পিয়াস মজিদ
প্রকাশ: ২১ আগস্ট ২০২১, ০২:৩৬ পিএম | আপডেট: ২১ আগস্ট ২০২১, ০২:৩৮ পিএম
ফাইল ছবি
কাঁদো প্রিয় দেশ বইটি উপমহাদেশের প্রখ্যাত বিবেকী বুদ্ধিজীবী অন্নদাশঙ্কর রায়ের লেখা অশ্রুময়ী গদ্যের সংকলন। এই বই সেই ছড়াশিল্পীর বঙ্গবন্ধু স্মরণার্ঘ্য যিনি লিখেছেন, সেই কালোত্তীর্ণ ছড়া- ‘যতকাল রবে পদ্মা মেঘনা/গৌরী যমুনা বহমান/ততকাল রবে কীর্তি তোমার/শেখ মুজিবুর রহমান। আলোচ্য বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় কলকাতার শঙ্কর প্রকাশন থেকে, আষাঢ় ১৩৮৩-তে। গ্রন্থটির বাংলাদেশ সংস্করণের ‘প্রসঙ্গ কথা’য় প্রয়াত লেখক- সাংবাদিক বেবী মওদুদ জানাচ্ছেন- তাঁর খুব ইচ্ছা বইটি এখানে প্রকাশিত হোক। অতঃপর বাংলাদেশের অন্বেষা প্রকাশন এর বাংলাদেশ সংস্করণ প্রকাশ করে ফেব্রুয়ারি ২০১০-এ। এরপর ২০১১ এবং ২০১৬-তে এর আরও দুটি মুদ্রণ প্রকাশিত হয়, যা এর পাঠকপ্রিয়তারই প্রমাণবহ। বইটির উৎসর্গপত্রও স্মরণীয়- নরহত্যা মহাপাপ, তার চেয়ে পাপ আরো বড়ো/ করে যদি যারা তাঁর পুত্রসম বিশ্বাসভাজন/ জাতির জনক যিনি অতর্কিতে তাঁরেই নিধন।/ নিধন সবংশে হলে সেই পাপ আরো গুরুতর।
সারা দেশ ভাগী হয় পিতৃঘাতী সে ঘোর পাপের/ যদি দেয় সাধুবাদ, যদি করে অপরাধ ক্ষমা।/ কর্মফল দিনে দিনে বর্ষে বর্ষে হয় এর জমা/ একদা বর্ষণ হয় বজ্ররূপে সে অভিশাপের।
রক্ত ডেকে আনে রক্ত, হানাহানি হয়ে যায় রীত।/ পাশবিক শক্তি দিয়ে রোধ করা মিথ্যা মরীচিকা।/ পাপ দিয়ে শুরু যার নিজেই সে নিত্য বিভীষিকা।/ ছিন্নমস্তা দেবী যেন পান করে আপন শোণিত।
বাংলাদেশ! বাংলাদেশ! থেকো নাকো নীরব দর্শক/ ধিক্কারে মুখর হও। হাত ধুয়ে এড়াও নরক।
ভূমিকা থেকে জানা যায় অন্নদাশঙ্কর রায় নীরবতার পাপ থেকে রেহাই পেতে চেয়েছেন অক্ষরের শরণ নিয়ে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর চারপাশের নিখিল নীরবতাকে প্রত্যাখ্যান করে তিনি লিখেছেন, প্রবন্ধের পর প্রবন্ধ, স্মৃতিগদ্যের পর স্মৃতিগদ্য, মূল্যায়নের পর মূল্যায়ন।
এই বইয়ে সংকলিত হয়েছে বারোটি গদ্য- কাঁদো, প্রিয় দেশ, ইন্দ্রপাত, আঁধারে আলো, হে মোর দুর্ভাগা দেশ, পালা বদল, স্মৃতিচারণ, বজ্রাঘাত, নীরব সাক্ষী, পোস্ট মর্টেন, মুজিববাদ, টালমাটাল, আত্মার আত্মীয়।
নামপ্রবন্ধ, ‘কাঁদো, প্রিয় দেশ’-এ তিনি খোলা চোখে দেখেছেন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের বাস্তবতা। উপলব্ধি করে মুজিব-হত্যার পটভূমি। আর তারপর উচ্চারণ করেন এমত অভীক শব্দমালা- পনেরোই আগস্টের প্রত্যুষে মুজিব পরিবারের সবাইকে হত্যা করা হয়েছে। তাঁর বহু আত্মীয়-স্বজনকেও। এর নাম ক্রাইম এগেইনস্ট হিউমানিটি। কাঁদো, প্রিয় দেশ। কাঁদো সকলের জন্য। ... গোটা বঙ্গোপাসাগরের জল দিয়ে এই রক্ত মুছে সাফ করা যাবে না। বরং রক্ত লেগে রাঙা হবে বঙ্গোপসাগরের নীল জল। কাঁদো, প্রিয় দেশ। তোমার চোখে যত জল আছে সব ঢেলে প্রক্ষালন করো এই রক্তাক্ত হাত। (পৃষ্ঠা ২৮) তিনি এই দেশকে কাঁদতে বলেছেন ‘মুক্তিদাতা মুজিবের জন্য’। সেই মুজিব যিনি গোটা জাতিকে মুক্তি দিয়েছিলেন অমানিশার অন্ধকার থেকে, হাত ধরে নিয়ে গেছেন আলোকিত ভোরের পানে। ‘ইন্দ্রপাত’ রচনা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের বিবরণ। ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি আয়োজিত জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনে অংশ নিয়ে মঞ্চে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সমাসীন ছিলেন অন্নদাশঙ্কর। মঞ্চে বসেই তিনি বঙ্গবন্ধুর অনানুষ্ঠানিক সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। এই সাক্ষাৎকারের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্ন-
বাংলাদেশের আইডিয়াটা প্রথম কবে আপনার মাথায় এলো?
তার চেয়েও তাৎপর্যপূর্ণ বঙ্গবন্ধুর উত্তর-
সেই ১৯৪৭ সালে। তখন আমি সুহরাবর্দী সাহেবের দলে। তিনি ও শরৎচন্দ্র বসু চান যুক্তবঙ্গ। আমিও চাই সব বাঙালির এক দেশে। বাঙালিরা এক হলে কী না করতে পারত। তারা জগৎ জয় করতে পারত।
দিল্লি থেকে খালি হাতে ফিরে এলেন সুহরাবর্দী ও শরৎ বোস। কংগ্রেস বা মুসলিম লীগ কেউ রাজি নয় তাঁদের প্রস্তাবে। তাঁরা হাল ছেড়ে দেন। আমিও দেখি যে আর কোনো উপায় নেই। ঢাকায় চলে এসে নতুন করে আরম্ভ করি। তখনকার মতো পাকিস্তান মেনে নিই; কিন্তু আমার স্বপ্ন সোনার বাংলা। সে স্বপ্ন কেমন করে পূর্ণ হবে এই আমার চিন্তা। হবার কোনো সম্ভাবনাও ছিল না। লোকগুলো যা কমিউনাল! বাংলাদেশ চাই বললে সন্দেহ করত। হঠাৎ একদিন রব উঠল, আমরা চাই বাংলাভাষা। আমিও ভিড়ে যাই ভাষা আন্দোলনে। ভাষাভিত্তিক আন্দোলনকেই একটু একটু করে রূপ দিই দেশভিত্তিক আন্দোলনে। পরে এমন এক দিন আসে যেদিন আমি আমার দলের লোকদের জিজ্ঞাসা করি, আমাদের দেশের নাম কী হবে? কেউ বলে, পাক বাংলা। কেউ বলে, পূর্ব বাংলা। আমি বলি, না, বাংলাদেশ। তারপর আমি স্লোগান দিই, জয় বাংলা। তখন ওরা বিদ্রুপ করে বলে, জয় বাংলা না জয় মা কালী! কী অপমান! সে অপমান আমি সেদিন হজম করি। আসলে ওরা আমাকে বুঝতে পারেনি। জয় বাংলা বলতে আমি বোঝাতে চেয়েছিলুম বাংলাভাষা, বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির জয়, যা সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে। (পৃ. ৩৩-৩৪)
‘আঁধারে আলো’ লেখাটি সেই ঐতিহাসিক সত্য তুলে ধরে যেখানে দৃশ্যমান- শেখ মুজিব হত্যা কেবল ব্যক্তিহত্যা নয় বরং আদর্শের হত্যা। এই লেখায় তথ্যপ্রমাণসহ দেখতে পাই ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫-এর পর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র নষ্ট করে একে ধর্মরাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালানো হয়, ‘জয় বাংলা’র বদলে রব তোলা হয় ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ বলে।
‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ’-এ লেখকের বিস্ময়-মুজিব আর কারও হাতে নয়, তার প্রিয় বাঙালি জাতির কিছু অপসন্তানের হাতেই প্রাণ হারান। এ বিষয়ে লেখকের বিস্ময়বাক্য পাঠককে স্পর্শ করে, নিপতিত করে আত্মগ্লানিতে-
তাই আমার মনজুড়ে ধ্বনি ওঠে, ‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ।’ যখন শুনি মুক্তিদাতা মুজিব নিহত হয়েছেন। পশ্চিমাদের হাতে নয়, বাঙালিদেরই হাতে। যাদের হাতে হাতিয়ার ধরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি তারাই তাঁকে মেরে বীরপনা ফলিয়েছে। আর চুনকালি মাখিয়ে দিয়েছে বাঙালি বলে যারা পৃথিবীতে পরিচিত তাদের সকলেরই গালে। হ্যাঁ, আমার গালেও। বাঙালি বাঙালির শাসন মানবে না, শাসকের যদি কোনো দোষ ঘটে থাকে, তবে তাঁকে আত্মসংশোধনের সুযোগ দেবে না। একজন মানুষ হিসেবে তাঁকে আত্মরক্ষার সুযোগ দেবে না। অরক্ষিত অবস্থায় অর্তকিতে হত্যা করবে। (পৃ. ৩৫)
‘পালা বদল’-এ লেখক দেখান শেখ মুজিবের হত্যার মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল শুধু ক্ষমতারই পালাবদল নয় বরং আদর্শেরও পতন। ‘স্মৃতিচারণ’ অন্নদাশঙ্কর রায় শেখ মুজিবকে নিয়ে তাঁর বিখ্যাত ছড়া লেখার পটভূমি বর্ণনা করেন- মুজিবকে তিনি সম্বোধন করেন ‘বাংলাদেশের আত্মা’ বলে।
এর পরের বেশ কয়েকটি লেখা মূলত কিছু পত্রপ্রবন্ধ, প্রত্যেকটিরই উপজীব্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ‘বজ্রাঘাত’ লেখাটি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে, নীরব সাক্ষী লেখাটি ঢাকার জনৈক সাহিত্যিক বন্ধুকে, ‘পোস্ট মর্টেম’ লেখাটি প্রবোধচন্দ্র সেনকে, ‘মুজিববাদ’ প্রবন্ধটি এই শিরোনামে গ্রন্থের লেখক খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসকে এবং ‘টালমাটাল’ প্রবন্ধটি চট্টগ্রামের সাহিত্যিক মাহবুব উল আলমকে লিখিত।
কাঁদো প্রিয় দেশ এভাবে হয়ে উঠে এক কালিক দলিল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকে এই বইয়ের লেখক অন্নদাশঙ্কর রায় বিবেচনা করেন বাঙালির যাবতীয় শুভবোধ এবং সুকৃতির হত্যা হিসেবে। বাংলা ভাষা, বাঙালি জাতি, বাঙালি সংস্কৃতি-সবকিছুর ওপরেই এই হত্যাকাণ্ডের ভয়ংকর অভিঘাতকে লেখক দিব্যদৃষ্টিতে অবলোকন করেছেন এবং দরদি অন্তরে ও সংবেদী ভাষায় যেন গোটা বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে উচ্চারণ করেছেন এমন অনুশোচনা এবং উত্তরণ-কথন-
কাঁদো, প্রিয় দেশ। কাঁদো মুক্তিদাতা মুজিবের জন্য। তাঁর সেই পরিচয়টাই ইতিহাসে অমর হবে। কাঁদো তাঁর সহমৃতা সাধ্বী সহধর্মিণীর জন্যও, বালক পুত্রের জন্যও। কাঁদো, কাঁদো, প্রিয় দেশ।