সমাজ ও রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব

গৌতম দাস

প্রকাশ: ০৫ আগস্ট ২০২১, ১২:৪৫ পিএম

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

আমরা চাই কিংবা না চাই, সমাজ ও রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব থাকবেই। সমাজ ও রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব, প্রতিক্রিয়া ও ভূমিকা কী- এই প্রশ্নে ট্রাডিশনাল রাজনৈতিক ধারার জবাবটা হলো, ধর্মকে অবশ্যই নির্বাসনে পাঠাতে হবে। আর এখানে ধর্মকে বলতে ইসলাম পড়তে হবে। তাদের সরাসরি কথাটা হলো রাজনীতিতে ধর্ম থাকতে পারবে না। থাকাটা নাকি খুব খারাপ জিনিস; কিন্তু আসলেই কী তাই? আরও গোড়ার প্রশ্ন ধর্মের ছাপ বা প্রভাব থেকে আসলেই কী সমাজ ও রাজনীতির মুক্ত থাকা সম্ভব? নাকি ব্যাপারটা আসলে এক ইসলামবিদ্বেষ ছাড়া আর কিছুই না! 

প্রথমত, ট্রাডিশনাল বলতে এখানে বোঝানো হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-৪৫) পরে প্রতিশ্রুতি অনুসারে যে রাজনৈতিক ধারায় আমাদের মতো দেশগুলোতে কমন যে রাজনীতির ধারা ফাংশনাল হতে শুরু করেছিল সেটাকেই। বর্তমানে যার বয়স প্রায় ৭৫ বছর। এর জন্মের সময় নতুন কলোনিমুক্ত দুনিয়ায় যা জেগে উঠেছিল আর তাতে যেসব রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যকে কেন্দ্র করে কলোনিমুক্ত স্বাধীন দেশগুলো যাত্রা শুরু করেছিল তা আসলে প্রায় ব্যতিক্রমহীনভাবে ছিল মূলত এক ‘জাতিবাদী’ রাজনীতি। এবং কোথাও কোথাও এর সঙ্গে ‘প্রগতিশীল’ বলে আরেক তকমার এক রাজনৈতিক ধারাও ছিল। তবে জাতিবাদী ধারাটির দেখা পাওয়া ছিল সবচেয়ে কমন; ফলে এশিয়া, আফ্রিকা বা ল্যাটিন আমেরিকা সবখানেই তা হাজির ছিল। আর এশিয়ায় আমাদের এদিকে ওই দুই বৈশিষ্ট্যের রাজনীতি নিয়ে কলোনিমুক্ত রাষ্ট্রগুলো নিজেদের পুনর্গঠিত করতে শুরু করেছিল। 

যেহেতু কলোনি দখল হয়ে যাবার আগে আমাদের মতো ওসব রাষ্ট্রে আগে রাজনীতি বলে কিছু ছিল না, এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এক ফ্যাক্টর। এ ছাড়া আবার কলোনিমুক্ত হবার পরে জাতিবাদ তাদের প্রথম রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য (আর কোথাও কোথাও সঙ্গে প্রগতিশীলতা) এবং বয়স যার প্রায় ৭৫ বছর- সে কারণে এটিকে ‘ট্রাডিশনাল’ নামে ডেকেছি। যদিও মোটামুটি চলতি নতুন শতক থেকে ‘গ্লোবাল ইতিহাসেই’ সেই ট্রাডিশনাল রাজনীতি বদলাতে শুরু করে দিয়েছে। বিশেষ করে ওয়ার অন টেরর আমেরিকার এই বিশেষ রাজনৈতিক চর্চা ও টার্নের প্রতিক্রিয়ায়। 

ট্রাডিশনাল মানে জাতিবাদী-প্রগতিশীল
ট্রাডিশনাল বলতে জাতিবাদী-প্রগতিশীল কেন হলো এর একটা সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা সবার আগে দিয়ে নেয়া যাক। প্রথমত ব্যাপারটি হলো যে (ব্রিটিশ) কলোনি দখলদারেরা আমাদের মতো দেশ ত্যাগ করে চলে গেলে এরপরে আমরা কোন ধরনের রাজনীতি করব, এটি কে নির্ধারণ করে দিয়েছিল তা বোঝা দরকার। তবে এরও আগের এক প্রশ্ন হলো রাজনীতি জিনিসটাই বা কী? আর রাজনীতি আমাদের করতে হবে কেন? এ ছাড়াও ‘রাজনীতি’ বলে এই বিষয়ের ভেতরে আমরাই বা ঢুকে গেলাম কী করে?

সেদিকে যাবার শুরুতেই বলে নিতে হয় এর মানে, কলোনি দখলদারেরা দখল ছেড়ে চলে যাওয়ার (যেমন ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া ছেড়ে চলে যাওয়া) পরে ‘রাজনীতি’ বলে একটা কিছু আমাদের লাগবেই এই অবস্থা তৈরি হয়েছিল কেন?

আসলে এই ব্যাপারটা বুঝতে হলে আমাদের ব্রিটিশদের ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া দখলের আগের পরিস্থিতিতে যেতে হবে। মানে একটু কল্পনা করে নিতে হবে। যেটিকে এখানে ব্রিটিশ-পূর্ব পরিস্থিতি নামে ডাকছি সেসময়টি হলো মোঘল শাসনের (১৫২৬-১৮৫৭) শেষ জমানা। যখন ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় মোঘল প্রশাসন বলতে যা কিছু এর অনেকটাই দুর্বল হয়ে গেছে, নাই হয়ে গেছে অথবা সব ভেঙে পড়তে শুরু করেছে। আর আমাদের এদিকে মানে বাংলায়, এর বহু আগে থেকেই বাংলা ভূখণ্ড হিসেবে এটি দিল্লি থেকে অনেক দূরের বলে স্থানীয় সুলতান বা নবাব ধারায় বাংলার শাসক ও শাসন কর্তৃত্ব গড়ে উঠেছিল। যারা রাজস্ব আদায়ের একাংশ দিল্লির সঙ্গে শেয়ার করত মানে, মোগলদের হাতে তুলে দেওয়ার বিনিময়ে মোঘল শাসনের চোখে বৈধতা লাভ করে শাসন চালাত। এদিকটি বুঝবার জন্য কলোনি শাসন শুরু বলতে শুধু ১৭৫৭ সালের ক্লাইভের ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে সিরাজ-উদ-দৌলার পতন বুঝলেই তা যথেষ্ট হবে না। বরং এরপরের ১৭৬৪ সালের বক্সারের যুদ্ধ আর শেষে ১৭৬৫ সালের ‘এলাহাবাদ চুক্তির’ দিকেও নজর দিতে হবে। এলাহাবাদ চুক্তি সারকথা বলা হয় যে, দিল্লির সম্রাট শাহ আলম বার্ষিক ২৬ লক্ষ টাকার বিনিময়ে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা বা দেওয়ানি প্রদান করা হয়েছিল। মানে ১৭৫৭ সালের পরপরেই ক্লাইভ বাংলার শাসন মানে দেওয়ানি শাসন নিজ হাতে তুলে না নিয়ে কেন ১৭৬৫ সালের পরে পর্যন্ত অপেক্ষার পর দেওয়ানি নিয়েছিল সেটা আমাদের মাথায় রাখতে হবে। 

তবে আমাদের এই লেখার জন্য প্রাসঙ্গিক ও যতটুকু প্রয়োজনীয় তা হলো, যেহেতু ক্লাইভের ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি মোঘল ও নবাবদের শাসন কর্তৃত্ব সমাপ্ত করে ১৭৬৫ সাল থেকে নিজেরাই দেওয়ানি শাসনকাজ শুরু করেছিল, তাই আমাদের এখানে প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন যে তাহলে ১৯৪৭ সালে স্বাধীন ও কলোনিমুক্ত হয়ে গেলে ভারত-পাকিস্তানের কি মোঘল শাসন ব্যবস্থায় ফেরত যাওয়াটা সঠিক হতো না? 

না। এটি অবাস্তব। তা সঠিক হতো না, বাস্তবে সম্ভব ছিল না। কারণ, দিল্লির মোঘল বা মুর্শিদাবাদের নবাব বলে কোনো কিছুর আর তত্ত্বদিনে অস্তিত্বই ছিল না। সারকথা আগের এমন কোনো রাজা বা সম্রাট-তান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা বলে সবকিছুই তত্ত্বদিনে অস্তিত্বহীন হয়ে গিয়েছিল। শুধু তাই না আরও বড় কথা, আমরা ইতিমধ্যে ‘রাজনীতি’ বলে একটা কিছু শিখেও ফেলেছিলাম এবং তা ব্রিটিশদের থেকে; কিন্তু তাতে কী?

আমরা অনেকেই খেয়াল করিনি হয়ত যে, রাজতন্ত্রের বিপরীতের এক মৌলিক ধারণা হলো ‘রাজনীতি’। তবে কেন ‘মৌলিক’ শব্দটা লাগিয়ে বললাম? কারণ, কোনো ভূখণ্ডের ‘শাসন ব্যবস্থা’ হিসেবে রাজতন্ত্রের সমতুল্য বিকল্প শব্দ হলো রিপাবলিক বা প্রজাতন্ত্র। মানে রাজার শাসনের বিপরীতে পাবলিকের (জনগণের) শাসন। আর পাবলিকের শাসন কথাটা ভেঙে বললে হয় জনগণের নির্বাচিত ‘জনপ্রতিনিধির’ হাতে ক্ষমতা দিয়ে এমন শাসনব্যবস্থার অধীনে সেই ভূখণ্ড শাসন। আর এই জনপ্রতিনিধি নির্বাচন থেকে শাসনব্যবস্থার কাঠামো পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য মানুষের সব তৎপরতাকেই ‘রাজনীতি’ বলে। তাই এবার সরাসরি বললে, রাজনীতিক তৎপরতা করেই একমাত্র রাজতন্ত্রের বিপরীতে এক রিপাবলিক ব্যবস্থা কায়েম করতে হয় বা সম্ভব। এ কারণে যেখানে রাজা বা রাজতন্ত্র আছে সেখানে ‘রাজনীতি’ শব্দ বা ধারণাটাই নাই। আর যেখানে রাজনীতি আছে, ফলে শব্দ ও ধারণায় তৎপরতাও আছে সেখানে আর রাজতন্ত্র নাই, বরং প্রজাতন্ত্র বা রিপাবলিক আছে। তাই সারকথা হলো মোঘল আমলে ‘রাজনীতি’ বলে কিছু ছিল না। 

মোঘল শাসন ব্যবস্থা রাজতন্ত্র কি না তা বুঝবার সবচেয়ে সহজ পথ হলো, শাসকের মানে রাজার মৃত্যু হলে বা তার পরবর্তিকালে; শাসকের সন্তান বা রক্তের উত্তরাধিকারী কেউ শাসক হচ্ছে কিনা- এমন ব্যবস্থা মানেই সেটা মূলত রাজতন্ত্র। তাতে সেটা কোনো আরবি শব্দের যেমন সুলতান বা সুলতানি শাসন ইত্যাদি যাই নাম থাক না কেন। একারণে কোনো সুলতানের আমলেও সেখানে রাজনীতি শব্দটা নাই, থাকে না। এমনকি খলিফা বা সুলতানি শাসনের প্রতি যতই প্রীতি আমাদের থাক না কেন ব্যাপারটা একটা রাজতন্ত্রই। আর ১৯৪৭ সাল আসতে আসতে পুরানা সব ধরণের রাজতান্ত্রিকতা তত্ত্বদিনে বিলুপ্ত বলে আমাদের আর কোনো রাজতন্ত্রে ফিরে যাবার সুযোগ ছিল না। 

তাহলে আমরা ‘রাজনীতি’ এই চিন্তা বা ধারণাটা কোথা থেকে শিখলাম?

এর ছোট উত্তর হলো, আমাদের উপরের শাসন কর্তৃত্ব ঔপনিবেশিক হলেও ইউরোপে ব্রিটিশদের নিজেদের রিপাবলিক শাসন ব্যবস্থা ছিল, আর সেটা দেখেই আমরা শিখেছিলাম। একথায় অনেকের মনে হতে পারে যে সে আমলে ব্রিটিশ-ভারতের কয়জন নেটিভের ইংল্যাণ্ডে যাবার সুযোগ হয়েছিল যে সেটাকে দেখে শিখেছিলাম তা বলা যাবে? এমন মোক্ষম প্রশ্ন শুনে অনেকের মনে হতে পারে তাইতো ঠিকই তো বলছে; কিন্তু না, উনি ঠিক বলছেন না। কেন?

মূল কারণ, আমাদের শিখবার জন্য ব্রিটেনে যেতে হয় নাই। মুলত ব্রিটিশ-ভারতে থেকেই দেখেছি ও শিখেছি অনেক। একটা ছোট উদাহরণ দেই। উপরে একটি শব্দ বলেছি ‘প্রতিনিধিত্ব’, মানে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করা বা রিপ্রেজেন্টেশন [representation]। এই শব্দটি সুদূর প্রসারি। কারণ এই শব্দ দিয়ে রাজতন্ত্র আর রিপাবলিক আলাদা হয়ে যায়। রাজতন্ত্রে প্রতিনিধিত্ব ধারণা নাই। মানে কী? মানে হলো, প্রতিনিধিত্ব ধারণার পিছনে আছে জনগণ বা নাগরিক ধারণা। নাগরিক ধারণা চালু থাকলে তবেই সেই নাগরিকের প্রতিনিধিত্ব করা যায়। রাজতন্ত্রে প্রতিনিধিত্বের ধারণা অপ্রয়োজনীয়, কারণ সেখানে মানুষ বলতে বোঝায় সকলে রাজার অধীনস্ত ‘প্রজা’ মাত্র; যার মূলকথা হলো প্রজারা কেউ ‘স্বাধীন’ ব্যক্তিসত্বা নয়। অন্যদিকে রিপাবলিকে এমনকি নাগরিকের স্বাধীন ব্যক্তিসত্বার স্বীকৃতি শুধু নয় আরও গুরুত্বপুর্ণ দিক হলো, নাগরিকের কিছু অবিচ্ছেদ্য (inalienable) অধিকার বা কেড়ে নেওয়া যায় না এমন নাগরিক অধিকার আছে তা স্বীকার করে নেয় রিপাবলিক রাষ্ট্র। এটিই নাগরিক সম্পর্কে গোড়ার মূল্যবোধ। ফলে রাজতন্ত্রের মানুষ নাগরিকই নয়, এই ‘নাগরিক’ স্বীকৃতি সেখানে থাকে না। আর এখান থেকেই আম-মানুষ মোঘল প্রজা হওয়ার চেয়ে কলোনি ব্রিটিশ-ভারতের নাগরিক হতে যায়, এই প্রশ্নে সে তুলনায় ‘নাগরিক’ হতেই পছন্দ করবে- এটিই স্বাভাবিক। যারা মোঘল আমল শাসন দেখেছেন আর পরে কোম্পানি শাসন দেখছেন তারা তুলনায় পরেরটা পছন্দ করতে শুরু করবে এবং করেছিলও স্বাভাবিকভাবে। 

এখন তবু আবার প্রশ্ন উঠতে পারে ব্রিটিশ শাসকদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক তো ছিল আমাদের দখলদার প্রভু তারা। ফলে ইউরোপে যুক্তরাজ্য একটি রিপাবলিক কিনা– সেটা যাই হোক তাতে আমাদের কী, আমাদের কাছে তো সে দখলদার- একথা বলতে পারে অনেকে। এর জবাব হলো যে হ্যাঁ, কথা এদিক দিয়ে সত্য। তবে এরপরেও কিছু কিন্তু রয়ে গেছে। যেমন ব্রিটিশ-ভারতের যে প্রশাসন ব্যবস্থা ছিল তা খোদ ব্রিটেনের প্রশাসন ব্যবস্থাকে অনুসরণ করে সাজিয়ে নিয়ে চলত। এতে ব্রিটেনে চর্চা হওয়া নাগরিক ধারণার অনেক কিছুর ছাপ তারা ভারতেও অনুসরণ করে চলত। একটা ভালো উদাহরণ দেওয়া যাক। 

রিপ্রেজেন্টেশন বা জনপ্রতিনিধিত্বের কথা বলছিলাম যেটি রিপাবলিক রাষ্ট্রের এক ভিত্তিমূলক ধারণা। কারণ, এখানে রাষ্ট্রের সব ক্ষমতার উৎস হলো নাগরিক জনগণ। কাজেই নাগরিকরা ভোট দিয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করে নিজেদের ক্ষমতা তাদেরকে ডেলিগেট [delegate] বা সাময়িক হস্তান্তর করে দেওয়া হয়েছে। যাতে এরপরে জনপ্রতিনিধিরা জনগণের পক্ষে থেকে এক শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করতে পারে। এই হলো শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা নিয়ে মৌলিক ধারণাটি আর এর সঙ্গে জনপ্রতিনিধিত্ব ধারণার গুরুত্ব। কাজেই ব্রিটিশ-ভারত কলোনি দেশ হলেও এখানে যে প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রচলন করা হয়েছিল তাতে একে দক্ষ প্রশাসন ব্যবস্থা করে গড়ে তোলা বলতে ব্রিটিশ প্রশাসনের ধারণাটাই পেছনে ছায়া হিসেবে কাজ করবে। আর তাই আপনি কলোনির মানুষ হলেও একধরনের নাগরিক মর্যাদা লাভ করবেন। যেমন আপনি একা বা কয়েকজন মিলে যদি ব্রিটিশ প্রশাসনকে কোন নাগরিক-পরামর্শ দিতে বা অভিযোগ বলতে চান তো প্রশাসন আপনাকে এলাও করবে। আপনাকে সময় দেবে কথা বলার জন্য। এটিই ব্রিটিশ ভাষায় ‘রিপ্রেজেন্টেশন দেওয়া’। আর প্রশাসনও চাইবে আপনার পরামর্শ শুনে সে নিজেকে বদলে অথবা ভুল সংশোধন করে নিয়ে আরও দক্ষ প্রশাসন হতে।

দক্ষ প্রশাসন হবার এটিই পথ বলে তারা মনে করত। আসলে মূল কারণটা ছিল এমন যে যতক্ষণ ভারতীয়-আপনি ব্রিটিশ কলোনিশাসকদের খোদ ক্ষমতাটাকেই চ্যালেঞ্জ করছেন না ততক্ষণ দখলদারেরা প্রশাসনকে প্রো-পিউপল করতে, দক্ষ করে তুলতে, প্রতিকার দেওয়া সম্ভব এমন আপনার অভিযোগ শুনতে তারা কোনো অসুবিধা দেখবে না বরং, এমন করলে সেটা শাসকদের পক্ষেই যাবে এটি বুঝত। সে কারণেই ১৮৮৫ সাল থেকে শুরু করে ১৯৩৫ সালের মধ্যে ‘ভারত শাসন আইনে’ ক্রমান্বয়ে সংশোধন এনে চলেছিল ব্রিটিশ শাসকেরা। সর্বশেষ প্রাদেশিক সরকারে (১৯৩৭ সালের নির্বাচন যেটি) স্থানীয় নেটিভদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়ে চালানোও বাস্তবায়ন করেছিল তারা। কেবল কেন্দ্রীয় শাসন-কর্তৃত্ব ব্যবস্থাটা নির্বাচিত স্থানীয়দের হাতে ব্রিটিশরা ছেড়ে দিতে পারে নাই, কারণ সেক্ষেত্রে ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া আর কলোনি থাকে না, স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে যায়, তাই এটি তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। যদিও ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ ব্রিটিশ শাসকদের মনে এক স্থায়ী ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিল যে ‘ভারত শাসন আইনে’ এসব সংস্কার বা ছাড় না দিলে না আবার কোনো বিদ্রোহ ঘটে যায়। এখান থেকেই কলোনি দখলদারেরা নেটিভ ভারতীয়দেরও নিজেকে নাগরিক মনে করার ক্রমান্বয়ে অনেকটা সুযোগ করে দিয়েছিল। 

একারণে দখলদার হলেও ব্রিটিশ শাসকরা স্থানীয় কিছু মানুষকে তাদের কমিউনিটি প্রতিনিধি (নাগরিক প্রতিনিধি ধারণার আদলে) হিসেবে শাসকদের সঙ্গে দেখা করে তাদের অভাব অভিযোগ জানাতে পারে- এই চর্চা আগেই চালু করে রেখেছিল। আর শাসকরা সেই অভিযোগ শুনে যতটা সম্ভব প্রশাসনকে ঢেলে সাজানো বা বদলানো সম্ভব তা নিয়মিতই করত। সারকথায় শাসক দখলদার হলেও এটি তারই দেওয়া সীমিত পরিসরে এক নাগরিক বা প্রতিনিধিত্ব বোধ। এটিই মোঘল শাসনের চেয়ে ব্রিটিশ প্রশাসন তুলনামূলক ভালো এই বোধ তৈরি করতে পেরেছিল। যার মূল কারণ মানুষকে প্রজা নয়, বরং সীমিতভাবে হলেও এক স্বাধীন সত্তা, কেড়ে নেওয়া যায় না এমন কিছু অধিকারের মানুষ-বলে স্বীকৃতি ব্রিটিশ প্রশাসন দিত।

এবার আরো স্পষ্ট করে মাঠের যে উদাহরণের কথা বলব; সেটা ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের সময়ের কথা। সেসময়ের শাসকের নিজ শাসন ব্যবস্থা নিয়ে যেসব উদ্বেগ ছিল সেগুলোঃ যেমন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে যেসব ভূখণ্ড ব্রিটিশ হেড কোয়ার্টার বা রাজধানী কলকাতা থেকে যতদূরে তাতে এর ওপর কলকাতার প্রশাসনের নজর বা খোঁজ নেওয়া ততই শিথিল ছিল। এই অভিযোগ শাসকেরা স্বীকার করত। এই বিচারে পূর্ববঙ্গের ওপর কলকাতার উপযুক্ত নজর মনোযোগ নাই এটি স্বীকৃত। আবার পূর্ববঙ্গে মুসলমানরা জনসংখ্যায় সংখাগরিষ্ঠ কিন্তু তা সত্ত্বেও জনপ্রতিনিধিত্বে মুসলমানদের ভূমিকা তেমন হাজির হয়নি। ব্রিটিশ রাজধানী কলকাতা মুসলমানদের এই সংখ্যাকে আমল করে না বা কান দেয় না- এমন অভিযোগ তাই জারি থাকত। আবার জমিদারিতে জমিদার-হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ট বলে এরাই মূলত স্থানীয় শাসকগোষ্ঠী হিসেবে মুসলমানদেরও কোনো প্রতিনিধিত্বকে উপেক্ষায় ঠেকিয়ে রাখা জায়েজ মনে করত। যেটিকে আবার ব্রিটিশ শাসকেরা তাদের স্বার্থ মনে করত না। কারণ কোনো জনগোষ্ঠী নিরন্তর উপেক্ষিত হতে থাকলে তাদের বিদ্রোহি হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এই ছিল তাদের বুঝবার তরিকা। 

আর তৃতীয় পয়েন্ট যেটি ছিল তা আরেক বড় ব্রিটিশস্বার্থ। তা হলো, ততদিনে আসাম ভালো চা উৎপাদনে দক্ষ ও উপযুক্ত হয়ে উঠেছে; কিন্তু ওই চা একমাত্র ইউরোপে নিয়ে বিক্রি করতে পারলে তবেই ভালো বাজার ও দাম হাসিল হতে পারে; কিন্তু তা ইউরোপে নিতে গেলে আসাম থেকে পূর্ববঙ্গ হয়ে রেলে নারায়ণগঞ্জ হয়ে বা সরাসরি চট্টগ্রাম নিতে পারলে এরপর তা জাহাজে ইউরোপে পৌঁছানোর কথা ভাবতে পারে; কিন্তু সেজন্য পূর্ববঙ্গ বা ঢাকার প্রশাসন তেমন মনোযোগ দিয়ে গড়ে তোলা হয়নি। তাই শাসকদের ইচ্ছা ছিল পূর্ববঙ্গে নজর গাঢ় করার আর তা হলো, পূর্ববঙ্গ ও আসামকে নিয়ে আলাদা প্রদেশ করে দেওয়ার পরিকল্পনা, যেটিকে আমরা বঙ্গভঙ্গ নামে চিনি। এ ছাড়া শাসকরা জানত যে পূর্ববঙ্গে মুসলমানেরা জনসংখ্যায় সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও প্রতিনিধিত্ব নেই বলে ক্ষোভ আছে। 

তাই এসব ব্যাপার সমাধান করতে তারা মুসলমান কমিউনিটির এক ডেলিগেশন প্রতিনিধির সঙ্গে সাক্ষাৎ দিয়ে তাদের অভিযোগ-গুলো শুনতে তাদেরকে রিপ্রেজেন্টেশন দিবার সুযোগ দিতে ১৯০৫ সালে তা আমল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। যার সারকথায় ছিল প্রতিনিধিত্ব ধারণার চর্চা। আর মানুষকে তুলনামূলক সম্মান ও স্বীকৃতি দেওয়ার এই চর্চা মোঘল আমলের যে কোনো চর্চা বা ধারণার চেয়ে অগ্রসর। শুধু তাই নয়। এই প্রতিনিধি দলটাই পরের বছর ১৯০৬ সালে সমাজের আরো অনেককে সঙ্গে নিয়ে মুসলিম লীগ নামে রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। কারণ এরও বিশ বছর আগে ১৮৮৫ সালে ততদিনে ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’ (সংক্ষেপে কংগ্রেস) নামে ভারতে প্রথম রাজনৈতিক দল খুলতে দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ এর তাৎপর্য লক্ষ্য করেন। দখলদার হলেও ব্রিটিশরা রাজনৈতিক দল পর্যন্ত করতে এলাও করতে পেরেছিল। অথচ মোঘল শাসন মানুষকে প্রজার বাইরে আর কোনো স্বীকৃতি দিতে একেবারেই অপারগ ছিল। কারণ তা করতে দিলে সম্পর্কটা আর রাজা-প্রজা থাকে না তাহলে। ঠিক যেমন, বর্তমান সৌদি বাদশাও যে কারণে তার দেশে রাজনৈতিক দল খুলতে দিতে অপারগ। কাজেই খুবই সুক্ষ বলে অনেকে হয়ত নাগরিক মানুষকে দেওয়া স্বীকৃতির দিকটা না বুঝে তুচ্ছ মনে করতে পারেন। যদিও এটি সাগর পরিমাণ ফারাক। এভাবেই আমরা রাজনীতি ধারণাটা শিখেছি, একইসঙ্গে এটিই মানুষের এক অবিচ্ছেদ্য ধারণা-বিশ্বাস-অধিকার ইত্যাদি এসব ধারণায় আবছা হলেও আমরা আপ্লুত হয়ে উঠেছিলাম। আর এটিই নির্ধারণ করে দিয়েছিল যে ১৯৪৭ সালের পরে আমরা রাজনীতিই করব এবং পাকিস্তান একটা রিপাবলিক রাষ্ট্রই হবে। এর আনুষ্ঠানিক নাম ছিল ইসলামি রিপাবলিক অব পাকিস্তান। সামনের ইসলামি শব্দটা ডেকোরেটিভ মানে সাজসজ্জামূলক। রাষ্ট্রটার মূল বৈশিষ্ট্য অবশ্যই রিপাবলিক মানে জনগণ সব ক্ষমতার উৎস এবং সেই ক্ষমতাটাই জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে উঠিয়ে এনে রাষ্ট্রশাসন পরিচালনার নীতি সে অনুসরণ করে বা করবে, এটি স্বীকার করেছে। শুরুতে ইসলামি শব্দটি থাকায় তাতে ঈর্ষায় কেউ দাবি করতে পারে যে এটি ইসলামি রাষ্ট্র বা ধর্মীয় রাষ্ট্র; কিন্তু তাতে কিছু এসে যায় না। আর এটি সামরিক শাসনে বেশির ভাগ সময় পরিচালিত হলেও না। 

এখন এক বুদ্ধিমান পাঠক প্রশ্ন করতে পারেন যে রাজনীতিই আমাদের লক্ষ্য, আমাদের ভাগ্য ও পরিণতি। তা না হয় বুঝলাম। এমনকি পাকিস্তান কেন কোনো রাজতন্ত্র নয় এক রিপাবলিক হয়েছিল তাও না হয় বুঝলাম; কিন্তু এই রচনার লক্ষ্য তো ছিল ‘সমাজ ও রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব, প্রতিক্রিয়া ও ভূমিকা’ নিয়ে কথা বলার। তো আমরা এখানে এলাম কেন? হা খুবই ভ্যালিড প্রশ্ন। আর এর জবাব হলো, সেদিকে যাবার আগে আসলে আমরা জানতে এসেছিলাম আমরা রাজনীতিতে ও রিপাবলিক রাষ্ট্রে কীভাবে এসে পৌঁছালাম সেটা বুঝে নিতে। এখন তাতে ‘ধর্মের প্রভাব’ প্রসঙ্গে যাব। একটু ধৈর্য্য ধরবেন।

যদি জিজ্ঞাসা করা হয় বা একটা সার্ভে করা হয় যে ভারতীয় উপমহাদেশে রাজনীতিতে ধর্ম ঢুকল কি করে? অনুমান করি বেশিরভাগ মানুষ এর জবাব দেবে এই বলে যে ‘ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ’ ও ‘ইসলামি পাকিস্তান রাষ্ট্র’ গড়া থেকে। আসলে এই কথা থেকে বোঝা যায় প্রপাগান্ডা কত শক্তিশালী মিথ্যা তৈরি করতে পারে। ফলে বাস্তব সত্যতা এর মধ্যে নাই। তবু এই মিথ্যার চাপ সমাজের কোণায় এখনো যে দু’চারজন একালের মুসলিম লীগার আছেন তারা আমার কানে কানে জিজ্ঞাসা করতে পারেন যে দাদা শেষে আমরা প্রমাণ করতে পারব তো, সত্য হাজির করতে পারব তো? ভয় নাই, যা ফ্যাক্টস একমাত্র তাই তো ফ্যাক্টস।

যে ‘রাজনীতি’ ধারণা আমরা পেয়েছিলাম ব্রিটিশদের হাত ধরে তাদের মুখে ও চর্চা থেকে, এর যাত্রার শুরুতেই লেখা হয়ে গেছিল যে ভারতে যে রাজনীতিক ধারা জাগবে তার সঙ্গে ধর্ম মাখামাখি হয়েই থাকবে। আর সেই রাজনীতিতে শুধু ইসলাম না সনাতন হিন্দুধর্মও থাকবে। কাজেই ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগের জন্ম আর ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের কারণে অখণ্ড ভারতের রাজনীতিতে ধর্ম হাজির হয় নাই। এটি শতভাগ মিথ্যা কথা। রাজনীতিতে ধর্ম হয়েছিল আরও বহু আগেই।

কত আগে এবং কীভাবে? আমরা তা জানব ও নিশ্চিত প্রমাণ পাব কীভাবে?
অখণ্ড ভারতে রাজনীতিতে ধর্ম একেবারে মাখামাখি হয়ে প্রবেশ করেছিল সেই ১৮১৫ সালে। আর তা ঘটেছিল, সেকুলার প্রগতিশীলদের চোখে ও বিচারে যিনি নাকি ভারতে রেনেসাঁর আদিগুরু, সেই রাজা রামমোহন রায়ের হাতে। এনিয়ে ১৯৩০ এর দশকে যারা কমিউনিস্ট পার্টিকে পুনরায় গুছিয়ে দাঁড় করিয়েছিলেন, পার্টির তত্ত্ব ও কর্মসূচির খসড়া লিখেছিলেন তাদের লেখা বই-পুস্তক থেকে আমি একথা লিখছি যে ‘রামমোহন ভারতে রেনেসাঁর আদিগুরু’ ছিলেন। প্রগতিশীলেরা আঁতকে উঠতে পারেন। তবু এ ঘটনা শতভাগ সত্য। ঘটনা হলো, যারা পড়ালেখা করেছেন মানে একাডেমিক লোক; মানে যেমন ধরেন যে সমাজবিজ্ঞানের কোনো শাখায় পিএইচডি করেছেন, বিশেষ করে যারা ইংরাজি সাহিত্যে পিএইচডি করেছেন তাদের অন্তত জমিদার হিন্দুরস্বার্থে ও তাদের বানানো বয়ানে আস্থা স্থাপন করা মানায় না। কারণ তাদের হাতের নাগালে তো বহুবিধ বইপুস্তক প্রমাণ আছে, তবু তাদের কেন এই দুর্গতি হবে? তাদের চোখে ইউরোপীয় রেনেসাঁ কী আধুনিকতার ‘আদিজ্ঞান’ নয়। 

আচ্ছা রামমোহন না হয় ভারতে রেনেসাঁর আদিগুরু হলেন! কিন্তু সেজন্য তিনি অখণ্ড ভারতের রাজনীতিতে প্রথম ধর্মকে আনা প্রধান পুরুষ হবেন কেন? 

কারণ ফ্যাক্টস অর্থে গভীর সত্যটা হলো, ঐ ১৮১৫ সালেই রামমোহন রেনেসাঁর আদিগুরু স্বীকৃতিপ্রাপ্ত হওয়া সত্বেও, সেই তিনিই এক নতুন ধর্ম প্রবতর্ন করেছিলেন যার নাম ব্রাহ্মধর্ম। আর সেই সঙ্গে এক ‘ব্রাহ্ম সমাজ’ গড়ার আন্দোলনে তিনি নেমে পড়েছিলেন। (সাবধান শব্দটা ব্রাহ্ম, ব্রাহ্মণ নয়। এছাড়া ব্রাহ্মণ ধারণার সঙ্গে এর কোনো তালুক নাই।)

এখন কথা হলো রেনেসাঁবাদী যারা তাদের চোখে ধর্মের উলটা প্রতিপাদ্যটাই তো রেনেসাঁ! রেনেসাঁবাদির চোখে ও বিশ্বাসে ‘রেনেসাঁ’-ই তো তাদের প্রগতিশীলতা (মানে যারা ধর্মের নিকুচি করে) ধারণার উৎস ধারণা! তাহলে তাদের গুরু রামমোহন-ই কিভাবে ধর্মের নিকুচি না করে উলটা নতুন করে আরেক ধর্ম, ব্রাহ্মধর্ম চালু করেন? এটি তো তাদের চোখে অবিশ্বাস্য মনে হবার কথা!

সেটা হোক আর নাই হোক, রামমোহন-ই নতুন এক ধর্ম চালু করেছিলেন। আর প্রগতিবাদীরা সেকথা যেন জানেন না দেখেন নাই ভান করে থাকেন। আর যারা পিএইচডি মনে করেন, আসলে যারা পড়াশুনা না করেই রেনেসাঁবাদী, ইসলাম কোপানির সুযোগ পেলেই যারা ছাড়তে চান না তারা আসলেই জানেন না। পড়াশুনা না করারও কিছু সুবিধা আছে সেটাই তারা নিয়ে থাকেন, উপভোগ করেন। তাই তারা এটি-সেটা কিছু একটা বলে বলে এপর্যন্ত বিষয়টা উপেক্ষা করে গিয়েছেন। আর বারে বারে ইংরাজিতে পিএইচডি কথাটা আনছি এজন্য যে এরা রেনেসাঁ নিয়ে পড়াশুনা না করে পিএইচডি পর্যন্ত আগাতে পারবেন না। কাজেই ইংরাজিতে পিএইচডি করে আসা লোকেরা তারা বাংলাদেশে ফিরলেই বিরাট ‘প্রগতিশীল’ তকমাধারী হয়ে যাবেন কিংবা রামমোহন সম্পর্কে জানবেনই না এবং উলটা মুসলিম লীগকেই অভিযুক্ত করে প্রপাগান্ডা করবেন এটি অগ্রহণযোগ্য-এটি তাদের জন্য চরম ডিসক্রেডিট বলেও প্রমাণিত হতে পারে। সে যাক; কিন্তু সারকথা, রাজনীতিতে ধর্ম এনেছিলেন রামমোহন রায়। একথা থেকে আমরা একচুলও সরার প্রয়োজন নাই। তবে আমরা এখানে রেনেসাঁ-র ধারণার ভিতরে আর বিস্তারে ঢুকব না। বরং খোঁজ করতে যাবে কেন রামমোহন ধর্মের দিকে ফিরেছিলেন? 

রাজনীতিতে ধর্ম এনেছিলেন রামমোহন রায়; কিন্তু আগেই বলেছি ব্রিটিশ রিপাবলিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা আর তার প্রশাসনে প্রতিনিধিত্ব ধারণার চর্চা আমাদের সকলকেই ব্রিটিশ-ভারতের প্রশাসনিক কাঠামোর প্রতি অনুরক্ত করে তুলেছিল। শুধু তাই নয়। সবচেয়ে বড় কথা বহু সাহসী ইন্টেলেকচুয়ালদের মনে তাদেরকে ব্রিটিশ রিপাবলিক রাষ্ট্রের মতই এক নয়া ‘ভারত রিপাবলিক’ গড়ার স্বপ্ন আকাঙ্খায় উচ্চকিত করে তুলেছিল। রামমোহন ছিলেন এমনদের অন্যতম। কংগ্রেস দলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন দাদাভাই নওরোজি, এক পার্সি ও পারিবারিকভাবে ব্যবসায়ী ভদ্রলোক সেকালের বোম্বাইয়ের বাসিন্দা। তিনিও একসময় খোদ ব্রিটিশ পার্লামেন্টের মেম্বার হয়েছিলেন, একই উদ্দেশ্যে। তাঁর এসব তৎপরতা নিয়ে লেখা একটা বই অন লাইনে গুগুল সার্চে পাওয়া যেতে পারে; কিন্তু শেষে হতাশ হয়ে তিনিও ছিলেন নয়া ‘ভারত রিপাবলিক’ গড়ার স্বপ্ন আকাঙ্খায় উচ্চকিত অন্যতম আরেকজন। 

রামমোহন রাজনীতিতে ধর্ম এনেছিলেন কেন
রামমোহনই প্রথম রাজনীতিতে ধর্ম এনেছিলেন, কিন্তু কেন? সেটা আমরা এখন খুঁজে দেখব। আর বুঝব কীভাবে আজকের ভারতের সব পাপের শুরু এখান থেকেই। তিনি অসৎ নন। তবে তাঁর কিছু ভুল ধারণা ও অনুমান এর পেছনের কারণ।

রামমোহনের সব বিভ্রান্তিরই উৎস হলো ‘জাতি’ ধারণা। এখানে জাতি মানে নেশন ধারণা অর্থাৎ যেখান থেকে নেশন- স্টেট [nation-state] বা জাতিরাষ্ট্রের ধারণা।

জাতি রাষ্ট্র নিয়ে বিস্তারে যাব না, সংক্ষেপে থাকব। সারকথাটা হলো, আসলে যেটি ছিল রাজনীতিক বা রাজনীতি ধারণা। মানে মানুষকে ‘রাজনীতিক মানুষ’ হতে হবে এই ধারণা। আরেকটু গুছিয়ে বললে, মানুষকে একটা ‘পলিটিক্যাল কমিউনিটি’ হিসেবে গড়ে ওঠার ধারণা। এটিই রাজতন্ত্রের বিপরীতে রাষ্ট্র বা পলিটিক্যাল স্টেটের ধারণা, যেটিকে আগে রিপাবলিক বলেছি; কিন্তু পলিটিক্যাল স্টেটের ধারণাটা পা-পিছলিয়ে ইউরোপেই শুরুর দিকে এক ‘জাতি’ ধারণার মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল। আর যে ভুল তারা সংশোধন করতে পেরেছিল ৩০০ বছর পরে; কিন্তু তাঁরা জাতি ধারণার মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল কেন? অথবা ‘রাজনীতিক মানুষ’ সহ সবকিছুই ভুলে এই জাতি ধারণার মধ্যে সবাই হারিয়ে গিয়েছিল কেন? এর মূল কারণ মনে করা হয় একদিকে সে সময়কালটা হলো যেমন ইউরোপের রাজতন্ত্রের বিকল্প খুঁজবার সময়কাল আবার একই সঙ্গে সেটা ইউরোপের কলোনি দখলে বেরিয়ে পড়ার সময়কাল ছিল। 

সোজাসাপ্টা বললে, সামরিকভাবে সজ্জিত দামি জাহাজ কেনায় বিনিয়োগ করে কোম্পানি খুলে (যেমন ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি) অন্যের দেশ দখলে এশিয়া, আফ্রিকা কি ল্যাটিন আমেরিকার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়া। এই ছিল সেকালের প্রধান ব্যবসা বা ইউরোপের প্রতিটা দেশের অর্থনীতির প্রধান খাত। আবার ওদিকে দেশ দখলে গিয়ে প্রতিযোগিতা ও লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছিল তারা যেমন, ব্রিটিশদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলেছিল ফরাসি বা ডাচ কোম্পানির সঙ্গেও। এভাবে ইউরোপেরই পড়শি দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা থেকেই ‘জাতি’ ধারণার উৎপত্তি। যেমন ক্লাইভের ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি চায় ডাচ বা ফরাসি কোম্পানির সঙ্গে তাঁর লড়াইটাকে দেশের ব্রিটিশেরা জাতিবোধ থেকে দেশের কোম্পানির বলে খোদ সরকারসহ দেশের লোকেরা সবাই তাঁর পক্ষে সমর্থন দিক। যেন ক্লাইভের কোম্পানির বিজয় মানে সেটা যেন ব্রিটিশ জাতির-ই বিজয়। এভাবে হাজির হোক। যেহেতু এমন জাহাজ বা কলোনিদখল ব্যবসা দেশের অর্থনীতিতে প্রধান খাত, ফলে সেখান থেকেই ফরাসি বা ডাচদের (বা অন্যান্য দেশের) বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের জাতির লড়াইয়ের নামে উত্থিত এক অর্থনীতির যুগ সেটা। যার পরিণতিতে ‘রাজনীতিক মানুষ’ হয়ে রিপাবলিক রাষ্ট্র গড়ার লড়াই পথ ভুলে জাতিরাষ্ট্র গড়ার রূপ নিয়ে বসেছিল। আর এভাবেই ৩০০ বছর পরে কলোনিযুগ শেষ হওয়া ছাড়া পরবর্তিতে ১৯৫৩ সালের আগে সারা ইউরোপ ভুলে, জাতিরাষ্ট্র গড়ার দিকে চলে যাবার ভুল-তারা আর সংশোধনের সুযোগ পায় নাই। 

কিন্তু আমাদের এদিকে দুর্ভাগ্য রামমোহনের। তিনি তাঁর কলোনিয়াল মাস্টারের ইতিহাসটি বুঝলেন এভাবে যে ব্রিটিশেরা একটা ‘জাতি’ ছিল বলেই তারা ব্রিটিশ জাতিরাষ্ট্র গড়তে পেরেছিল। মনে রাখতে হবে রামমোহন যখন এসব দেখছেন তখন আধুনিক রাষ্ট্র মানে তা জাতিরাষ্ট্রই, আর তা খুবই পপুলার ও যেন ‘বিপ্লবী’ ধারণা, যার কোনো ব্যতিক্রম নাই। আর এখান থেকেই রামমোহনের সবচেয়ে মারাত্মক ভুল রিডিং হলো যে, জাতিরাষ্ট্র গড়তে সক্ষম হবার মূল উপাদান নাকি আগে এক ‘ধর্মীয় জাতি’ হওয়া। আর তা থেকেই সহজে জাতিরাষ্ট্রে পৌঁছানো এই ছিল তার মারাত্মক ভুল অনুমান। যেমন ব্রিটিশেরা হলো, এংলো ক্যাথলিক খ্রিশ্চান ধর্মের, ফলে এই ধর্মের ভিত্তিতে নিজেদের এক জাতি কল্পনা তাদের জন্য খুবই সহজ হয়েছিল। এই ভিত্তিহীন অনুমান তিনি করেছিলেন। শুধু তাই না। আর ব্রিটিশদের সম্পর্কে এই অনুমান কপি করতে গিয়ে তিনিও ভারতে একটা ‘একই ধর্মে আমরা সবাই’ এমন না থাকার অভাবকে বিরাট খামতি বলে চিহ্নিত করেছিলেন। আর সেই অভাব পূরণ করতেই তাঁর নতুন একেশ্বরবাদি এক ধর্ম - ব্রাহ্মধর্ম প্রবর্তনের চেষ্টা। তিনি এরপর বেঁচে ছিলেন মাত্র আঠারো বছর, ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত। এরপর তার অনুসারিদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের দাদা দ্বারকানাথ ঠাকুর ব্রিটিশদের সঙ্গে তাঁর নানান ব্যবসার কারণে প্রমিন্যান্ট ছিলেন।  ফলে তিনি রামমোহন-উত্তর ব্রাহ্মসমাজের দায়ভার নিলেও মাত্র ১৮৭২ সালের মধ্যে ব্রাহ্মসমাজ তিনভাগ হবার পর স্তিমিত হয়ে যায়। এরপরে হিন্দুধর্মের ভিত্তিতেই ভারতে জাতিগঠন আর তা জাতিরাষ্ট্র গড়তে হবে এই ধারণা প্রবল হয়ে যায়। সারা ভারতকে ব্রাহ্ম বানানোর স্বপ্ন এখানেই শেষ হয়ে যায়; কিন্তু তাহলে রিপাবলিক ভারত এই জাতিরাষ্ট্র গড়ার প্রকল্পের কী হবে? যেহেতু চেষ্টা করেও সফল হওয়া যায় নাই তাই এবার হিন্দুধর্মের ভিত্তিতেই একটা জাতি বানিয়ে (মানে অন্য ধর্মগুলোকে জবরদস্তিতে এতে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়ে) ভারত জাতিরাষ্ট্র গড়ার স্বপ্নকে পুনর্গঠিত করে নেয়া হয়েছিল। এর কারিগর ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিবেকানন্দ, অরবিন্দ ঘোষ প্রমুখ। এভাবেই শেষে এই ভিত্তিতেই ১৮৮৫ সালে কংগ্রেস দলের জন্ম দেওয়া হয়। এটিই মুসলমানদেরকেও ‘মুসলমান-জাতি’ ধারণার ভিত্তিতে পাকিস্তান গড়তে চাওয়ার দিকে ঠেলে দিয়েছিল। যদিও তারা একাজ কংগ্রেসের জন্মের পরেই তৎক্ষণাৎ শুরু করে নাই। ২০ বছর অপেক্ষা করেছিল। এরপর ১৯০৬ সালে তারাও হিন্দু-জাতি ধারণার মতোই এক বিকল্প হিসেবে মুসলিম লীগের জন্ম দিয়েছিল।

সারকথায় রাষ্ট্রতত্ত্ব বা রাষ্ট্রগড়ার আলাপে স্বচ্ছ চিন্তার অভাবেই রামমোহনের ভুল ও ব্যর্থতায় সেই থেকে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান আজও অস্থিতিশীলতায় ডুবে আছে। আবার দেখা যাচ্ছে সমস্যাটা কোনোভাবেই কেবল ইসলাম বা মুসলমানের নয় যদিও; তবু এক ইসলামবিদ্বেষ দিয়ে তা থেকে কথিত সেকুলারিজম দিয়ে সমস্যাটিকে আড়াল করার চেষ্টা হয়েছে সবখানে। যেমন আমাদের ভূখণ্ডে মুসলিম লীগের কাছে জমিদারি ও ক্ষমতা হারিয়ে কমিউনিস্ট ছাতার নিচে আশ্রয় পাওয়া জমিদার-হিন্দুর কথিত এই প্রগতিশীলতাই মূলত ইসলামবিদ্বেষী ধারা। মুখে যদিও তারা দাবি করে গেছে যে তারা সাধারণভাবে ধর্মকে এনিমি মনে করে। আর তাই যেন এদের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য হলো ধর্মবিদ্বেষ; কিন্তু বাস্তবে তাদের এই ধর্মবিদ্বেষ শব্দের মানে হলো সুনির্দিষ্ট করে ইসলামবিদ্বেষী। সাধারণভাবে ধর্ম নয়। সুনির্দিষ্ট করে ইসলাম।

এর সবচেয়ে ভালো প্রমাণ হলো ভারতে। তাদের কথিত প্রগতিশীল-ভারতজুড়েই আজ সবচেয়ে ভালোভাবে হিন্দুত্বের উত্থান ঘটেছে। মানে হিন্দু-শ্রেষ্ঠত্ববাদের রাজনৈতিক উত্থান ঘটে গেছে। অথচ এই প্রগতিশীলতার তাতে কোনো বিকার নাই। যেমন আমেরিকায় ডেমোক্র্যাটদের পরে রিপাবলিকান দল ক্ষমতায় এসেছে এমনই সাধারণ ঘটনা এটি। কলকাতায় কমিউনিস্ট-প্রগতিশীলেরাই তৃণমূলের কাছে হেরে ক্ষোভে ২০১৯ সালে বিজেপির পক্ষে কাজ করেছে, বিজেপিকে ১৮ আসন এনে দিয়েছে। কারণ তৃণমূলের জনভিত্তির এক বড় অংশ (অন্তত আঠাশ ভাগ) হলো মুসলমান ভোটার। তাই এই কথিত প্রগতিবাদিরা বিজেপিকে উঠিয়ে এনেছিল। আর তাতে এবার ২০২১ সালে সেই প্রগতিবাদিরা নিজেরাই নির্মূল হয়ে গেছে। 

তাই কথাটা সম্ভবত এভাবে বলা যায় যে হিন্দু-জাতিবাদী (সফট-হিন্দুত্ববাদি) প্রগতিশীলরা নিরন্তর ইসলামবিদ্বেষী রাজনীতি চালিয়ে যাবার নিট ফলাফল হলো এবার এরপরে এক কড়া হিন্দুত্ববাদের উত্থান, বিজেপি-আরএসএসের আগমন ও জয়যাত্রা। কারণ কঠোরভাবে ইসলামবিদ্বেষ চালিয়ে যে শূন্যস্থান তৈরি করা হয়েছিল সেটাই দখলে চলে গেছে মোদীর বিজেপি-আরএসএসের রাজনীতির কব্জায়। কমিউনিস্ট-প্রগতিশীল তারা আসলে চক্ষুলজ্জায় সফট-হিন্দুত্ববাদের ভেতরের কংগ্রেস বা বাম হয়েই থেকে যেতে চেয়েছিল। মানে জাতিবাদী-প্রগতিশীলেরা বাইরে কথিত সেকুলারিজমের এক সাইনবোর্ড টানিয়ে ভিতরে সফট-হিন্দুত্ববাদী থাকতে চেয়েছিল। আর এটিকেই মোদি-ভগত দেখেছিলেন হিন্দুত্ববাদের ক্ষমতার চরম অপচয় হিসেবে। তাই তারাই তাদের কড়া হিন্দুত্ববাদকে অল্প পুশ করতেই সারা ভারত হিন্দুত্ববাদের উন্মাদনা-জোয়ারে ভেসে যায়। এবং আরও হয়তো হয়ে যেত, যদি না করোনার দ্বিতীয় ওয়েভ বা মমতা এর গতিরোধ করে উঠে দাড়াত; কিন্তু লক্ষণীয় হলো, এতে জাতিবাদী-প্রগতিশীলদের মধ্যে এখনো কোনো অপরাধবোধ নাই, বিকার নাই। এমনকি সর্বশেষ পশ্চিমবঙ্গের ভোটাভুটি বলছে বাম-কংগ্রেস অবলীলায় এবার তাদের কনস্টিটিউয়েন্সি বা ভোট মোদির বিজেপিকে দিয়ে দেওয়ার ফলে সত্যিকারের সর্বহারা হয়ে গেছে; যেটি গত ২০১৯ সাল থেকে তারা চেষ্টা করে আসছিল; কিন্তু তবু এ ঘটনায় বিজেপি একমাত্র বিরোধী দল হয়ে যাওয়াতে এতে খারাপ কিছু হয়েছে, হিন্দুত্ববাদ এই চরম নেতিবাচক ধর্মীয় উত্থান ঘটেছে কিনা এটিও কমিউনিস্ট-প্রগতিশীলেরাই এখনো দেখতে পারছে না। অর্থাৎ এতদিন ধর্ম বলতে একমাত্র ইসলামবিদ্বেষেই যে তারা মিন করত সেকথাটা এখানে এসে দিনের আলোর মতো ফুটে উঠেছে।

এটি গেল ট্রাডিশনাল সেই জাতিবাদী-প্রগতিশীল তবে ভারতীয় ধারার পরিণতি। যেটি এখন আসলে কঠোর হিন্দুত্ববাদের মধ্যে ও নিচেই হারিয়ে আছে আর মোদী-উত্থানে যাদের ভিতর কোনো অস্বস্তিও নাই। আবার বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপরও ছেঁয়ে বসার চেষ্টা করছে। তবে বাংলাদেশে? এখানে অবশ্যই নব্বইভাগ মুসলমান জনগোষ্ঠীর দেশে এখানে সবার মধ্যে ভারতের পরিণতি হবার কথা না। যদিও এখানেও জাতিবাদী-প্রগতিশীল নামে ইসলামবিদ্বেষী ধারা বহাল আছে। সরকার ক্ষমতায় আছে বলে এর ভেতরেও যে ক্ষয় ধরেছে তা সহজে বোঝা যাচ্ছে না। বরং সাধারণভাবে এক ইসলামিজম বেড়েছে এবং মূলত তা গত ২০ বছরে পশ্চিমে ইসলামকে যেভাবে মার্জিনালাইজ করা হয়েছে, মিথ্যা ভয়ে বা ভুলে যেভাবে মোকাবেলা করা হয়েছে, যেভাবে তাদের ট্রিট করা হয়েছে ঠিক তেমন বা অনুরূপ এরই পালটা প্রতিক্রিয়াও তেমন হবারই কথা। ফলে ইসলামের যেসব নতুন ধারা পপুলার হয়েছে সেসবেরই চিন্তা-আইডিয়ার ঢেউ ও প্রভাব বাংলাদেশেও পড়াটাই স্বাভাবিক। এর পরিণতিতে বাংলাদেশ পরে কোনোদিকে যায় তা সামনে আমাদের দেখতে হবে স্বাভাবিক।

তবে কথাগুলো একটু শুরু থেকে গুছিয়ে বলা যাক। এর প্রধান ঘটনা ও বড় ফ্যাক্টর হলো, ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশেরা চলে যাবার পরে মুসলিম লীগের নেতৃত্বে ভারত ভেঙে আলাদা পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল। তবু এভাবে বলা আসলে অর্ধেকটা বলা। বাকি অর্ধেকটা হলো এই যে, আগের পূর্ববঙ্গে জমিদার হিন্দুদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য লোপাট করে দিয়ে এসব ক্ষেত্রে মুসলিম লীগের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছিল শুধু তাই না রাষ্ট্রক্ষমতাতেও যারা এসেছিল তা এক বড় ধরনের শ্রেণি বদল ঘটতে দেখা যায়। কারণ, জমিদার উচ্ছেদ আইন পাশ হয়েছিল ১৯৫১ সালে। তাই নতুন গড়া পূর্ব পাকিস্তানেও এর প্রতিক্রিয়ায় জাতিবাদী ও ইসলামবিদ্বেষী কথিত প্রগতিশীলতা মূলত কমিউনিস্ট পার্টি নামে হাজির হয়েছিল। আর তা মুলত পুনর্গঠিত হয়েছিল মোটামুটি ১৯৪৮ সাল থেকেই। বলা যায়, আগের শাসকেরা তাদের হারানো জমিদারি-ক্ষমতার অন্তত কিছুটা ফিরে পেতে এবার রাজনৈতিক দল করার যুগ তাই পুরনো কমিউনিস্ট পার্টিটাকেই নিজেদের দল হিসেবে একে কেন্দ্র করে পুনরায় সংগঠিত হতে শুরু করেছিল। তাই ১৯৪৮ সালের পুনর্গঠিত কমিউনিস্ট পার্টি হয়ে যায় জাতিবাদী-প্রগতিশীল নামে রাজনৈতিক ধারা শুরুর প্রধান ছাতা; কিন্তু বাস্তবত এই দলটিই জমিদারি ক্ষমতা হারানোদের প্রধান আশ্রয়স্থল। সেকারণে এই প্রগতিশীলতার বিশেষ মানে হলো চরম ইসলামবিদ্বেষ। কারণ মুসলিম লীগ অর্থাৎ এক ইসলামি জাতিবাদের কাছে সে পরাজিত হয়েছে, তার ১৫৪ বছরের পুরানা জমিদারি পুরা রাজত্ব প্রভাব আধিপত্য সবকিছু এখানে লোপাট হয়ে গেছে। 

আর সঙ্গে মুসলিম লীগ ভেঙে যারা বেরিয়ে এসেছিলেন তাদের নিয়ে গঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগ (যেটা আজকের আওয়ামী লীগ)- এটিও প্রগতিশীল দল পরিচয়ে সংগঠিত হতে শুরু করেছিল। আসলে এর এক্টিভিস্টেরা ছিল কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য; কিন্তু ১৯৫১ সালে সামরিকভাবে ক্ষমতা দখল করতে গিয়েছিল বলে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হয়ে যায় ও নেতারা মামলার মুখে পড়েছিল। তাই এসব এক্টভিস্টেরাই আওয়ামী লীগ দলে ঢুকে যেন ওর সদস্য এভাবে রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করেছিল। অতএব ইসলামবিদ্বেষী ও ক্ষমতাহারানো জমিদার হিন্দুদের কমিউনিস্ট পার্টি কার্যত আওয়ামী লীগ নামে সমাজে তৎপর থেকে যায়। 

এভাবে একাত্তর সালে আমরা যে নতুন বাংলাদেশ পাই সেটাও সেই জাতিরাষ্ট্র অবশ্যই। তবে ঠিক আগের মত ধর্মভিত্তিক জাতির জাতিরাষ্ট্র নয়, তবে ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতিরাষ্ট্র যেটি আবার পাহাড়ি সমস্যা আমল করতে গিয়ে আর ইসলামবিদ্বেষ থেকে বের করতে গিয়ে বাংলাদেশি জাতিরাষ্ট্র করতে যাওয়া হয়; কিন্তু সমস্যা মেটেনি, বেড়েছে। কারণ এর প্রতিদ্বন্দ্বিরা ইসলামবিদ্বেষী। তাই যারা ঠিক ইসলামি রাজনীতি বলে না তবে ইসলাম-ছুঁয়ে থাকতে চায় তাদের মধ্যে এই ইসলামবিদ্বেষের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হওয়ারই কথা। তাই তারা অনেক সময় রাগে-জিদে কনস্টিটিউশনে সেকুলারিজমের জায়গায় ‘আল্লার ওপর অগাধ বিশ্বাস’ ধরণের কথা ঢুকিয়েছে বা কখনও ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ বলে শব্দ বসিয়েছে। আবার বুদ্ধিমানের মত এসব কথা যুক্ত করাতে নাগরিক অধিকারে এর যাতে কোনো প্রভাব না থাকে সেখানে কোনো হাত না দিয়ে তা নিশ্চিত রেখেছে। মোটকথা যতই কথিত সেকুলারিজম শব্দ দিয়ে ইসলামবিদ্বেষ জারি রাখার চেষ্টা করা হয়েছে, ততই জিদ বা রেষারেষিমূলক কাজ ঘটেছে। 

এ কারণে বলা যায় জাতিরাষ্ট্র ধারণাই সব রেষারেষি বাস্তবায়নের একটি উপায়। কারণ জাতিরাষ্ট্র মানে কোনো না কোনো একটি আইডেনটিটি যেমন- ধর্ম, ভাষাভিত্তিক জাতি ধারণার উপস্থিতি এমনকি ভৌগোলিক জাতিবাদ যেমন জুমজাতি বা পাহাড়িজাতি ধারণার উৎপাতও এখান থেকে। 

আবার ইউরোপের দিকে তাকালে আমরা দেখব তারা জাতিরাষ্ট্রের ফাঁদ থেকে বের হয়ে গেছে। সম্ভবত সবচেয়ে ভয়ংকর হিটলারের এরিয়ান জাতিরাষ্ট্রের গ্যাস চেম্বারে পুড়িয়ে মারাতে এটি তাদের সকলকে কিছুটা আক্কেল দিয়েছে। তাই ১৯৫৩ সালে তারা একযোগে ৪৭টি ইউরোপীয় রাষ্ট্র একসঙ্গে হিউম্যান রাইট ইস্যুতে এক সম্মেলন করে সকল রাষ্ট্রই নাগরিক মানবিক অধিকারেরর ভিত্তিতে তাদের রাষ্ট্রের ভিত্তি বদলে নিয়েছে। তাই তারা কেউ আর এখন জাতিরাষ্ট্র নয়। অধিকারভিত্তিক নাগরিক রাষ্ট্র, যা মূলত নাগরিকের রাজনৈতিক সাম্যের রাষ্ট্র। যদিও চর্চায় কোনো কোনো রাষ্ট্রে ইসলামবিদ্বেষ তবু রয়েই গেছে। বিশেষত যারা মাইগ্রেন্ট মুসলমান নাগরিকদেরকে এসিমিলেশন মেনে চলতে বাধ্য করার নীতিতে চলতে যায়। অর্থাৎ ব্রিটেনের মাল্টিকালচারের নীতির বিপরীত যেমন ফ্রান্স। এরা হোস্ট দেশের ধর্ম ও কালচার মুসলমানদের অনুসরণ করে চলতে হবে বলে বাধ্যবাধকতা দেয়।

তবু জাতিরাষ্ট্র এর ভিত্তি উঠে যাওয়া, একটা ভালো সমাধান অবশ্যই। তবে ব্রিটেনের মত মাল্টিকালচারের নীতি অনুসরণ, যেখানে সবাই পাশাপাশি যার যার কালচার নিয়ে বসবাস ও সকলকেই জায়গা করে দেওয়া অবশ্যই কাম্য। আর আমাদের মত দেশে জাতিরাষ্ট্র ভিত্তি ত্যাগ করে এক রাজনৈতিক সাম্যের বা অধিকারের সাম্যের ভিত্তিতে নয়া রাষ্ট্র গড়া অবশ্যই ভালো সমাধান হতে পারে।

রাষ্ট্র থেকে ধর্ম আলাদা রাখাটা কী অনিবার্য অর্থে জরুরি?
এখন অন্য আরেক দিক থেকে শেষ প্রসঙ্গটা হাজির করা যাক। সেটা হলো, আচ্ছা রাষ্ট্র থেকে ধর্ম আলাদা রাখাটা কী অনিবার্য অর্থে জরুরি? 

এই প্রশ্নের জবাবটা অন্য দিক থেকে তোলা যাক যে, রাষ্ট্র থেকে ধর্ম আলাদা রাখা কী সম্ভব? এর জবাব হলো এটি অসম্ভব। কেন এবং কী অর্থে?

কারণ মানুষের ইতিহাস মানে আসলে কোনো না কোনো ধর্মতত্ত্বের ইতিহাস। অর্থাৎ কোনো না কোনো ধর্মতত্ত্বের হাত ধরেই মানুষ সব সময় পথ হেঁটেছে। এরপর একসময় এসেছিল মানুষের জীবন ও জিজ্ঞাসায় ধর্মতত্ত্বের কোনো প্রভাব নাই এই অনুমানের ওপর দাঁড়িয়ে বস্তুগত দুনিয়াকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা ও চিন্তা করার যুগ। এভাবে রেনেসাঁর যুগ, এনলাইটেনমেন্টের যুগ, আরও পরে হেগেলের চিন্তা-পদ্ধতির যুগ পেরিয়ে গেছি আমরা ঠিকই; তবু ধর্মতত্ত্ব স্তিমিত হয়ে যায়। এখনো পাশাপাশি চলছে।

ফলে আমরা যা কিছু চিন্তা করেছি বা এখনো করি, তাতে নাম বা ব্যাখ্যা করতে যেসব শব্দ দিয়েছি সবকিছুতে বিশেষ রুট শব্দগুলো এখনো সব ধর্মতত্ত্বীয় থেকে গেছে। কাজেই ধর্মতত্ত্ব বা ধর্মকে বাদ দিয়ে চিন্তা চর্চা অনেকটাই অসম্ভব। কারণ চিন্তা ভুঁইফোড় নয়। এর গভীর অতীত আছে। যেটি ধর্মতত্ত্বের গর্ভেই লালিত হয়ে এসেছে।

তার মানে কী কিছুই বদলায় নাই। অবশ্যই বদলিয়েছে; কিন্তু সেটা কোথায় কীভাবে?

এর ছোট্ট উত্তর হলো লন্ড্রিতে পাঠিয়ে। মানে কী? প্রত্যেকটা শব্দে যে ধর্মতত্ত্বীয় গন্ধ, দাগ বা চিহ্ন রয়ে গেছে তাকে যেন একটা লন্ড্রিতে পাঠিয়ে সেসব মুঝে সাফসুতারা করে কিন্তু শব্দ একই রেখে ওর এক নতুন অর্থ দিয়ে দেওয়া ঘটেছে। মিথ্যা অভিনয় করা হয়েছে যেন ধর্মতত্ত্ব বলে দুনিয়াতে কিছু এখন নাই, আগেও ছিল না। 

যেমন ধরা যাক, খ্রিশ্চান গির্জার সেই ধর্মীয় তত্ত্বকথা আলোচনার সেমিনারিজ [seminaries]- সেটা এখনো ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে একটু ছেটে নিয়ে ‘সেমিনার’ বলে। আর তা নট নেসেসারিলি সেখানে আলোচনার বিষয় ধর্মতত্ত্বই হতে হবে। না এর কোনো দরকার আর এযুগে নাই। তা একাডেমিক, রাজনীতিক বা সাইন্টিফিক এমন যে কোনো বিষয় এখন হতে পারে। মানে এখানে বিষয় বলতে এটিকে এখন সার্বজনীন করে নেওয়া হয়েছে। আবার এমনকি তা কেবল খ্রিশ্চানিটিই নয় বরং যে কোনো ধর্মীয়ও হতে পারে নাও পারে এমন করে নেয়া হয়েছে। সোজাকথা সবকিছুর জন্য সব প্রসঙ্গেই সেমিনার ডাকা যেতে পারে। বরং ‘সেমিনার’ শব্দের আজকের রূপ দেখে বুঝার উপায় রাখা হয় নাই যে এর অরিজিন খ্রিশ্চিয়! এটিকেই বলা হয় শব্দ, অর্থ এবং এর ব্যবহারকে ধর্মীয় অরিজিনকে সার্বজনীন করে তোলা এবং ব্যবহার করা। এ ছাড়া মডার্ন যুগের আর গতি কী? অনেকে এই প্রক্রিয়াকে সেক্যুলারাইজেশন বলে ব্যাখ্যা করতে চান। তা বলুক, তবে তারা বোকা ইসলামবিদ্বেষী না হলেই হয়; কিন্তু আবার খেয়াল রাখতে হবে এটি কোনো নাস্তিকতার মামলা একেবারেই কিন্তু নয়। 

ইউরোপে খ্রিশ্চান রাষ্ট্র দাঁড়ালো না কেন:
ব্যাপারটি আরেকটা দিক থেকে দেখা যাক। ইউরোপে কখনো খ্রিশ্চান রাষ্ট্র বলে কখনো কিছু দাঁড়ালো না কেন? যেখানে জর্মানিতে সবচেয়ে প্রভাবশালী মার্টিন লুথার (১৪৮৩-১৫৪৬) যিনি এক বড় সংস্কারক। প্রটেস্টান্ট খ্রিশ্চান ধারার জনক, থিওলজিক্যাল একাডেমিশিয়ান। রেনেসাঁর শুরুর দিকের তিনি প্র্যাকটিসিং ক্যাথলিক চর্চার সামাজিক সমালোচনা করতে গিয়ে আস্তে আস্তে শেষে প্রটেস্টান্ট সংস্কারক হয়ে যান। আর তাতে আবার গরিবের দিক থেকে ধর্মতত্ত্বীয় তাফসির-কারক তিনি। তবুও রাজতন্ত্রের পরিসমাপ্তিতে ইউরোপ রিপাবলিক রাষ্ট্রের দিকে রওনা দিয়েছিল। অথচ কোনো খ্রিশ্চান ফ্যাকড়ার শাসন চালু হয় নাই।

অনেকে এর কারণ হিসেবে মনে করেন যে ইউরোপের ত্রিশ বছরের (১৬১০-১৬৪৮) যে গৃহযুদ্ধ [Thirty years Civil War] চলেছিল সেটাকে। যেটি সোজা ভাষায় বললে খ্রিশ্চানিটির বিভিন্ন ফ্যাকড়ার মধ্যে একে অন্যকে মেনে না নেয়ার যুদ্ধ। মানে কেউ অপরের তাফসিরকে সহ্য করতে চায় নাই -এভাবে আভ্যন্তরীণ যুদ্ধ চলেছিল যা শেষে জার্মানির এক শহরে ‘ওয়েস্টফিলিয়া চুক্তিতে’ (১৬৪৮) এর আপোষ ও সমাধান করা হয়েছিল। কী এই সমাধান টানা হয়েছিল? সেটা আমাদের সকলের জন্যই বহুদিক থেকে শিক্ষণীয়। সেটা এভাবে যে তখনও ইউরোপ বলতে মূলত রাজতন্ত্রের যুগ তবে ওর শেষ জমানা- যদিও ওর তরুণ রাজকুমারেরাও ব্যাপকভাবে ধর্ম ও সমাজ সংস্কারে আগ্রহী। যদিও মোটের ওপর তখনও সেটা রাজতন্ত্রেরই আমল। 

ওই ওয়েস্টফিলিয়া [Peace of Westphalia] সমাধানে বলা হয়েছিল, রাজা তখন থেকে আর কোনো ফ্যাকড়ার বা ধারার খ্রিশ্চানিটিকে বিশেষ খাতির দেখানো, অথবা কোনো ফ্যাকরার নাগরিকের প্রতি বৈষম্য অথবা যে নাগরিক রাজার নিজ ফ্যাকড়ার খ্রিশ্চানিটির চেয়ে ভিন্ন ফ্যাকড়ার খ্রিশ্চান যদি হয়ও তবু রাজা কোনো নাগরিককে বৈষম্য করবেন না। বঞ্চিত করতে পারবেন না। মানে সব ফ্যাকরার খ্রিশ্চানের উপরেই সমান আচরণ করতে রাজা বাধ্য থাকবেন। এই ছিল ওই গৃহযুদ্ধ থেকে ইউরোপের বাইরে আসার ও সমাপ্তি টানার সেসময়ের কার্যকর একমাত্র উপায় ও ফর্মুলা। ক্ল্যাসিক্যাল সেক্যুলারিজমের উৎপত্তি এখান থেকেই।

তাই এখান থেকে সারকথা ও শিক্ষাটা হলো- দুনিয়াতে এমন কোনো ধর্মতত্ত্ব নাই হয় না যার অনেকগুলো তাফসির মানে ধারা ফ্যাকড়া হয় নাই। ওই গৃহযুদ্ধ মানুষকে এই শিক্ষাই দিয়েছে যে সকলে একই ধর্মের হলেও ওর ব্যাখ্যার ভিন্নতার কারণে তা কত মারাত্মক হানাহানির হয়ে উঠতে পারে। অর্থাৎ ধর্মতত্ত্বীয় শাসন ব্যবস্থা মাত্রই তা ফ্যাকড়ার হানাহানিতে পতিত হবে। কাজেই যে কোনো একটা খ্রিশ্চান ফ্যাকড়ার আধিপত্য কোনো খ্রিশ্চান ধর্মতত্ত্বভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা সমাজ বা রাষ্ট্র পরিচালনা খাড়া করা অসম্ভব। কারণ সেক্ষেত্রে অন্যান্য ফ্যাকড়ার খ্রিশ্চানেরা ওই শাসন মানতে অস্বীকার করবেই, কোনোটা সহি আর কোনটা সহি না ইত্যাদি চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দিবে। এই কারণেই শক্তিশালী ধর্মতত্ত্ব হওয়া সত্ত্বেও ইউরোপে খ্রিশ্চান ধর্মতত্ত্ব¡ভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা (খ্রিশ্চান রাষ্ট্র) গড়ার চেষ্টা আর কখনো করা হয় নাই। তাই সবমিলিয়ে একমাত্র বিকল্প হিসেবে রিপাবলিক রাষ্ট্র [যদিও এর জাতিরাষ্ট্র ভার্সান] ইউরোপে সহজেই জায়গা করে নিতে পেরেছিল। 

ফলে ধর্মতত্ত্বভিত্তিক রাষ্ট্র বা সমাজের উদ্যোগকে সীমিত করে আনতেই এটিও একটা কারণ শব্দের ধর্মতাত্ত্বিক রুট শব্দগুলো লুকিয়ে ফেলা হয়েছিল। বা লন্ড্রিতে পাঠিয়ে চিহ্ন মুছে আনা হয়েছিল। বরং ফ্যাকড়া নির্বিশেষে গ্রহণযোগ্য করার জন্য সার্বজনীনতা বুঝায় এমনভাবে শব্দে আকার দেওয়া হয়েছিল। 

কিন্তু এই ফাঁকে মনে করিয়ে দেই, সমাজ ও রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব, প্রতিক্রিয়া ও ভূমিকা এতে কিন্তু উধাও হয়ে যায় নাই, করাও হয় নাই অথবা সেটা করাও এর লক্ষ্য ছিল না। তাহলে আসলে কী হয়েছিল? সেটা হলো ধর্মকেই সমাজ ও রাজনীতি আপন করে অভ্যন্তরে ঢুকিয়ে নিয়েছিল। আর সেটা এতই অন্তরে ও আপন করে নেয়া যে বাইরে থেকে তা বোঝা যায়নি। 

শেষ কথাটা হলো, আপনি ধর্ম অনুসরণে চলা মানুষ হবেন কি হবেন না সেটা একান্তই আপনার ব্যাপার; কিন্তু ধর্মবিদ্বেষ বিশেষত প্রগতিশীলতার উসিলায় ইসলামবিদ্বেষ অগ্রহণযোগ্য। আমার চায়ের কাপ নয় বলে - অন্যের চায়ের কাপ আপনার নয় বলে আপনি চা নাও খেতে পারেন; কিন্তু চায়ের বিরুদ্ধেই ঘৃণা-বিদ্বেষ সাজানো এটি ক্রাইম। তাতে পাল্টাপাল্টি রাগ-জিদ-ঈর্ষার ছড়াছড়িতে সমাজ নুন্যতম স্থিতিশীল রাখা বা থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে।


লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh