রূপগঞ্জে অগ্নিকাণ্ড: তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে ১০ দফা সুপারিশ

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩১ আগস্ট ২০২১, ০২:৫৪ পিএম

নাগরিক কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ

নাগরিক কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজের ফুডস ফ্যাক্টরিতে (সেজান জুসের কারখানা) গত ৬ জুলাই যে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল সে বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে নাগরিক কমিটি। ওই ঘটনায় ১০ দফা সুপারিশ জানানো হয় কমিটির পক্ষ থেকে।

মঙ্গলবার (৩১ আগস্ট) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) নসরুল হামিদ মিলনায়তনে নাগরিক তদন্ত কমিটি আয়োজিত ‘হাসেম ফুড কারখানায় অগ্নিকাণ্ড ও নিহতের ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদন’ প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসব তথ্য জানান কমিটির আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বডুয়া।

প্রতিবেদনে আরো জানানো হয়, সরেজমিন পরিদর্শন ও বিভিন্নজনের ভাষ্য থেকে আমরা নিশ্চিত হয়েছি যে, ভবনটিতে আগুন লাগার সম্ভাব্য সব ধরনের অবস্থা ছিলো। কিন্তু আগুন নিয়ন্ত্রণ ও জীবন বাঁচানোর কোনো ব্যবস্থা ছিলো না।

জ্যোতির্ময় বডুয়া বলেন, ভবনের একেকটি ফ্লোর প্রায় ৩৪ হাজার ৫০০ বর্গফুটের বেশি। দেশের ভবন নির্মাণ বিধি অনুযায়ী কর্মীদের বিচরণের জায়গা থেকে সিঁড়ি ও ফায়ার এসকেপের যে সর্বোচ্চ দূরত্ব থাকার নিয়ম রয়েছে, ভবনটিতে তা মানা হয়নি।

তিনি আরো বলেন, তথ্য প্রমাণ বলছে, এই অগ্নিকাণ্ডে সরকারি সংস্থাগুলোর দায় অনেক। সরকারি সংস্থাগুলো বিশেষ করে শ্রম অধিদফতর ও কলকারখানা এবং প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের বিরুদ্ধে দায়িত্বও অবহেলার অভিযোগ থাকার পরও কেনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি প্রশ্নটি আবারো জোরদার হয়ে ওঠেছে।

তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে ওই ঘটনায় ১০ দফা সুপারিশ জানানো হয়। এগুলো হচ্ছে-

১. ব্যাংক ঋণসহ বিভিন্ন বিবেচনায় দেখা যায় যে, আলোচ্য কারখানাটি রফতানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠান হিসেবে আর্থিকভাবে যথেষ্ট শক্তিশালী। এই শিল্প গ্রুপের অধীনে আরো ১০টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কাজেই কোনো যুক্তিতেই কারখানায় ন্যূনতম নিরাপত্তা না থাকা, নিম্ন মজুরি, অনিরাপদ কর্মপরিবেশ তাদের অক্ষমতার ফলাফল নয়। বরং অনিচ্ছা, অবহেলা, জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলে মুনাফা বৃদ্ধির তাড়না থেকে এই ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে। সেজন্য এটিকে আমরা দুর্ঘটনা না বলে কাঠামোগত হত্যা বলে চিহ্নিত করছি এবং সেভাবেই দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করা আবশ্যক বলে মনে করছি। কর্মস্থলে নিরাপত্তা নিশ্চিত না করা এবং শ্রমিকদের ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য করার কারণে যে দুর্ঘটনা ঘটছে তা কার্যত হত্যাকাণ্ড।

২. কারখানা ভবনের নকশা অনুমোদন, অগ্নিনির্বাপণ ও শ্রম আইনের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেনি। তাই দায়িত্ব অবহেলাকারী কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে তাদেরও বিচারের আওতায় আনতে হবে।

৩. বিদ্যমান আইনের বহু রকম দুর্বলতা ও ঘাটতির অন্যতম দৃষ্টান্ত ক্ষতিপূরণ বিষয়ক আইন। আমরা মনে করি, কর্মস্থলে একজন শ্রমিক যদি নিহত হন, তাহলে ক্ষতিপূরণ এমন হতে হবে যা তার বেঁচে থাকলে সারাজীবনের সম্ভাব্য আয়ের বেশি হয় এবং যা কর্তৃপক্ষের জন্য আর্থিক শাস্তিস্বরূপ হয়। শ্রম আইনের বিদ্যমান সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে নিহত, আহত ও নিখোঁজ শ্রমিকদের পরিবারকে যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করতে হবে। আহতরা পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তাদের সব চিকিৎসা ব্যয়, চিকিৎসাকালীন সময়কে সবেতন ছুটি হিসেবে গণ্য করা এবং যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করতে হবে। ওই কারখানায় চাকরি করতেন এমন সব শ্রমিকের বিকল্প কর্মসংস্থান ও কাজ হারানোর ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে।

৪. কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতর, শ্রম অধিদফতর, ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানে সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে লোকবল বাড়াতে হবে। পরিদর্শকের সংখ্যা ও দক্ষতা বাড়ানো এবং যেখানে আইনের ব্যত্যয় ঘটছে। সেখানে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার মতো সক্ষম করে তোলা প্রয়োজন। অগ্নিনির্বাপণে ফায়ার সার্ভিসের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি দিয়ে এই প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করতে হবে।

৫. সব শিল্প প্রতিষ্ঠানে কর্মপরিবেশ ও শ্রমিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অগ্নি নির্বাপণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রাখার পাশাপাশি সব শ্রমিক ও কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ বাধ্যতামূলক করতে হবে।

৬. কর্মস্থল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়লে বা সেখানে আইনানুগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না হলে, শ্রমিকরা যেন পরিদর্শন অধিদফতরকে যেকোনো সময় অবহিত করা পারে। একইসঙ্গে এবং পরিদর্শন অধিদফতর যেন খবর পাওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কর্মস্থলে হাজির হয়ে ব্যবস্থা নিতে পারে, সেজন্য আইনি বিধান রাখা জরুরি।

৭. শ্রমিকদের ইউনিয়ন করার অধিকার নিশ্চিত করা এবং অবাধে ইউনিয়ন করার সুযোগ নিশ্চিতে সংগঠকদের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা (পেশাগত, আইনি ও সামাজিক) প্রদান করতে হবে।

৮. কর্মস্থলে চিকিৎসা ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করতে হবে। কারখানা কর্তৃপক্ষ বা নিয়োজককে নিজ খরচে ও দায়িত্বে চিকিৎসা করতে হবে।

৯. শিশুশ্রম নিরসনে দরকার শিশুদের অভিভাবকদের আয় বৃদ্ধি করা। সেজন্য জাতীয় ন্যূনতম মজুরি এমন পর্যায়ে নির্ধারণ করতে হবে, যা দিয়ে তারা শিশুর শিক্ষার পুরো ব্যয় এবং তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও পুষ্টি আংশিক হলেও নিশ্চিত করতে পারেন।

১০. সমগ্র শিল্পখাতে তালিকাভুক্ত ও তালিকা বহির্ভূত কারখানাগুলোর ভবন নিরাপত্তা, কর্মপরিবেশ ও শ্রমিক অধিকার, বিদ্যমান আইনের ঘাটতি ও আইন প্রয়োগের দুর্বলতা, এ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যসহ সরকারের পক্ষ থেকে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে। বর্তমান বিপজ্জনক, প্রাণঘাতী পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য করণীয় নির্ধারণ ও তা বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের প্রতিনিধি ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিশন গঠন করতে হবে।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন- শ্রম আইন বিশেষজ্ঞ ও কমিটির সদস্য সচিব মাহবুবুর রহমান ইসমাইল, ওই নাগরিক কমিটির সদস্য স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, অধ্যাপক সি আর আবরার, ডা. মো. হারুন রশিদ, সাংবাদিক কলামিস্ট সোহরাব হাসান, অধ্যাপক তানজীম উদ্দিন খান, গবেষক ও সাংবাদিক প্রিসিলা রাজ, বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সভা-প্রধান তাসলিমা আকতার লিমা, গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম সবুজ, গার্মেন্টস শ্রমিক মুক্তি আন্দোলনের সভাপতি শবনম হাফিজ, প্রকৌশলী মোশাররফ হোসেন, বাংলাদেশ শ্রম ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি গোলাম মুর্শেদ, সাংবাদিক কলামিস্ট ফারুক ওয়াসিফ, তথ্যচিত্র নির্মাতা ব্রাত্য আমিন, গবেষক মাহা মিজা, শিল্পী ও সংগঠক বীথি ঘোষ এবং গবেষক ও মানবাধিকার কর্মী রেজাউর রহমান লেনিন।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh