বিশেষ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২১, ০৮:৫৩ এএম
প্রতীকী ছবি
করোনাভাইরাস গত দেড় বছর ধরে গোটা বিশ্বের কাছে জ্বলন্ত ইস্যু। পৃথিবী বলতে গেলে বন্ধই হয়ে গেছে করোনার কারণে। প্রায় প্রতিদিন লাখো লাখো মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন এবং বহু মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন এই ভাইরাসের কারণে।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। যেসব জায়গা মানুষের পদচারণায় মুখর থাকে, সেগুলো দেখলে এখন ভূতুড়ে মনে হয়। সবার কাছে এখন একটিই প্রশ্ন, এর শেষ কোথায়? মানুষ কবে নাগাদ তাদের স্বাভাবিক দৈনন্দিন জীবনে ফিরতে পারবে?
জনসংখ্যার হিসাবে বিশ্বের খুবই সামান্য একটি অংশ এখন পর্যন্ত টিকার আওতায় এসেছে। সামাজিক দূরত্ব আর স্বাস্থ্যবিধিগুলোই যে কিছু দেশে কাজে লেগেছে, সেটি অনেকটা প্রমাণিত। আবার কিছু কিছু দেশে করোনার বিরুদ্ধে হার্ড ইমিউনিটি বা গণপ্রতিরোধও তৈরি হচ্ছে। যেমন- যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিলে জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এরই মধ্যে করোনা আক্রান্ত হয়ে গেছেন। তাদের বড় একটি অংশ হয়ত পরীক্ষার আওতায়ই আসেনি।
কোনো কোনো গবেষক এমনটাও বলছেন যে, মিউটেশন বা নিজেকে বদলাতে গিয়ে করোনার ভাইরাস যে দুর্বল হয়ে পড়ছে সেটিও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি এমন একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে চিকিৎসা বিষয়ক জার্নাল সায়েন্সে। সেখানে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের ক্রমাগত পরিবর্তনে মহামারি অতিমারিতে রূপ নেবে।
অতীতের মহামারিগুলোর অভিজ্ঞতা বলছে যে, একটা পর্যায়ে তা থেমে যেতে পারেভ সবশেষ দুইটি মারাত্মক ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারির একটি ছিল ১৯৫৭ সালের এশিয়ান ফ্লু৷ এতে মারা যান ৪০ লাখ মানুষ। অন্যদিকে ১৯৬৮ সালের হংকং ফ্লু কেড়ে নেয় ৩০ লাখ প্রাণ। সেগুলো যতটা দ্রুত এসেছিল ততটা দ্রুতই কিন্তু বিদায় নিয়েছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯১৮ থেকে ১৯২০ সালের মধ্যে স্প্যানিশ ফ্লুর দ্বিতীয় ঢেউয়ে সবচেয়ে বেশি পাঁচ কোটি মানুষ মারা যান। জীবাণু টিকে থাকলেও স্প্যানিশ ফ্লু তৃতীয় ঢেউ খুব দ্রুতই শেষ হয়ে যায়। এর দুর্বল ধরন হিসেবে পরবর্তীতে এইচওয়ানএনওয়ানের (সোয়াইন ফ্লু) আবির্ভাব হয়, যা আজকের দুনিয়ায় সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জা হিসেবেই বিবেচিত।
ঠিক একইভাবে সার্স-কোভ-টু বা করোনাভাইরাসও একটা পর্যায়ে এমন রূপ নিতে পারে যা হয়তো কোনো একটি এলাকা বা অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ থাকবে। ধরন বদলানোর কারণে সেটি যত দুর্বল হবে, তত কম বিপদজনক হবে। কিন্তু গোটা বিশ্বে একটি ইতিবাচক ট্রেন্ড বা প্রবণতা যতদিন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না, ততদিন স্বাস্থ্য বিধিগুলোর একটি সমন্বয় করে নিতে হবে।
বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন, যেভাবে বড় বড় শহর বন্ধ রাখা হচ্ছে এবং মানুষের দৈনন্দিন চলাফেরারা উপর বিধি আরোপ করা হচ্ছে, সেটি দীর্ঘমেয়াদি চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এভাবে সবকিছু বন্ধ থাকলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব হবে মারাত্মক। তারা বলছেন, এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য দেশগুলোকে একটি কৌশল খুঁজে বের করা উচিত। বিধিনিষেধগুলো প্রত্যাহার করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার উপায় খুঁজতে হবে।
এডিনবরা ইউনিভার্সিটির সংক্রামক রোগ বিষয়ক অধ্যাপক মার্ক উলহাউজ বলেন, এখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কৌশল কী হবে এবং সেখান থেকে আমরা কিভাবে বের হয়ে আসবো – এ নিয়ে নিয়ে বড় সমস্যা আছে। বিষয়টি নিয়ে পৃথিবীর কোনো দেশেরই কোনো কৌশল নেই। এই কৌশল ঠিক করা বড় ধরণের বৈজ্ঞানিক ও সামাজিক চ্যালেঞ্জ।
এর তিনটি উপায়ের কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
১. টিকা দেয়া
২. বহু মানুষের মধ্যে ভাইরাস সংক্রমণের ফলে তাদের মধ্যে এ নিয়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠা
৩. স্থায়ীভাবে মানুষ ও সমাজের আচার-আচরণে পরিবর্তন নিয়ে আসা
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবেলার জন্য জন্য ব্রিটেন যে কৌশল নিয়েছে সেটি হচ্ছে, আক্রান্তের সংখ্যা যতটা সম্ভব কমিয়ে আনা যাতে হাসপাতালগুলো রোগীতে পরিপূর্ণ না হয়ে যায়। হাসপাতালগুলো রোগীতে পরিপূর্ণ হয়ে গেলে আইসিইউতে জায়গা পাওয়া যাবে না। ফলে মৃতের সংখ্যা বাড়তে থাকবে।
ব্রিটেনের প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা স্যার প্যাট্রিক ভ্যালান্সি বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কখন কোন পর্যায়ে যাবে সেটি নিয়ে সুনির্দিষ্ট সময়সীমা দেয়া সম্ভব নয়।
লন্ডনের ইমপেরিয়াল কলেজের অধ্যাপক নিল ফার্গুসন বলেন, আমরা সংক্রমণের মাত্রা কমিয়ে রাখার কথা বলছি যাতে করে দেশের একটি কম সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হয়। আমরা যদি দুই বছরের বেশি সময় যাবত এটা করতে পারি তাহলে দেশের একটি বড় অংশ ধীরে ধীরে আক্রান্ত হবে। এর ফলে স্বাভাবিক নিয়মে রোগ প্রতিরোধ গড়ে উঠবে।
কিন্তু এ কৌশলের মাধ্যমে গড়ে ওঠা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা কতদিন টিকবে সেটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অতীতে করোনাভাইরাসের অন্যান্য ধরণের যেসব সংক্রমণ হয়েছে সেসব ক্ষেত্রে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা খুব ভালো কাজ করেনি। অনেকে মানুষ তাদের জীবনে বেশ কয়েকবার আক্রান্ত হয়েছে।
অধ্যাপক উলহাউজ বলেন, সংক্রমণ প্রতিরোধের অন্যতম উপায়, মানুষের আচার-আচরণে স্থায়ী পরিবর্তন নিয়ে আসা। বর্তমানে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তার মধ্যে কিছু বিষয় রয়েছে। যেমন: কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে তাকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা কিংবা পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়টি জোরদার করা।
তিনি বলেন, আমরা শুরুতেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের শনাক্ত করেছি ও তারা যাদের সংস্পর্শে গিয়েছে তাদেরও খুঁজে বেরি করেছি। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। কোভিড-১৯ এর ওষুধ আবিষ্কার করা সম্ভব হলে সেটি অন্য কৌশলগুলো বাস্তবায়নের জন্যও সাহায্য করবে। মানুষের মধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের লক্ষণ দেখা দেয়ার সময় ওষুধ প্রয়োগ করলে সেটি অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে যাবার বিষয়টি বন্ধ করতে পারে। অথবা হাসপাতালে চিকিৎসা দেবার মাধ্যমে এই রোগের মাত্রা কমিয়ে আনা যাতে আইসিইউ বা নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের উপর চাপ কমে। এটি করা সম্ভব হলে সবকিছু বন্ধ করে দেয়া বা লকডাউনের আগে দেশগুলো বেশি রোগী সামাল দিতে পারবে।
তিনি আরো বলেন, এছাড়া হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বা আইসিইউতে বেশি শয্যার ব্যবস্থা করে অধিক সংখ্যক রোগী সেবা দেয়া সম্ভব। পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য এটিও একটি উপায়।