আফগান যুদ্ধের পেছনে কত খরচ?

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশ: ১৬ আগস্ট ২০২১, ০২:০৬ পিএম

কাবুল বিমানবন্দরের বাইরে তালেবান প্রহরা। ছবি : রয়টার্স

কাবুল বিমানবন্দরের বাইরে তালেবান প্রহরা। ছবি : রয়টার্স

দীর্ঘ ২০ বছর ধরে কোটি কোটি ডলার খরচ করে, হাজার হাজার সেনার দেহ কফিনবন্দি করে, দেশের ইতিহাসের দীর্ঘতম যুদ্ধ শেষ করে খালি হাতেই আফগানিস্তান থেকে ফিরতে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রকে।

মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর পেন্টাগন থেকে এখনো পর্যন্ত যে পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে সেই অনুযায়ী, গত ২০ বছরে আফগানিস্তানে যুদ্ধের পেছনে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি ডলার খরচ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যে শুধুমাত্র আফগান সেনাকে প্রশিক্ষণ দিতেই খরচ হয়েছে ৮ হাজার ৯০০ কোটি ডলার। ২০২০ সালের একটি রিপোর্টে পেন্টাগন জানায়, সরাসরি যুদ্ধেই তাদের ৮১ হাজার ৫৭০ কোটি ডলার খরচ হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের পরেই আফগানিস্তানে সবচেয়ে বেশি সৈন্য রয়েছে যুক্তরাজ্য ও জার্মানির। যুক্তরাজ্য আফগানিস্তানে ৩ হাজার কোটি আর জার্মানি এক হাজার ৯০০ কোটি ডলার খরচ করেছে বলে ধারণা করা হয়।

মূলত আল কায়দা ও তাদের আশ্রয়দাতা তালেবান নিধনের লক্ষ্যেই আফগানিস্তানে পা রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু আফগানিস্তানকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে ঋণ পর্যন্ত নিতে হয় তাদের। সেই ঋণের সুদ বাবদই যুক্তরাষ্ট্রকে ৫৩ হাজার কোটি ডলার গুনতে হয়েছে বলে স্পেশ্যাল ইনস্পেক্টর জেনারেল ফর আফগানিস্তান রিকনস্ট্রাকশনের (সিগার) একটি রিপোর্টে উঠে এসেছে। 

২০০৯ সালে আফগানিস্তানে সেনা বাড়িয়ে এক লাখ করেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। আফগান সেনা ও পুলিশ মিলিয়ে তালেবানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে লড়াইয়ে নামে ৩ লাখ সেনা।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০১২ সাল নাগাদ যখন দেশটিতে এক লাখের বেশি সৈন্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের, তখন বছরে ১০ হাজার কোটি ডলার খরচ হতো।

ব্রাউন ইউনিভার্সিটির ২০১৯ সালের গবেষণা অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র দেশটিতে ৯৭ হাজার ৮০০ কোটি ডলার খরচ করেছে। তবে ওই গবেষণাতে এটিও উল্লেখ করা হয় যে, যুদ্ধের সার্বিক খরচ নিরূপণ করা কঠিন কারণ সরকারের নানা দফতরের হিসাব রাখার আলাদা আলাদা ধরন রয়েছে। সময়ের সাথে সাথে তার পরিবর্তনও হয়েছে।

সিগারের রিপোর্ট বলছে, ২ হাজার ৪৪২ জন মার্কিন সেনার মৃত্যু হয়েছে। বেসরকারি সংস্থা থেকে নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে আফগানিস্তানে গিয়ে প্রায় ৪ হাজার জন মারা গিয়েছেন, তাদের অধিকাংশের মৃত্যুর কোনো রেকর্ডই নেই পেন্টাগনের কাছে। আবার গুরুতর জখম হয়ে ফিরেছেন ২০ হাজার ৬৬৬ জন। 

সিগারের দাবি, সবমিলিয়ে আফগানিস্তান থেকে বেঁচে ফিরেছেন যে সব সৈনিক, তাদের চিকিৎসা ও কল্যাণমূলক ভাতা বাবদ ২৯ হাজার ৬০০ কোটি ডলার খরচ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। যত দিন তারা বেঁচে থাকবেন তত দিন তাদের ভাতা দিতে হবে মার্কিন সরকারকে।

তবে যুক্তরাষ্ট্র জলের মতো টাকা খরচ করলেও গত ২০ বছরে আফগানিস্তানের পরিস্থিতির তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। বাঁধ, পাকা রাস্তা, স্কুল, হাসপাতাল তৈরি হয়েছে বটে, কিন্তু ২০২০ সালে বিশ্ব ব্যাংকের হিসেব অনুযায়ী, আফগানিস্তানে এখনো বেকারত্বের হার ২৫ শতাংশ ও দারিদ্রের হার ৪৭ শতাংশ।

শুধুই কি আর্থিক ক্ষতি? এই দীর্ঘ যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা টাকার অঙ্কে নির্ণয় করা সম্ভব নয় বলে মত কূটনীতিকদের একটা বড় অংশের। তাদের মতে, ভিয়েতনাম থেকে শিক্ষা নিয়ে আফগানিস্তান থেকে আগেই সরে যাওয়া উচিত ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। শান্তি ও স্থিতাবস্থা ফিরিয়ে আনার আশ্বাস দিয়ে এক সময় আফগানিস্তানে ঘাঁটি গেড়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু আফগানবাসীকে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে পাততাড়ি গুটিয়ে নেয়া মার্কিনীদের পক্ষে মঙ্গলজনক নয় বলে মনে করছেন কূটনীতিকরা। 

দু’দশক আগে যুক্তরাষ্ট্রের নেয়া একতরফা সিদ্ধান্তে এখনো পর্যন্ত আফগানিস্তানেরই সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। ৯/১১ হামলায় যদি তিন হাজার নিরীহ মানুষের প্রাণহানি হয়ে থাকে, গত ২০ বছরে আফগানিস্তানে প্রাণ হারিয়েছেন ৪৭ হাজার ২৪৫ জন নাগরিক। তালেবান, মুজাহিদিন বা অন্য কোনো জঙ্গি সংগঠনের সাথে কোনো সংযোগ ছিল না তাদের। 

আফগানিস্তান নিয়ে খবর করতে গিয়ে ৮০ জন সাংবাদিক প্রাণ হারিয়েছেন। আবার যুদ্ধক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করতে গিয়ে ৪০০-র বেশি মানুষ মারা গিয়েছেন। এই সব তথ্য দিয়েছে যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে করা ব্রাউন ইউনিভার্সিটির একটি রিপোর্ট।

যুদ্ধে নেমে কত জন সেনা মারা গিয়েছেন এখনো পর্যন্ত তার সঠিক হিসেব যদিও খোলসা করেনি আফগানিস্তান সরকার। সেনার মনোবল ভেঙে যাবে বলেই তা গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানিয়েছে আফগান সরকার। তবে গত ২০ বছরে প্রায় ৭০ হাজার আফগান সেনা মারা গিয়েছেন বলে অনুমান বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের।

কিন্তু এত কিছুর পরেও ‘শক্তিমান যুক্তরাষ্ট্র’ তালেবানকে কেন রুখতে পারল না? এই বিষয়ে নানা ব্যাখ্যা উঠে আসছে। কূটনীতিকদের একাংশের মতে, আফগানিস্তানে আসলে অহংয়ের লড়াই লড়তে গিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তালেবানের কাছে তা ছিল শিকড় রক্ষার লড়াই। তাই যত বার আঘাত নেমে এসেছে, ভূপতিত হয়েও বার বার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে তারা। গুলি-বোমায় একজন তালেবান যোদ্ধা মারা গেলে তার জায়গায় আরো ১০ জন এগিয়ে এসেছেন।

তালেবান যোদ্ধার সংখ্যা ৬০ থেকে ৮০ হাজারের মতো। কোনো ইউনিফর্ম নেই, সিংহভাগ যোদ্ধার পায়ে জুতা পর্যন্ত নেই। কিন্তু তাদের চাপে তাসের ঘরের মতো ধসে পড়ছে আফগান বাহিনীর প্রতিরোধ।

তালেবানের এই সামরিক সাফল্যে হতচকিত হয়ে পড়েছে খোদ যুক্তরাষ্ট্র। অধিকাংশ পশ্চিমা সামরিক বিশ্লেষক এখন বলছেন, ন্যাটো বাহিনী তালেবানের কোনো ক্ষতি তো করতে পারেইনি, বরঞ্চ গত ২০ বছরের মধ্যে তালেবান এখন সবচেয়ে শক্তিধর।

এত দ্রুতগতিতে তালেবানের অগ্রযাত্রায় যুক্তরাষ্ট্র বিস্মিত হলেও আফগান কমান্ডাররা কিন্তু বিস্মিত নন। তারা জানতেন, আফগান সরকারি বাহিনীর দুঃখ–দুর্দশা প্রশমনে কখনো নজর দেয়া হয়নি। পশ্চিমা দেশ–সমর্থিত প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির সরকারের ভেতরে গেড়ে ছিল দুর্নীতির লম্বা শিকড়। যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা পেলেও অনেক আফগান সেনা ও পুলিশ সদস্যকে মাসের পর মাস বেতন দিতে ব্যর্থ হয়েছে তার সরকার। সরকারি বাহিনীর মধ্যে ঘটেছে বিদ্রোহের মতো ঘটনাও।

আফগান সেনা থেকেও বহু জন তালেবানের সাথে যোগ দিয়েছে। আবার হানাহানি এড়াতে তাদের সাথে সমঝোতার পথ বেছে নিয়েছেন বিভিন্ন প্রদেশের গভর্নররা। গত দু'মাস ধরে হাজার হাজার আফগান সৈনিক লড়াই না করেই তালেবানের হাতে অস্ত্র, যানবাহন, রসদ তুলে দিয়ে ইউনিফর্ম খুলে চলে যাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়াতে অনেক ভিডিও পোস্টে দেখা গেছে, আত্মসমর্পণের পর অনেক সৈনিক তালেবান যোদ্ধাদের আলিঙ্গন করছে। তালেবান তাদের পকেটে কিছু টাকা গুজে দিয়ে বাড়িতে চলে যেতে বলছে। মাস-খানেক আগে এক হাজারেরও বেশি সরকারি সৈন্য দলত্যাগ করে প্রতিবেশী তাজিকিস্তানে পালিয়ে যায়।

আশরাফ গনি, যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোকে হটিয়ে ২০ বছর পর ফের তালেবান কাবুলে শাসন কায়েম করেছে বলে মনে করছেন কূটনীতিকরা। -বিবিসি ও আনন্দবাজার পত্রিকা

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh