ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২১, ১১:৫৭ এএম | আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২১, ০৪:৩৬ পিএম
লকডাউনের তৃতীয় দিন রবিবার যাত্রাাবাড়ীতে চলাচল বেড়েছে রিকশা ও ব্যক্তিগত গাড়ির। ছবি : স্টার মেইল
করোনাভাইরাস মহামারিতে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে ১ জুলাই থেকে দেশে ‘কঠোর’ বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল সরকার। কিন্তু করোনা সংক্রমণের ভয়াবহতার মধ্যেই ঈদুল আজহা উপলক্ষে বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়।
আর বিধিনিষেধ শিথিলের সুযোগে কোরবানির পশুর হাট, শপিং মল, মার্কেটে স্বাস্থ্যবিধি মানা হয়নি। অনেকেই ঢাকা থেকে বাস, ট্রাক, লঞ্চে গাদাগাদি করে ঈদ করতে গেছেন গ্রামে। আবার ঈদ শেষে ঢাকায় ফিরেছন তারা।
এদিকে ২৩ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ফের কঠোর বিধিনিষেধও দেয়া হয়েছে। তবে এই কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যেও ঢাকায় ফিরেছে অনেকে। ফেরি, বাসে ছিল না স্বাস্থ্যবিধির বালাই।
ঈদুল আজহার পর থেকে শনিবার (২৪ জুলাই) পর্যন্ত ২১ লাখ ৮ হাজার ২৬৮ সিমধারী ঢাকায় প্রবেশ করেছেন। আর ১৫ থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত এক কোটি ১৪ লাখ ১১ হাজার ২৮৭ সিমধারী ঢাকা ছেড়েছিলেন। তবে হিসাবের মধ্যে মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন না এমন ব্যক্তি ও শিশুরা আসেনি।
গতকাল রবিবার (২৫ জুলাই) রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এমনটি জানিয়েছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। তিনি বলেন, ‘এ পরিসংখ্যান দিয়ে কিন্তু সঠিকভাবে বলা যাবে না যে এত মানুষ ঢাকা ছেড়েছে। মানুষের সংখ্যা এর চেয়ে কমও হতে পারে। তবে কত ভাগ কম হবে তা বলা কঠিন।’
বিধিনিষেধ শিথিলের সুযোগে বিপুল সংখ্যক মানুষের ঢাকা ত্যাগ ও ফিরে আসার বিষয়টি করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতিকে আরো নাজুক করে তুলবে কি না- তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, বিধিনিষেধের শিথিলতার সুযোগে যেভাবে মানুষ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাতায়াত করেছে, তাতে সংক্রমণ আরও ছড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। যা আর কয়েকদিনের মধ্যেই বোঝা যাবে।
ঈদুল আজহায় মানুষের চলাচলের কারণে করোনা সংক্রমণ কিছুটা বাড়বে বলে গত শনিবার আশঙ্কা প্রকাশ করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও।
তিনি বলেন, ‘জনসাধারণকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে সরকার চেষ্টা করেছে, জরিমানা করেছে, জেলে ঢুকিয়েছে, তারপরও মানুষ মানেনি। তারা বেপরোয়াভাবে ঘুরে বেড়িয়েছে। মানুষের ঈদে গরুর হাটে যাতায়াত, গ্রামের বাড়িতে যাওয়া-আসা, বাজার, দোকানপাট, আত্মীয় বাড়িতে যাতায়াত- এসবের ফলে নিশ্চয়ই সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে।’
এদিকে দেশের আট বিভাগের মধ্যে সাত বিভাগেই করোনা সংক্রমিত ব্যক্তির নমুনা থেকে জিনোম সিকোয়েন্সে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে। জার্মানির গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা ডেটার (জিআইএসএআইডি) তথ্য অনুযায়ী, দেশের সাতটি বিভাগে এখন পর্যন্ত ১৫০টি নমুনায় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট বি-১৬১৭ পাওয়া গেছে।
দেশে গত আটদিনে মারা গেছেন ১ হাজার ২৮৯ জন। শনাক্ত হয়েছে ৭৫ হাজার ৯৬১ জন। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) জানিয়েছে, বর্তমান সংক্রমণে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টই বেশি।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, আগামী মাস অর্থাৎ আগস্টে বড় একটা ধাক্কা আসবে। হাসপাতালের সক্ষমতা কমে আসছে দ্রুত। নির্ধারিত বেডের চেয়ে রোগী বেশি হলে সামলানো যাবে না।
এদিকে গতকাল দুপুরে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ভার্চুয়াল বুলেটিনে অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম জানান, ঈদের বন্ধে পরীক্ষা কম হলেও সংক্রমণের হার কমেনি। বরং গত এক সপ্তাহ ধরেই এটা ৩০ শতাংশের ওপরে ছিল।
তিনি আরো বলেন, জেলাভিত্তিক শনাক্তের হিসাবে ঢাকা শীর্ষে অবস্থান করছে। ঢাকায় ইতিমধ্যে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা চার লাখ ছাড়িয়ে গেছে। তারপর আছে যথাক্রমে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট, বগুড়া, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা ও ফরিদপুর। সবচেয়ে কম সংখ্যক রোগী চিহ্নিত হয়েছে রাজশাহীতে, ১৮ হাজার ৪১৬ জন। বিভাগভিত্তিক মৃত্যুর হারেও এগিয়ে আছে ঢাকা। এরপরই রয়েছে খুলনা বিভাগ।
স্বাস্থ্য অধিদফতর ঈদুল আজহার আগে কোরবানির পশুর হাট না বসানোর সুপারিশ করে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম গত ৫ জুলাই বলেছিলেন, গতবছর কোরবানির পশুর হাট ফিজিক্যাল হওয়ার কারণে সংক্রমণ বেড়ে যায়। আর সেই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে অনেক সময় লেগেছিল। যে কারণে এবার পশুর হাট ফিজিক্যাল না করে অনলাইনে করার সুপারিশ করা হয়েছিল।
কিন্তু সে সুপারিশ উপেক্ষা করে কেবল ঢাকাতেই বসেছিল ১৯টি হাট। পুরো দেশে যেসব হাট বসেছিল সেখানেও স্বাস্থ্যবিধির বালাই ছিল না। অধিদফতরও বলেছিল, পশুর হাটে স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘন হচ্ছে। এটা বেশ উদ্বেগজনক।
ঈদের আগে কঠোর বিধিনিষেধ শিথিল করায় গভীর উদ্বেগ জানায় কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরার্মশক কমিটি। কমিটি বিধিনিষেধ শিথিল করার পরিবর্তে আগের বিধিনিষেধ আরো ১৪ দিন বাড়ানোর সুপারিশ করেছিল। কিন্তু সেটাও আমলে নেয়া হয়নি।
কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, এতে করে ‘অবস্থা খুবই ভয়াবহ হবে’। এই শিথিল লকডাউনের ফল দেখা যাবে পরের সপ্তাহে কিংবা তার পরের সপ্তাহে।
কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেছেন, সংক্রামক রোগের স্বাভাবিক যে গতি-প্রকৃতি তাতে আমরা ধরেই নিচ্ছি যে সংক্রমণটা ছড়িয়ে যাবে বা গেছে। এটা আর কয়েকদিন পর থেকেই বোঝা যাবে।
এই অধ্যাপক মনে করেন, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে লকডাউন বা বিধিনিষেধই একমাত্র সমাধান না। তাই লকডাউনের সাথে আরেকটি বিষয় যোগ করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘শুরু থেকেই আমরা এটা অবহেলা করে এসেছি। সেটা হচ্ছে মানুষকে মাস্ক পরতে বাধ্য করা। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বাধ্য করা। এটা করতে পারলে এতদিনে সংক্রমণটা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব ছিল। লোকাল সংক্রমণটাও বন্ধ করা যেত।’
বিশেষজ্ঞ বলছেন, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে লকডাউন আরোপ করাই একমাত্র সমাধান না। এজন্য প্রত্যেক উপজেলাসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতেও ব্যাপকহারে পরীক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। টিকাদান কর্মসূচিকে আরো বেগবান করতে হবে।
সেইসাথে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা নিশ্চিতের জন্য এখনই হাসপাতালগুলোতে কোভিড শয্যা বাড়ানোর ব্যবস্থা নেয়া ও পর্যাপ্ত অক্সিজেন ও জরুরি ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছেন তারা।
এদিকে কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে সরকারি অভিযানের অংশ হিসেবে আগামী বছরের মধ্যে দেশের ১৭ কোটি জনসংখ্যার ৮০ শতাংশকে টিকা দেয়ার সময়সীমা নির্ধারণ করেছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা. খুরশিদ আলম বলেন, আমরা ২০২২ সালের মধ্যে দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশকে টিকা দেয়ার পরিকল্পনা করছি। আগামী বছরের জুন মাসের মধ্যে বাংলাদেশ প্রায় ১৪ কোটি টিকা ডোজ কিনতে যাচ্ছে। অন্যদিকে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য পরবর্তী মাসগুলোতে প্রয়োজনীয় বাকি টিকা সংগ্রহ করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
কোভিড-১৯ এর সংক্রান্ত জাতীয় প্রযুক্তিগত উপদেষ্টা কমিটি (এনটিএসি) সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, প্রতি মাসে দেশের এক কোটি মানুষকে টিকা দিতে হবে। যার অর্থ প্রতিদিন চার লাখ মানুষ টিকার সুবিধা পাবে। দ্রুত টিকাকরণ সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার উভয়েই হ্রাস করবে।