করোনার বর্জ্যে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি

কে এম ওবায়দুল্লাহ

প্রকাশ: ৩০ জুলাই ২০২১, ০৪:৪০ পিএম

যত্রতত্র পড়ে আছে করোনা বর্জ্য

যত্রতত্র পড়ে আছে করোনা বর্জ্য

নির্জীব, চলৎশক্তিহীন ও সর্বংসহা মনে হলেও প্রকৃতি আসলে তা নয়; বরং বিজ্ঞ বিচারক। কারও অণু পরিমাণ অপরাধও সহ্য করে না প্রকৃতি। হাজার বছর পরে হলেও চুকিয়ে নেয় পুরনো হিসাব। আবারও দেয়ালে ঠেকেছে পিঠ, তাই বিদ্রোহে নেমেছে প্রাণ-প্রকৃতি। বঞ্চনার বদলা নিতে যেন ব্যবহার করছে আদিম দুনিয়া থেকে বের করে আনা প্রাচীন অস্ত্র, নাম যার করোনাভাইরাস। লক্ষ বছর তারা ঘুমিয়ে ছিল হিমবাহের নিচে কিংবা পারমাফ্রস্টের (জমে যাওয়া মাটি) স্তরে স্তরে। হামলে পড়ছে নিয়ন্ত্রকদের ওপর। মুখের হাসি কেড়ে নিয়ে পুরো বিশ্বকে আটকে দিচ্ছে বন্দিশালায়। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হচ্ছে লাশের সারি। এই অস্ত্রের সঙ্গে কোনো পরিচয় নেই আধুনিকের। তাই নিজেকে ঢেকে রেখে কোনো রকমে বাঁচার লড়াইয়ে মানুষ। করোনা প্রতিরোধে পরছে সার্জিক্যাল মাস্ক, গ্লাভস, গগলস আরও কত কী। বাইরে বেরোলে গায়ে জড়াচ্ছে সুরক্ষা পোশাক বা পিপিই। এসব সামগ্রীও ধীরে ধীরে হয়ে উঠছে আত্মঘাতী। 

কোনো প্রাণীই নিজের বসবাসের জায়গাকে ক্ষতি করে না। উল্টো বাঁচিয়ে চলে সেখানকার পরিবেশ; কিন্তু আমরা আমাদের বাসস্থান, এই ধরণির সঙ্গে বিরাট প্রশ্ন চিহ্ন জুড়ে দিয়েছি। তৈরি করে চলেছি বর্জ্যরে পাহাড়। পৃথিবীর শরীর তাই আজ ভাঙতে বসেছে! চলমান মহামারিতে যত্রতত্র ফেলা মাস্ক, গ্লাভস, পিপিই বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে চলে যাচ্ছে ড্রেনে। আর ড্রেন থেকে নদী ও সাগরের তলদেশে গিয়ে বিনষ্ট করছে জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ। বিজ্ঞানীদের ধারণা, গত বছর প্রায় ১৫০ কোটি মাস্কের ঠাঁই হয়েছে সাগরে। এসব সুরক্ষাসামগ্রীতে থাকা বিভিন্ন উপাদান পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। সাগরে বাস করা প্রাণিদের জন্যও বিপজ্জনক। এখনো যদি উদ্যোগ না নেওয়া হয়, ভবিষ্যতে মানুষের বাসস্থানই ধ্বংসের সম্মুখীন হবে।

করোনা প্রতিরোধে রাস্তায় নাগরিকদের মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেছে সরকার; কিন্তু ব্যবহৃত সুরক্ষাসামগ্রী ফেলার নির্দিষ্ট কোনো ব্যবস্থা নেই। হাসপাতালগুলোতেও নেই করোনা বর্জ্য শোধনের ব্যবস্থা। তাই ফুটপাতসহ নগরীর অলি-গলিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে নানা কোভিড-বর্জ্য। বাড়ছে সংক্রমণ ঝুঁকি। নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকেই। অবশ্য কর্তৃপক্ষের দাবি, মূলত রোগী কিংবা তাদের স্বজনরাই এসব ফেলে যাচ্ছে। বর্জ্য ফেলার নির্দিষ্ট জায়গা থাকলেও, সেখানে ঠিকঠাকভাবে রাখা হচ্ছে না। সময়মতো পরিষ্কারও করা হচ্ছে না সেই আঁস্তাকুড়গুলো। ফলে হাসপাতালের কর্মীরাই সংক্রমণের শঙ্কায় আছেন। অনেকে তো হাসপাতালে এসে কাজ করতেই ভয় পাচ্ছেন।

সম্প্রতি ঢাকা মেডিক্যালসহ রাজধানীর বেশ কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, করোনা ইউনিটের বাইরে কিংবা রাস্তার দু’ধারে যত্রতত্র পড়ে রয়েছে কোভিড রোগীদের জামাকাপড়, মাস্ক, গ্লাভস ও পিপিই। এমনকি হাসপাতাল চত্বরেও পানির বোতল, প্লাস্টিকের ওয়ানটাইম বাটি ও গ্লাস, স্যালাইনের ব্যাগ, সিরিঞ্জ, ওষুধের খালি প্যাকেটসহ ব্যবহৃত নানান মেডিক্যাল-বর্জ্যরে ছড়াছড়ি। হাওয়ায় উড়ে ঘুরছে এদিক-ওদিক। খাবারের সন্ধানে ভাগাড়ের বর্জ্য নিয়ে কুকুরের টানাটানি। তার থেকেই ছড়িয়ে পড়তে পারে সংক্রমণ। শুধু তাই নয়, হাসপাতালের এসব বর্জ্য থেকে কাগজ ও প্লাস্টিক কুড়িয়ে নিচ্ছে টোকাইয়ের দল। খালি হাতেই ময়লার স্তূপের নিচ থেকে বের করে আনছে প্রয়োজনীয় জিনিস। পরে তারা সেগুলো বিক্রি করছে আনন্দবাজার, চাঁনখারপুল ও নিমতলীর ভাঙাড়ির দোকানে। সেখান থেকে ঝুঁকিপূর্ণ এসব পণ্য হাতবদল হয়ে রাজধানীসহ বিভিন্ন জায়গা চলে যাচ্ছে। করোনাকালে যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকির। 

এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘সাধারণত হাসপাতালের বর্জ্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। আর তা যদি হয় করোনায় আক্রান্ত রোগীর, সেগুলো আরও মারত্মক ক্ষতিকর হবে এটাই স্বাভাবিক। আর রাস্তার মধ্যে পড়ে থাকা মাস্ক ও গ্লাভসে থাকা করোনার জীবাণু খালি জায়গায় বেঁচে থাকে দুই-তিন দিন পর্যন্ত। এই বর্জ্যরে দ্রবণীয় ক্ষতিকর পদার্থ নানাভাবে মানুষের, স্থলচর ও জলচর প্রাণির খাদ্যচক্রে প্রবেশ করে। পুরো ব্যাপারটিই মানুষের অসুস্থতা এবং পরিবেশ দূষণের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। তাই এসব বর্জ্যরে ক্ষেত্রে মাটিচাপা কিংবা পুড়িয়ে ফেলতে হয়। তবে মাটিচাপা দেওয়াই উত্তম। নয়তো যে কেউ সংক্রমিত হতে পারে।’

রাজধানীর যে কোনো এলাকার রাস্তা কিংবা অলিগলি ধরে মিনিট কয়েক হাঁটলে দেখা মিলছে, যেখানে-সেখানে পড়ে থাকা মাস্ক। করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে এসব সুরক্ষাসামগ্রী যত্রতত্র ফেলে যাওয়ার অসচেতনতাই বয়ে আনবে বড় ঝুঁকি। হতে পারে অন্যেরও বিপদের কারণ। সেই সঙ্গে পরিবেশের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির ঝুঁকি তো রয়েছেই।

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের গত বছরের একটি জরিপ অনুযায়ী, করোনার সুরক্ষাসামগ্রী থেকে প্রতিদিন ২৮২ দশমিক ৪৫ টন বর্জ্য তৈরি হয়। এর পুরোটাই অপসারণ করা হয় গৃহস্থালী বর্জ্যরে সঙ্গে। আর সারাদেশে সুরক্ষাসামগ্রী ও মেডিকেল বর্জ্যরে মাত্র ৬ দশমিক ৬ শতাংশ সঠিক ব্যবস্থাপনার আওতায় আসছে। বেসরকারি সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনও (এসডো) একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল গেল বছরের মে মাসে। তাদের সেই সমীক্ষা বলছে, একবার ব্যবহৃত দ্রব্য থেকে এক মাসেই দেশে ১৪ হাজার ১৬৫ টন ক্ষতিকর প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়। এর ১২ দশমিক ৭ শতাংশই এসেছে সার্জিক্যাল ফেস মাস্ক থেকে। ওই সময়ে প্রায় সাড়ে ৪৫ কোটি মাস্ক ব্যবহার করা হয়, যা থেকে অন্তত ১ হাজার ৫৯২ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়েছে। অন্য শহরের তুলনায় ঢাকায় এর পরিমাণটা স্বাভাবিকভাবেই অনেক বেশি। এ ছাড়া মোট বর্জ্যরে ২৪ দশমিক ২ শতাংশ ছিল পলিথিনের তৈরি সাধারণ হ্যান্ড গ্লাভস থেকে, ২২ দশমিক ৬ শতাংশ সার্জিক্যাল হ্যান্ড গ্লাভস থেকে এবং ৪০ দশমিক ৮ শতাংশ খাদ্যদ্রব্য বহনে ব্যবহৃত পলিথিনের ব্যাগ। ওই সমীক্ষার এক বছরেরও বেশি সময় পরে এসে জানতে চাইলে এসডোর মহাসচিব শাহরিয়ার হোসেন বলেন, ‘গত এক বছরের কোভিড বর্জ্য নিয়েও আমরা গবেষণা চালিয়েছি। তাতে যে প্রবণতা দেখেছি, দ্বিগুণ বলা যাবে না, তবে আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে।’ 

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘সার্বিকভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়েই রয়েছে আমাদের সীমাবদ্ধতা। তাই কোভিড বর্জ্য নিয়ে জাগছে শঙ্কা। ভাইরাসটি থেকে নিজেদের সুরক্ষায় যেসব সামগ্রী রয়েছে, তা ব্যবহারের পর আলাদাভাবে রাখতে হয়। পাশাপাশি বাসা-বাড়ি থেকে সেগুলো আলাদা করে সংগ্রহ করার কথা। এটা যদি না করা হয়, তবে যারা এই বর্জ্য সংগ্রহ করছেন, তারা সংক্রমিত হবেন। আবার তাদের থেকে হবেন অন্যরা।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘মেডিকেল ও প্লাস্টিক বর্জ্য সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য একটি সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি। এ নিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। ব্যাপকভাবে সচেতন করতে হবে সাধারণ মানুষকে, যেন তারা মাস্ক কিংবা অন্যান্য কোভিড-১৯ বর্জ্য যত্রতত্র না ফেলে আলাদা করে রাখেন। তা না হলে নগরীর পরিবেশ দূষণের সঙ্গে আটকানো যাবে না নগরবাসীর স্বাস্থ্যঝুঁকিও।’

দেশের বিভিন্ন নগরে হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করে প্রিজম বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন। তাদের এক হিসাব বলছে, মহামারির আগে যেখানে ১৪ টন মেডিকেল বর্জ্য উৎপাদিত হতো। বর্তমানে সেটা অর্ধেকে নেমে এসেছে। তবে বর্তমান বর্জ্যরে ৭০ ভাগই কোভিড বর্জ্য। এর কারণ হিসেবে ধারণা করা হচ্ছে, জরুরি অপারেশন কিংবা জটিল সমস্যা ছাড়া এখন অন্য রোগী হাসপাতালে যাচ্ছেন কম। এর বাইরে যারা যাচ্ছেন বেশিরভাগই কোভিড রোগী। 

এদিকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নীতিমালা অনুযায়ী, মেডিকেল বর্জ্যগুলো অটোক্লেভস মেশিনের মাধ্যমে জীবাণুমুক্ত করে তা বায়োহ্যাজার্ড ব্যাগে ভরে রাখার কথা। যদিও অধিকাংশ হাসপাতালই মেডিকেল বর্জ্য জীবাণুমুক্ত করে বায়োসেফটিক্যাল ব্যাগে ভরে রাখছে না। 

মেডিকেল বর্জ্যকে ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনতে ২০০৮ সালে ‘চিকিৎসা বর্জ্য’ (ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ) বিধিমালা করা হয়েছিল। যদিও তা এক যুগেও বাস্তবায়ন হয়নি। ২০১৮ সালের জাতীয় পরিবেশ নীতিতেও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে সব বর্জ্যরে উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি গ্রহণ বাধ্যতামূলক করতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (বর্জ্য ও রাসায়নিক পদার্থ ব্যবস্থাপনা) ড. আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে চিকিৎসা বর্জ্য (ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ) বিধিমালা সংশোধন নিয়ে অধিদপ্তর কাজ করছে।’


সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh