হাসান হামিদ
প্রকাশ: ০৪ আগস্ট ২০২১, ০৭:১২ পিএম
ফাইল ছবি
দেশে করোনায় এখন প্রায় প্রতি দিন ১০ থেকে ১২ হাজার মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন এবং দুইশ’র বেশি মানুষ মারা যাচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতেও গত ১৫ জুলাই থেকে লকডাউন শিথিল করা হয়েছিল, যা মোটেই ঠিক হয়নি বলে বলছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ, লকডাউন শিথিলের ঘোষণা আসতে না আসতেই মানুষ এমন করে হুমড়ি খেয়ে রাস্তায় নেমেছিল, যেন করোনা আর নাই! যে দেশের মানুষকে বাঁচাতে গিয়ে সরকারকে সেনাবাহিনী রাস্তায় নামাতে হয়, সেই জাতি ভুগবে সেটাই স্বাভাবিক। জীবিকার জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে বের হলে অন্য কথা; কিন্তু জীবিকার প্রয়োজন ছাড়াও অনেকে বের হন। ভাবা উচিত, যারা এখন ঘর থেকে অকারণে বের হচ্ছেন, তারা আসলে করোনা বিস্তারেই সহায়তা, সমাজ এবং দেশের ক্ষতি করছেন।
ইতিমধ্যে সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। জাতিসংঘ বাংলাদেশকে করোনা সংক্রমণের দিক থেকে ৩১তম বেশি সংক্রমণের দেশ হিসেবে ঘোষণা করেছে। আমরা জেনেছি, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দ্রুত ছড়ায়। এ জন্য প্রতিনিয়ত পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। করোনা থেকে বাঁচতে আমরা নানান সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহার করছি; কিন্তু ব্যবহারের পর ভয়ানক ঝুঁকিপূর্ণ এসব বর্জ্য আমরা কীভাবে কোথায় ফেলছি, তা কি ভাবছি? বাসার বাইরে, হাসপাতালে এসব সরঞ্জাম অনেক বেশি। অন্যান্য মেডিক্যাল আবর্জনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে করোনা বর্জ্য। প্রায় সবাই এখন মাস্ক, গ্লাভস ও গগলস ব্যবহার করছেন, এরপর যত্রতত্র তা ফেলে দিচ্ছেন বা গৃহস্থালি বর্জ্যরে ঝুড়িতে রাখছেন। এই জিনিসের ব্যবস্থাপনায় নেই কোনো কার্যকর উদ্যোগ। নাগরিকরা যেন সুরক্ষাসামগ্রীর বর্জ্য আলাদা পাত্রে ভরে তা ফেলেন, সে ব্যাপারে সচেতন করার কোনো কার্যক্রম নেই বরং এ নিয়ে উদাসীনতার নানা খবর পত্রিকায় আসছে।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক কোভিড মহামারিতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও চিকিৎসা বর্জ্য নিয়ে গবেষণা করেছে। তাদের গবেষণায় দেখা যায়, কোভিড মহামারিতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও চিকিৎসা বর্জ্যরে মাত্র ছয় দশমিক ছয় ভাগের সঠিক ব্যবস্থাপনা হয়। বাকি ৯৩ ভাগ পড়ে থাকছে আমাদেরই আশপাশে! করোনার বর্জ্যরে ঝুঁকি বিবেচনায় সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য পরিবেশ অধিদফতর ২০২০ সালের ১৩ জুন হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোকে ৫টি নির্দেশনা মানতে চিঠি দিয়েছিল। সেসব নির্দেশনায় প্রত্যেক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে করোনা বর্জ্য আলাদা করার প্রক্রিয়া নিয়ে পরিচ্ছন্নকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা বলা হয়। বলা হয়, দুই স্তরবিশিষ্ট প্লাস্টিক ব্যাগের দুই-তৃতীয়াংশ এসব বর্জ্য ভর্তি করে ব্যাগের মুখ ভালোভাবে বেঁধে আলাদা বিনে রাখতে হবে, বিনের গায়ে লেখা থাকতে হবে- কোভিড-১৯ বর্জ্য। খবর নিয়ে জেনেছি, সরকারি হাসপাতালগুলোতে অল্পসংখ্যক পরিচ্ছন্নতাকর্মীকে প্রশিক্ষণ দিলেও দুই একটি ছাড়া কোনো বেসরকারি হাসপাতালে এমন কোনো উদ্যোগ নেই। এমনকি এসব প্রতিষ্ঠানে বর্জ্য অপসারণের কোনো তাগিদও নেই।
পরিবেশ নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন দেশব্যাপী ১ হাজার ৭০০ জনের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে একটি জরিপ করেছে। তাদের প্রতিবেদন বলছে, গত এক মাসে দেশে মাস্ক, গ্লাভসসহ মোট প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়েছে প্রায় ১৪ হাজার ৫০০ টন। এর মধ্যে সার্জিক্যাল গ্লাভস ও মাস্ক ছিল দুই হাজার টনের কাছাকাছি। এই বর্জ্য কোথায় যাচ্ছে? কীভাবে যাচ্ছে?
পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, দেশের বেশিরভাগ বিশেষত শহরে মানুষজন তাদের ব্যবহৃত করোনা সুরক্ষার সরঞ্জামগুলো গৃহস্থালি বর্জ্যরে ভ্যানে ফেলেন। আর তাতে কী ঘটে। জানা যায়, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় এসব বর্জ্য ভ্যানে তুলে নিয়ে যান প্রায় ১২ হাজার বেসরকারি পরিচ্ছন্নতাকর্মী। এই পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা আবর্জনা নাড়াচাড়া করেন। ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া মাস্ক-গ্লাভস-গগলস-পিপিইগুলো এভাবে তাদের সরাসরি সংস্পর্শে আসে। আর এভাবে সংক্রমণের প্রত্যক্ষ ঝুঁকিতে আছেন তারা। আবার এই কর্মীরা প্রতিদিন নগরীর প্রায় সবকটি বাড়িতে যাচ্ছেন। তারা এলাকার জন্য নির্ধারিত ময়লাঘর আর কনটেইনারে বর্জ্য রেখে যাওয়ার পর করপোরেশনের কর্মীরা সেগুলো নিয়ে ফেলেন ভাগাড়ে। সেখানে মহানগরীর দেড় কোটির বেশি বাসিন্দার নিত্যদিনের মাছ-মাংস-সবজির আবর্জনা আরও হাজারো বর্জ্যরে সঙ্গে পড়ে থেকে গণসংক্রমণের ঝুঁকি ছড়াচ্ছে তাদের ব্যবহৃত করোনা সুরক্ষার সরঞ্জামগুলো। ঢাকার মতো অন্যান্য শহরেও প্রায় একই অবস্থা; কিন্তু এতে যে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হচ্ছে, তা কি কেউ ভাবছেন?
জানা যায়, মেডিকেল বর্জ্য নিয়ে কাজ করে একটিমাত্র বেসরকারি সংগঠন- প্রিজম বাংলাদেশ। ঢাকার সরকারি-বেসরকারি ২৭টি হাসপাতালের সঙ্গে কাজ করছে এ সংগঠন। এগুলো থেকে কোভিড বর্জ্য সংগ্রহ হয় প্রায় দুই হাজার কেজি! জানা যায়, সারাদেশে চিকিৎসাসেবা কেন্দ্রগুলো থেকে প্রতিদিন প্রায় ২৪৮ টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। যার মাত্র ৩৫ টন ব্যবস্থাপনার আওতায় ছিল। এর অধিকাংশই ঢাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। আবার মাস্কসহ অন্যান্য স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী ব্যবহার করছে ৭১ ভাগ মানুষ। তাদের মাস্ক ও অন্যান্য করোনা বর্জ্য পুরোটাই গৃহস্থালি বর্জ্যরে সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। প্রতিবেদনে এসেছে, পরিচ্ছন্নতাকর্মীরাও জানিয়েছেন, তারা প্রায় সব বাড়ি থেকেই গৃহস্থালি বর্জ্যরে সঙ্গে মাস্ক ও গ্লাভস পাচ্ছেন।
আমরা বুঝতে পারছি, হাসপাতালগুলোর করোনা বর্জ্য শহরাঞ্চলে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে; কিন্তু হাতেগোনা দু-একটি ছাড়া হাসপাতালগুলো যথাযথ পদ্ধতিতে বর্জ্য রাখছে না। এ জন্য সংক্রামক বর্জ্য সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ দিতে হবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত সব কর্মীকে। করোনা বর্জ্য এবং হাসপাতালের সব ধরনের বর্জ্য বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে ডিসপোজ করার জন্য সরকারি-বেসরকারি সমন্বয়ে একটি ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা বিশেষ জরুরি হয়ে পড়েছে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, করোনা বর্জ্য মূলত ‘সংক্রামক বর্জ্য’। তাই আমাদের উচিত করোনা বর্জ্য যেন পরিবেশে ছড়িয়ে সংক্রমণ বাড়াতে না পারে, সেদিকে খেয়াল রাখা। আর করোনা মহামারি যেহেতু এই পরিবেশ বিপর্যয়ের ফল; সেহেতু পরিবেশ রক্ষায় আরও সচেতন হতে হবে। তা না হলে আমাদের জন্য অপেক্ষায় থাকবে আগামীর অন্য কোনো বিপর্যয়। বর্তমান শতাব্দীর জলবায়ু রক্ষা কিংবা পরিবেশ বাঁচাও এসব চ্যালেঞ্জের সঙ্গে করোনাভাইরাস আমাদের জন্য নিয়ে এসেছে নতুন এক চ্যালেঞ্জ।
সূত্র : ব্লুমবার্গ, রয়টার্স ও জিসিসি বিজনেস নিউজ