মামলা, গ্রেফতার, জামিন ও অব্যাহতি বিতর্ক

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ৩১ আগস্ট ২০২১, ১১:১৬ এএম

আমীন আল রশীদ

আমীন আল রশীদ

সম্প্রতি বরিশাল সদর উপজেলা পরিষদ চত্বরে হামলা ও পুলিশের গুলির ঘটনায় পুলিশ এবং ইউএনও বাদী হয়ে যে দুটি মামলা করেছেন, তাতে মো. নাদের নামে একজনকে আসামি করা হয়েছে, যিনি মারা গেছেন অনেক বছর আগে। খোদ প্রশাসনের করা মামলায় একজন মৃত ব্যক্তি কী করে আসামি হন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। 

গণমাধ্যমের খবর বলছে, গত ১৮ আগস্ট রাতে বরিশাল সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নকর্মীরা অব্যবহৃত ব্যানার, পোস্টার পরিষ্কার করতে ইউএনওর বাসায় গেলে তাদের বাধা দেওয়া হয়। এরপর ঘটনাস্থল পর্যবেক্ষণ করতে প্যানেল মেয়র সেখানে যান এবং বাকবিতণ্ডার এক পর্যায়ে ইউএনওর বাসায় হামলা চালানো হয়। পরে সেখানে উপস্থিত আনসার সদস্যরা গুলিবর্ষণ করেন। পরিচ্ছন্নতা অভিযানকে কেন্দ্র করে ইউএনওর সরকারি বাসভবনে একদল মানুষ হামলা চালায়। পরে এ নিয়ে মামলা হয় এবং পুলিশ একজন কাউন্সিলরসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে, যারা মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর অনুসারী বলে পরিচিত।

এই ঘটনার জের ধরে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন বরিশাল সিটি মেয়রকে গ্রেফতারের দাবি জানায়। তবে অ্যাসোসিয়েশনের বিবৃতিতে যে ধরনের আক্রমণাত্মক ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, সেটি নিয়েও সমালোচনা হচ্ছে। জনকর্মচারীরা এরকম ভাষা ব্যবহার করতে পারেন কি-না- তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তারও চেয়ে বড় প্রশ্ন, শুধুই কি পোস্টার সরানো নিয়েই প্রশাসন ও মেয়র মুখোমুখি হলেন, না-কি এর পেছনে স্থানীয় রাজনৈতিক বিরোধ এবং প্রশাসনের সঙ্গে তাদের অন্য কোনো বড় ধরনের ঝামেলা আছে- যার ফলে গোলাগুলি এবং খোদ সিটি মেয়রকে এক নম্বর আসামি করে প্রশাসনের তরফে দুটি মামলা দেওয়া হলো? 

তবে বরিশাল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুনিবুর রহমান, কোতোয়ালি থানার ওসি এবং ইউএনওর বাসভবনে দায়িত্বরত আনসার সদস্যসহ ৩০ থেকে ৪০ জনের নামে আদালতে দুটি মামলার আবেদন করার পরে দৃশ্যপট বদলে যায়। দু’পক্ষকে নিয়ে সমঝোতায় বসেন বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার এবং তাদের মধ্যে মিটমাট হয়ে গেছে বলে জানানো হয়। প্রশ্ন হলো, কী কী শর্তে এই ‘মিটমাট’ হলো এবং যদি মিটমাটই হবে, তাহলে ইউএনওর বাসায় হামলা এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে গুলি ও গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হলেন, তাদের ক্ষতিপূরণ কে দেবে? যেহেতু এখানে একাধিক অপরাধ সংঘটিত হয়েছে- ফলে এসব অপরাধের বিচার হবে কী করে? যদি না হয়, তাহলে ভবিষ্যতেও এরকম ঘটনা ঘটতে থাকবে এবং কিছু লোক ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং তারপর মিটমাট হয়ে যাবে। যার মধ্য দিয়ে আসলে মূল ঘটনা আড়ালেই থেকে যাবে। অপরাধের পথ বন্ধ হবে না। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে না। 

চিত্রনায়িকা পরীমনির জামিন ইস্যুতে যা হচ্ছে, তা নিয়েও সমালোচনা হচ্ছে। বাসায় কয়েক বোতল মদ পাওয়া গেছে- এই অভিযোগে গ্রেফতারের পরে তাকে একাধিকবার রিমান্ডে নেওয়া হয় এবং তাকে জামিন দেওয়া হচ্ছে না। প্রশ্ন উঠেছে, যেখানে অনেক বড় বড় অপরাধীও জামিনে বেরিয়ে যান, সেখানে কয়েক বোতল মদ পাওয়ার অভিযোগে করা মামলায় কেন পরীমনির জামিন হচ্ছে না? উপরন্তু তাকে কারাগার থেকে আদালতে আনা-নেওয়ার পথে যে বিশাল পুলিশের বহর দেখা যায়, যেভাবে তাকে বিপুলসংখ্যক পুলিশ কর্ডন করে নিয়ে যায়, সেই দৃশ্য দেখে যে কারও মনে এই প্রশ্ন জাগতে পারে যে, পরীমনি কোনো বড় মাপের সন্ত্রাসী কি-না? পরীমনির মুক্তির দাবিতে জাতীয় জাদুঘরের সামনে শিল্পীদের একটি মানববন্ধন কর্মসূচিতে অভিনেতা আজাদ আবুল কালাম সংশয় প্রকাশ করে বলেছেন, বারবার রিমান্ডের নামে পরীমনির মতো একজন ‘সুন্দরীকে’ ছুঁয়ে দেখাও হয়তো কারও উদ্দেশ্য হতে পারে।

স্মরণ করা যেতে পারে, পুরান ঢাকার আলোচিত সংসদ সদস্য হাজি সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিমকে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত সাজা দিলেও এই মামলায় পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে অব্যাহতি দিয়েছেন আদালত। প্রশ্ন হলো, কয়েক ঘণ্টাব্যাপী অভিযান চালিয়ে ইরফান সেলিমের বাসা থেকে পিস্তল, গুলি, এয়ারগান, ওয়াকিটকি, বিদেশি মদসহ ইরফানকে গ্রেফতার এবং তাকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের সাজা দেওয়ার পরেও এই মামলায় তাকে কী করে অব্যাহতি দেওয়া হলো? র‌্যাব তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে সাজা দিয়েছিল কীসের ভিত্তিতে? র‌্যাবের অভিযানটি কি তাহলে সঠিক ছিল না বা যে অপরাধে সাজা দেওয়া হয়েছিল সেটি কি মিথ্যা? অভিযানের দিন যে পিস্তল, গুলি, এয়ারগান, ওয়াকিটকি ও বিদেশি মদ উদ্ধারের দাবি করা হলো এবং যেসব ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হলো, তা কি ভুল? তাহলে সেই অস্ত্র ও মাদক কার?

পুলিশ বলছে, মামলায় মাদক ও অস্ত্রে ইরফানের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে তথ্যগত ভুল ছিল। সে কারণে চূড়ান্ত প্রতিবেদনে তার অব্যাহতি চাওয়া হয়েছে। প্রশ্ন হলো, পুলিশের এই দাবি যদি সত্যি হয়, তাহলে ইরফানকে আড়াই মাস জেল খাটতে হলো কেন? সুতরাং ইরফান সেলিমকে অব্যাহতির পেছনে কোনো চাপ থাকার সম্ভাবনা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই।

তার মানে একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিচারের পুরো বিষয়টি নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তার ওপরে। তিনি যদি আদালতে লিখিতভাবে জানান যে, ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়নি, তাহলে অনেক বড় অপরাধীরও শুধু জামিন নয়, বরং তিনি মামলা থেকেই অব্যাহতি পেয়ে যান। আবার অপেক্ষাকৃত ছোট অপরাধীকেও দিনের পর দিন কারাগারে রাখা যায়, গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে এবং আরও পাওয়া যাবে মর্মে আবেদন করলে। আসামি নারী হোন আর সামাজিকভাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিই হোন, তাকে বারবার রিমান্ডেও নেওয়া যায়। পুরো বিষয়টি নির্ভর করে আসলে কোন ঘটনার পেছনে কে আছেন এবং সেখানে টাকা ও ক্ষমতার প্রভাব কতটুকু কাজ করছে। ফলে সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে যেসব নাগরিককে আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী বলা হয়েছে, সেটি নিতান্তই কেতাবি কথা কি-না- সে প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh