ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ২৬ আগস্ট ২০২১, ০৯:২৪ এএম
৩২নং রোডের সেই বাড়ি
স্বপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার সাথে জড়িত ছিল সেনাবাহিনীর কিছু কর্মকর্তা। তাদের কয়েকজন ও কিছু সৈনিক বাড়িটির সামনে ও ভেতরে ছিলেন। কিন্তু অফিসিয়ালি আদেশপ্রাপ্ত হয়ে বাড়িটির মধ্যে প্রথমবারের মতো যান লে. কর্নেল এম এ হামিদ পিএসসি।
সে সময়ে তিনি ঢাকা স্টেশনের দায়িত্বে ছিলেন। তার লেখা ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান এবং না বলা কিছু কথা’ বইটিতে লিখে রেখে গেছেন সেই সময়ের কিছু তথ্য।
তিনি সেখানে দেখতে পান বাড়ির মূল দরজায় মেজর পাশা ও মেজর বজলুল হুদা দাঁড়িয়ে ছিলেন। হুদা প্রথমেই তাকে নিয়ে গেলেন নিচতলার রিসিপশন রুমে। সেখানে শেখ কামালের মৃতদেহ টেবিলের পাশে একগাদা রক্তের মাঝে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। একটা টেলিফোনের রিসিভার টেবিল থেকে ঝুলছিল।
লে. কর্নেল হামিদের মনে হয়েছিল, শেষ মুহূর্তে কাউকে ফোন করতে চাইছিলেন শেখ কামাল। একটা হাত তার ওদিকেই ছিল। টেবিলের পাশে আর একটি মৃতদেহ। একজন পুলিশ অফিসার। প্রচুর রক্তক্ষরণেই দুইজন মারা গেছেন। কামালের ভাঙ্গা চশমা পাশে পড়েছিল।
সিঁড়ির উপর শেখ মুজিব
তিনি বলেন, ‘এরপর আমরা দুইতলায় উঠতে পা বাড়ালাম। সিঁড়ির মুখেই চমকে উঠলাম। সিঁড়িতেই দেখি পড়ে আছেন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। তার পরনে ছিল সাদা পাঞ্জাবি ও চেক লুঙ্গি। পাশে পড়ে আছে তার ভাঙ্গা চশমা। তার দেহ সিঁড়ির ওপরে এমনভাবে পড়েছিল যেন মনে হচ্ছিল সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে হঠাৎ পা পিছলে পড়ে গেছেন। কারণ তার মুখে কোনো রকমের আঘাতের চিহ্ন ছিল না। চেহারা ছিল সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। তার বুকের অংশটুকু ছিল ভীষণভাবে রক্তাক্ত। মনে হলো ব্রাস লেগেছে’।
তিনি আরো লিখেছেন, ‘তার বাম হাতটা ছিল বুকের উপর ভাঁজ করা, তবে তর্জনী আঙ্গুলটা ছিঁড়ে গিয়ে চামড়ার টুকরার সাথে ঝুলেছিল। তার দেহের অন্য কোনো অঙ্গে তেমন কোনো আঘাত দেখিনি। সারা সিঁড়ি বেয়ে রক্তের বন্যা।’
সিঁড়ির মুখেই ঘরটাতে বেগম মুজিবের দেহ দেউড়ির উপর উপুড় হয়ে পড়ে ছিল। তার গলার হারটা ঢুকে ছিল মুখের মধ্যে। তিনি লিখেছেন, ‘মনে হলো স্বামীর উপর গুলির শব্দ শুনে তিনি ছুটে আসছিলেন। কিন্তু দরজার মুখেই গুলিবিদ্ধ হয়ে দেউড়িতে লুটিয়ে পড়েন। তার দেহ অর্ধেক বারান্দায় অর্ধেক ঘরের ভেতরে’।
এক ঘরের মধ্যেই সবার মরদেহ
লে. কর্নেল হামিদ লিখেছেন, ‘তাকে পাশ কাটিয়ে কামরার ভেতরে প্রবেশ করলাম। কামরার মেঝেতে এক সাগর রক্ত থপথপ করছিল। আমার বুটের সোল প্রায় অর্ধেক ডুবে যাচ্ছিল। বিধ্বস্ত পরিবেশ। রক্তাক্ত কামরার মধ্যে পড়ে আছে কয়েকটি লাশ। বাম পাশেরটি শেখ জামাল। তার দেহের ক্ষতবিক্ষত অবস্থা দেখে মনে হলো কামরার ভেতরে গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। মিসেস রোজী জামাল সদ্য বিবাহিতা হাতে তাজা মেহেদীর রং। ব্রাস অথবা গ্রেনেডের আঘাত সরাসরি তার মুখে লেগেছিল’।
‘পাশে মিসেস সুলতানা কামাল। প্রচুর রক্তক্ষরণে এখন তার চেহারা সম্পূর্ণ বিবর্ণ ,শুকনো। তার কোল ঘেঁষে ছোট রাসেলের মৃতদেহ। তার মাথার পিছনদিক একেবারে থেঁতলে গিয়েছিল’।
‘সবগুলো ঘর ছিল খোলা। প্রতিটি ঘরেই দামি দামি জিনিসপত্র। রাষ্ট্রপতির পরিবার। মাত্র কদিন আগেই দু‘দুটি বিয়ে হয়ে গেছে ওই বাড়িতে শেখ কামাল এবং শেখ জামালের। আনন্দ মুখর আনন্দ ভবনটি এখন নীরব নিথর।
নিচের তলার একটি বাথরুমে পড়েছিল শেখ মুজিবের ভাই শেখ নাসেরের রক্তাপ্লুত মৃতদেহ, চেনাই যাচ্ছিল না। বাড়ির পিছনে আঙ্গিনায় একটি লাল গাড়ির পেছনের ইটে হেলান দিয়ে বসিয়ে রাখা ছিল কর্নেল জামিলের প্রাণহীন দেহ।
১৫ অগাস্ট দুপুর পেরিয়ে বিকেল। কিন্তু তখনো ক্ষমতার পালাবদলের হিসাব-নিকাস চলছে। মাথাব্যথা নেই ৩২ নং রোডের বাড়ির দিকে।’
রাতের অন্ধকারে দাফনের সিদ্ধান্ত
বঙ্গভবন থেকে রাত ৩টার দিকে ফোন এলো লে. কর্নেল হামিদের কাছে। ৩২নং বাড়ি, শেখ মনি, আবদুর রব সেরনিয়াবাতসহ অন্যান্য যারা ওই ঘটনায় মারা গিয়েছেন তাদের বাসা থেকে মৃতদেহ কালেক্ট করে বনানী গোরস্থানে দাফন করতে হবে। তবে শেখ সাহেবের লাশ শুধু বাড়িতে থাকবে, স্থান পরে জানানো হবে।
লে. কর্নেল এম এ হামিদ বলছেন, ‘আমার পৌঁছানোর আগেই শেখ সাহেবের পরিবারের সবগুলো লাশ কফিন বন্দি করে সাপ্লাই ব্যাটালিয়নের ট্রাকে তুলে আমার আগমনের অপেক্ষা করছিল। শুধু শেখ সাহেবের লাশ কফিন বন্দি করে বারান্দার এক কোনে ফেলে রাখা হয়েছে’।
লে. কর্নেল হামিদের মনে সন্দেহ হয়। তিনি সুবেদারকে কফিনটি খুলতে বলেন- তখন দেখেন সেটা তার ভাই শেখ নাসেরের মরদেহ। সুবেদার এর ব্যাখ্যা দিয়েছিল দুজনেই দেখতে অনেকটা, একরকম তাছাড়া রাতের অন্ধকারের কারণে এই ভুল।
মরদেহ দাফন
সাপ্লাই ব্যাটালিয়নের সৈনিকরা একটানা কাজ করে ১৮টি কবর খুঁড়ে রেখেছিল। ভোর হওয়ার আগেই লাশগুলা দাফন করা হয়। তিনি লিখেছেন, ‘লাশগুলো দাফনের পর আমি আমার অফিসে ফিরে এক এক করে নামগুলো আমার অফিস প্যাডে লিপিবদ্ধ করি। এছাড়া আর কোথাও এই সামধিগুলোর রেকর্ড নেই’।
প্রয়াত রাষ্ট্রপতির দাফন
বঙ্গভবন থেকে আবার মেসেজ পাঠানো হল। শেখ সাহেবের ডেডবডি টুঙ্গিপাড়া পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। একটি এয়ারফোর্স হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ১৬ অগাস্ট সন্ধ্যার আগে আগে তার দাফন কাজ সম্পন্ন হয়। তার শরীরে ১৮টি বুলেটের দাগ দেখতে পাওয়া যায়। তাকে শেষ বিদায় জানানো হয় অতি নীরবে, নিঃশব্দে টুঙ্গিপাড়ার একটি গ্রামে। -বিবিসি