অবহেলাতেই রয়ে গেল চামড়া শিল্প

মাহমুদ সালেহীন খান

প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০২১, ০৫:০১ পিএম

চামড়া

চামড়া

চামড়া বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানি খাত। এ শিল্পের ওপর ভর করে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় নয় লাখ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে। তবে বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এ শিল্প ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। চামড়া শিল্প থেকে রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে না। কোরবানির ঈদকে ঘিরে চামড়ার একটি বড় লেনদেন হয়ে থাকে; কিন্তু গত কয়েক বছর ধরেই কোরবানির পশুর চামড়ার দাম কমছে। ন্যায্যমূল্য না পেয়ে অনেককে চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলতে দেখা গেছে। এতকিছুর পরও মূল্য বিপর্যয় থেকে উত্তরণের জন্য কোনো ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। এবারও অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ী চামড়া কিনে ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করতে না পারায় সর্বস্বান্ত হয়েছেন।

বাংলাদেশে ২০১৬-১৭ সালকে চামড়াবর্ষ হিসেবে সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়েছিল; কিন্তু চামড়া শিল্পের পতন সেই সময় থেকেই শুরু। এক যুগ আগেও ছোট আকৃতির গরুর চামড়ার দাম ছিল ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা। মাঝারি আকারের চামড়ার দাম ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা এবং বড় সাইজের চামড়ার দাম ২ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকা। এখন সেই চামড়া আকৃতিভেদে বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ৬০০ টাকায়। কোরবানির চামড়ায় ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার এই দায় প্রতি বছর ট্যানারি মালিক ও চামড়া পণ্য রফতানিকারকদের নিতে হচ্ছে। তবে অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক বাস্তবতায় স্বস্তিতে নেই চামড়াশিল্পের মালিকরাও। তাদেরও মোকাবেলা করতে হচ্ছে প্রতিকূল পরিস্থিতি।

বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বাজার ইতালি, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন, রাশিয়া, ব্রাজিল, জাপান, চীন, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র। রফতানির বড় বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো; কিন্তু ইউরোপে রফতানির জন্য ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড অর্গানাইজেশনের (আইএসও) সার্টিফিকেট প্রয়োজন।

থাকতে হয় লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজি) নামে ইউরোপের আরেকটি শক্তিশালী সংস্থার পরিবেশ স্বীকৃতির সনদও; কিন্তু ট্যানারিশিল্পের সামগ্রিক উৎপাদন-প্রক্রিয়াটি পরিবেশগত সমস্যা থেকে মুক্ত হতে না পারায় এর কোনোটিই নেই বাংলাদেশের রফতানিকারকদের। যদিও এই স্বীকৃতি সনদ পেতে আবেদন করা হয়েছে সেই ২০১৭ সালেই; কিন্তু সবুজ পরিবেশে উৎপাদন মানদ-ে সন্তোষজনক অবস্থানে না থাকায় সাড়া পাওয়া যায়নি এই আবেদনে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, ‘আইএসও ও এলডব্লিউজি কমপ্লায়েন্ট সার্টিফিকেট না পাওয়ার কারণে এখন ওই সব দেশে বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য ঢুকতে পারছে না। কেউ কেউ চীন, তাইওয়ান, কোরিয়া ও ইতালির মতো কয়েকটি দেশে এখনো রফতানি চালিয়ে যাচ্ছে। তবে সেখানে পাওয়া যাচ্ছে না পণ্যের প্রত্যাশিত দাম। সংকটের মূলে রয়েছে এই দুটি সংস্থার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না পাওয়া। তিনি দাবি করেন, এটি যত দিন আমরা না পাচ্ছি, তত দিন চামড়াশিল্পে স্থিতিশীলতা আসবে না। দেশেও চামড়ার প্রকৃত মূল্য নিশ্চিত করা যাবে না।

এই স্বীকৃতি পাওয়ার উপায় কী, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সাভারে আমাদের যে শিল্পনগরী, তা পুরোপুরি সম্পন্ন হয়নি। কারণ শিল্পনগরীতে সিইটিপি হয়েছে। ডাম্পিং ইয়ার্ডও হয়েছে; কিন্তু এখনো সলিড ওয়েস্ট ডেস্ট্রয় ম্যানেজমেন্টের কোনো স্থায়ী সমাধান হয়নি। এটিই আইএসও ও এলডব্লিউজির স্বীকৃতি না পাওয়ার অন্যতম কারণ। একে পরিপূর্ণ করার উদ্যোগ সরকার বা বিসিককেই নিতে হবে।

এলডব্লিউজির সনদ পেতে ১৩৬৫ নম্বরের মান যাচাই প্রক্রিয়া হয়। এর মধ্যে বিসিক অর্জন করেছে মাত্র ২০০ নম্বর। যেখানে ১০০ নম্বর সিইটিপি দিয়ে, বাকি ১০০ নম্বর ডাম্পিং ইয়ার্ড দিয়ে। অবশিষ্ট ১১৬৫ নম্বর এখনো বিসিক ও ট্যানারি মালিকদের অর্জন করতে হবে। 

এ দিকে আন্তর্জাতিক বাজারে এখন প্রক্রিয়াজাত প্রতি বর্গফুট চামড়ার দাম যেখানে ৫ দশমিক ৫০ থেকে ৬ দশমিক ২০ মার্কিন ডলার অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় ৪৬৭ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ৫২৭ টাকার মধ্যে, সেখানে বাংলাদেশি রফতানিকারকরা দেড় থেকে ২ ডলার বা ১২৭ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১৭০ টাকা পর্যন্ত দাম পাচ্ছেন পরিবেশগত সার্টিফিকেট না থাকার কারণে। অর্থাৎ রফতানিকারকরা আন্তর্জাতিক বাজার থেকে পণ্যের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না।

অবশ্য রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) জানিয়েছে, বেশ কয়েক বছর পর চামড়া রফতানিতে প্রবৃদ্ধিতে ফিরেছে বাংলাদেশ। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করে ৯৪ কোটি ১৬ লাখ ডলার আয় হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৮ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। তবে এ প্রবৃদ্ধি সংকট উত্তরণের কোনো ইঙ্গিত নয় বলে মনে করেন বেসরকারি আর্থিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, চামড়া রফতানিতে আয় বাড়ছে বলে যে দাবি করা হচ্ছে, তার নেপথ্যে এই মুহূর্তে দেশীয় চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের ভূমিকা নেই। এই আয় বাড়ার নেপথ্যে রয়েছে কিছু রফতানিকারক কর্তৃক বিদেশি চামড়া আমদানি করে তা দেশীয় ট্যানারিতে পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে মূল্য সংযোজন ঘটিয়ে পুনরায় রফতানির উদ্যোগ।

লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এলএফএমইএবি) সভাপতি মো. মহিউদ্দিন আহমেদ মাহিন বলেন, চামড়াশিল্পের সুদিন ফেরাতে এবং টেকসই করার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ক্রেতা আকৃষ্ট করতে আইএসও এবং এলডব্লিউজির সনদ প্রাপ্তি ছাড়া এই মুহূর্তে কোনো বিকল্প আমাদের হাতে নেই। তিনি আরও বলেন, আমাদের রফতানিতে যেতে হলে এবং ইউরোপের মতো বড় বাজার ধরতে হলে যে কোনোভাবে এই সনদ অর্জন করতে হবে। এই সনদ পেতে মালিকরা যে কোনো কাজ করতে প্রস্তুত; কিন্তু তার আগে তো এই শিল্পনগরীকে আন্তর্জাতিক মানে রূপ দিতে হবে। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক আবু ইউসুফ বলেন, চামড়া বিপর্যয় মাথায় রেখে বাংলাদেশকে দুটি কাজ করতে হবে। যেমন কাঁচা চামড়ার চোরাচালান বন্ধ, চামড়ায় মূল্য সংযোজন ও বাজারজাত করার নীতি নেওয়া। এ দুটি কাজ করা গেলে আগামী চার থেকে পাঁচ বছর চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রফতানি কমপক্ষে ১০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে পারবে বাংলাদেশ। অর্থাৎ বর্তমানের প্রায় ১০ গুণ! এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চামড়া পণ্য উৎপাদকদের ‘রফতানি গিল্ড’ গঠন করা অত্যন্ত জরুরি। এরা নিম্নতম মূল্য নির্ধারণ করে দেবে। যেনতেন মূল্যে চামড়া বিক্রয়ের রাস্তা থেকে সরে আসাই হবে এই খাতের মূল লক্ষ্য। কস্ট ম্যানেজমেন্ট করে ৬০ থেকে ৭০ সেন্টে চামড়া বিক্রি করাকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

চামড়াপণ্য উৎপাদনকারী, ট্যানারি মালিক ও আড়ত মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিন বছর ধরেই দেশে চামড়ার দাম কম। রেওয়াজ অনুযায়ী, প্রতি বছর ঈদুল আজহার সময় ট্যানারি মালিকরা আড়ত মালিকদের পুরনো বকেয়া শোধ করেন, যা দিয়ে চামড়া কিনে আবার ট্যানারি মালিকদের দেন আড়তদারেরা। অথচ দাম না পেয়ে দেশের মানুষ চামড়া ফেলে দিচ্ছে। বিপরীতে দেশে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আমদানি হয়েছে প্রায় ৯৪৫ কোটি টাকার বিদেশি চামড়া। কেন এই আমদানি? কারণ, চামড়াশিল্প নগর পরিবেশবান্ধব না হওয়ায় বিদেশি বড় ব্র্যান্ড বাংলাদেশি চামড়ার তৈরি পণ্য কেনে না। এ কারণে অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের মতো বড় প্রতিষ্ঠান বিদেশ থেকে চামড়া এনে তা দিয়ে পণ্য তৈরি করে রফতানি করে।


সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh