ঢাকামুখী জনস্রোত: বারবার ভুল না হঠকারিতা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ আগস্ট ২০২১, ১২:৩১ পিএম

 গণপরিবহন বন্ধ থাকায় অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে ও পায়ে হেঁটে আসছেন তারা

গণপরিবহন বন্ধ থাকায় অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে ও পায়ে হেঁটে আসছেন তারা

করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে দেয়ে কঠোর বিধিনিষেধের পাঁচদিন বাকি থাকতেই কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত হলেও বন্ধ ছিলো দূরপাল্লার সব ধরনের যানবাহ ৷ কারখানার পক্ষ থেকেও কোনো যানবাহনের ব্যবস্থা করা হয়নি৷ তাই পায়ে হেঁটে, ভ্যান ও রিকশায় করে যে যার মতো ফিরছিলেন৷ ফেরিঘাট আর সড়কে ঢাকামুখী পোশাক কর্মীদের যেন মিছিল নামে৷ এমন চিত্র নতুন নয়। ২০২০ সালের মার্চে যখন প্রথমবার বিধিনিষেধের ঘোষণা হলো তখন শুরুতেই মানুষ ছুটে গ্রামে। ঢাকায় থাকার অনিশ্চয়তা, করোনা সংক্রমণ বিষয়ে তথ্য না জানা-সব মিলিয়ে ঢাকা ত্যাগকেই একমাত্র উপায় হিসেবে বিবেচনায় নেয় তারা। এরপর অন্তত পাঁচবার তারা যাওয়া আসার মধ্যেই থাকলো। প্রত্যেকবারই গণপরিবহন না থাকায় ব্যাপক হারে গাদাগাদি করে ট্রাকে-ফেরিতে ছুটলো মানুষ। এর মধ্যে বড় অংশই ভোগান্তির শিকার হয়েছে গার্মেন্টস বন্ধ আর খোলার সিদ্ধান্ত নিয়ে দোলাচলের কারণে। 

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুরু থেকে এই যাওয়া-আসা ঠেকাতে না পারার কারণে পুরো দেশ সংক্রমিত হয়েছে। তারা বলছেন, একবার দুইবার হলে বোঝা যায় অভিজ্ঞতা না থাকায় সামলাতে ব্যর্থ হচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু একই ভুল বারবার হলে ধরে নিতে হবে যারা সিদ্ধান্তগুলো নিচ্ছেন তারা জানেনই না তারা কী চান।

শিল্পপ্রতিষ্ঠান খোলার ঘোষণায় গ্রাম থেকে ফিরতে শুরু করেছেন বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা। কঠোর বিধিনিষেধে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে ও পায়ে হেঁটে আসছেন তারা। আবার অনেকে পিকআপ ভ্যানে ও ট্রাকে চড়েও আসছেন। শনিবার (৩১ জুলাই) হাজার হাজার শ্রমিকের ভোগান্তির পরে সন্ধ্যায় ঘোষণা আসে রবিবার বেলা ১২টা পর্যন্ত গণপরিবহন থুলে দেয়ার।

যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, গার্মেন্টস মালিকরা কারখানার আশেপাশের শ্রমিকদের দিয়ে ‘আপাতত’ কাজ চালানোর শর্তে কারখানা খোলার কথা বলছে। কেবল এইবার না, ২০২০-এর এপ্রিলে একইভাবে টেনে আনা হয়েছিল শ্রমিকদের। সেবার বিজিএমইএ-বিকেএমইএ ঘোষণা দেয়, কাজ হবে নির্ধারিত কিছু বিভাগে। অবশিষ্ট কারখানাগুলো খোলা হবে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন ধাপে। তবে, কারখানার মালিকরা চাপ না দিলেও চাকরি হারানোর আশঙ্কা কাটাতে কাজে যোগদানের উদ্দেশ্যে গ্রামে অবস্থানকারী প্রায় সব শ্রমিকই ঢাকামুখী হয়। 

এ বছর ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহায় ঢাকার বাইরে যেতে নানাভাবে নিরুৎসাহিত করা হলেও ঈদের ছুটি শেষ হলেও গাদাগাদি করেই ঢাকায় ফিরেছে মানুষ। নৌ ও সড়ক পথে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করেই হাজারো মানুষকে রাজধানী ছেড়ে গেছে এবং ফিরে এসেছে। দূরপাল্লার পরিবহন বন্ধ থাকলেও নানা যানবাহনে ভেঙে ভেঙে ঢাকায় ফিরছে তারা। ফলে চাইলেও শারীরিক দূরত্ব বা স্বাস্থ্যবিধি মানতে পারছে না অনেকে।

শ্রমিকদের কারখানায় আসার জন্য বিজিএমইএ’র সদস্যভুক্ত কোনো মালিক বাধ্য করছেন না বলে শনিবার জানিয়েছেন সংগঠনটির সভাপতি ফারুক হাসান। তিনি বলেন, ‘কারখানা চালু করতে সব শ্রমিকের প্রয়োজন হয় না। আপাতত, ঈদের ছুটিতে যারা বাড়িতে যায়নি এবং যারা স্থানীয় শ্রমিক তাদের দিয়ে কারখানা চালু করা হচ্ছে। তবে শ্রমিকরা হয়তো নিজ থেকে আসা শুরু করেছে।’ 

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ একদিন আগে বলেছে, ৮০ ভাগ শ্রমিকই চলে এসেছে৷ যারা চলে এসেছে তাদের দিয়েই পোশাক কারখানা চালু করা হবে৷ যারা আসতে পারবে না তাদের চাকরি যাবে না৷ খোলা হবে ঢাকার আশপাশের কারখানা৷ বিজিএমইএর সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম দাবি করেন, ঈদের ছুটিতে এবার শ্রমিকরা বাড়ি যায়নি৷ যারা গেছে তারা এরইমধ্যে চলে এসেছে৷ ২০ ভাগের মতো শ্রমিক বাড়িতে আছে৷ তাদের যে শনিবারের মধ্যে আসতে হবে তা নয়৷ লকডাউন শেষে আসলেও চলবে৷

জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনও বলেছেন শ্রমিকরা না আসতে পারলে তাদের চাকরি যাবে না৷ কিন্তু বাস্তবে পরিস্থিতি উল্টো৷ ফিরে আসা পোশাক শ্রমিকরা বলেন, তাদের ফোন করে এবং মেসেজ দিয়ে তাদের কারখানা থেকে বলা হয়েছে শনিবারের মধ্যে আসতে হবে৷ রবিবার থেকে খোলা৷ না আসতে পারলে চাকরি থাকবে না৷

জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, বিজিএমইএ অসত্য কথা বলছে৷ ঈদের ছুটিতে শতভাগ শ্রমিক গ্রামের বাড়িতে গেছেন৷ তারা এখন খোলার খবরে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন৷ আগে কোনো শ্রমিক ঢাকা আসেননি৷ তাদের চাকরির ভয় দেখিয়ে এই লকডাউনের মধ্যেও আসতে বাধ্য করা হচেছ৷ কিন্তু তাদের জন্য কোনা ধরনের যানবাহনের ব্যবস্থা করা হয়নি৷

তিনি আরো বলেন, পোশাক শ্রমিকরা বিপাকে পড়ে আমাদের ফোন করছেন৷ কিন্তু আমরা তাদের জন্য কিছুই করতে পারছি না৷ তারা অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করে কর্মস্থলে ফিরছেন৷

বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, শ্রমিকরা যেভাবে গিয়েছেন সেভাবেই ফিরছেন৷ তারা দুই ঈদেই এরকম করেছেন৷ এই ঈদে তাদের বাড়ি না যেতে বলা হয়েছিলো৷ কিন্তু তারা গিয়েছেন৷ এখন খোলার খবর পেয়ে ছুটে আসছেন৷ তবে কেউ আসতে না পারলে চাকরি যাবে না৷ আমরা চাইনা যে এই ভাবে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে কেউ আসুক৷

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রবিবার থেকে পুরো স্বাস্থ্যবিধি মেনেই পোশাক কারখানা চালু হচ্ছে৷ ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট-এর কারণে আমরা আরো বেশি সতর্ক থাকব৷

বাংলাদেশে সাড়ে চার হাজারের মতো পোশাক কারখানায় ৪০ লাখেরও বেশি শ্রমিক কাজ করেন৷ যাদের অধিকাংশই নারী৷ এই শ্রমিকরা এখন ছুটছেন গণপরিবহন বিহীন লকডাউনের মধ্যে৷

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ লেলিন চৌধুরী বলেন, বারবার একই রকম ভুল করা থেকে বোঝা যায়, যারা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তারা কী চান জানেন না। যে কারণে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে বারবার বদলাচ্ছেন। এখন যে বিধিনিষেধ চলছে সেটা শুরুর আগে বলা হয়, এবার আক্ষরিক অর্থে কড়াকড়ি লকডাউন হবে। কিন্তু সেটা শেষ না হতে গার্মেন্টস মালিকদের আবদার পূরণে কারখানা খুলে দেয়া হলো। খোলা হলো বটে, কিন্তু কোনো যানবাহন না থাকায় আবারো বিপাকে পড়লো শ্রমিকরা। তারা যে যেভাবে পারলো আসতে শুরু করলো আগের মতোই। মানে হলো, যারা কাজটা করছেন তারা নিজেদের কাজটা জানেন না। সরকারের মধ্যে সমন্বয়হীনতা পরিলক্ষিত হচ্ছে এবং চূড়ান্তভাবে মুনাফার কাছে মানুষকে বলি দেয়া হচ্ছে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh