ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০১ আগস্ট ২০২১, ০২:৫২ পিএম
প্রতীকী ছবি
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শেষ হওয়া নিয়ে মাস দুয়েক আগে আশার আলো দেখিয়েছিলেন বিশেষজ্ঞেরা। বলেছিলেন, করোনার ডেলটা ভ্যারিয়েন্টেই বিপদের শেষ। এরপরে ক্ষমতা কমতে শুরু করবে ভাইরাসের।
কিন্তু সে আশায় জল ঢেলে দিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। তাদের দাবি, ডেলটা আসলে বিশ্বের উদ্দেশে এক ‘সতর্কবার্তা’। এর পরে মিউটেশন ঘটিয়ে আরো ভয়ানক স্ট্রেন তৈরি করতে পারে করোনাভাইরাস।
পাশাপাশি নতুন কোনো ধরন আসার আগেই করোনা সংক্রমণ দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে বলেও সতর্ক করেছে সংস্থাটি।
মহামারি শুরুর পর থেকে করোনার ধরনগুলোর মধ্যে ডেলটা সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে। এটি আগের যেকোনো ধরনের চেয়ে অনেক বেশি সংক্রামক বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
১৩২টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট। যুক্তরাষ্ট্রে নতুন করে সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে এর জেরে। পশ্চিম এশিয়ায় চতুর্থ ঢেউ আছড়ে পড়ার অন্যতম কারণ ডেলটা। চীনে নতুন করে সংক্রমণ বেড়েছে। দেশটির ১৪টি প্রদেশে ছড়িয়ে পড়েছে ডেলটা ধরন। অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম বড় শহর ব্রিসবেন ও কুইন্সল্যান্ড প্রদেশের একাংশে লকডাউন জারি করা হয়েছে। দেশের উপ-প্রধানমন্ত্রী স্টিভেন মাইলস জানিয়েছেন, তিনদিনের জন্য সম্পূর্ণ গৃহবন্দি থাকতে হবে লাখ লাখ বাসিন্দাকে।
ডেলটা ধরনের বিস্তারের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে করোনার চতুর্থ ঢেউ দেখা দিতে পারে বলে হুঁশিয়ার দিয়েছে ডব্লিউএইচও। এই দেশগুলোতে টিকা প্রয়োগের হার খুবই কম এবং মধ্যপ্রাচ্যের ২২টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে ১৫টিতে ডেলটা ছড়িয়ে পড়েছে বলে উল্লেখ করেছে সংস্থাটি।
তিউনিসিয়াসহ উত্তর আফ্রিকার অনেক দেশেই করোনাভাইরাসের কারণে প্রতিদিনই মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। এসব দেশ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে রীতিমতো লড়াই করছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, চিকেন পক্সের মতো ছোঁয়াচে ডেল্টা স্ট্রেনটি। একজন সংক্রমিতের থেকে নিমেষে ৮-৯ জনের শরীরে তা ছড়িয়ে পড়তে পারে।
অতিসংক্রামক স্ট্রেনটি সম্পর্কে ডব্লিউএইচও’র জরুরি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রক বিভাগের প্রধান মাইকেল রায়ান বলেন, ডেল্টা হচ্ছে আসলে একটা সতর্কবার্তা। সবাইকে সতর্ক করে দেয়া যে, ভাইরাস তার ভোল বদলাচ্ছে এবং এটাও মনে করিয়ে দেয়া যে আরো ভয়ানক ভ্যারিয়েন্ট তৈরি হতে পারে।
ডেলটা ধরনের ভয়াবহতা অনেক বেশি হলেও তা নিয়ন্ত্রণে সামাজিক দূরত্ব, মাস্ক পরিধান ও বারবার হাত ধোয়ার মতো বিষয়গুলো এখনো কার্যকর বলে জানিয়ে রায়ান আরো বলেন, এই সুরক্ষা ব্যবস্থাগুলো ডেলটা ধরনের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। টিকা নেয়া থাকলে এগুলো আরো কার্যকর হচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক তেদ্রস অ্যাধানম গেব্রিয়েসুস এতে যোগ করেছেন, এখনো পর্যন্ত চারটি ‘ভেরিয়েন্ট অব কনসার্ন’ তৈরি হয়েছে। ভাইরাসটি যত ছড়াবে, এ রকম উদ্বেগ করার মতো ভ্যারিয়েন্ট আরো তৈরি হবে।
পুরো বিশ্বকে ছয়টি অঞ্চলে ভাগ করে পর্যালোচনা চালায় ডব্লিউএইচও। করোনা সংক্রমণ পুনরায় বিশ্বব্যাপী বৃদ্ধি পাচ্ছে- সংস্থাটি এ ঘোষণা দিয়ে বলেছে, সংস্থার ছয়টি অঞ্চলের মধ্যে পাঁচটি অঞ্চলে গত ৪ সপ্তাহে সংক্রমণ গড়ে ৮০ শতাংশ বেড়েছে। ডেলটা ভ্যারিয়েন্টের কারণে এই সংক্রমণ লাফিয়ে দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
রায়ানের বক্তব্য, ডেল্টার প্রকোপে বেশ নড়বড়ে অবস্থা হয়েছে কিছু দেশের। কিন্তু তাতেও তারা যথেষ্ট সতর্ক করতে পারেনি বাসিন্দাদের। সংক্রমণ রুখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করতে এখনো ব্যর্থ বেশ কিছু দেশ। পারস্পরিক দূরত্ববিধি মানা হচ্ছে না। লোকজন মাস্ক পরছেন না। স্যানিটাইজার ব্যবহার, হাত পরিষ্কার রাখা, হাওয়া চলাচলের ব্যবস্থা কম এরকম বদ্ধ ঘরে বেশিক্ষণ না-থাকা, ভিড়-জটলা এড়িয়ে যাওয়া- এর কোনোটার উপরেই জোর দেয়া হচ্ছে না।
রায়ানের কথায়, টিকাকরণে কাজ দিচ্ছে। টিকা নেয়া থাকলে বাড়াবাড়ি কম হচ্ছে। কিন্তু এটাও মাথায় রাখতে হবে, ভাইরাস একটা ফিল্টার পেয়ে গিয়েছে। সংক্রমণের গতি আরো বাড়িয়েছে ভাইরাস। আমাদের যে ‘গেম প্ল্যান’ রয়েছে, সেটা কাজ দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সেটা দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। বরং আগের থেকে আরো গতি বাড়াতে হবে টিকাকরণের।
বিশ্বে টিকার সমবণ্টনের উপরে বারবার জোর দিচ্ছে জাতিসংঘ। কিন্তু তা যে হচ্ছে না; যা নিয়ে উদ্বিগ্ন তারা। বিশ্বে এ পর্যন্ত কোভিড টিকার ৪০০ কোটি ডোজ প্রয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু এর বেশিটাই গিয়েছে ধনীদের ঘরে।
বিশ্ব ব্যাংকের হিসেব বলছে, উচ্চ আয় সম্পন্ন দেশগুলোতে ১০০ জনের মধ্যে ৯৮টি ডোজ বিতরণ করা হয়েছে। এদিকে ২৯টি দ্ররিদ্র (কম-আয়) দেশে এই হার প্রতি ১০০ জনে ১.৬ ডোজ। আয়ের ভিত্তিতে দেশগুলোর শ্রেণিবিভাগ করেছে বিশ্ব ব্যাংক। দেশগুলোর মধ্যে টিকাদানের এই অসমতাকে ‘নৈতিক অনাচার’ বলে উল্লেখ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
এই পরিস্থিতিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আবেদন, সেপ্টেম্বর মাস শেষ হওয়ার মধ্যে সব দেশকে অন্তত ১০ শতাংশ বাসিন্দার টিকাকরণ শেষ করতে হবে। ২০২২ সালের মাঝামাঝির মধ্যে ৭০ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান তেদ্রসের আক্ষেপ, লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে। কিন্তু লক্ষ্যে পৌঁছতে অনেকটা পথ হাঁটা বাকি!
উচ্চ ও নিম্ন আয়ের উভয় দেশই ডেলটা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, টিকাদানে বৈষম্য রেখে, ব্যাপক লোককে টিকাদানের আওতার বাইরে রেখে আরো বিপর্যয়ের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।