মাহমুদ সালেহীন খান
প্রকাশ: ১৬ আগস্ট ২০২১, ০২:৫৪ পিএম
ফাইল ছবি
‘প্রিয় গ্রাহক, জাতীয় স্বাস্থ্যসেবার কলসেন্টার স্বাস্থ্য বাতায়ন ১৬২৬৩-তে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের সব লাইন এই মুহূর্তে ব্যস্ত আছে। আমাদের একজন ডাক্তার শিগগিরই আপনার কলটি রিসিভ করবেন। ততক্ষণ পর্যন্ত অনুগ্রহপূর্বক অপেক্ষা করুন।’ মোবাইল ফোনে স্বাস্থ্যসেবার (টেলিমেডিসিন) সরকারি কলসেন্টারে বারবার ফোন করে অন্য প্রান্ত থেকে এমন বার্তা শুনতে পাচ্ছিলেন রাজধানীর ওয়ারির বাসিন্দা সোহেল আহমেদ। বাসায় তার স্ত্রী করোনায় আক্রান্ত। পরিবারের আরও দু’জনের আছে করোনার লক্ষণ। হাসপাতালে ভর্তি হতে না পেয়ে বাসায় থেকেই তার স্ত্রী চিকিৎসা নিচ্ছেন; কিন্তু জরুরি প্রয়োজনে তিন দিন ধরে তিনি অন্তত ১৫ বার ফোন করেও সংযোগ পাননি। এটি নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে সোহেল আহমেদের প্রশ্ন, ‘শিগগির মানে কতক্ষণ? বিপদের সময় যদি ডাক্তার না পাওয়া যায়, তাহলে এই সেবা থেকে কী লাভ?’
একদিকে করোনা আর অন্যদিকে ডেঙ্গু- এই মহামারির সময়ে সোহেলের মতো হাজারো মানুষ ২৪ ঘণ্টার স্বাস্থ্যসেবার এই প্ল্যাটফর্ম থেকে সেবা নিতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছে। সহজেই চিকিৎসা পরামর্শ পাওয়ার আশায় বারবার কল করে অপেক্ষায় থাকতে থাকতে, তাদের মোবাইল ফোনের ব্যালেন্স শেষ হচ্ছে; কিন্তু সেবা মিলছে না।
বেশ কিছুদিন ধরেই টেলিমেডিসিনে হয়রানির অভিযোগ আসছে। অধিকাংশ জেলা হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে টেলিমেডিসিন সেবা পেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোন করেও চিকিৎসক না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। স্বাস্থ্য বাতায়নে কল করে প্রতি মিনিটে ৬০ পয়সা করে খরচ হয় গ্রাহকের। ফ্রিতে টেলিমেডিসিন সেবা দেওয়ার কথা থাকলেও, অনেক ডাক্তারের বিরুদ্ধে ফিস নেওয়ার অভিযোগ আসছে। ওয়েব ক্যাম ও ল্যাপটপ বিকল হয়ে বন্ধ রয়েছে অনেক সরকারি হাসপাতালের টেলিমেডিসিন কার্যক্রম। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েও নির্ধারিত সময়ে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ না করিয়ে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ বিষয়ে কোনো গাইডলাইন না থাকায় চিকিৎসক ও সেবাগ্রহীতাদের ভোগান্তি বাড়ছে।
করোনা ও ডেঙ্গুর এই সময়ে অন্যান্য রোগীদের চিকিৎসাসেবা পেতে টেলিমেডিসিনের ওপর আস্থা কমে গেছে গ্রাহকদের। পরিসংখ্যান দেখলেই বোঝা যায়। করোনা শুরুর পর থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত শুধু স্বাস্থ্য বাতায়ন ১৬২৬৩ থেকে টেলিমেডিসিন সেবা নিয়েছেন- এক কোটি ৭৩ লাখ ৬৪ হাজার ২৫১ জন। এসব কলের মধ্যে ৭০ শতাংশ চিকিৎসা ও পরামর্শ নিয়েছে। এর মধ্যে ২০২০ সালে কল এসেছিল এক কোটি ৯ লাখ ৭৮ হাজার ৩৩২টি। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত কল এসেছে ১৬ লাখ ৫২ হাজার ৭০১টি। এর মধ্যে গত মে মাসে কল এসেছে এক লাখ ৫০ হাজার ৫৯১টি, জুনে ৮৯ হাজার ৯৬৫টি । জুলাইয়ে কল এসেছে ৪৫ হাজার ২৭৪টি।
করোনা শনাক্ত হলেও যাদের উপসর্গ মারাত্মক নয়, তাদের বাসায় থেকে টেলিমেডিসিন সেবা নিতে পরামর্শ দেওয়া হয়। এ সেবা নিতে বিড়ম্বনায় পড়েন করোনা আক্রান্ত আব্দুল গনি (৪৫)। অসুস্থ আব্দুল গনিকে মুগদা হাসপাতাল থেকে যাত্রাবাড়ীর বাসায় ফেরত নিয়ে যান ছেলে সাব্বির আহমেদ।
তিনি বলেন, বাবার করোনা শনাক্ত হলেও কোনো মারাত্মক উপসর্গ না থাকায় চিকিৎসকরা তাকে বাসায় থেকে জাতীয় স্বাস্থ্যসেবার ১৬২৬৩ নম্বরে ফোন দিয়ে চিকিৎসা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন; কিন্তু ফোন করে নাজেহাল হচ্ছি, সময়মতো সেবা পাচ্ছি না।’
অর্থের বিনিময়ে টেলিমেডিসিন সেবা নেওয়ার অভিজ্ঞতার কথা জানালেন গুলশানের বাসিন্দা তথ্যপ্রযুক্তিবিদ সানাউল করিম। তিনি বলেন, বেশ কিছু শারীরিক সমস্যার কারণে প্রতি মাসে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া হয়। পরিস্থিতির কারণে বাইরে যাওয়াটা ঝুঁকিপূর্ণ। তাই চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে নির্ধারিত ফি দিয়ে টেলিমেডিসিন সেবা নিয়েছেন। ওয়েব ক্যামের সামনে বসে থেকে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে পরামর্শ নিয়েছি। পরে তিনি ব্যবস্থাপত্র মেইল করেছেন; কিন্তু আমাকে নির্ধারিত ফি’র বাইরেও চিকিৎসককে তার অতিরিক্ত ফি দিতে হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চিকিৎসক জানান, মোবাইল ফোনে সাধারণ চিকিৎসাসেবা দেওয়ায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তিনি কোনো ধরনের পরামর্শ ফি নেন না। তবে বিভিন্ন জটিল রোগীদের নির্ধারিত ফির বিনিময়ে ব্যবস্থাপত্র দিয়ে থাকেন। এ ক্ষেত্রে সেসব রোগীর জন্য তাকে ইন্টারনেট সংযুক্ত কম্পিউটারের সামনে বসে ওয়েবক্যামের মাধ্যমে রোগীর শারীরিক বিষয়াদির খোঁজখবর এবং ডায়াগনস্টিক রিপোর্ট দেখেই ব্যবস্থাপত্র দিয়ে থাকেন।
গ্রাহক ভোগান্তির কারণ জানতে চাইলে সিনেসিস হেলথের প্রধান নির্বাহী পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. নিজাম উদ্দিন আহমেদ বলেন, করোনার ঊর্ধ্বগতিতে কলের চাপ বাড়ছে। কল লোড যেহেতু অনেক বেশি, তাই অপেক্ষার সময়ও বেড়ে যাচ্ছে। একজন ডাক্তার প্রতি শিফটে ১০০টি কল ধরতে পারেন। যত বেশি ডাক্তার আমরা পাবো, তত দ্রুত সংযোগ পাওয়া যাবে।
স্বাস্থ্য বাতায়নের সূত্র মতে জানা যায়, করোনার প্রথম ঢেউয়ে স্বাস্থ্য বাতায়নে ৪০০ জন ডাক্তার ছিল। এখন আছেন মাত্র ৬০ জন। কলের চাপ সমালাতে এখনো ৩০০-৩৫০ জন চিকিৎসক এবং ৫০ জন স্বাস্থ্যবিষয়ক তথ্য কর্মকর্তা দরকার।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সিনিয়র সচিব এন এম জিয়াউল আলম বলেন, এখন করোনা বেড়ে যাওয়ায় কল আসছে; কিন্তু ডাক্তার না থাকার কারণে গ্রাহকরা ভোগান্তিতে পড়ছেন। আস্থা কমছে। সেবাটির উন্নয়ন চলমান প্রক্রিয়া। ডাক্তার বাড়ানোর জন্য আমরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে বলব। ভবিষ্যতে করোনা না থাকলেও এসব সেবা নাগরিকদের জন্য চালু রাখতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, এ সেবাটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বেসরকারি খাত থেকে প্রতিযোগিতামূলক টেন্ডারের মাধ্যমে কিনে নিয়ে পরিচালনা করছে। তাদের জায়গা থেকে কোনো দুর্বলতা থাকলে আমরা দেখব। পাশাপাশি এই সেবার পরিধি আরও বাড়ানোর জন্য নতুন করে টেন্ডার প্রক্রিয়া চলছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) বিভাগ ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবার হটলাইন কার্যক্রমের সমন্বয়ক শাখার পরিচালক ডা. মিজানুর রহমান বলেন, মানুষের কেন সংযোগ পেতে দেরি হচ্ছে, সেটা খোঁজ নিয়ে দেখব। ডাক্তারের সংখ্যা বাড়ানো হয়নি। বাড়ানো যায় কি-না আমরা দেখব।
একসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রকল্পের ন্যাশনাল কনসালট্যান্ট (ল্যান্ড ইনোভেশন) গোলাম মোহাম্মদ ভূঁইয়া বলেন, সবকিছু সামাল দিয়েই আমাদের চলতে হচ্ছে। মানুষকে যাতে লম্বা সময় অপেক্ষা করতে না হয়, তার জন্য সেবাটির উন্নয়নে ভিন্ন বিজনেস মডেলে যাওয়ার বিষয়টিও আমরা চিন্তা করছি। আগামী মার্চ থেকে আরও আধুনিক প্রযুক্তি প্রবর্তনের পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে।