সেপ্টেম্বরেও থাকবে ডেঙ্গুর প্রকোপ

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩১ আগস্ট ২০২১, ০২:৫২ পিএম

রাজধানীর মিডফোর্ড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীরা। ছবি : স্টার মেইল

রাজধানীর মিডফোর্ড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীরা। ছবি : স্টার মেইল

চলতি বছরের প্রথম আট মাসেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ১ জানুয়ারি থেকে এই পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মোট আক্রান্ত হয়েছে ১০ হাজার ৯০ জন।

এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে এই আগস্ট মাসেই। এই এক মাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৭ হাজার ৪৩২ জন। দেশটিতে সব মিলিয়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৪২ জন।

ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন ঢাকা শহরের বাসিন্দারা। তবে সারা দেশেই ডেঙ্গু রোগের সংক্রমণ রয়েছে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এক হাজারের বেশি মানুষ চিকিৎসা নিচ্ছেন। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পাশাপাশি ডেঙ্গুর এই সংক্রমণ সারা দেশের মানুষের জন্য নতুন ভীতি হিসাবে দেখা দিয়েছে।

আশঙ্কাজনক হারে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরাও। গত শুক্রবার (২৭ আগস্ট) রাজধানীর শিশু হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ৭৬ শিশু। একে এক দিনে সর্বোচ্চসংখ্যক রোগী ভর্তি থাকার রেকর্ড বলছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এর আগে ২০১৯ সালে এক দিনে হাসপাতালটিতে সর্বোচ্চ ৬৯ জন রোগী ভর্তি ছিল।

রাজধানীর সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতাল ও শ্যামলীর শিশু হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী বেশি ভর্তি হচ্ছে বলে জানা গেছে।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, বর্তমানে প্রতিদিনই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। শিশুদের জন্য কোভিডের চেয়ে বিপজ্জনক হলো ডেঙ্গু। আক্রান্তরা দ্রুত ‘শক’ এ চলে যাচ্ছে। পালস থাকে না, রক্তক্ষরণ হয়, ব্লাডপ্রেশার কমে যায়। তাই জ্বর হলেই ডেঙ্গু পরীক্ষা করে চিকিত্সকের পরামর্শে থাকতে হবে। একই সঙ্গে এডিস মশার প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস করতে হবে।

মশা বিষয়ে জাপানের কানাজোয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার। তিনি বলেন, এই বছর এপ্রিল ও মে মাস থেকেই বেশ বেশি বৃষ্টিপাত হচ্ছে। বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা- এই তিনটা এডিস মশার বংশবৃদ্ধির জন্য সহায়ক। ফলে জুন মাস থেকেই আমরা আশঙ্কা করছিলাম যে, এবার ডেঙ্গুর সংক্রমণ বেশি হতে পারে। এসব মিলিয়ে আমাদের ধারণা- সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবটা বেশি থাকবে।

তিনি আরো বলেন, এখনো আবহাওয়া ও বর্ষার যেসব পূর্বাভাস রয়েছে, তাতে পুরো সেপ্টেম্বর মাস জুড়ে ডেঙ্গু রোগের এই রকম প্রকোপ থাকবে।

এদিকে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) একটি গবেষণা প্রতিবেদনে জানিয়েছে, দেশের রোগীদের মধ্যে তারা ডেঙ্গুর নতুন সেরোটাইপ বা একটি ধরন শনাক্ত করেছেন। ডেনভি-৩ নামের এই ধরনে ঢাকার বাসিন্দারা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। এই ধরনের কারণে রক্তের কণিকা প্লাটিলেট দ্রুত কমে যায়। কারণে আক্রান্ত ব্যক্তিরা খুব দ্রুত অসুস্থ হয়ে পড়েন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সাইফুল্লাহ মুন্সী বলছেন, দেশে এই ডেনভি-৩ ধরনের ডেঙ্গু ধরন আমরা প্রথম দেখতে পাই ২০১৭ সালের দিকে। তার আগে ডেঙ্গুর আরও দুইটি ধরন, ডেনভি-১ ও ২) শনাক্ত হয়েছিল। ডেনভি-১ ও ২ এর বিরুদ্ধে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়েছে। কিন্তু নতুন এই ধরনটি আগের চেয়ে অনেক বেশি ভয়ঙ্কর।

তিনি আরো বলেন, আগে কেউ ডেঙ্গুর কোনো ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হয়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হওয়ার পর, আবার যদি এই ডেনভি-৩ ভাইরাসের ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হয়ে যান, তাহলে তার অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ার আশঙ্কা বেশি হয়। এবারের ডেঙ্গুতে এই ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত রোগী বেশি দেখা যাচ্ছে।

বিসিএসআইআরের চেয়ারম্যান মো. আফতাব আলী শেখ বলেন, সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো, ডেঙ্গু হওয়ার পর রক্তের প্লাটিলেট দ্রুত নেমে যাচ্ছে, আগে যেটা ধীরগতিতে নামত।

এ বছরের আগস্ট মাস পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ৪২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে শুধুমাত্র আগস্ট মাসেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৩০ জনের মৃত্যু হয়েছে।

দেশে সবচেয়ে বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ২০১৯ সালে। সেই বছর লক্ষাধিক মানুষ ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। সেই বছর শুধুমাত্র আগস্ট মাসে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৫০ হাজারের বেশি মানুষ। বেসরকারি হিসাবে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ২৭৬ জনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া যায়। যদিও সরকার তার মধ্যে ১৭৯ জনের মৃত্যু ডেঙ্গুজনিত কারণে নিশ্চিত করেছে।

এদিকে চলতি বছর এর মধ্যেই হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীদের জায়গা পাওয়া কঠিন হয়ে উঠেছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেছেন, দুটো মহামারি যদি একত্রে চলমান থাকে, তাহলে মানুষের জীবনের জন্য একটি প্রবল হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।

আবার করোনাভাইরাসের সাথে ডেঙ্গু রোগের উপসর্গ মিলে যাওয়ায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার পর অনেকে কোভিড আক্রান্ত হয়েছেন বলেও ধরে নিচ্ছেন। ফলে জটিলতা আরো বাড়ছে।

ডেঙ্গু এডিস মশাবাহিত একটি ভাইরাস জ্বর। এই ভাইরাস বহন করে এডিস ইজিপ্টি ও এডিস এলবোপিকটাস প্রজাতির মশা। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে ডেঙ্গু বিস্তারে ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ ভূমিকা রাখে গৃহপালিত ও নগরকেন্দ্রিক এডিস ইজিপ্টি মশা। ডেঙ্গু বিস্তারে ৫ থেকে ১০ শতাংশ ভূমিকা রাখে এডিস এলবোপিকটাস, যাকে ‘এশিয়ান টাইগার’ মশা বলা হয়। বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামেই এ মশা রয়েছে। 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার ডেঙ্গু বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে বলেন, আমাদের দেশে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বেশ দুর্বল। যেমন কোনো একটা এলাকায় সংক্রমিত এডিস মশা দেয়া যায়, তখন যদি সেই সংক্রমিত এডিস মশা ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তাহলে জ্যামিতিক হারে রোগটির বিস্তার দেখা যায়।

তিনি বলেন, আমরা স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে ডেঙ্গুর যে রিপোর্টটি পাচ্ছি, আসলে কিন্তু তার চেয়ে সংক্রমণ অনেক বেশি। কারণ অনেক বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিক থেকে বা বাসায় চিকিৎসাধীন ডেঙ্গু আক্রান্তের তথ্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের কন্ট্রোল রুমে যায় না।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh