ট্রেন টু পাকিস্তান; জনতাই যেখানে নায়ক

ফ্লোরা সরকার

প্রকাশ: ৩১ আগস্ট ২০২১, ০৩:৫৩ পিএম

ট্রেন টু পাকিস্তান

ট্রেন টু পাকিস্তান

খুশবন্ত সিংয়ের সাড়া জাগানো ক্ল্যাসিক বা সামাজিক দলিল হিসেবে চিহ্নিত উপন্যাস ‘ট্রেন টু পাকিস্তান’-এর ওপর নির্মিত পামেলা রুক্সের ‘ট্রেন টু পাকিস্তান’ ছবিটির ওপর আলোচনা করতে গেলে, আমরা দেখতে পাব, ছবির আলোচনার পাশাপাশি উপন্যাসের অনেক বর্ণনা চলে আসে। কারণ, পরিচালক পামেলা রুক্স ছবিটা নির্মাণের সময় উপন্যাসের ঘটনা যথাসম্ভব অনুসরণ করার চেষ্টা করেছেন। যে কারণে এই উপন্যাস পাঠের সময় একদিকে পাঠক যেমন নিবিড় পাঠ করেন, অন্যদিকে একইরকম মনোসংযোগ ঘটে ছবিটি দেখার সময়।

উপন্যাসের বর্ণনা খুব স্বাভাবিকভাবে কিছুটা দীর্ঘ হয়, সিনেমার বর্ণনার সময় সংক্ষিপ্ততার কারণে হয় কিছুটা ছোট। যেমন উপন্যাসের শুরুতে যে স্থানকে ঘিরে এর কাহিনি আবর্তিত সেই মানো মাজরা গ্রাম, যেখানে শিখ, মুসলমান এবং হিন্দু সম্প্রদায় মিলেমিশে এক পরিবারের মতো বসবাস করে, এর আর্থ-সামাজিক অবস্থা, প্রাকৃতিক বর্ণনা ইত্যাদির কোনো বর্ণনা আমরা ছবিতে পাই না। একইভাবে উপন্যাসের অনেক কিছু হয়তো ছবিতে আমরা পাই না; কিন্তু এতে ছবির কাহিনি উপস্থাপনে কোনো হেরফের ঘটে না। পরিচালক পামেলা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে উপন্যাসের মূল ঘটনাগুলো তুলে ধরেছেন তার ছবিতে। ছবিটি দেখলে আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না, একটা শান্ত নিরিবিলি গ্রামের সহজ-সরল মানুষের ওপর, শুধু দেশভাগের মতো অভিশাপ নয়, ধর্মের রাজনীতিকরণে মানুষের ওপর কত দুর্যোগ, অসহায়ত্ত এবং দুরবস্থা নেমে আসতে পারে। ধর্ম নিয়ে রাজনীতি এবং ধর্ম এক বিষয় না। প্রত্যেক ধর্মের মানুষ যার যার জায়গা থেকে তাদের ধর্মকে দেখে এবং সেভাবে পালন করে। সাধারণ জনগণ বিশেষ করে যারা নিষ্ঠার সঙ্গে ধর্মকর্ম পালন করেন, তারা এক আল্লাহ বা ভগবান বা ঈশ্বর চিন্তা ছাড়া অন্য কিছু চিন্তা করেন না। তাদের সব চিন্তা-ভাবনা শুধুই নিজ নিজ ধর্মকে ঘিরে আবর্তিত হয়। খুব বেশি হলে, তারা হয়তো নিজ নিজ ধর্ম নিয়ে অহঙ্কার বোধ করে এবং অন্য ধর্মকে ছোট করে দেখে; কিন্তু অন্য ধর্মের মানুষদের কতল বা নিশ্চিহ্ন করার কথা তারা কখনোই ভাবে না। নির্দিষ্ট কোনো জনগোষ্ঠীর ক্ষতি করা যায়; কিন্তু কখনোই ধ্বংস বা নিশ্চিহ্ন করা যায় না। মানো মাজরা গ্রামে ১৯৪৭-এর ভারত ভাগের আগে পর্যন্ত ধর্ম নিয়ে কোনো ধরনের বাড়াবাড়ি, সংঘর্ষ বা ভেদাভেদ দেখা যায়নি; ঠিক যখন থেকে ধর্ম নিয়ে এই উপমহাদেশে রাজনীতি শুরু হলো, যে রাজনীতির শুরু সাধারণ জনগণ নয়, দেশের শিক্ষিত এবং রাজনৈতিক নেতাদের হাত দিয়ে ঘটেছিল, ঠিক তখন থেকেই বিভিন্ন ধর্মাবলম্বিদের মাঝে ভেদাভেদ, হানাহানি, মারামারি শুরু হলো। এই কারণে এই উপন্যাস এবং সিনেমা এমন এক ঐতিহাসিক দলিলে পরিণত হয়েছে, যার প্রতিক্রিয়া আমরা এখনো, এই একবিংশ শতাব্দীতেও দেখতে পাই। 

উপন্যাসটি পড়লে বা ছবিটি দেখলে কোনো সম্প্রদায়ের ওপরেই আমাদের কোনো বিদ্বেষ বা ঘৃণা জন্মায় না। এমনকি কাহিনির অন্যতম চরিত্র (গল্পটি এত সুন্দর করে সব চরিত্রের মাঝে বণ্টন করা হয়েছে যে, এখানে কেন্দ্রীয় চরিত্র বলে কাউকে পাওয়া যায় না, জনগণই যেন নায়ক) ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হুকুম চাঁদ (মোহন আগাসে) কন্যাসম হাসিনা (দিব্যা দত্ত) নামে এক গায়িকার সঙ্গে রাত কাটানো, মদ পান ইত্যাদি করলেও তার ওপর আমাদের কোনো ঘৃণা জন্মায় না। সরকারি আদেশ-নির্দেশ অন্যায় জেনেও সে শুধু হুকুম পালন করার জন্য হুকুম দেয় তার অধিনস্তদের। বিচক্ষণ হুকুম চাঁদ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার চরম সময়ে বলেন, ‘ঝড় শুরু হলে তা না থামা পর্যন্ত মাথা নত করে থাকাই ভালো অথবা জ্ঞানী লোকেরা স্রোতকে অনুসরণ করে কূলে ওঠে। ’ হুকুম চাঁদ খুব ভালো করেই জানেন, দেশভাগের কারণে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দাবানল তার একার চেষ্টায় প্রতিহত করা যাবে না; কিন্তু তাই বলে, হুকুম চাঁদ নির্বিকার থাকেন না। ঠিক সময়ে ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে, পাকিস্তানগামী ট্রেনভর্তি মুসলমানদের পরোক্ষভাবে, বুদ্ধির জোরে প্রাণ রক্ষা করেন। জীবনে প্রচুর মৃত্যু (এমনকি নিজের কন্যার মৃত্যু পর্যন্ত) দেখে দেখে হুকুম চাঁদ হয়ে উঠেছেন দয়ালু, পরোপকারী ও সহনশীল; কিন্তু যেদিন পাকিস্তান থেকে ভারতগামী ট্রেনভর্তি লাশ মানো মাজরার স্টেশনে আসে, সেটি যেন তার সহ্যের বাইরে চলে গেল। লাশভর্তি ট্রেনের দৃশ্যটি আমাদের মার্কেজের ‘নিঃসঙ্গতার একশত বছর’ উপন্যাসের ট্রেনভর্তি লাশের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। যেদিন মাকোন্দোর রেলস্টেশনে সেখানে ধর্মঘটরত তিন হাজার শ্রমিককে গুলি করে হত্যা করে ট্রেনে ওঠানো হয়। সেই হাজার হাজার লাশের মাঝে হোসে আর্কাদিও সেগান্দোও ছিল। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায়। যে ঘটনার পরে হোসে আর্কাদিও সেগান্দো তিন জায়গায় তিনজনকে বলতে শোনেন, এখানে (মাকোন্দো) কোনো লোক মারা যায়নি। এমনকি হোসে আর্কাদিও সেগান্দোর ভাই অরেলিয়ানো সেগান্দোও গণহত্যার গল্পটি বিশ্বাস করেনা। আগের রাতে সে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া একটি অসাধারণ ঘোষণা পড়েছিল। সেখানে বলা হয়েছে, শ্রমিকরা স্টেশন ত্যাগ করে শান্তভাবে দলে দলে বাড়ি ফিরে গেছে। ঠিক একইভাবে, এই ছবিতেও আমরা দেখি, ট্রেনভর্তি লাশের কথা গ্রামবাসীকে জানানো হয় না; কিন্তু এত লাশ রাখাও সম্ভব না। যখন বিভিন্ন বাড়ি থেকে লাশ পোড়ানোর জন্য জ্বালানি জোগাড় করতে হয়, তখন গ্রামবাসীদের আর অজানা থাকে না, সেই ট্রেনের ভেতর কী ছিল। এমন বীভৎস ঘটনার পরেও গ্রামবাসী টুঁ শব্দ করতে পারে না, যেমন করতে পারেনি মাকোন্দো গ্রামের অধিবাসীরা। এভাবেই পৃথিবীর বড় বড় অন্যায়গুলো জায়েজ হয়ে যায়। 

ছবির আরও দুই চরিত্র ডাকাত আলম সিং, যাকে ছবির শুরুতে ফাঁসিকাষ্ঠে ফাঁসি দিতে দেখা যায়, সেই আলমের ছেলে জুগ্গাত সিং (নির্মল পাণ্ডে), গ্রামে এবং পুলিশের খাতায় যে বদমায়েশ বলে পরিচিত এবং দিল্লি থেকে আসা ইকবাল (বাজিত কাপুর), শহুরে বিপ্লবী কমিউনিস্ট, নিজেকে যে সমাজকর্মী বলে পরিচিতি দেয়, সেই ইকবাল যখন মানো মাজরা গ্রামে আসে, এই দু’জনের মধ্যে দেখা যায় দু’মুখী চরিত্র। দু’জনই অন্যায়ের বিরুদ্ধে একইরকম সোচ্চার। জেলের ভেতর জুগ্গা যখন ইকবালকে বলে, সে একটা বদমায়েশ। সব সরকারই জুগ্গাকে জেলে ঢোকায়। ইকবাল তখন রেগে জবাব দেয়, সরকারই জুগ্গাকে বদমায়েশ বানিয়েছে। সরকারের যদি কাউকে পছন্দ না হয় তখন তারা তাকে অসৎ চরিত্র, অপরাধী ইত্যাদি বলে জেলে ঢোকায়; কিন্তু কোনো অন্যায়ে বিরুদ্ধে যখন বাস্তব কোনো পদক্ষেপ নিতে হয়, তখন দেখা যায়, শহুরে প্রতিবাদীর চেয়ে গ্রামের সাধারণ জুগ্গার মতো মানুষেরাই এগিয়ে আসে। তাই ছবির একদম শেষে, চন্দন নগর থেকে মুসলমান ভর্তি ট্রেন যখন পাকিস্তানের দিকে রওনা হয় এবং কিছু লোক পরিকল্পনা করে ট্রেনের সব মানুষকে মেরে ফেলার, সেই ট্রেন রক্ষার দায়িত্ব একমাত্র জুগ্গাকে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিতে দেখা যায়। যদিও, এখানে প্রেম একটা বড় বিষয় হিসাবে চলে আসে। কারণ, সেই ট্রেনে জুগ্গার প্রণয়ী মুসলমান মেয়ে নুরানও (স্মৃতি মিশ্র) অন্যান্য মুসলমানদের সঙ্গে ছিল। জুগ্গার তখন একমাত্র চিন্তা যেভাবেই হোক, এই ট্রেন রক্ষা করতে হবে। তারপরেও আমরা দেখতে পাই, ট্রেনের এই আগাম খবর ইকবাল বা হুকুম চাঁদ জানা সত্ত্বেও কেউ এগিয়ে আসে না তাদের রক্ষা করতে। ছবির শেষে ট্রেনটিকে রক্ষা করতে যেয়ে জুগ্গা নিজের জীবন দিয়ে দেয় শেষ পর্যন্ত। একটা অনন্য দৃষ্টান্ত যেন জুগ্গার চরিত্রের মধ্যে দিয়ে আমরা পেয়ে যাই। 

সাম্প্রদায়িক বৈষম্য, অর্থনৈতিক বৈষ্যমের চেয়ে কতটা শক্তিশালী এখানে আমরা দেখি। অর্থনৈতিক বৈষম্য যাকে আমরা শ্রেণি বৈষম্য বলি সেই বৈষম্য মানো মাজরা গ্রামের অধিবাসীদের কখনো বিভক্ত করতে পারে নাই। যে প্রধান তিন ধর্মীয় সম্প্রদায় এখানে বসবাস করে, তাদের মধ্যে একমাত্র হিন্দু একটা পরিবার, মহাজন লালা রামলাল এবং তার পরিবার (যে রামলাল খুন হয় এবং যে খুনকে ঘিরে কাহিনির শুরু), শিখ সম্প্রদায় জমির মালিক এবং মুসলমান সম্প্রদায় রায়ত শ্রেণি, তারা মালিকের জমি চাষ করে ফসলের ভাগ পায়। শান্ত এই গ্রামে কখনই শিখরা মুসলমানদের বা মুসলমানরা শিখদের দুশমন বলে মনে করেনি। মসজিদ এবং শিখ মন্দির পাশাপাশি থাকলেও, ফজরের আজান শেষ না হলে, মন্দিরের মন্ত্রপাঠ শুরু হয় না। অথচ সাতচল্লিশের আগস্টের কিছু আগে এবং পরে, এসব শান্তি তছনছ হতে শুরু করে। এমনকি মানো মাজরা গ্রামের সব মুসলমানদের যখন পাকিস্তান পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়, তখনো অধিকাংশ শিখ প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। পাকিস্তান থেকে আগত শিখ, হিন্দু এবং স্থানীয় কিছু শিখ, মুসলমানদের পরিত্যক্ত বাড়ির আসবাবপত্র, গরু-ছাগল লুট শুরু করে। ধর্মীয় বৈষম্য আর্থিক লোলুপতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। প্রচণ্ড গরম, বৃষ্টি এবং ট্রেনের হুইসেলের তীব্র শব্দ, ছবির আবহকে করেছে বিষণ্ণ এবং ভয়াবহ। এই গরম, বৃষ্টি এবং শব্দ যেন একেকটা চরিত্র হয়ে দেখা দিয়েছে ছবিতে। 

উপন্যাসটি লেখা হয় ১৯৫৬ সালে, ছবিটা মুক্তি পায় ১৯৯৮ সালে। পরিচালক পামেলা রুক্স অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে ছবিটি যেমন নির্মাণ করেছেন, বিভিন্ন চরিত্রে রূপদানকারী অভিনয় শিল্পীরাও সেভাবে বাস্তবোচিত অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে ছবিটিকে করেছেন প্রাণবন্ত। ক্যামেরার কাজে সানি জোসেফ ছিলেন অত্যন্ত যত্নশীল। সব মিলিয়ে ট্রেন টু পাকিস্তান একদিকে যেমন সব সময়ের পাঠযোগ্য উপন্যাস, অন্যদিকে এই সিনেমাও সব সময়ের জন্য দৃশ্যযোগ্য। এখান থেকে আমরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ভেঙে পড়ার এক অভিনব শিক্ষা নিতে পারি। যে শিক্ষা আমাদের ভবিষ্যৎ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করার ক্ষেত্রে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে এবং আমরা আরও সতর্ক হতে পারব।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh