকল স্বৈরাচারবিরোধী পথনাটক। ২০১৮ সালের ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ ছাত্র আন্দোলনের বৈচিত্র্যময়তার দিকেও নজর দেওয়া যেতে পারে। সে সময় পোস্টার, প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুনের অধিকাংশই ছিল নতুন ভাষার ও পরিভাষার, যা আগে অন্য কোনো সময় দেখা যায়নি। ভাষা সৃষ্টির বাইরে কিশোরদের সড়ক-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দৃশ্যটি ছিল অভাবিত ও অভূতপূর্ব। ‘পুলিশ কোন চ্যাটের বাল’ স্লোগানটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। জনমানসে এই স্লোগানের শ্লীলতা-অশ্লীলতাবিষয়ক বিচ্ছিন্ন কিছু আপত্তি উত্থাপিত হলেও, সেগুলো তেমন কোনো সামাজিক অভিঘাত তৈরি করেনি। বরং জনমানসে স্পষ্ট হয়ে ধরা দিয়েছিল, ছাত্রদের সংক্ষুব্ধতা এবং পুলিশি বাধার মুখে প্রতিক্রিয়ার ধরন। 

২০২১ সালের মার্চ মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির বাংলাদেশে আগমনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে একটি বিক্ষোভ হয়। সেই বিক্ষোভে সংক্ষুব্ধদের একদল দেশি লাঠি-বল্লম ও ঢালের প্রদর্শনীতে নামে। একজন ঘোড়সওয়ারি যোদ্ধা সেজে আসেন। [তাকে চিহ্নিত করে গ্রেফতারও করা হয়, যা আদতে বিস্ময়কর। পারফর্মেন্স জনজীবনে হুমকি হয়, এমন কোনো উদাহরণ নৃবিজ্ঞানে নেই।] বিক্ষোভের স্বাভাবিক চরিত্রই এ রকম যে একটি সময় পর বিক্ষোভ ঝলমলে দৃশ্যায়নমুখী পারফর্মেন্সের দিকে মোড় নেবেই নেবে। কারণ একটি ছবি হাজার শব্দের চাইতে শক্তিশালী। বিক্ষোভাকারীরাও খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে চায় না। কারণ তাতে অনর্থক সময়ক্ষেপণ হতে পারে। শত্রুপক্ষ ততক্ষণে পাল্টা কৌশল নিয়ে ফেলতে পারে। তাই বিক্ষোভকে কার্যকর ও বহুশ্রুত করতে পারফর্মেন্সের প্রয়োজন দেখা দেয়। পারফর্মেন্স বিক্ষোভের আরাধ্য দাবিগুলোকে সহজে ও স্বল্প সময়ে ব্যাপক জনপরিচতি দেয়। ২০১৩ সালে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকালে ঢাকার শাহবাগ এলাকায় প্রদর্শনী ও দৃশ্যায়নমুখী পারফর্মেন্সের কমতি ছিল না। অসংখ্য মোমবাতি প্রজ্বলিত হয়। গান, কোরাস, পোস্টার-ফেস্টুন, প্রহসন-নাট্য, নূর হোসেনের নকলে অঙ্কিত দেহে যুদ্ধাপরাধীর বিচার দাবি ইত্যাদি বহু পারফর্মেন্সেই পরিবেশিত হয়েছিল। তাতে আন্দোলনটি যারপর নাই গতি পেয়েছিল। 

 চার

শুধু মানুষই পারফর্মেন্সের একমাত্র মাধ্যম নয়। শুধু বিক্ষোভ বিদ্রোহেই পারফর্মেন্স বেশি দৃশ্যমান হবে, তেমনও নয়। দৃশ্যায়িত নৃবিজ্ঞান বা ভিজ্যুয়াল অ্যান্থোপলজি পাঠের একটি অনুজ্ঞা এই যে, মানবের তৈরি করা যে কোনো দৃশ্যমান মাধ্যম সফল মানবিক যোগাযোগ তৈরি করতে পারে। যোগাযোগ-নির্মাণে সচল দৃশ্যায়ন (অ্যানিমেটেড ভিজ্যুয়ালাইজেশন, যেমন- নাটক, সিনেমা, নাচগান, স্লোগান, স্টান্ট) যতটা সক্ষম, নিশ্চল দৃশ্যায়নও (ইনঅ্যানিমেটেড ভিজ্যুয়ালাইজেশন বা আনঅ্যানিমেটেড ভিজ্যুয়ালাইজেশন, যেমন- আলোকচিত্র, দেয়াললিখন, বিজ্ঞাপন, পোস্টার-প্ল্যাকার্ড, গ্রাফিতি, ব্যঙ্গচিত্র ইত্যাদি) সমান সক্ষম। প্রতিষ্ঠিত অভিজ্ঞান- একটি (অর্থপূর্ণ) আলোকচিত্র হাজার শব্দের চাইতে বেশি শক্তিশালী। কেভিন কার্টারের ১৯৯৩ সালের বিখ্যাত আলোকচিত্র ‘দ্যা ভালচার অ্যান্ড দ্য লিটল গার্ল’ আলোকচিত্রটির কথাই ধরা যাক। একটি শকুন অপেক্ষা করছে কখন শিশুটি মরবে। দুর্ভিক্ষপীড়িত দক্ষিণ সুদানে একটি মৃতপ্রায় শিশু গড়িয়ে গড়িয়ে জাতিসংঘের খাবার বিতরণ কেন্দ্রের দিকে যাচ্ছে। শকুনটি পিছু নিয়েছে, নজর রাখছে। মানবিক বোধ তৈরিতে একটি আলোকচিত্রের সক্ষমতা যে কতটা হতে পারে, তার আরেকটি সাম্প্রতিক উদাহরণ তুর্কি সাংবাদিক নিলুফার দেমির-এর ২০১৫ সালে তোলা সমুদ্রতটে ভেসে আসা মৃত তিন বছর বয়সি সিরিয়ান শিশু আইলান কুর্দির ছবিটি। 

ধরা যাক, একটি ছবি আলোকচিত্র, তাতে একটি বর্ণও লেখা নেই; কিন্তু মুখে অথবা চোখে স্কচটেপ আঁটা। ছবির ভাষ্য কী আমরা মুহূর্তেই জেনে যাই। সম্প্রতি অনেকেই ফেসবুক প্রোফাইলে ব্যবহার করছেন ঠোঁট সেলাই করা, অথবা তালা লাগানো মুখের ছবি। ভাষ্য স্পষ্ট। আমাদের কথা বলার স্বাধীনতাটুকু আর নেই। ‘নাম বললে চাকরি থাকবে না’ বাক্যটি বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে একটি প্রবাদে পরিণত হয়েছে। অনেকেই ভাষ্যটিকে গ্রাফিতি বানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের পাতায় সেঁটে রাখছেন। বিশ্ববিখ্যাত গ্রাফিতিকার ব্যাঞ্জির আদলে বাংলাদেশে ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা’ কাব্যিক গ্রাফিতিটি অল্প সময়েই লোকনজরে এসেছে। তার ভাষ্য স্পষ্ট। একটি অবদমিত সময়ে যুব সমাজের হতাশা, অক্ষমতা ও ব্যর্থতার আক্ষেপ গ্রাফিতিটির নতুন নতুন সংস্করণে আরও স্পষ্ট। ‘কষ্টে আছি আইজুদ্দি’ দেয়াল-লিখনও একটি স্বতন্ত্র অনুভূতি-ভাষ্য তৈরি করে লোকনজর কেড়েছিল। 

নিশ্চল দৃশ্যায়নে প্রচ্ছন্ন কৌতুকাঘাত বা ডার্ক হিউমার থাকে। কখনো কখনো থাকে কৌতুকপ্রজ, বুদ্ধিদীপ্ত ও ইঙ্গিতপূর্ণ প্রাণরস। যেমন- ‘স্মাইল, ইউ আর অন ক্যামেরা!’ আপনি কী করছেন না করছেন সবই দেখছি- আপনি নজরদারির তলে আছেন’ সতর্কতাবাণীটিই একটি কৌতুকাবহপূর্ণ বুদ্ধিদীপ্ততায় প্রকাশিত। বাংলাদেশে ছোট দেশি যানবাহনের গায়ে লেখা ‘আমি ছোট, আমাকে মেরো না’ আরেকটি উদাহরণ। অনেক দেয়াল লিখনে ‘ব্যান্টার’ বা পরিহাসও থাকে। আশির দশকের মাঝামাঝি ধূমপানবিরোধী একটি সংগঠনের নামে দেয়াল-লিখন ও পোস্টার দেখা যেত। ‘বিড়ি খাবি খা, মরে যাবি যা’ লেখা পোস্টারটির ভাষ্য সাম্প্রতিক ‘ধূমপান মৃত্যুর কারণ’ সতর্কতাবাণীটির চাইতে বেশি শক্তিশালী ছিল। বাংলাদেশে কোভিড-১৯ অতিমারির প্রেক্ষাপটে জনসচেতনতা নির্মাণের একটি কার্যকর ও গণমুখী দৃশ্যায়নের উদাহরণ দিয়ে লেখাটি শেষ করব। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল স্বাপ্নিক ছাত্র ‘পাশে আছি ইনিশিয়েটিভ’ নামে দাতব্য সমাজসেবামূলক একটি কর্মকাণ্ড চালিয়ে নিচ্ছে। সংগঠনটির একটি জনসচেতনতামূলক উদ্যোগ ঢাকায় নগরবাসীদের নজর কেড়েছে। অত্যাধুনিক মুদ্রণযন্ত্র সহজলভ্য হয়ে ওঠায় বাংলাদেশে রিকশাচিত্র আঁকিয়েদের অনেকেই বেকার হতে চলেছে। উদ্যোগটি তাদের সহায়তার জন্য, একই সঙ্গে মাস্ক পরতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে ভিন্নরকম বুদ্ধিদীপ্ত রিকশাচিত্র আঁকিয়ে নেবার উদ্যোগ নেয়। কাজে লাগিয়েছে দর্শকপ্রিয় ও ব্যবসা সফল বাণিজ্যিক সিনেমা ও নাটকের বিভিন্ন স্থিরচিত্রকে। স্থিরচিত্রগুলোতে বিভিন্ন জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পীদের মুখে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে নতুন কৌতুকপূর্ণ সংলাপ। সংলাপের মুখ্য বিষয় মাস্ক পরা না পরা এবং করোনার বিপদ ও ভয়াবহতা। দৃশ্যভাষ্যের শক্তিকে ব্যবহার করে জনসচেতনতামূলক যোগাযোগের এই কর্মযজ্ঞটিও বাংলাদেশের নৃবিজ্ঞান পাঠে আলোচ্য হয়ে উঠতে পারার দাবিদার। 

সারা পিংক দৃশ্যায়নি নৃবিজ্ঞান সম্পর্কে এক কথায় যা বলেছেন, সেটি প্রণিধানযোগ্য। তার মতে এটি ‘এঙ্গেইজিং দ্য সেন্সেস’- ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতার সর্বৈব ব্যবহার। পশ্চিমের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভিজ্যুয়াল এথনোগ্রাফি ল্যাব জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ক্যামেরার ভাষায় তাঁরা তুলে আনছেন সমাজ-সম্পর্কের দৃশ্যচিত্র। যখনই যেখানে নজরকাড়া কোনো দৃশ্যায়িত সামাজিক প্রপঞ্চের দেখা মিলছে, তাঁরা সংগ্রহ করছেন অডিও-ভিজ্যুয়াল স্থিরচিত্র ও সচলচিত্র। বাংলাদেশে আন্দোলন সংগ্রামের দৃশ্যায়ন-পাঠ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি। তার পেছনে মূল কারণ অ-গণতন্ত্র এবং রাজনৈতিক অবদমন। সিটিজেন্স জার্নালিজম বা নাগরিক সাংবাদিকতা দৃশ্যায়নি নৃবিজ্ঞান বিকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। বাংলাদেশে অসহনশীল ও অসংবেদনশীল রাজনৈতিক পরিবেশ নাগরিক সাংবাদিকতা বিকাশে একটি বড় বাধা। বাংলাদেশ একটি অপার সম্ভাবনার দেশ। বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে বাংলাদেশে নাগরিক সাংবাদিকতা বিকশিত হলে, দৃশ্যায়নের নৃবিজ্ঞানও বাংলাদেশে একটি পরিণত সমাজপাঠ হয়ে উঠতে পারে।  

লেখক : সমাজতাত্ত্বিক ও অধ্যাপক

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়


সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh