যে কারণে লকডাউনেও বাড়ছে দুর্ঘটনা

বিশেষ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ আগস্ট ২০২১, ০৭:৫০ এএম

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

করোনা মহামারির কারণে গত ১৪ এপ্রিল থেকে সারাদেশে লকডাউন ঘোষণা করে সরকার। এরপরও থেমে নেই সড়ক দুর্ঘটনা। স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় দুর্ঘটনার সংখ্যা কিছুটা কমলেও তাকে আতঙ্কজনক বলছেন গণপরিবহন বিশেষজ্ঞরা। 

তাদের দাবি, অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফলে সড়কে গতি বাড়লেও গতিকে নিরাপদ করতে যেসব কাজ করা দরকার সেগুলো হচ্ছে না। যে কারণেই এমনটা ঘটছে।

এবার ঈদুল আজহায় শহর থেকে গ্রামে যাওয়া এবং ছুটি শেষে শহরে ফিরে আসার সময় সড়ক, রেল ও নৌ-পথে ২৬২টি দুর্ঘটনায় ২৯৫ জন নিহত ও ৪৮৮ জন আহত হয়েছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সমিতির পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। ঈদযাত্রা শুরুর দিন গত ১৪ জুলাই থেকে ঈদ শেষে কর্মস্থলে ফেরা ২৮ জুলাই পর্যন্ত বিগত ১৫ দিনে ২৪০টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৭৩ জন নিহত ৪৪৭ জন আহত হয়েছে। 

প্রতিবেদনে দেখা যায়, বরাবরের মতো এবারো দুর্ঘটনার শীর্ষে রয়েছে মোটরসাইকেল। এবারের ঈদে ৮৭টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৯৩ জন নিহত, ৫৯ জন আহত হয়েছে। যা মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৩৬.২৫ শতাংশ, নিহতের ৩৪.০৬ শতাংশ এবং আহতের ১৩.১৯ শতাংশ। 

দুর্ঘটনার ধরন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মোট সংঘটিত দুর্ঘটনার ৩৩.৩৩ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ৪৩.৩৩ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে, ১৮.৩৩ শতাংশ ফিডার রোডে এবং ০.৮৩ শতাংশ রেল ক্রসিং এ সংঘটিত হয়। এছাড়াও সারাদেশে সংঘটিত মোট দুর্ঘটনার ৩.৩৩ শতাংশ ঢাকা মহানগরীতে, ০.৮৩ শতাংশ চট্টগ্রাম মহানগরীতে সংঘটিত হয়।

লকডাউনের কারণে মানুষের যাতায়াত সীমিত হলেও স্বল্পসময়ের জন্য গণপরিবহন চালু করায় সড়কে গণপরিবহনের পাশাপাশি ব্যক্তিগত যান বিশেষ করে প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেল, অটোরিকশা-ব্যাটারীচালিত রিকশা, ট্রাক-পিকআপ ও কাভার্ডভ্যানে একসাথে গাদাগাদি করে যাতায়াতের কারণে বিগত ৬ বছরের তুলনায় এবারের ঈদে সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহাণি দুটিই বেড়েছে।

সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের জরিপে উঠে এসেছে চলতি বছরের গত জুন মাসে দেশে ৩২৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৯৮ জন মারা গেছেন। আহত হয়েছেন ৪২৩ জন। মে মাসের তুলনায় জুনে সড়ক দুর্ঘটনা কম। মে মাসে ৪৪১ দুর্ঘটনায় ৫৬২ জন মারা যান। গড়ে প্রতিদিন মারা গেছেন ১৮.১২ জন। জুন মাসে প্রতিদিন মারা যান ১৩.২৬ জন। জুন মাসের অর্ধেক সময়জুড়ে এলাকাভিত্তিক লকডাউনে বিভিন্ন জেলা শহরে যানবাহন বন্ধ ছিলো এবং ২৮ জুন থেকে সর্বাত্মক লকডাউনে সারা দেশে গণপরিবহন বন্ধ ছিলো। জরিপে দেখা গেছে, সড়কে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে চরম হুমকি হয়ে উঠেছে মোটরসাইকেল ও ট্রাক। অপ্রাপ্তবয়স্ক ও যুবকদের বেপরোয়া মোটরবাইক চালানোর ফলে তারা নিজেরা দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে এবং অন্যান্য যানবাহনকেও ঝুঁকিতে ফেলছে। তাই পরিস্থিতি বিবেচনায় সড়ক দুর্ঘটনা রোধে একটি সমন্বিত টেকসই উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানিয়েছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন।  

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, দুর্ঘটনা কমানোর জন্য যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার, সরকার এখনো সেটা শুরু করেনি। সহসা শুরু করবে বলেও মনে হচ্ছে না। আমাদের কঠোর আইন আছে, কিন্তু তার বাস্তবায়ন নেই। আমরা মনে করি আইনটা সহজ করে যদি তার কঠোর বাস্তবায়ন হতো, তাহলেও অপরাধ কমতো।

পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক দুর্ঘটনা নির্মূলের জন্য যেসব বিষয় শনাক্ত হয়েছে বা যেসব সুপারিশ দেয়া হচ্ছে সেগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে না। বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াও নেই। সড়ক নিরাপদ করতে যেসব উপাদান দরকার, তার মধ্যে অবকাঠামো উন্নয়ন ছাড়া কিছু হয় না। অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফলে গতি বাড়ছে। কিন্তু গতিকে নিরাপদ করতে যেসব কাজ করা দরকার সেগুলো হচ্ছে না।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, বিগত ঈদগুলোতে সরকারের নানা মহলের তৎপরতা থাকায় দুর্ঘটনার লাঘাম কিছুটা টেনে ধরা সক্ষম হলেও কঠোর লকডাউনের কারণে মানুষের যাতায়াত সীমিত থাকার পরেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারি না থাকায় সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বেড়েছে। লকডাউনে যাত্রীবাহী বড় গাড়ি বন্ধ থাকলেও ছোট গাড়িগুলো বন্ধ হয়নি। তাছাড়া বড় গাড়িগুলো দুর্ঘটনা কম ঘটায়। দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে ছোট গাড়িগুলো বেশি দায়ী। যে কারণে মৃত্যুর মিছিল কমেনি।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদনে সড়ক দুর্ঘটনার বেশকিছু কারণ  চিহ্নিত হয়েছে। দুর্ঘটনা প্রতিরোধে তারা বেশকিছু সুপারিশও করেছে। 

দুর্ঘটনার কারণ  

১. লকডাউনের কারণে যানবাহনের বেপরোয়া গতিতে যাতায়াত।
২. জাতীয় মহাসড়কে রোড সাইন বা রোড মাকিং, সড়কবাতি না থাকা৩. জাতীয়, আঞ্চলিক ও ফিডার রোডে টানিং চিহ্ন না থাকা।
৪. মহাসড়কের নির্মাণ ত্রুটি, যানবাহনের ত্রুটি, ট্রাফিক আইন অমান্য করার প্রবণতা। 
৫. উল্টোপথে যানবাহন চালানো, সড়কে চাঁদাবাজি, পণ্যবাহী যানে যাত্রী পরিবহন ইত্যাদি।

দুর্ঘটনার প্রতিরোধে সুপারিশ 

১. জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে রাতের বেলায় অবাধে চলাচলের জন্য আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা। 
২. দক্ষ চালক তৈরি ও যানবাহনের ত্রুটি সারানোর উদ্যোগ গ্রহণ। 
৩. ধীরগতির যান ও দ্রুতগতির যানের জন্য আলাদা লেনের ব্যবস্থা করা। 
৪. সড়কে চাঁদাবাজি বন্ধ করা, চালকদের বেতন ও কর্মঘন্টা সুনিশ্চিত করা।
 ৫. সড়কে রোড সাইন, রোড মার্কিং স্থাপন করা। 
৬. সড়ক পরিবহন আইন যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা। ট্রাফিক আইনের অপপ্রয়োগ রোধ করা। 
৭. গণপরিবহন বিকশিত করা, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএর অনিয়ম দুর্নীতি বন্ধ করে সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। 
৮. মানসম্মত সড়ক নির্মাণ ও মেরামত সুনিশ্চিত করা, নিয়মিত রোড সেইফটি অডিট করা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh