দারিদ্র্য-প্রতিকূলতা জয় করা বিশ্বসেরা ৮ তারার গল্প

খলিলুর রহমান

প্রকাশ: ০১ আগস্ট ২০২১, ১২:৩১ পিএম

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

ছোটবেলায় অতি দরিদ্র্রতা ও নানা প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে পরবর্তীতে সাফল্যের স্বর্ণশিখরে পৌঁছেছেন, বিশ্ব ইতিহাসে এমন নজির ভুরিভুরি। কর্মক্ষেত্রের সব অঙ্গনেই এমন দৃষ্টান্ত রয়েছে। তবে চরম দারিদ্র্য জয় করে সাফল্যের চূড়ায় ওঠার সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন ফুটবল। বিশ্ব ফুটবল ইতিহাসের সর্বকালের সেরা ফুটবলারদের বেশির ভাগই ছিলেন গরিব ঘরের সন্তান। সর্বকালের সেরা দুই ফুটবলার হিসেবে বিবেচিত ব্রাজিল কিংবদন্তি পেলে এবং আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি ডিয়েগো ম্যারাডোনা যার বড় বিজ্ঞাপন।

দু’জনেই ছিলেন অতি দরিদ্র্র পরিবারের সন্তান। বুট, জার্সি কেনা দূরের কথা, ছোটবেলায় ফুটবল কেনার সামর্থ্যই তাদের ছিল না। পেলে বা ম্যারাডোনার বাবা তাদের ছেলেদের সখ পূরণের জন্য ফুটবল কিনে দিতে পারেননি। দু’জনেরই ফুটবলের প্রথম পাঠ রাস্তায়। চামড়ার বল দিয়ে নয়, দু’জনেই খেলেছেন খড়ের তৈরি বল দিয়ে! ছেঁড়া কাগজ বা পুরনো কাপড়ের টুকরো দিয়ে পুঁটলি বানিয়ে! সেখান থেকেই তারা পৌঁছেছিলেন সাফল্যের স্বর্ণশিখরে।

শুধু অতীতের ছোট্ট ডি মারিয়া সময় পেলেই রাস্তায় ফুটবল খেলতেন। এবং ভালোও খেলতেন। এভাবে খেলতে খেলতেই একদিন স্থানীয় এক ক্লাবের স্কাউট দলের নজরে পড়ে যান। ওই ক্লাবটি তাকে কেনার প্রস্তাবও দেয়; কিন্তু ছোট্ট ডি মারিয়া নিজের দাম হিসেবে টাকা না চেয়ে ৩৫টি ফুটবল চান অনুশীলনের জন্য!

লিওনেল মেসি
ফুটবলপ্রেমীমাত্রই লিওনেল মেসির জীবন কাহিনি জানা। বিশ্বের পত্রপত্রিকায় কতবার যে মেসির ছোটবেলার গল্প, ফুটবলার হিসেবে বেড়ে ওঠার গল্প, বার্সেলোনায় যোগদানের গল্প ছাপা হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। মেসির বাবা হোর্হে মেসি একটি স্টিল কোম্পানিতে চাকরি করতেন। মা সেলিয়া কুচিত্তিনি কাজ করতেন একটি চুম্বক কোম্পানিতে। দু’জনের আয়ে ৬ সদস্যের সংসার কোনোভাবে চলে যেত। তবে সন্তানদের শখ মেটানো বা উন্নতভাবে লালন-পালনের সামর্থ্য তাদের ছিল না।

আর্থিক এই প্রতিকূলতার মধ্যেও মাত্র ৪ বছর বয়সেই স্থানীয় ক্লাব গ্র্যান্ডলি যোগ দিয়ে নিজের অমিয় ফুটবল প্রতিভা জানান দিতে শুরু করেন ছোট্ট মেসি। যেখানে তার কোচ ছিলেন স্বয়ং তার বাবা! এরপর ৬ বছর বয়সে যোগ দেন নিওয়েলস ওল্ড বয়েজ ক্লাবে। এই ক্লাবটির হয়ে গোলের বান বয়ে দিতে থাকেন ছোট্ট মেসি। বলা হয়, মাত্র ৬ বছরেই (১২ বছর বয়স পর্যন্ত) নিওয়েলস ওল্ড বয়েজের হয়ে ‘৫০০’ গোল করে ফেলেন ছোট্ট মেসি!

ছোট্ট মেসির ফুটবল প্রতিভা এবং গোল-দক্ষতায় মুগ্ধ ছিলেন সবাই; কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় অন্যখানে। মাত্র ১০ বছর বয়সেই হরমোনজনিত রোগে আক্রান্ত হন তিনি। হরমোনের ঘাটতির কারণে ছোট্ট মেসি ছিলেন রোগাক্রান্ত। শরীর ছিল লিকলিকে হাড্ডিসার। যেন হালকা বাতাসেই পড়ে যাবেন! এমন রোগাপটকা ছেলে পেশাদার ফুটবলার হবে, এমনটি বিশ্বাস করাও ছিল কঠিন। ছেলের যে চিকিৎসা করাবেন, সেই সামর্থ্যও মেসির বাবার ছিল না। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানা যায়, হরমোনের ঘাটতিজনিত ওই রোগের চিকিৎসার জন্য মাসে অন্তত ১ হাজার ডলার করে লাগবে! এত টাকা মেসির গরিব বাবা-মা পাবেন কোথায়!

নিওয়েলস ওল্ড বয়েজ ক্লাব প্রথমে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, মেসির চিকিৎসার ব্যয়ভার তারা বহন করবে। ছোট্ট মেসির কঠিন রোগের চিকিৎসা তারা করবে; কিন্তু ক্লাবের আর্থিক দৈন্যতার কারণে পরে সেই প্রতিশ্রুতি নিওয়েলস ওল্ড বয়েজ ফিরিয়ে নেয়। ছেলের চিকিৎসা ভাবনায় অথৈ সাগরে পড়ে মেসির পরিবার, এখন উপায়?

ভাগ্যে যার ‘বিশ্বসেরা হওয়া’ লেখা, কোন প্রতিকূলতা তাকে ঠেকিয়ে রাখবে? ভাগ্যদেবীর আশীর্বাদে ঠিক কঠিন ওই সময়েই ছোট্ট মেসির ওপর নজর পড়ে ইউরোপের দেশ স্পেনের বিশ্বসেরা ক্লাব বার্সেলোনার স্কাউট দলের প্রতিনিধিদের। বার্সেলোনার পক্ষ থেকে সরাসরি প্রস্তাব দেওয়া হয় ছোট্ট মেসিকে নেওয়ার।

মেসির বাবা প্রথমেই একটি শর্ত জুড়ে দেন, ছেলেকে তিনি যেতে দেবেন, তবে তার ছেলের চিকিৎসার জন্য বার্সেলোনাকে তহবিল সংগ্রহ করতে হবে। মানে ছেলের চিকিৎসার ব্যয়-ভার বহন করতে হবে। হোর্হে মেসির এই শর্ত মেনেই ২০০০ সালে চরম রোগাক্রান্ত ছোট্ট মেসিকে আর্জেন্টিনা থেকে স্পেনে উড়িয়ে আনে বার্সেলোনা। এই উড়ালের মধ্যদিয়েই খুলে যায় মেসির ভাগ্যের চাকা। উন্নত চিকিৎসার মাধ্যমে হরমোনজনিত সেই কঠিন রোগ থেকেই শুধু মুক্ত হননি মেসি, সময়ের চাকায় চড়ে হয়েছেন বিশ্বসেরা ফুটবলার। কারো কারো মতে তো, মেসিই সর্বকালের সেরা।

ফুটবল পায়ে অবিশ্বাস্য সাফল্য, খ্যাতি, যশ কামানোর পাশাপাশি দু’হাতে কাড়ি কাড়ি টাকাও কামিয়েছেন মেসি। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী গত ৪ বছরেই মেসি ক্লাব বার্সেলোনা থেকে কামিয়েছেন ৫৭০২ কোটি টাকা। ক্যারিয়ারজুড়ে কত টাকা কামিয়েছেন, একমাত্র তিনিই জানেন। ছোটবেলায় যার চিকিৎসা করানোর টাকা ছিল না, সেই মেসিই এখন চলাচল করেন ব্যক্তিগত বিমান নিয়ে। বার্সেলোনায় আলিশান বাড়ি কিনেছেন। জন্ম শহর রোজারিওতে প্রাসাদতূল্য বাড়ি বানিয়েছেন। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডাতেও বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কিনেছেন বলে গুঞ্জন আছে। সম্পদের তালিকায় আছে আরও কত কি!

অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়া
মেসির মতো অ্যাঙ্গেল মারিয়ারও জন্ম রোজারিও শহরে। বয়সে এক বছরের ছোট হলেও ডি মারিয়া মেসির খুব ভালো বন্ধু। আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের হয়ে দীর্ঘদিন ধরে খেলছেন একসঙ্গে। স্বদেশী এই দুই বন্ধুর সঙ্গে আরও একটি বড় মিল, মেসির মতো ডি মারিয়াও দরিদ্র্র ঘরের সন্তান। বরং ছোটবেলায় দারিদ্রের চরম কষাঘাত মেসির চেয়ে ডি মারিয়া আরও বেশি দেখেছেন!

তার বাবা মিগুয়েল এবং দুই বোন ভানেসা ও ইভেলিন কাজ করতেন কয়লা খনিতে; কিন্তু তাদের স্বল্প আয়ে সংসার ঠিক চলত না। অভাব-অনটন সঙ্গী ছিল সব সময়ই। পরিবারের অভাব দূর করার আশায় ছোট্ট ডি মারিয়াও বাবা এবং বোনদের সঙ্গে কয়লা খনিতে কাজে লেগে যান! কয়লা খনিতে কাজ করলেও ফুটবলের প্রতি বিশেষ আসক্তি ছিল ছোট্ট ডি মারিয়ার; কিন্তু তার বাবার পক্ষে ছেলের সখ পুরণের সাধ্য ছিল না। তবে ছোট্ট ডি মারিয়া সময় পেলেই রাস্তায় ফুটবল খেলতেন। এবং ভালোও খেলতেন। এভাবে খেলতে খেলতেই একদিন স্থানীয় এক ক্লাবের স্কাউট দলের নজরে পড়ে যান। ওই ক্লাবটি তাকে কেনার প্রস্তাবও দেয়; কিন্তু ছোট্ট ডি মারিয়া নিজের দাম হিসেবে টাকা না চেয়ে ৩৫টি ফুটবল চান অনুশীলনের জন্য!

সময়ের পরিক্রমায় সেই হত-দরিদ্র্র পরিবারের সন্তান অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়া বর্তমানের অন্যতম দামি ফুটবলার। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন খ্যাতির চূড়ায়। ক্যারিয়ার রাঙিয়েছেন রিয়াল মাদ্রিদ, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মতো বিশ্বসেরা ক্লাবে। বর্তমানে খেলছেন তারকাখচিত পিএসজিতে। খ্যাতি, যশ, সাফল্যের পাশাপাশি কামিয়েছেন কাড়ি কাড়ি টাকা। ছোটবেলার যার বুট কেনার সামর্থ ছিল না, সেই ডি মারিয়াও এখন মেসির মতো ব্যক্তিগত বিমান নিয়ে ঘুরে বেড়ান।

লুইস সুয়ারেজ
চাটাইয়ে শুয়ে লাখপতি হওয়ার স্বপ্ন যে তারা একসঙ্গে দেখেননি, এটা নিশ্চিত। কারণ, তাদের বাড়ি ভিন্ন ভিন্ন দেশে। বয়সেও ফারাক আছে। তবে দারিদ্র্য জয় করে বিশ্বসেরা হওয়াদের তালিকায় মেসির আরও দুই পরম বন্ধুও আছেন-লুইস সুয়ারেজ ও নেইমার।

সুয়ারেজের কথাই আগে বলি। দেশ উরুগুয়েতে সুয়ারেজের বাবা সান্দা দিয়াজ ছিলেন একজন অভিবাসী। করতেন কুলির কাজ। সুয়ারেজরা ছিলেন ৭ ভাই-বোন। কুলির কাজ করে ৯ সদস্যের পরিবার চালানো কতটা কঠিন, সেটি সহজেই অনুমেয়। ছেলে-মেয়েদের কোনো চাহিদাই পূরণ করতে পারতেন না তার বাবা। সখ পূরণ করা দূরের কথা, দু-বেলা দুটো মুঠো খাবারই জুটত না ছোট্ট সুয়ারেজদের।

ঠিক মতো খাবার না পেলেও ছোটবেলাতেই ফুটবলের প্রেমে পড়ে যান সুয়ারেজ। বুট কিনতে না পেরে খালি পায়েই রাস্তায় ফুটবল খেলতেন। যা করতেন ভালোও করতেন। রাস্তায় রাস্তায় খেলেই নিজের অমিয় ফুটবল প্রতিভার জানান দেন। স্থানীয় এক ক্লাবের স্কাউট দলে ডাকও পান; কিন্তু অভাবের ধাক্কায় প্রায়ই উদাসিন থাকতেন! অন্যমনস্ক হয়ে ঘুরে বেড়াতেন! পেটে খাবার না পড়লে কি আর ফুটবল খেলার টান থাকে! 

৯ বছর বয়সে আরও বড় একটি ধাক্কা লাগে। বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটিয়ে আলাদা হয়ে যান তার বাবা-মা। ছোট্ট সুয়ারেজের জীবনে নেমে আসে আরও কষ্ট। এভাবেই গড়াতে থাকে সময়। অভাবের অন্ধকার গলি দিয়ে গড়াতে গড়াতে সুয়ারেজ পা রাখেন ১৫-তে। ভাগ্যদেবীর আশির্বাদে এই ১৫ বছর বয়সেই ঘুরে যায় সুয়ারেজের ভাগ্যের চাকা। চাকাটা ঘুরিয়ে দেয় ‘ভালোবাসা’। হ্যাঁ, ভালোবাসাই পাল্টে দিয়েছে সুয়ারেজের জীবনের চিত্র। চরম দারিদ্রের সঙ্গে লড়াইয়ের মধ্যেই ১৫ বছর বয়সে তার জীবনে আসেন এক নারী। আসলে এক কিশোরী বলাই ভালো। সোফিয়া বালবী নামের ওই কিশোরীর প্রেমে মজে যান সুয়ারেজ।

সোফিয়া বালবীকে সুয়ারেজ এতটাই ভালোবেসে ফেলেন যে, একবার রাস্তায় কিছু কয়েন কুড়িয়ে পান তিনি। সেই কয়েন ভালোবাসার উপহার হিসেবে তুলে দেন প্রেমিকা সোফিয়া বালবীর হাতে। প্রতিদানে সোফিয়া বালবী প্রেমিক সুয়ারেজের জীবনের চাকাটাই পাল্টে দিয়েছেন। সুয়ারেজের উদাসিন মনকে শান্ত করে ডুবিয়ে দেন ফুটবলের প্রতি একনিষ্ঠ ভালোবাসায়। সেই যে শুরু, বছর কয়েকের মধ্যেই সুয়ারেজ পৌঁছে যান খ্যাতির চূড়ায়। উরুগুয়ে জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার পাশাপাশি ডাক পেতে থাকেন ইউরোপের নামিদামি ক্লাবগুলো থেকে। ইউরোপে পাড়ি জমানোর মধ্যদিয়ে গরিব সুয়ারেজ বনে যান কোটিপতি।

আয়াক্স, লিভারপুল, বার্সেলোনার মতো ক্লাবে খেলা সুয়ারেজ বর্তমানে খেলছেন অ্যাতলেতিকো মাদ্রিদে। নিশ্চিতভাবেই ৩৪ বছর বয়সী সুয়ারেজ বর্তমানের অন্যতম সেরা ফরোয়ার্ড। ফুটবল সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছানোর মধ্য দিয়ে চাটাইয়ে শুয়ে লাখপতি নন, সুয়ারেজ এখন হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক! যার সংস্পর্শে জীবনের রঙ পাল্টে যাওয়া, সেই সোফিয়া বালবীর সংস্পর্শ এখনো ছাড়েননি সুয়ারেজ। বরং ২০০৯ সালে সোফিয়াকে বিয়ে করে বেঁধেছেন সুখের ঘর। যে ঘর আলোকিত করেছে তাদের তিন সন্তান-মেয়ে দেলফিনা এবং দুই ছেলে বেঞ্জামিন ও লওতি।

সুয়ারেজ কি নিজ সন্তানদের কাছে নিজের ছোটবেলার অভাবের কথা বলেন? বললে তা নিশ্চয় প্রবল বিলাসিতার মধ্যে বেড়ে ওঠা দেলফিনা, বেঞ্জামিন, লওতিদের কাছে রূপকথার গল্পের মতোই মনে হবে।

নেইমার
দারিদ্র্যের কষাঘাত কাকে বলে, ছোটবেলায় হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন মেসি-সুয়ারেজের আরেক বন্ধু নেইমারও। ব্রাজিল তারকার বাবা নেইমার সান্তোস সিনিয়রও পেশাদার ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নই দেখেছিলেন। স্বপ্ন পূরণের চেষ্টাও করেছেন; কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন। তারকা হয়ে ওঠা হয়নি। বড় ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন শেষ হয়ে যাওয়ায় নেইমার সান্তোস সিনিয়র মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। ভগ্ন মন নিয়েই তাকে নেমে পড়তে হয় কর্ম-যুদ্ধে। সংসার তো চালাতে হবে।

কিন্তু যোগ্যতা বলতে ফুটবলটাই যা একটু খেলতে পারতেন। ফুটবলার হতে চাওয়ায় লেখাপড়া বেশি দূর এগোয়নি। অন্য কাজ করার অভিজ্ঞতাও ছিল না। ফলে, আয়- রোজগার ভালো হয়, এমন কোনো কাজই তিনি খুঁজে পাননি। সংসারের ঘানি টানতে বাধ্য হয়ে নেইমারের বাবা একসঙ্গে তিনটি কাজ খুঁজে নেন। তিনটি কর্মখাত থেকে যা আয় হতো তা দিয়ে কোনো রকমে দু’বেলা দু’মুঠো খাবার হয়তো জুটত। ছেলে-মেয়েদের বাড়তি কোনো সখ পূরণের সাধ্য তার ছিল না। এমনকি ছোটবেলায় আদরের ছেলে নেইমারকে একটি বুটও কিনে দিতে পারেননি তার বাবা!

ছিল না থাকার জন্য ভালো একটি বাড়িও। ছোট্ট একটি রুমে কোনোরকমে গাদাগাদি করে থাকত নেইমারদের পুরো পরিবার। এমনকি তাদের ঘরে বিদ্যুৎও ছিল না। সেই আলোহীন অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরের ছেলেটিই আজকের নেইমার। নিশ্চিতভাবেই বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার। চুক্তি মূল্যের ভিত্তিতে বিশ্ব ফুটবল ইতিহাসের সর্বকালের সবচেয়ে দামী ফুটবলার।

২০১৭ সালের আগস্ট, বার্সেলোনা থেকে তাকে ২২২ মিলিয়ন ইউরো দিয়ে কিনে এনেছে পিএসজি। বাংলাদেশি মুদ্রায় অঙ্কটি ২২৪২ কোটি ৯ লাখ ৮ হাজার ৪০৩ টাকা। ফুটবল ইতিহাসে আর কোনো ফুটবলারই এমন উচ্চমূল্যের চুক্তিতে দলবদল করতে পারেননি। চুক্তি মূল্যে সর্বকালের সবচেয়ে দামী ফুটবলার শুধু নন, বার্ষিক পারিশ্রমিক প্রাপ্তির ভিত্তিতেও বর্তমান বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা নেইমার। শুধু বেতন হিসেবেই ফরাসি ক্লাব পিএসজি থেকে নেইমার বছরে আয় করেন ৩৬ মিলিয়ন ইউরো। বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩৬৩ কোটি ৫৮ লাখ ২২ হাজার ৯৮৪ টাকা। অন্যান্য বোনাস, প্রাইজমানি, ইমেজ সত্ব, বিজ্ঞাপনী চুক্তি মিলিয়ে তার বার্ষিক আয় কত, একমাত্র তিনিই বলতে পারবেন।

কুঁড়ে ঘর থেকে উঠে নেইমার নিজেই যে শুধু দুহাতে টাকা কামাচ্ছেন তা নয়। এক সময় সংসার চালাতে খাবি খাওয়া নেইমার সান্তোস সিনিয়রও বিখ্যাত ছেলের সুবাদে টাকা কামাচ্ছেন দুহাতে। বাবা নেইমার সান্তোস সিনিয়রই যে ছেলে নেইমারের এজেন্ট। নিজের ছেলের এজেন্টগিরি করে এক সময়ের অতি গরিব নেইমার সান্তোস সিনিয়রও এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। বাপ-ছেলে মিলে কত টাকা আয় করছেন, তারাই ভালো জানেন।

গ্যাব্রিয়েল জেসুস
গ্যাব্রিয়েল ফার্নান্দো ডি জেসুস নেইমারেরই স্বদেশী। বর্তমানে ব্রাজিল জাতীয় দলের হয়ে একসঙ্গেই খেলেন। দুই বন্ধুর মধ্যে এর চেয়েও বড়মিল, নেইমারের মতো গ্যাব্রিয়েল জেসুসও অতি দরিদ্র্র পরিবারের সন্তান। বরং নেইমারদের চেয়েও জেসুসদের পরিবারের অবস্থা ছিল বেশি করুণ। নেইমারের বাবা তবু ছেলে-মেয়েদের মুখে দু’বেলা খাবার তুলে দিতে পারতেন, জেসুসদের পরিবারের সেই সাধ্যও ছিল না। পরিবারের ভরণ-পোষণের খরচ মেটাতে তাই সেই ছোটবেলাতেই ছোট্ট জেসুসকে নেমে পড়তে হয় কর্ম-যুদ্ধে। এ কাজ, ওকাজ করে যা আয় করতেন, তুলে দিতেন বাবা-মার হাতে!

২০১৪ সালে পুরো ব্রাজিল যখন ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজন নিয়ে মাতোয়ারা, তখনো কিশোর জেসুস পরিবারের ঘানি টানার কাজে ব্যস্ত। এমনকি বিশ্বকাপ চলার সময়ও কিশোর জেসুস রাস্তা রঙ করার কাজ করেছেন! রঙ তুলি ও রঙের কৌটা হাতে রাস্তা রঙ করার সময় খবরও তিনি। রঙমিস্ত্রির ভূমিকায় সেসময় তার ছবিও প্রকাশিত হয় ব্রাজিলের পত্রপত্রিকায়। পরে তা বিশ্ব গণমাধ্যমেও ছাপা হয়েছে।

সৃষ্টিকর্তার কি আশির্বাদ! নিজ দেশে অনুষ্ঠিত ২০১৪ বিশ্বকাপে রাস্তা রঙ করার কাজ করা জেসুস ৪ বছরের ব্যবধানে ২০১৮ বিশ্বকাপে খেলেছেন ব্রাজিলের বিখ্যাত হলুদ জার্সি পরে! পরিবারের দৈন্যতায় ছোটবেলাতেই কাজে নেমে পড়েন ঠিকই, পাশাপাশি ফুটবলের পাঠটাও নিয়েছেন। আর দশজন ব্রাজিলিয়ানের মতো তার রক্তেও মিশেছিল ফুটবলের নেশা। ছিল সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত অমিয় প্রতিভা। সেই অমিয় প্রতিভার জোরেই চরম দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সাফল্যের ঊর্ধ্বাকাশে।

ফুটবলের শুরুটা তার রাস্তায়। এরপর যোগ দেন স্থানীয় এক অপেশাদার ক্লাবে। সেখান থেকে দ্রুতই ঘুরে যায় তার ভাগ্যের চাকা। ২০১৩ সালে যোগ দেন ব্রাজিলের বিখ্যাত ক্লাব পালেমেইরাসের যুব একাডেমিতে। এই পালমেইরাসের হয়েই ২০১৫ সালে তার অভিষেক হয় পেশাদার ফুটবলের শীর্ষ পর্যায়ে। এরপর কেবলই তরতর করে ওপর থেকে ওপরে উঠে যাওয়া। ২০১৭ সালে পালমেইরাস ছেড়ে পাড়ি জমান ইংল্যান্ডের অন্যতম সেরা ক্লাব ম্যানচেস্টার সিটিতে। এখন ম্যানসিটিতেই আছেন। বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম সেরা এই ক্লাবটির আক্রমণভাগের প্রধান অস্ত্র তিনি।

ক্লাব ক্যারিয়ারে অবিশ্বাস্য সাফল্যের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের গ্রাফটাও দ্রুতই বদলে যায়। ২০১৫ সালে পালমেইরাসের হয়ে শীর্ষ পর্যায়ের ফুটবলে অভিষেক হওয়ার বছরই তিনি জায়গা করে নেন ব্রাজিলের অনূর্ধ্ব-২০ দলে। ব্রাজিলের অনূর্ধ্ব-২৩ দলেও ডাক পান ওই বছরই। ২০১৬ সালেই ডাক পান ব্রাজিলের জাতীয় দলে। দুই বছরের মধ্যেই জাতীয় দলে নিজের জায়গাটা করে পাকা খেলেছেন ২০১৮ বিশ্বকাপে। ক্লাব ম্যান সিটির মতো বর্তমানে ব্রাজিল জাতীয় দলেরও আক্রমণভাগের অন্যতম সেরা অস্ত্র তিনি।

নিশ্চিতভাবেই বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সেরা ফরোয়ার্ডদের একজন গ্যাব্রিয়েল জেসুস। বিশ্বতারকা বনে যাওয়ার সুবাদে কামিয়েও যাচ্ছেন কাড়ি কাড়ি টাকা।

লুকা মড্রিচ
লুকা মড্রিচকে ফুটবলপ্রেমীদের কাছে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। ক্রোয়েশিয়ান মিডফিল্ডার সেই ২০১২ সাল থেকে বিশ্বসেরা রিয়াল মাদ্রিদে খেলছেন। বিগত অনেক দিন ধরেই রয়েছেন দুর্দান্তফর্মে। ৩৫ বছর বয়সী মড্রিচ ক্যারিয়ারের সবচেয়ে আলোকোজ্জ্বল বছরটি কাটিয়েছেন ২০১৮ সালে। রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত ২০১৮ বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়ার মতো দেশকে তুলেছিলেন ফাইনালে। অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্সের সুবাদে জিতেছিলেন টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার সোনার বল।

শুধু তাই নয়। মেসি-রোনালদোর রাজত্বে হানা দিয়ে ২০১৮ সালে ব্যালন ডি’অর, ফিফা বর্ষসেরা এবং উয়েফার বর্ষসেরাসহ বছরের সব ব্যক্তিগত পুরস্কারই জিতেছিলেন লুকা মড্রিচ। বয়স ৩৫ হয়ে গেলেও এখনো পায়ের জাদু ঠিক আগের মতোই আছে। শরীরে দমও আছে আগের মতোই। মাঠে নামলে যেন এতটুকু ক্লান্তিও তাকে ছুঁতে পারে না! এখনো পুরো মাঠজুড়ে দৌড়ে বেড়ান ষাড়ের মতো। নিশ্চিতভাবেই লুকা মড্রিচ বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সেরা মিডফিল্ডার।

কিন্তু জানেন কি, সাফল্যের এই আকাশ ছোঁয়ার আগে লুকা মড্রিচকে কতটা কাঁটা বিছানো কষ্টের পথ পাড়ি দিতে হয়েছে? লুকা মড্রিচের জন্ম ১৯৮৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর। ক্রোয়েশিয়ার জাডারের নিকটবর্তী ভেলেবিত পর্বতমালার পাদদেশে অবস্থিত এক ছায়া-শীতল গ্রামে। থাকতেন দাদার সঙ্গে এক পাথরের তৈরি বাড়িতে; কিন্তু গ্রামের ছায়া-শীতল সেই মনোরম পরিবেশে খুব বেশি দিন থাকতে পারেননি মড্রিচ।

ভাগ্য তাকে মাত্র ৬ বছর বয়সেই গ্রামের সেই মনোরম পরিবেশ থেকে তুলে এনে আঁচড়ে ফেলে এক শরণার্থী শিবিরে। সত্যিই তাই। ৬ বছর বয়সেই ছোট্ট লুকা মড্রিচের আশ্রয় হয় শরণার্থী শিবিরে। ১৯৯১ সালে যুগোস্লাভিয়া প্রজাতন্ত্র থেকে স্বাধীন হওয়ার জন্য যুদ্ধ শুরু করে ক্রোয়েশিয়া। স্বাভাবিকভাবেই লুকা মড্রিচের পরিবার ছিল ক্রোয়েশিয়ার স্বাধীনতার পক্ষে। নিটওয়্যার কোম্পানিতে কাজ করা তার বাবা তো ক্রোয়েশিয়ার সেনাবাহিনীতেও যোগ দেন। 

দেশের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নেওয়ার জন্য চড়া মূল্যই দিতে হয় লুকা মড্রিচদের পরিবারকে। তাদের গ্রামের বাড়িটি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলে যুগোস্লাভিয়ার কেন্দ্রীয় সরকারের সেনাসদস্যরা। পাহাড়ের পাদদেশে গরু চড়াতে যাওয়া তার দাদা লুকাকে পাহাড়ে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। ছোট্ট লুকাসহ তাদের পরিবারের অন্য সদস্যদের আশ্রয় হয় জাডারের নিকটবর্তী শরণার্থী শিবিরের কোলোভারে হোটেলে।

শরণার্থী শিবিরে বসবাস করতে গিয়ে সব রকম কষ্টেরই মুখোমুখি হতে হয় ছোট্ট মড্রিচকে। খাদ্য, বস্ত্র, পানি-জীবন ধারনের জন্য অপরিহার্য এই উপাদানগুলোও সেভাবে পেতেন না। এমনকি শান্তিমতো ঘুমাতেও পারতেন না। প্রায়ই ছোট্ট লুকার ঘুম ভাঙত গুলি-বোমার শব্দে। দুর্বিসহ কষ্টের মধ্যেও ছোট্ট লুকাকে পেয়ে বসে ফুটবলের নেশা। শরণার্থী শিবিরের হোটেলের লনেই অন্য শরণার্থী শিবিরের শিশুদের সঙ্গে মিলে খেলতেন ফুটবল।

হোটেল লন থেকে রাস্তা, রাস্তা থেকে স্কুলের মাঠ-খুদে ফুটবলার মড্রিচের ফুটবল খেলার পরিসর ক্রমেই বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে নেশাও। সেই নেশা ১০ বছর বয়সেই পরিণত হয় স্বপ্নে। ততদিনে যুগোস্লাভিয়া থেকে ক্রোয়েশিয়া স্বাধীন হয়ে গেছে। শরণার্থী শিবির ছেড়ে লুকারাও উঠেছেন নিজেদের বাড়িতে। তো ১০ বছর বয়সেই মড্রিচ কচি হৃদয়ে বুনে ফেলেন স্বপ্নের চারা গাছ- বড় হয়ে একজন নামকরা ফুটবলার হবেন! এই স্বপ্ন বুকে নিয়েই একদিন এক বন্ধুকে নিয়ে চলে যান স্থানীয় এক ফুটবল ক্লাবে ভর্তি হতে। ক্লাবটিতে ভর্তি হওয়ার আশায় ট্রায়ালও দেন ছোট্ট লুকা।

ট্রায়ালে নিজের অমিয় ফুটবল প্রতিভার বার্তা ঠিকই দেন; কিন্তু তারপরও স্থানীয় ওই ক্লাবটি ভেঙে চুরমার করে দেয় ছোট্ট লুকার পেশাদার ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন। কম প্রতিভা সত্ত্বেও তার বন্ধুকে ঠিকই ভর্তি করে নেয় ক্লাবটি; কিন্তু লুকাকে ভর্তি না করে ফিরিয়ে দেয় বাড়িতে। কেন? এই কেন-র পেছনের কারণটা বড়ই নির্মম। যা শুনে ছোট্ট লুকা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। অমিয় ফুটবল প্রতিভা সত্ত্বেও যে লুকাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় শারীরিক অক্ষমতার দোহাই দিয়ে!

ছোটখাটো গড়নের লুকা ছিলেন রোগাক্রান্ত। শরীরটা ছিল লিকলিকে হাড্ডিসার। ‘এই শরীর নিয়ে তুমি ফুটবল খেলতে পারবে না খোকা, তুমি বরং বাড়ি ফিরে গিয়ে অন্য কিছু করো। সেটাই তোমার জন্য ভালো হবে!’-ট্রায়ালের কোচ ঠিক এভাবেই ফিরিয়ে দেন ছোট্ট লুকাকে। কচি বয়সেই সেই কোচের এমন নির্মম উপদেশ ছোট্ট লুকার মনোজগতটাকে যেন ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। বড় ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নটাকে সেখানেই যেন মাটিচাপা দিয়ে হতাশ বদনে বাড়ি ফিরে আসেন লুকা মড্রিচ।

হতাশায়, স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় ছোট্ট লুকা এতটাই ভেঙে পড়েন যে, পরের বছর তিনেক তিনি আর ফুটবল খেলার কথাই ভাবেননি; কিন্তু ভাগ্যে যার বিশ্বখ্যাত ফুটবলার হওয়ার কথা লেখা-তিনি কি ফুটবল থেকে দূরে থাকতে পারেন। ১৩ বছর বয়সে আবার তাই তার ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নটি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। এবং আবারও পেশাদার ক্লাবে গিয়ে ট্রায়াল দেওয়ার মনোস্থির করেন। এবার ঠিক করেন এনকে জাডার নামের এক ক্লাবে ট্রায়াল দেওয়ার। পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে এনকে জাডারের যুব একাডেমীতে ট্রায়াল দেন এবং টিকেও যান। এরপর কেবলই সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে এগিয়ে যাওয়া।

এনকে জাডার থেকে হাজদুক স্প্লিত, সেখান থেকে ক্রোয়েশিয়ার বিখ্যাত ক্লাব ডায়নামো জাগরেব। ডায়নামো জাগরেব থেকে ইংলিশ ক্লাব টটেনহাম। সেখান থেকে ২০১২ সালে যোগ দিয়েছেন বিশ্বসেরা রিয়াল মাদ্রিদে। সেই থেকে গত ৯ বছর ধরেই রিয়ালের মাঝমাঠ মাতিয়ে আসছেন। জায়গা করে নিয়েছেন সময়ের সেরাদের আসনে। খ্যাতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গড়েছেন অর্থ-সম্পদের পাহাড়ও।

ভিক্টর মোসেস
উপরোক্ত ৬ জনের মতো বিশ্বসেরাদের কাতারে হয়তো তিনি নেই। তবে গায়ে বিশ্বতারকার তকমা লাগিয়েছেন অবশ্যই। একজন ফুটবলার হিসেবে ভিক্টর মোসেস সফলদেরই একজন; কিন্তু ছোটবেলায় তাকে এমন একটি ভয়ংকর ও কষ্টের পথ পাড়ি দিয়ে আসতে হয়েছে, যা শুনলে ভয়ে গা শিউরে ওঠে। বর্তমানে প্রতিনিয়তই ফুটবল মাঠ মাতিয়ে চলেছেন নাইজেরিয়ান এই ফুটবলার। অথচ মাত্র ১১ বছর বয়সেই নিভে যেতে পারত তার জীবন প্রদীপ। জীবনের স্বাদ পাওয়ার আগেই নিভে যেতে পারত তার জীবনের আলো।

সত্যিই তাই। ভিক্টর মোসেসদের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। তার বাবা ছিলেন স্থানীয় এক গির্জার যাজক। তা থেকে অল্প সামান্য যা আয় হতো, তা দিয়েই কোনো রকমে চলত তাদের সংসার। ফলে ছেলে ভিক্টরের বাড়তি কোনো সাধ মেটানোর সাধ্য তার বাবা-মায়ের ছিল না। যেমন শত আবদারের পরও ছোট্ট ভিক্টরকে বুট কিনে দিতে পারেনি তার বাবা-মা। ভর্তি করাতে পারেননি কোনো ক্লাবে; কিন্তু ফুটবলের নেশাটা ছ্ট্টো ভিক্টরের মননে এমনভাবে মিশে গিয়েছিল যে, কোনো খামতিই তাকে ফুটবলের বাইরে রাখতে পারেনি। সুযোগ পেলেই ছোট্ট ভিক্টর নিজের ছোট্ট বলটা নিয়ে চলে যেতেন রাস্তায়। একাকীই খেলতেন ফুটবল।

নিয়তির কি খেলা, যে নেশা ছোট্ট ভিক্টরকে পাগল করে তুলেছিল, সেই ফুটবলের নেশাই মৃত্যু থেকে বাঁচিয়ে দেয় ছোট্ট ভিক্টরকে। ধর্মীয় সংঘর্ষের জের ধরে তার বাবা-মাকে হত্যা করা হয়। উগ্রপন্থী দাঙ্গাবাজরা তাদের বাড়িতে ভয়ংকর এক হামলা চালিয়ে নৃশংসভাবে তার বাবা-মাকে হত্যা করে। পাশাপাশি তাদের ঘর-বাড়িও গুঁড়িয়ে দেয় উগ্রপন্থীরা। বাড়িতে থাকলে ছোট্ট ভিক্টরের জীবনও সাঙ্গ হতো। কারণ, উগ্রপন্থীরা তাদের পরিবার ধ্বংস করার নিমিত্তেই নৃশংস ওই হামলা চালিয়েছিল; কিন্তু সৃষ্টিকর্তার পরম আশীর্বাদ, ভয়ংকর ওই হামলার সময় ছোট্ট ভিক্টর ফুটবল খেলতে চলে গিয়েছিল রাস্তায়। ভিক্টরের বয়স তখন মাত্র ১১।

তবে রাস্তায় ফুটবল খেলতে গিয়ে বেঁচে গেলেও ছোট্ট ভিক্টরের জীবননাশের ঝুঁকি ছিলই। সেই ঝুঁকি থেকে বাঁচাতে তাকে তারই এক বন্ধুর পরিবার টানা এক সপ্তাহ লুকিয়ে রাখে! এরপর মানুষের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে ছোট্ট ভিক্টরকে গোপনে দেশ নাইজেরিয়া থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় যুক্তরাজ্যের লন্ডনে! কিন্তু লন্ডনে গিয়ে ইংরেজি না জানা ছোট্ট ভিক্টর থাকবে কোথায়? হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া তার পরিবারের অন্য সদস্যরা যুক্তরাজ্য সরকারের কাছে ছোট্ট ভিক্টরকে আশ্রয় দেওয়ার আবেদন করে। সৃষ্টিকর্তার পরম কৃপায় লন্ডনে এসে এক পালিত বাবার বাড়িয়ে আশ্রয় হয় তার। 

শুধু আশ্রয়ই নয়, ওই পালিত বাবা ছ্ট্টো ভিক্টরকে স্কুলেও ভর্তি করিয়ে দেন ইংরেজি শেখার জন্য। পড়ালেখার পাশাপাশি কসমস ৯০ এফসি নামের এক ক্লাবের হয়ে ফুটবল খেলাও শুরু করেন। ১১ বছর বয়সী একটি ছেলের জন্য জীবনের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ভয়ংকর এই ঝড় সামাল দেওয়া সহজ ছিল না; কিন্তু দৃঢ় মনোবলের অধিকারী ভিক্টর মোসেস শুধু বাবা-মাকে হারানো এবং নিজের জীবনের ঝুঁকির ওই ঝড়ই সামাল দেননি, কষ্টের পথ পাড়ি দিয়ে জীবনকে এগিয়েও নিয়েছেন।

কসমস ৯০ এফসিতে যোগ দেওয়ার পর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এরপর তরতর করে পৌঁছে যান সাফল্যের ঠিকানায়। কসমস ৯০ এফসি থেকে যোগ দেন ক্রিস্টাল প্যালেসের যুব একাডেমিতে। সেটা ২০০২ সালের ঘটনা। ৫ বছর যুব একাডেমীতে খেলার পর জায়গা করে নেন ক্রিস্টাল প্যালেসের মূল দলে। নাইজেরিয়ার মাটিতে ১১ বছর বয়সে যার জীবনের আলো কেড়ে নেওয়ার ঝড় উঠেছিল, সেই ভিক্টর মোসেসের অভিষেক হয় বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফুটবল লিগ, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে! ক্রিস্টাল প্যালেসের মূল দলের হয়ে ৩ বছর খেলে ২০১০ সালে যোগ দেন উইগান অ্যাথলেটিক ক্লাবে। এখানে দুই বছর খেলে ২০১২ সালে নাম লেখান বিশ্বের অন্যতম সেরা ক্লাব চেলসিতে।

এখনো এই চেলসিরই চুক্তিবদ্ধ খেলোয়াড় তিনি। তবে চেলসির খেলোয়াড় হলেও গত ৯ বছরের বেশির ভাগ সময়ই তিনি বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে ধারে খেলেছেন। বর্তমানে যেমন ধারে খেলছেন রাশিয়ান ক্লাব স্পার্তাক মস্কোর হয়ে। চেলসি ছাড়াও খেলেছেন লিভারপুল, ইন্টার মিলানের মতো নামিদামি ক্লাবে। 

ছোটবেলায় জীবন বাঁচাতে দেশ নাইজেরিয়া থেকে পালিয়ে লন্ডনে এলেও ভিক্টর মোসেস জন্মভূমির প্রতি ভালোবাসা ভোলেননি। তাইতো জাতীয় দল হিসেবে নাইজেরিয়াকেই বেছে নেন তিনি। নাইজেরিয়া জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন ২০১৪ ও ২০১৮ বিশ্বকাপ। দেশ নাইজেরিয়ার হয়ে জিতেছেন আফ্রিকান নেশনস কাপের শিরোপাও। ক্লাব ক্যারিয়ারে জিতেছেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ, ইউরোপা লিগের শিরোপা। খেলেছেন উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগেও। সব মিলে ৩০ বছর বয়সী ভিক্টর মোসেসের প্রাপ্তির খাতাটি ভরা। ফুটবল সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে দু’হাতে কামিয়েছেন টাকাও। এখন আর অন্যের আশ্রয়ে নয়, লন্ডনে তার নিজেরই একটি বিলাসবহুল বাড়ি আছে। যেখানে স্ত্রী-সন্তানদের (দুই সন্তান, এক ছেলে, এক মেয়ে) নিয়ে কাটাচ্ছেন বিলাসী জীবন। আছেন সুখেও।

কার্লোস বাক্কা
কলম্বিয়ান এই স্ট্রাইকারের ফুটবলার হওয়ার গল্পটি আরও বেশি বিস্ময়কর। ২০ বছর বয়সেও কার্লোস বাক্কা জানতেন না, তিনি ফুটবলার হবেন! মানে ২০ বছর বয়সেও কার্লোস বাক্কা ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখেননি। ২০ বছর বয়সেও তিনি করতেন বাস গাড়ির হেলপারের চাকরি!

আসলে জীবন নিয়ে স্বপ্ন দেখার জন্যও তো একটি ভিত্তি থাকা চাই। কার্লোস বাক্কাদের পরিবারের সেই ভিত্তিই ছিল না। চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস যাদের, দুবেলা দু’মুঠো খাবার জোটে না, নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, জীবন নিয়ে তারা আবার স্বপ্ন দেখবে কি! কার্লোস বাক্কাও স্বপ্ন দেখেননি। বরং পরিবারকে সাহায্য করতে সেই ছোট্টবেলাতেই বেছে নেন আয়-রোজগারের পথ। নেমে পড়েন কর্ম-যুদ্ধে। কঠোর পরিশ্রম করে যা আয় করতেন, তুলে দিতেন বাবা-মার হাতে।

পরিবারকে আর্থিক সাহায্য করতে নানা রকমের কাজই করেছেন কার্লোস বাক্কা। এমনকি জেলের কাজও করেছেন। জাল দিয়ে সাগরে মাছ ধরে বিক্রি করতেন! তবে অমিয় ফুটবল প্রতিভা ছিল। ফুটবল খেলাটি বড় ভালো বাসতেন; কিন্তু ফুটবলার হিসেবে ক্যারিয়ার গড়বেন, বড় ফুটবলার হয়ে কাড়ি কাড়ি টাকা কামাবেন, এমন স্বপ্ন কখনো দেখার সুযোগই পাননি। তবে অবসর পেলেই ফুটবল খেলতে নেমে পড়তেন এবং ভালোও খেলতেন; কিন্তু ফুটবল নিয়ে সিরিয়াস হননি কখনোই। আসলে কলম্বিয়ার উপকূলীয় শহর পুয়ের্তোতে জন্ম নেওয়া কার্লোস বাক্কা বর্তমানের আয়ের পথ বাদ দিয়ে ভবিষ্যতের আয়ের পথ তালাশ করার সাহসই পাননি; উপায়ও ছিল না। 

কি ভেবে যেন ২০০৬ সালে স্থানীয় অ্যাথলেটিক জুনিয়র ক্লাবে যোগ দেন কার্লোস বাক্কা; কিন্তু যোগ দিলেও অ্যাথলেটিক জুনিয়রের হয়ে খুব বেশি খেলার সুযোগ পেতেন না। কার্লোস বাক্কাও খেলার আশায় বসে থাকতেন না। পরিবারকে সাহায্য করতে তখনও তিনি বাস গাড়ির হেলপারের চাকরি করতেন! তবে পরের বছরই ঘুরে যায় তার ভাগ্যের চাকা। হেলপারের চাকরি ছেড়ে ২০০৭ সালে পুরোপুরি ফুটবলার বনে যান। অ্যাথলেটিক জুনিয়রের হয়ে নিয়মিত ম্যাচ খেলাই শুধু নয়, মাঠে আলোও ছড়াতে শুরু করেন। ফল, দ্রুতই বাড়তে থাকতে কার্লোস বাক্কার পরিচিত, জনপ্রিয়তা। বাড়তে থাকে চাহিদাও। বাড়তে থাকে ফুটবলার হিসেবে আয়- রোজগারও। ২০০৭ সালেই অ্যাথলেটিক জুনিয়র থেকে ধারে খেলতে শুরু করেন অপেক্ষাকৃত নামিদামি, ধনী ক্লাবগুলোতে। যে কারণে হেলপারের চাকরি ছাড়লেও পরিবারকে আর্থিক সাহায্য করতে পারতেন।

এভাবে ২০১১ সাল পর্যন্ত নিজ দেশ কলম্বিয়ার লিগেই খেলেন। ২০১১ সালে পাড়ি জমান ইউরোপে। যোগ দেন বেলজিয়ান ক্লাব, ক্লাব ব্রুজে। সেখান থেকে স্প্যানিশ ক্লাব সেভিয়া। সেভিয়া থেকে যোগ দেন ইতালির বিশ্বখ্যাত এসি মিলানের মতো ক্লাবে। ৩৪ বছর বয়সী কার্লোস বাক্কা বর্তমানে খেলছেন স্প্যানিশ ক্লাব ভিয়ারিয়ালের হয়ে। ক্লাব ফুটবলের পাশাপাশি কলম্বিয়া জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন ২০১৪ ও ২০১৮ বিশ্বকাপ এবং ২০১৫ ও ২০১৬ কোপা আমেরিকায়।

এক সময়ের জেলে, বাসের হেলপার কার্লোস বাক্কা ফুটবলার হিসেবে সফল। নাম কামিয়েছেন অনেক। কামিয়েছেন টাকাও। অভাব কি, সেটি এখন তাদের ঘরে দুরবীন দিয়েও খুঁজে পাবেন না। পাবেন শুধুই বিলাসিতা ও জাঁকজমকের ছোঁয়া।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh