সেলিম আল দীনের ‘ধাবমান’ মৃত্যুর বিপরীতে জীবনের গল্প

ড. আফসার আহমদ

প্রকাশ: ০১ আগস্ট ২০২১, ১১:২৫ এএম | আপডেট: ০১ আগস্ট ২০২১, ১১:২৬ এএম

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের মৃত্যুর দুঃসহ বেদনা ভার বুকে নিয়ে তাঁর প্রিয় নাট্যদল ঢাকা থিয়েটার মঞ্চে নিয়ে এসেছিল আচার্যের লেখা নাটক ধাবমান। এটিই সেলিম আল দীনের অবর্তমানে ঢাকা থিয়েটারের প্রথম মঞ্চ নাটক ছিল। নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন শিমুল ইউসুফ। এই নাটকে আমরা দেখি সব মানবিক সুখ ও শোকের নূপুরধ্বনির ঝঙ্কার তুলে জীবন ও মৃত্যু একটি রেখায় মিলেছে। আর মৃত্যু যদি এমনই তবে তা সব বেদনা, অভিমান ও শঙ্কার মানবিক বলয়ে বন্দি থাকে কেন? আমি যতবার ধাবমান পাঠ করেছি-ততবারই মৃত্যুভীতি মাড়িয়ে, জীবন যেখানে বিকেলের লাল আলো ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে পরদিনের ভোরের কমলা রোদের অপেক্ষায়; তেমন একটা স্থানহীন স্থানে দাঁড়িয়ে থাকি। এভাবেই আমি ধাবমান নাটকের ষ- মোষ সোহরাবের গল্পের সঙ্গে মানবজীবনের নানামুখী বেদনা বেহাগের সুরের সঙ্গে আত্মলীন মগ্নতায় ডুবে যেতে থাকি। সেলিম আল দীনের ধাবমান নাটকের গল্পের সর্বব্যাপ্ত আবেদনটি অনুভব করার জন্য মানুষের বোধের সমান্তরাল এই ষণ্ড মোষের মানবিক কষ্টকথার খানিকটা তুলে ধরব।

সোমেশ্বরীর পাড়ের কোনো এক গ্রামের দরিদ্র কৃষক নহবতের বাড়িতে জন্ম নেয় একটি মহিষ শাবক। নহবত তার নাম রাখে সোহরাব। মহিষটি সন্তানের যত্নে বেড়ে ওঠে নহবতের ঘরে। এভাবে ক্রমে ক্রমে একটি বলদর্পী ষণ্ড মোষে পরিণত হয় সোহরাব। তার মানব পিতা ভ্রমেও ভাবেনি সোহরাব সন্তান নয়, নিতান্তই পশু। সে নহবতের বিকলাঙ্গ পুত্র এশাকের ভালোবাসা, মমতা ও ঈর্ষার মধ্যদিয়ে এক সঙ্গে বড় হতে থাকে। কিন্তু একদিন এশাক স্বপ্ন দেখে যে এই মোষটিকে খোদার নামে জবাই দিলে তার আরেকটি পা ভালো হয়ে যাবে। সে এই নিদারুণ স্বপ্নকথা শোনালে শুরু হয় নহবতের ভেতরে মানবিক টানাপড়েন। একদিকে পুত্র অন্যদিকে প্রায় পুত্রসম সোহরাব, একটি মোষ। তার কেবলি ভাবনা জাগে মনে আর পীড়িত হতে থাকে এই ভেবে যে, তবে কি শুধু হত্যার নিমিত্তে সোহরাবকে সে পালন করেছে? এভাবে মানুষ পরাজিত হয় আত্মজ প্রীতির অমোঘতার কাছে। কসাইরা একদিন রোরুদ্যমান নহবতের হাত থেকে সোহরাবকে নিয়ে যায়। জবাইকালে কসাইয়ের ধারালো ছুরির নিচ থেকে পালিয়ে যায় মৃত্যুভীত সোহরাব। সে পালাতে থাকে অনিবার্য মৃত্যুর থাবা থেকে দূরে, বহুদূরে। কিন্তু সে পালাতে পালাতে এই ভেবে অভিমানী ও আতংকিত হতে থাকে, যে মানবপিতা তাকে সব বিপদ থেকে এতকাল রক্ষা করেছে, তার অভয় হাত নেমে আসে না আর তার ওপর। তিনদিন তিনরাত প্রাণিটি শ্রাবণের সোমেশ্বরীর পাড়ে আকস্মিক মানব কোলাহলের বন্যা তুলে গ্রাম থেকে গ্রাম এবং হাট বাজার লণ্ডভণ্ড করে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচবে বলে ছুটে চলে দিগ্বিদিক। তার শিঙে-ক্ষুরে খুন হয়েছিল এক কসাই এবং আরও অন্য একজন। তারপর একদিন সেই মোষটি ক্লান্ত এবং অসহায় ফিরে আসে ফেলে যাওয়া সেই গৃহে, যেখান থেকে পালিয়েছিল আর ফিরবে না বলে। সে এক গভীর মানবিক অভিমান যেন সোহরাবের। ঠিকানাবিহীন জীবনে যে মানব গৃহের ছায়াতলে জন্মেছে, বেড়েছে, সেখান থেকে তার মৃত্যু পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ের আটপৌরে আনন্দ-বেদনার ঘটনাগুলোকে নানা প্রাসঙ্গিকতায় একটি সূতোয় বেঁধে অসাধারণ ভাষার যাদুতে পাঠকের নিকট শরীরী প্রতিমায় দাঁড় করিয়েছেন সেলিম আল দীন। আমার বিবেচনায় বাংলা সাহিত্যেই নয় বিশ্বসাহিত্যেও এ ধরনের গল্প বিরল। এই গল্পে মানুষের স্বাভাবিক হত্যা প্রবণতার বিরুদ্ধে মানবিক প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়েছে। ষণ্ড মোষকে মানুষ হত্যা করতে চেয়েছে মাংসের লোভে। অন্যদিকে মোষটি মানুষ হত্যা করেছে অন্যায্য অথচ নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচবে বলে। এভাবেই এই নাটকে মানুষের জন্য আপাতদৃষ্টিতে অপরিহার্য বলে বিবেচিত মহিষ জবাইয়ের কাজটি মানবিকতার বিচারে নৃশংসতা বলে গণ্য হয়। ষণ্ড মোষের জন্য আমাদের বেবাক সহানুভূতি ও সহমর্মিতা উপচে পড়ে।

ধাবমান নাটক না উপন্যাস না আখ্যান সে বিবেচনাকে নাট্যকার নিজে প্রাধান্য দেননি কখনো। বাঙলা নাট্য সাহিত্যের সহস্র বছরের ইতিহাসে গেয় আখ্যান কাব্যের ধারা অনুসারে নির্দিষ্ট আঙ্গিক কাঠামোবিহীন যে ঔপনিবেশিক অবলেশমুক্ত নাট্য রচনার ধারা তৈরি করেছেন সেলিম আল দীন, এটি তারই পরিণত ও সংহত পরিবেশনা। তাই এটিকে ফর্মের বেষ্টনীর মধ্যে ফেলে এর প্রাণ ভোমরাকে শ্বাসরুদ্ধ করতে চাননি নাট্যকার। ধাবমান নাটকের কোথাও তিনি নিজেকে শুধু নাট্যকার বলে দাবি করেননি। বলেছেন গল্পটি ‘হয়তো কোনো এক চারণিক মান্দি কবি সোহরাব বধের প্রত্যক্ষদর্শী অথবা অন্যকোনো ধরনের কোনো কবির কল্পনাজাত গল্প মাত্র।’ শব্দে, বাক্যে এবং ভাষার অনিবর্চনীয়তায় যে দৃশ্যকল্পগুলো তিনি এই নাটকে তৈরি করেছেন তাতে প্রাচ্যের হাজার বছর ধরে প্রচলিত গল্পকথনরীতির রূপ প্রতিমাকে আধুনিক জীবন-যন্ত্রণার সামীপ্যে নিয়ে এসেছেন। সেলিম আল দীন হাজার বছরের সংলাপধর্মী নাট্যরীতির প্রথা ভেঙে এভাবে হয়ে উঠেছেন দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পী। দেশকালহীন, সম্প্রদায়হীন নিখিল বিশ্বের সর্বপ্রাণবাদী ভাবধারায় তিনি হয়ে ওঠেন বিশ্ববিহারি। আর সেখানেই তিনি শিল্পবোধের ক্ষেত্রে সাবলাইমের সাক্ষাৎ লাভ করেন।

ধাবমান নাটকে সেলিম আল দীন গল্প ও জীবনের অনিবার্যতায় মান্দি সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি ও কৃত্যের যে মিশ্রণ ঘটিয়েছেন তাতে সোহরাব এভাবেই মানুষের ঘরে পালিত জীবনের মধ্যদিয়ে ক্রমাগত মানবের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে; দর্পী অথচ অসহায়, ক্রুদ্ধ এবং অভিমানী। মানুষের নির্মমতার বিরুদ্ধে এ যেন এক সর্বপ্রাণবাদী নাট্যকারের আত্মার ক্রন্দনধ্বনি, যেনবা সব মৃত্যুর বিরুদ্ধে ঋকমন্ত্রের জীবনভাষ্য- হোকনা সে পশু- সে যে মানবিক জীবন যাপনের অংশীদার হতে চেয়েছিল।

ধাবমান নাটকে সেলিম আল দীনের ঋষিবাক্য প্রায় বাকপ্রতিমার সমাহার এমন একটি নাটক। এখানে এই নাটকের গল্পের মুখ ফেরানো কতটা ধর্ম কিংবা মিথের দিকে। অথবা এভাবে বলা যায় ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন দেশের মিথ কিংবা গল্প মিশে গেছে ধাবমানের শরীরে। গল্পের পাঠক মানুষ নয়, মোষের প্রতিই করুণাদ্র হয় এই ভেবে যে মানুষের ঘরে পালিত হলো, অথচ স্বাভাবিক মৃত্যুর অধিকার তার হলো না। এ প্রসঙ্গে এই নাটকে মহানবী (সা.) কর্তৃক একটি বৃদ্ধ উটকে মালিকের কাছ থেকে ক্রয় এবং মুক্তি প্রদানের কথা আছে। ধাবমান নাটকের ষণ্ড মোষ সোহরাব, গ্রিক বীর একিলিস, মেঘনাদ কিংবা শাহনামা মহাকাব্যের সোহরাব এক হয়ে যায়। কেননা গুপ্ত ঘাতকের চিরায়ত সুড়ঙ্গ দিয়ে হত্যাকারী তাদের হনন করেছিল। এভাবে এই নাটকে সেলিম আল দীন নাটকের সীমানা ছাড়িয়ে শিল্পের সমগ্রতার অন্বেষণে স্বদেশ ও সমকালকে গল্পের অন্বিষ্টি করেছেন। বাঙালির সহস্র বছরের গল্পকথনের ধারায় সর্বপ্রাণবাদী প্রত্নপ্রতিমার সঙ্গে জীবনের ভাঙন-গড়নের প্রেক্ষাপট আধুনিক এপিক দৃষ্টির সংযোগ ঘটিয়েছেন।

একথা সত্যি যে এই নাটকের রচয়িতা অনবরত ভাঙন-গড়নের ভেতর দিয়ে জীবনকে অবলোকন করেছেন। জীবনের প্রস্ফুটিত পদ্মকোরকের ওপর ভোরের সূর্যালোক তিনি এতটাই প্রবলভাবে অনুভব করেছেন যে পৃথিবীর তাবৎ নৃশংসতার বিরুদ্ধে তিনি জীবনের উত্থানকেই পাঠ করেছেন। একথা এজন্যই বলছি যে, 

মানব জীবন এবং প্রাণি জীবনের প্রতিটি দুঃখ, বেদনা এবং আনন্দের সঙ্গে এই নাটকের চরিত্রগুলোকে তিনি সস্পৃক্ত করেছেন। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় জেনেছি, তিনি মনে করতেন প্রাণিকুল এবং মৎসকুলের জীবনকে মহাকাব্যের প্রেক্ষাপটে উপস্থাপন করে নাটক রচনা করবেন। ধাবমান এবং স্বর্ণবোয়াল নাটক তাঁর এমনি মহৎ প্রয়াসের উদাহরণ। নাটকে বিধৃত বিচিত্র সব চরিত্রের আনন্দ-বেদনার অনুরণন শুনেছি তাঁর কণ্ঠে নাটক পাঠ কালে। আমি দেখেছি যে তাঁর অশ্রু ঝরে পড়ছে মানবিক বেদনায় সোহরাবের জন্য- ভেবে পাইনি তা কি মানবিক বেদনা না কি অনিবার্যতার প্রেক্ষাপটে মানুষের অসহায় ক্রোধের অশ্রুধারা।

সেলিম আল দীন আজ বেঁচে নেই। কিন্তু তাঁর সৃষ্টি তো আছে- তা এত বেশি অমোঘ যে তাঁর রচিত বাক্যবন্ধে মিলিত হয় সহস্র বছরের শিল্পতীর্থগামী মানুষের কলরব। বর্ণনায় দৃশ্যমানতা সৃজনের যে বিস্তৃত আকাশে তিনি গড়েছেন, তার ছাদের নিচে এসে পঙ্ক্তিবদ্ধ হোক শিল্পতীর্থগামী মানুষ। তবে নাটকের সংলাপ রীতির প্রচল ভেঙে তিনি যে হাজার বছরের পথচিহ্ন ধরে শিল্পাভিসারী হয়েছেন এ কথা যেমন সত্যি, তেমনি বাঙালির গেয়কাব্যের আখ্যানধর্মী পরিবেশনা রীতিকেও তাঁর নাটক কিংবা কাব্য যা-ই বলিনা কেন তার বর্ণনার পরতে পরতে উন্মোচন করেছেন।

ধাবমান- নাটকের নির্দেশনায় শিমুল ইউসুফ নাট্যচার্য সেলিম আল দীনের উল্লিখিত শিল্পভাবনার মঞ্চরূপ দিয়েছেন দক্ষতার সঙ্গে। নাটকটির শব্দে, বাক্যে এবং কথনশৈলীর ভেতর দিয়ে সমগ্র গল্পের যেমন শরীরী রূপ ফুটে উঠেছে, তেমনি নাটকের নির্দেশনার মধ্যেও দৃশ্যের চিত্রকল্প এবং চিত্রকল্পের মঞ্চরূপ মূর্ত হয়েছে। ফলে এই নাটকের দর্শক তাই নাটকটি দেখতে দেখতে নাটক পাঠের আনন্দ নিয়েই ঘরে ফিরবেন- নির্দেশকের জন্য এটি নিঃসন্দেহে শ্লাঘ্য। সেলিম আল দীনের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে প্রকাশিত ধাবমান- নাটকের নির্দেশনায় শিমূল ইউসুফ নাট্যকারের বেদনাকে স্পর্শ করতে পেরেছেন একই শিল্পবোধের অনুসারী বলে।

ধাবমানের সোহরাবের মতো সেলিম আল দীনও মৃত্যুর আগে, অপার বেদনায় মুত্যুকে অবিকল্প আকাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভোরের আলোয় কালো ছায়া হিসেবে দেখেছেন? তবে কি তিনিও মৃত্যুপূর্ব সোহরাবের মতো এভাবে বলতে চেয়েছেন-


এই তবে আমার সঙ্গী।

ছায়াভ্রমে যে চলেছে আমার পথেই

গতরে মিলায়ে গা

খুরে শিঙে সমান সমান।

একে আমি পৃথক করব

সুতীক্ষ্ণ শৃঙ্গে

ছিঁড়ে ফেলব তবে

পড়ে থাকবে ছেঁড়া ছায়া

আর আমি চলে যাব

মৃত্যু ছায়াহীন ভূমিদেশ।

হায়, মানুষ কি তা পারে? মানুষ তবু ধাবমান মৃত্যুর বিপরীতে জীবনের ছায়া দেখে, নড়ে চড়ে শূন্যে মিলায়।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh