খুনি

নাহিদা আশরাফী

প্রকাশ: ০২ আগস্ট ২০২১, ১২:৫৮ পিএম

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

গল্পটা ঠিক কীভাবে শুরু করলে বেশ গোছানো হবে অথবা গল্পটি কীভাবে শুরু করলে আপনারা সহজে ধরতে পারবেন বুঝতে পারছি না। পাখি ধরা কঠিন; কিন্তু বাগানের ফুলটা? ওর তো ডানা নেই, ওকে ধরা কঠিন কিছু নয় নিশ্চয়ই। তাই না? এ গল্পে ডানা আছে। সত্যি আছে। অতএব, অখণ্ড মনোযোগ না পেলে গল্প কিন্তু উড়ে যেতে পারে। তখন আবার আমাকে দুষবেন না। স্থির হোন। দেখবেন গল্প ঠিক আপনার কাঁধে হাত রেখেছে। 

গল্পটা বলা খুব প্রয়োজন, অন্তত আমার জন্য। আজ প্রায় দশ দিন ধরে আমি গল্পটা বলব বলে ভীষণ রকম প্রস্তুতি নিয়েছি। ভাবছেন কী এমন গল্প যার জন্য একেবারে দশ দিন ধরে প্রস্তুতি নিতে হবে। তাই তো! কী এমন গল্প? গল্প যেমনই হোক আমার দশ দিন ধরে নেওয়া প্রস্তুতিতে আপনাদের দশ মিনিটের মনোযোগ তো চাইতেই পারি। মানে যারা পড়বেন আর কি। পড়বেনই যখন; আপনার অতি গুরুত্বপূর্ণ মস্তিষ্ক যখন খাটাচ্ছেনই তখন সঙ্গে পূর্ণ মনোযোগ স্থাপন করুন। এই যে ব্রেনের ইনভেস্টমেন্ট তা পুরোপুরি উঠে আসবে। ইনিভেস্টমেন্ট উইদাউট বেনিফিট; পুঁজিবাদী এই সমাজ আপনাকে মেনে নেবে? না। নেবে না। অতএব, বি এটেনটিভ। 

গত ১০ দিন আগে আমি একটা মানুষ খুন করেছি। সরি সরি। একটু ভুল হলো। একটা নয়। দুটি এবং এটাই সত্যি- এই বাক্যটা দিয়েই গল্প শুরু করা যেত কিন্তু সমস্যা হলো এটা আজকাল আর অতটা ক্যাচি বাক্য নয়। আজকাল সকালবেলা কারওয়ান বাজারে গিয়ে আলু ফুলকপি কেনার জন্য দরদাম করা আর ভাড়াটে খুনির সঙ্গে মানুষ খুন করার জন্য দরদাম করার মধ্যে খুব একটা পার্থক্য আছে বলে মনে করছে না এই জাতি। যে সময়ের যে বাতাস; কিন্তু শুরুই বা করব কী দিয়ে? সত্যিটা যেহেতু বলতেই চাই এত ভনিতারই বা কী দরকার। আমি তো পল্টনে রাস্তা ব্লক করে ভাষণ দিচ্ছি না কিংবা সাহিত্য সভায় কোনো প্রভাবশালী কবি অথবা লেখকের গুণগান গাইছি না যে এত ভনিতার ভেতর দিয়ে আমাকে যেতে হবে। আমি যা করেছি তাই খুব অকপটে স্বীকার করে যাচ্ছি। বরং আপনাদের উচিত আমাকে মাথায় করে রাখা। অথবা কোন জাদুঘরেও ঠাঁই হতে পারে আমার। কারণ এত নিখুঁতভাবে খুন করেছি যে, পুলিশ অবধি এক্সিডেন্ট ভেবে বসে আছে। পুলিশ যেখানে মামলা প্রায় ডিসমিস করে দিয়েছে সেখানে আমার স্বীকারোক্তি দিয়ে নিজেকে খুনি উপস্থাপনের বিষয়টি; কিছুটা আলাদা না? বাদ দিন। মূল কথায় আসা যাক। 

মানুষটা দেখতে শুনতে ভালোই ছিল। প্রথম দিন দেখেই মনে হলো সুন্দর এক ব্লু কোরাল সাপ। হ্যাঁ, সত্যি! বিশ্বাস করুন। আর এই মনে হওয়াটাই আমাকে বাধ্য করলো তার প্রেমে পড়তে। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার মাথা ভর্তি চুল আর অপূর্ব দুটি পায়ের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ছেলেদের পা এত সুন্দর হবার কোনো দরকার নেই, তবু তার পা সুন্দর। আমি দূর থেকে দেখি। এ ঘরের সিমেন্ট পলিস মেঝেটার দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মেঝেটাকে হঠাৎই পদ্মবিলের ঘোলা জলের দিঘি মনে হয়। আর মানুষটা যখন খাটে বসে পা দোলাতে থাকে, তখন মনে হয় পদ্মবিলে দুটি পদ্ম বাতাসে আনমনে দুলছে। চুলগুলো দেখলে মনে হয় রাজশাহীর কোনো সিল্কের দোকান থেকে অর্ডার করা। স্পেশাল রেশমের মথ দিয়ে তৈরি এই চুল একটা একটা করে যত্ন নিয়ে কোন রেশম শিল্পী মানুষটার মাথায় লাগিয়ে দিয়েছে। এত উপমার ঘনঘটা দেখে আশা করি আপনাদের বুঝতে বাকি নেই, আমি মানুষটার প্রেমে পড়েছি এবং বেশ শক্তপোক্তভাবেই পড়েছি। যদিও আমি অন্যের হয়ে গেছি বহু আগেই। অদ্ভুত একটা ব্যাপার খেয়াল করেছেন? কী সাবলীলভাবে, যার ঘরে আমি দশ বছর পার করে ফেলেছি তাকে অন্যমানুষ বলছি। আর দিন দশেকের দেখা মানুষটাকে আপন মানুষ ভাবছি। প্রেমে পড়লে এমনি হয়। আকাশকে বাড়ির ছাদ আর বাড়ির ছাদকে খাঁচা মনে হয়। যাই হোক, ঘরের মানুষটাকে অন্য মানুষ ভাবতে কষ্ট না হলেও বাচ্চা দুটির কথা ভেবে বুকটা দুমড়েমুচড়ে যায়। অপরাধবোধ হয়। ওদের কাছে আমি কতটা আশ্রয়ের তা তো বুঝি; কিন্তু সব বোঝাবুঝি থেমে যায় রাজশাহী সিল্কের চুল আর পদ্ম পা ওয়ালা মানুষটাকে দেখে। আমার সম্পর্কে তার ইচ্ছে, মতামত কোনো কিছু না জেনেই দুম করে প্রেমে পড়ার মতো বয়সও তো আমার নেই; কিন্তু বিজ্ঞানের এত উন্নতির পরও মানুষ দুটি জিনিসকে আয়ত্বে আনতে পারেনি। এক দাবানল আর দুই হচ্ছে মন। আর সেই দাবানল যদি মনের বনে লাগে তো কী হতে পারে ভাবুন। অষ্টপ্রহর দশদিকে আপনি শুধুই আগুন জ্বলতে দেখবেন। আমার অবস্থাও তাই। ওহ আপনাদের বলা হয়নি, আমার ঘরের মানুষটা আর এই মানুষটা আবার জানেজিগার দোস্ত। অন্যের বেলায় শান্তা-কান্তার বাবা বাইরে যেয়ে কথা বলে নয়তো বারান্দার এক চিলতে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে কথা বলে। শুধু এই মানুষটা এলেই তার আচরণ পালটে যায়। আবারও খেয়াল করুন এবার মানুষটাকে সম্বোধন করলাম শান্তা-কান্তার বাবা বলে। ভালোবাসা ভালো বাসা অব্দি এলে আমরা আপনজনকে অন্যের সম্পর্কের সূত্র ধরে ডাকি অথচ আশা করি মানুষটা আমার থাকবে। হয় তা! 

ঘটনার শুরু মাস ছয়েক আগে। সম্ভবত কোনো এক শুক্রবার। দু’চারদিন এদিক ওদিক, শনি বা বৃহস্পতিবারও হতে পারে। ভাতঘুম দুপুরে হালকা একটু ঝিমুনি এসেছিল। ভেজানো দরজাটা মুখে না মনে হ্যাঁ টাইপের শব্দ করতেই বুঝলাম কেউ একজন ওর গায়ে খুব সাবধানে হাত রেখেছে। শান্তা-কান্তা পাশের বাড়িতে খেলতে গেছে। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখি আমার পদ্মপুরুষ একটা মেয়েকে নিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। 

মেয়েটাকে দেখে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। আরে! এই মেয়ে কেন তার সঙ্গে? বিদ্যাময়ী গার্লস স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী, বাবা মুসতাক মিয়া সাত্তার ইলেকট্রনিকসের মেকানিক। মেয়েটার নামও শুনেছিলাম। অধিক উত্তেজনায় ভুলে গেছি, কিছুতেই মাথায় আনতে পারছি না। সে যাক, মেয়েটিকে নিয়ে সে খাটে বসল। হালকা গল্প, রসিকতা করার চেষ্টা করছিল। মোবাইলে কী যেন জোর করে মেয়েটাকে দেখাচ্ছে আর মেয়েটা অনিচ্ছায় এদিক-ওদিক মাথা দোলাচ্ছে। এরপর মেয়েটার কানে কানে কী একটা বলাতে মেয়েটা কাঁদতে শুরু করতেই অনেকটা জোর করে বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হলো। এরপরের গল্প মোটামুটি কমন। শুরু হলো ব্ল্যাকমেইল। কখনো আমার ঘরের মানুষটা, কখনো আমার পদ্মপুরুষ। এই একটাই মেয়ে তা কিন্তু নয়। আরও কয়েকটি মেয়েকে আনা হতো। দু’একজন ছাড়া অন্য কাউকেই চিনতাম না। বোবা বলে এই দুই জানেজিগার দোস্ত আমাকে গোনাতেই ধরতো না। এই দেখুন কথায় কথায় বলতেই ভুলে গেছি আমি কিন্তু বোবা। 

সম্ভবত বছর ছয়েক আগে বা তারও কিছু আগে, ঠিক মনে নেই। আমার ঘাড়ে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হলো। ঘুরতে গেলেই মট করে শব্দ হয়। আমাকে তিনি হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। মেয়েটিকে সেদিনই প্রথম দেখি। স্কুল ড্রেস পরা মেয়াটা বাবার হাত ধরে নাচতে নাচতে স্কুলে যাচ্ছে। একটা ছটফটে প্রজাপতি যেন। ফ্রক আর বেণির পাখা ওকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সকালের রোদ মেয়েটার ফ্রকেও এক মায়াসময় এঁকে দিয়েছে। এই দৃশ্যটাই মাথায় বড়শির মতো গেঁথে গেল। গেল তো গেল। আর সরে না। কী একটা নামে মেয়েটিকে ডাকছিল বাবা। মনোযোগ দেবার আগেই আমাকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো। আর কী অদ্ভুতভাবে মেয়েটিকে দেখার পর থেকেই আমার ভেতরে মাতৃত্বের এক তীব্র হাহাকার জেগে উঠল। মেয়েটির অই ছোট ছোট আলো ফেলা ফ্রক, বিনুনি, ছোট ছোট পা ফেলায় পৃথিবী দুলেছিল কিনা জানি না আমি দুলে উঠেছিলাম। আমার নানারকম ইনভেস্টিগেশন চলে আর আমি ভাবি লেবার রুমে শুয়ে আছি। একটু পরেই ঠিক ওরকম একটা প্রজাপতি আমার কাছে এনে বলবে, ‘দেখুন মাশাআল্লাহ আপনার মেয়ে কত সুন্দর হয়েছে। ’ খুবই হাস্যকর চিন্তা। অন্তত আমার জন্য। 

আরেকটি মেয়েকেও চিনতাম। আমাকে নিয়ে শান্তা-কান্তার বাবা নিউমার্কেটের একটা দোকানে গিয়েছিলেন। তার উল্টোপাশের দোকানটাতেই মেয়েটা সম্ভবত বিয়ের শপিং করছিল। দোকানী অনেকগুলো লাল খয়েরী কাতান নিজের গায়ে বিচিত্র ভঙ্গিমায় পেঁচিয়ে মেয়েটিকে কনভিন্স করার চেষ্টা করছিল। ছেলেদের এই কসরত দেখলে আমার কেন যেন হাসি পায়। যদিও বুঝি এই হাসি পাওয়াটা অন্যায়। প্রোডাক্ট সেল এর জন্য সেলসম্যান মরিয়া হবে এটাই তো স্বাভাবিক। আমার তো মাঝেমধ্যে মনে হয় আমরা সবাইই সেলসম্যান। যে যার মতো প্রোডাক্ট বেচতে চাই। তেমন করে ভাবলে আমি নিজেও একটা প্রোডাক্ট, আবার আমি যার প্রোডাক্ট সেও অন্যের প্রোডাক্ট, সে আবার অন্য কারও। এভাবেই তো। সবাই সেলসম্যান, সবাই প্রোডাক্ট। ধুর! মূল প্রসঙ্গ রেখে আবারও অন্যদিকে। এত বাঁকবদল কেন করছি, কে জানে? আর হলেই বা দোষ কী? কথা তো নদীর মতো। বয়ে যাবার পথ পেলে নানানদিকেই বইতে পারে। যা বলছিলাম, মেয়েটির কথা। একটু বাদেই দেখলাম, মেয়েটি গাল ফুলিয়ে দোকানের গ্লাসডোর ঠেলে বাইরে এসে দাঁড়াল। যা বুঝলাম মেয়েটি বিয়েতে লেহেঙ্গা বা অই জাতীয় কিছু একটা পড়তে চায়। আর ছেলেটি শাড়ির জন্যই পীড়াপীড়ি করছে। একটু বাদে দেখলাম ছেলেটি একটা লাল রঙের কাতান প্যাকেট করে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। মেয়েটার চোখ দুটি এত সুন্দর যে ছলছলে চোখ দুটিকে আমার ফ্লোরিডার গিনিস উইংস হৃদ মনে হলো। আমি নিশ্চিত কোকাকোলা কোম্পানি এই মেয়ের চোখের জলের সন্ধান পেলে কষ্ট করে আর এই হৃদ অবধি যেতো না। এই মেয়ের চোখের পিছে দৌড়াত। এই মেয়েটির ওপরেও কী নির্মমতা চলেছে, আমি দেখেছি। কিছুদিন পর মেয়েটির আসা বন্ধ হয়ে গেল। তারও বেশ কিছুদিন পরে বিছানায় রাখা পেপারে মেয়েটির খণ্ডবিখণ্ড লাশের ছবি দেখার সঙ্গে দেখেছি দুই বন্ধুর ক্রুর নীরব হাসি। 

আচ্ছা একটু পেছেন ফিরে দেখুন তো আমি গল্পের প্রসঙ্গান্তরে চলে গেছি কিনা। ঘাড় ঘুরিয়ে যে দেখবো তারও উপায় নেই। দুটি ভেইনই নাকি ছিঁড়ে ফানাফানা। আমি তো মৃত্যুর বুকে ঝাপিয়ে পড়েই তাকে সহ মরতে চেয়েছিলাম; কিন্তু এখনো কেন বেঁচে আছি সেটাই আশ্চর্য। হয়তো আর কয়েক সেকেন্ড, মিনিট বা ঘণ্টা। যাই হোক সময় হাতে বেশি নেই। তাই গল্পটি শেষ করে যেতে চাই। 

এখন খুনের গল্পটা বলি। খুনের পরিকল্পনাটা আমি সেদিনই করি যেদিন আমার সেই প্রজাপতি মেয়েটি ঘরের ল্যাড়বেড়ে সিলিং ফ্যানটার সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করলো। মেয়েটাকে ঘরে আটকে রেখে বাইরে কী একটা আনতে গিয়েছিল আমার পদ্মপুরুষ। এর মধ্যেই মেয়েটা অঘটন ঘটিয়ে ফেললো। আমি না কিছু বুঝলাম না প্রতিরোধের সুযোগ পেলাম। তার আগেই সব শেষ। এরপর থানা, পুলিশ যা হয় আর কি। ধরে নিয়ে গেল কান্তা, শান্তার বাবা আর পদ্মপুরুষকে। আমি মহা খুশি যদিও তা উপরে দেখাতে পারছি না; কিন্তু আমার সেই খুশি স্থায়ী হলো না। মাত্র এক মাসের মাথায় দুই বন্ধু টেলিভিশনে ক্যাডবেরি ফাইভ স্টারের রমেশ আর সুরেশ, এই দুই ভাইয়ের মত একে অপরের গলায় হাত দিয়ে এসে হাজির। তার চেয়েও অবাক হলাম যখন দেখলাম মধ্যরাতে এক পেটমোটা টাকওয়ালা লোক এলো আর দুই বন্ধু গোটা দুই বোতল আর এক নারীকে উপঢৌকন হিসেবে তাকে দিয়ে দু’জনই বেরিয়ে গেল। ওপর থেকে আমি সবই দেখলাম; কিন্তু এরা তো আমাকে হিসেবেই ধরে না। বরং তাদের সেবার জন্য আমাকেই নিয়োগ করে গেল। আমি বাধ্য। কই যাব? আমার তো যাবারও কোনো জায়গা নেই। 

যাই হোক। মনে মনে ফন্দি আঁটতে লাগলাম। একটা উপায় কেমন করে বের করা যায় তাই শুধু ভাবতে থাকি দিনরাত। সুযোগটা দুম করেই এসে যায়। কয়েক দিন ধরেই ঘাড়ের ব্যথাটা বেশ ভোগাচ্ছিল। শোল্ডার একেবারে ফ্রিজ হয়ে যায় অবস্থা। জয়েন্টে এত ব্যথা যে খুলে আসতে চায় যেন। একদিন এই অসুস্থতার কারণেই তার জানেজিগার দোস্তকে সেবা করতে কিঞ্চিৎ দেরি হয়েছিল। এইবার আরেকবার আপনাদের মনোসংযোগে বিঘ্ন ঘটাব। কথা দিচ্ছি এবারই শেষ। খেয়াল করেছেন? এবার আমার পদ্মপুরুষকে আমি সম্বোধন করলাম শান্তা-কান্তার বাবার জানেজিগার দোস্ত হিসেবে। মানে সম্পর্কটা এখন শান্তা-কান্তার বাবা হয়ে তার বন্ধু অবধি গিয়ে ঠেকেছে। আসলে অজান্তেই আমাদের মন ও মস্তিষ্ক এইসব সম্পর্কগুলোকে কার্যকারণের নানান সূত্রে ও ছাঁচে ঢেলে গলিয়ে নেয়। 

বলেছিলাম এটাই শেষ। আর ডালপালা নয়, মূল কথা এখনই বলব। আমারও আর সময় নেই সম্ভবত। মিনিট দশেক আগে আমার ডাক্তাররা আমাকে মৃত ঘোষণাও করে ফেলেছে। 

যা বলছিলাম, এই সেবাপ্রদানের দেরিতে ক্ষিপ্ত হয়ে শীতল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে শান্তা-কান্তার বাবা তার জানে জিগার দোস্তকে বললেন, রদ্দি মাল, আর কত সার্ভিস দেবে বল। ভাবিস না, চেঞ্জ করে ফেলব।’ শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। আমার সঙ্গে এতদিনের সম্পর্ক সে এক মুহূর্তে শেষ করে দিলো! মুহূর্তেই আমি অকেজো মাল! এমন করে বলতে পারলো! মানছি আমি বোবা। দেখতে অসুন্দর; কিন্তু এসব দেখেই তো আমাকে এনেছিল সে। তবে? তার মানে তুমি মানুষই হও আর মেশিন, এই বাজার অর্থনীতিতে তোমার কোনো মূল্যই নেই যদি তুমি প্রোপার সার্ভিস দিতে না পারো। তাহলে সেই মূল্যহীনতার দায় নিশ্চয়ই একতরফা হওয়া উচিত না। একদল সার্ভিস নিয়েই যাবে আরেক দল বেকুবের মতো সার্ভিস দিয়েই যাবে উপরন্তু অবহেলার শিকারও হবে! যাক এত কেতাদুরস্ত চিন্তায় আমার কাজ নেই। আমি আমার সিদ্ধান্ত আগেই নিয়েছি। তাতেই অটল রইলাম। প্রস্তুতির একটা ব্যাপারও ছিল। শান্তা-কান্তা গেছে তাদের দাদার বাড়িতে। এটাই সুযোগ। কারণ আমি চাই না আমার কর্মকাণ্ড বাচ্চা দুটির চোখে পড়ুক। ওরা কোনো আতঙ্কিত স্মৃতি নিয়ে বড় হোক, তা চাইনি। 

এবার স্পষ্টতই মনে আছে, দিনটা ছিল শনিবার। দুই বন্ধু বাইরে থেকে এসেই বসলো বোতল খুলে। কিছুক্ষণ পরেই এলো এক ফর্সা মেয়ে। তিনজন মিলে যা শুরু করলো তার বর্ণনা দিতে ঘেন্না লাগছে। আমি ততক্ষণে প্রস্তুত। সেই ভয়াবহ প্রস্তুতির গল্প আর নাই বলি। কেমন করে যে নিজেকে একটু একটু করে বিচ্ছিন্ন করেছি সব বন্ধন থেকে তা শুধু আমিই জানি। আমি ঈশ্বর বিশ্বাসী নই। তাই এ নিয়ে মাথাব্যথাও নাই। আমি শুধু জানি আমি কোনো ভুল করছি না। ব্যাস। 

দুই বন্ধু বিছানায় আধা নেংটো হয়ে পড়ে আছে। মেয়েটি কাপড় ঠিক করে উঠে পড়তে শান্তা-কান্তার বাবাই মেয়েটিকে উচ্চারণ অযোগ্য এক ভাষা প্রয়োগ করে সুইচটা অন করতে বলল। আমি ততক্ষণে প্রস্তুত। সুইচ অন করে মেয়েটি বেরিয়ে গেল। আমি একটু একটু করে শক্তি সঞ্চয় করছি আর আমার টার্গেট ঠিক করছি। হ্যাঁ এই তো আরেকটু, আর একটু শক্তি। সাই সাই করে আমি ঘুরতে থাকলাম। সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে আমার দুটি ব্লেড খুলে একদম গলা বরাবর ছুড়ে দিলাম। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটতে লাগল। আমি তখন দিগ্বিদিক শূন্য। একটাই উদ্দেশ্য। দুটিকেই শেষ করে দিতে হবে। ততক্ষণে তৃতীয় ব্লেডটাও ছুড়ে দিয়েছিলাম। একটা তক্ষুণি শেষ। আরেকটা একটু নড়ছিল। তাই ওটাকেও শেষ করতে নিজেই পিচাশটার মাথা বরাবর এসে পড়ি। মাথা থেতলে মগজ ছিটিয়ে পড়ে চারদিকে। চারদিকে এত রক্ত, কাটা মাংস, মাথার খুলি। অথচ আমার মনে হচ্ছিল আমি কোন নন্দন কাননে আছি। বিশ্বাস করুন এত আনন্দ আমি আমার জন্মাবধি কখনো পাইনি। লাল রক্তেও এত আনন্দ থাকে কে জানতো। আর এই আনন্দ আমি একা না, আমার প্রজাপতি মেয়েটাও পাচ্ছিল। বিশ্বাস করুন। আমি ওকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। এতদিন ও তো আমার সঙ্গেই ছিল। দূর থেকে ওর খিলখিল হাসি আর হাততালির আওয়াজও পাচ্ছিলাম। আবারও খেয়াল করুন এবার আমি আত্মহত্যা করা মেয়েটিকে ‘আমার প্রজপতি মেয়ে’ বললাম। হায়রে সম্পর্ক !

তবে আমি আনন্দিত। ভীষণ আনন্দিত। এতটুকুও কষ্ট হচ্ছে না আমার। এখানে আপনারা ভাবতে পারেন কেন শান্তা-কান্তার বাবাকে খুন করতে গেলাম। স্রেফ রদ্দি মাল বা আমাকে বিদায় করে দেবে এই ভয়ে? না। ওদেরকে এই নরকের কীটদের থেকে বাঁচাতে যে তার জানেজিগার দোস্তকে নিয়ে অপেক্ষায় ছিল শান্তা-কান্তা বড় হবার। আরেকটু বড় হলেই বিক্রি করলে কত পাওয়া যাবে এই চিন্তায় বিভোর দুই জানোয়ারকে মারার অপরাধে আমি গর্বিত। 

এখন আমার নবজন্মের পালা। আগুনে গলে আমি নতুন রূপে ফিরে আসব। আসবোই। আর ফিরে এসে যদি এমন কোনো ঘটনার মধ্যে আবারও পড়ি তবে? 

তবে আর কি? গল্প টু বি কন্টিনিউড ...

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh