আফগানিস্তানে তালেবান যুগের লজ্জা ও কলঙ্ক

শেখর দত্ত

প্রকাশ: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১২:০৯ পিএম

শেখর দত্ত

শেখর দত্ত

বিগত শতকের শেষ দিকেও এমনটাই বিশ্বাস ছিল যে, ধনতন্ত্র-সমাজতন্ত্র ঠান্ডাযুদ্ধ যুগে বিশ্ব পুঁজিবাদ ক্ষয়িষ্ণু, মরণঘণ্টা বাজছে। সমাজতন্ত্রে উত্তরণের যুগ চলছে। ওই যুগে তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে যখন সমাজতন্ত্র অভিমুখীনতার জয়জয়কার, তখন পাকিস্তান ছিল মধ্যযুগীয় চিন্তা-চেতনা দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত অবৈজ্ঞানিক ও কৃত্রিম রাষ্ট্র।

ধনতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের যুগে এমন অন্ধ-অনঢ়- স্বৈরাচারি রাষ্ট্র অচল, টিকে থাকতে পারে না। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দেশবাসীর বীরোচিত মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে প্রতিষ্ঠিত আমাদের নবজাত দেশটিও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গণতন্ত্রের পথে সমাজতন্ত্র, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে ওই অভিযাত্রায় শামিল হয়েছিল। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল।

আর এখন! বিশ্বের দেশে দেশে ধর্ম-জাতি নির্বিশেষে মানুষের মধ্যে আধুনিক যুগের যুক্তি-বিজ্ঞানের চিন্তা-চেতনার ভাটার মধ্যে ধর্মীয় ও জাতীয় জাত্যাভিমানের জোয়ার যেন উথলে উঠছে। ওই যুগে যুদ্ধ ও যুদ্ধান্মোদনা থাকলেও শান্তি ও সমঝোতার রাজনীতি-কূটনীতি, অগ্রগণ্য অবস্থান নিয়েছিল। দেশে দেশে পারমাণবিক অস্ত্রসজ্জার বিরুদ্ধে শান্তি আন্দোলন ছিল অগ্রসরমান। ফেলে আসা যুক্তিহীন মধ্যযুগ আর আধুনিক যুগের অভিধা যেন চলমান যুগে এসে পাল্টে যাচ্ছে। এই পাল্টা জোয়ারের পরিস্থিতিতেই বিবেচনায় নিতে হবে আফগানিস্তানে তালেবান উত্থান ও রাষ্ট্র্ক্ষমতা দখল। এটাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ভাবার কোনো অবকাশ নেই।

প্রশ্ন হলো, তবে কী বিশ্ব চলে যাচ্ছে মধ্যযুগীয় চিন্তা চেতনায়। এমনটা ভাবার কোনো অবকাশ নেই। যুগের ধর্মই হচ্ছে, ভালো-মঙ্গলের সঙ্গে মন্দ-অমঙ্গল চিন্তা চেতনা ও কাজ রেখে যায়। যুগ যখন অন্য যুগের দিকে যাত্রা শুরু করে তখন ওই ফেলে যাওয়া যুগের সঙ্গে বেমামান ও মন্দ অবশিষ্টাংশ বিশ্ব, রাষ্ট্র ও সমাজকে বেশ জোরের সঙ্গেই পিছু টানতে থাকে। 

কোনো কোনো অঞ্চল ও দেশের জন্য কখনো কখনো তা ভয়ংকর হয়ে ওঠে। যুগ যুগের ইতিহাসের ধরাবাহিকতায় ‘আধুনিক-সভ্য’ ব্রিটিশের কূটচাল আর আমাদের পূর্বপুরুষদের ভ্রান্ত রাজনীতির ফলশ্রুতিতে ভারত ও পাকিস্তান এবং পরে ওই ভুল সংশোধন করতে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পরও মধ্যযুগীয় বিষফোঁড়াসম দ্বিজাতিতত্ত্বের ধর্মীয় উন্মাদনার দংশন থেকে আমরা মুক্তি পাচ্ছি না। তেমনি আফগানিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যও সাবেক যুগের ক্ষতের কারণে গভীর যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে।

’৭০-এর দশকে সোভিয়েত সহযোগিতায় সমাজতন্ত্র অভিমুখীন ‘সাওর (ফার্সি বর্ষপঞ্জির দ্বিতীয় মাস) বিপ্লব’, কমিউনিস্টদের ক্ষমতা দখল এবং তা রক্ষার্থে সোভিয়েত সৈন্যের আফগানিস্তান দখল তখন আন্তর্জাতিকতাবাদ ও প্রগতির সমার্থক হলেও এটা ছিল সমাজতন্ত্রের নামে দেশটির জাতীয় ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ, অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক অবস্থা ও জনগণের চিন্তা-চেতনার বিপরীতে ওপর থেকে স্বৈরতান্ত্রিক ও দমনমূলক ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়ারই নামান্তর। সব ক্রিয়ারই অছে প্রতিক্রিয়া। ‘প্রগতি’ ঠেকাতে গণতন্ত্রের নামাবলি গায়ে দিয়ে মধ্যযুগীয় ধর্মীয় চিন্তা-চেতনার ওপর ভর করে ‘মুক্ত দুনিয়ার নেতা’ আমেরিকা ও পাকিস্তানের মদদে গড়ে ওঠে তালেবান বাহিনী। আজ যদি পিছনে তাকানো যায় তবে দেখা যাবে, প্রগতি আর গণতন্ত্র যে নামেই তখন যা হোক না কেন, এর সঙ্গে ছিল স্ব স্ব জাতীয় স্বার্থও। 

তালেবান বাহিনী ছিল মাদ্রাসা ছাত্রদের ক্ষুদ্র একটি উগ্র গ্রুপ। পাক-মার্কিন মদদে পরে এক বিশাল বাহিনী গড়ে ওঠে এবং রাষ্ট্রক্ষমতাই দখল করে নেয়। মোল্লা ওমরের আত্মীয়তার সূত্রে সৌদি আরব ছেড়ে ওসামা বিন লাদেন আফগানিস্তান এসে গড়ে তোলে ভয়ংকর আল-কায়েদা বাহিনী। এরাই এক সময়ে তালেবান-মদদদাতা আমেরিকার ভূখণ্ডে প্রথম আঘাত হানে। দেশটির গর্ব টুইন টাওয়ার হয় সম্পূর্ণ ধ্বংস এবং পেন্টাগন হয় আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত। এই বুমেরাং-এর ঘটনাই ইতিহাসের নিয়তি!

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়, তবে পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুযায়ী হয় ভিন্নরূপে। একবার যদি আসে বিয়োগান্তক নাটকরূপে, পরে আসে প্রহসন-নাটক হিসাবে। সত্তরের দশকে রাশিয়ার আফগান প্রবেশ যদি হয় বিয়োগান্তক নাটক, একবিংশ শতকের শুরুতে আমেরিকার ওই দেশ দখল ছিল প্রহসন নাটক। ইতিহাসের স্বপ্ন ভঙ্গ করে বিয়োগান্তক নাটকের যবনিকা ফেলে সোভিয়েত ইউনিয়ন তার দায় শোধ করেছে। তবে উল্লেখিত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় ওই যুগে সৃষ্ট তালেবানের উত্থান এই যুগে এসেও সর্বোচ্চ লজ্জা ও কলঙ্ক এবং সমস্ত বিশ্বের ভয়ংকর ভীতি হিসেবে বিশ্ব পরিমণ্ডলে স্থান করে নিয়েছে।

জানা যাচ্ছে, পরাজয়ে গ্লানি-লজ্জা ছাড়াও সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে আমেরিকার কেবল আফগানিস্তানেই (পাকিস্তানে ব্যয় ছাড়া) গচ্চা গেছে ১ ট্রিলিয়ন ডলার। তাতেও কি আছে রক্ষা! ওই দেশ ছেড়ে আসার সময় আইএসের হামলায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত বিমানবন্দরেও মারা গেছে ১৭ জন সৈন্যসহ ১৭০ জন। এরই প্রতিক্রিয়ায় আমেরিকার ড্রোন হামলায় আইএসের আক্রমণকারী সন্ত্রাসী শেষ করা হলেও এক অভাগা শিশুর মৃত্যু হয়েছে। 

বাস্তবে কত খেলা যে অবশিষ্ট আছে! পাকতুন, তাজিক, হাজরা, উজবেক, আইমাক, তুর্কমেন, বালুচ প্রভৃতি উপজাতিগোষ্ঠীতে বিভক্ত অনুন্নত-পশ্চাৎপদ এবং আগের যুগের বলি ও বর্তমান যুগের সঙ্গে বেমানান আফগানিস্তান রাষ্ট্রে জাতিগত গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব বিরাজমান। তদুপরি সাবেক সরকারের অনুগত সেনাবহিনীর একাংশ পালিয়ে সশস্ত্র অবস্থায় তালেবানবিরোধী অবস্থানে রয়েছে। জনগণের মধ্যে আছে তালেবানবিরোধী শক্তি। তাই আমেরিকা ‘পালিয়ে এসেছে’ কথাটা বলা যায় বলে মনে হয় না। ভিয়েতনামে আমেরিকা পরাজিত হয়েছিল ঠিক; কিন্তু এখন পরাশক্তি আমেরিকাকে কী ছাড়তে পেরেছে! ষাটের দশক পর্যন্ত চীন ছিল আমেরিকার একনম্বর শত্রু। পরে গলায় গলায় ভাব করে নিজেকে ‘পৃথিবীর কারখানা’ করে পরাশক্তি হতে পেরে আমেরিকার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।

তাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণে রাখতে আফগানিস্তান আমেরিকা ছাড়বে না। এই দেশের সীমানায় আগের যুগের মিত্র আর বর্তমান যুগের শত্রু চীন আছে না! প্রসঙ্গত, জ্বালানি তেলের বিকল্প পাওয়ার কারণে তা এখন আর ‘তরল ডলার’ নয় যে, আমেরিকাকে মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থান করে মোড়লিপনা তথা দখল-দাপট-ষড়যন্ত্র করতে হবে। আর রাশিয়াও এখন আমেরিকার এমন প্রতিদ্বন্দ্বী নয় যে, সেই দেশের সীমান্তে নানা জোট করে সামরিক শক্তি-সম্ভার বাড়াতে হবে। আম খাওয়া হয়ে গেলে আঁটির আর মূল্য কী! তবে পরাশক্তি হিসেবে সেখানেও পক্ষে বা বিপক্ষে থাকতে চাইবে আমেরিকা। বহু-বিভক্ত দেশ ও অঞ্চলে প্রয়োজনে গুটি চলাবে। তবে এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, তালেবানরা এখন কী করবে?

সরকার পরিচালনায় অন্ধত্ব ও গোঁড়ামি প্রশ্নে কতটা নমনীয় হয়ে যুগের সঙ্গে কিছুটা হলেও ভারসাম্য বজায় রেখে শরীয়া আইনকে সংস্কারের পথে নিয়ে যেতে পারবে? এখনো পর্যন্ত তেমন বিশেষ কোনো লক্ষণ পরিদৃষ্ট হচ্ছে না। কমবেশি দুই সপ্তাহ হয়ে গেলেও সরকার গঠন করতে পারেনি। ইতিমধ্যে সাবেক চিফ এক্সিকিউটিভ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল্লাহ আবদুল্লাহ’র নেতৃত্বে গঠিত বাড়ি থেকে সরে যাওয়া সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই, সাবেক মুজাহিদিন আমেরিকা-পাকিস্তানের মিত্র ও বর্তমান রাজনৈতিক দল হেজাবে ইসলামি গুলবদিন নেতা গুলবদিন হেকমতিয়ারের সমন্বয়ে গঠিত ‘হাই কাউন্সিল ফর ন্যাশনাল রিকন্সিলিয়েশন’ চাইছে সমঝোতা করে সরকার গঠন করতে। মূলত সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী পাকতুনদের মধ্যে প্রতিষ্ঠা পাওয়া তালেবানরা কি পারবে অন্যান্য গোষ্ঠীকে সঙ্গে রাখতে?

আফগান অর্থনীতিরই কী হবে? ব্যাংক ব্যবস্থা এখনও দেশের সর্বত্র সচল হয়নি। ইতিমধ্যে ২০০ ডলার বা ২০ হাজার আফগান মূদ্রা তোলার হুকুম জারি করা হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ। সবচেয়ে আগ্রহোদ্দীপক ব্যাপার হচ্ছে, এই অবস্থায় একজন সাবেক স্কুল শিক্ষককে নাকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান করা হয়েছে। ইতিমধ্যে গান-বাজনা বন্ধ এবং মিডিয়ায় মহিলা কণ্ঠ নিষিদ্ধ হয়েছে। যারা আমেরিকার পুতুল সরকারকে সাহায্য করেছিল তাদেরইবা কি হবে? হত্যার খবরও তো আসছেই। আমেরিকার ফিঙ্গারপ্রিন্ট প্রযুক্তি পর্যন্ত তাদের হাতে এসে গেছে বলে জানা গেছে।

কী হবে বিদেশ নীতি ও বৈদেশিক সম্পর্কের। ইউরোপীয় ইউনিয়ন কানাডাসহ বিভিন্ন্ দেশে তলেবানরা উগ্র সন্ত্রাসী দল হিসেবে নিষিদ্ধ, পারবে কী সিদ্ধ হতে? আমেরিকা আফগানিস্তানের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আটকে রেখেছে। বৈদেশিক সব সাহায্য ও প্রজেক্ট রয়েছে বন্ধ। তুরস্কের সৈন্যদের আফগানিস্তান ত্যাগ করতে হয়েছে। তবে তালেবানরা হামিদ কারজাই বিমানবন্দর সচল রাখতে তুরস্ককে অনুরোধ করেছিল, সেই দেশটি এখনো সাড়া দেয়নি শঙ্কায়; সেখানে তো রয়েছে আইএসের আক্রমণ। জানা যায়, ভবিষ্যৎ সরকারের সঙ্গে যুক্ত হতে অধুনালুপ্ত তালেবানবিরোধী জোট নর্দান এলায়েন্সের শীর্ষ নেতার পাকিস্তানের সঙ্গে দেনদরবার করছে। পাকিস্তান ইতোমধ্যে জাতিসংঘের মহাসচিবকে বলেছে, মানবিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক সাহায্য অব্যাহত রাখার জন্য। জানা যাচ্ছে, পাকিস্তান তুরস্ক চীন রাশিয়া তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে। ইরানও এর সঙ্গে আছে। তাই চ্যলেঞ্জ হলেও ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের কারণে তালেবানরা ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারার সম্ভাবনা আছে।

তবে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে স্থায়ীভাবে পারবে কী টিকে থাকতে? এটা হচ্ছে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন! আপাতত বা স্থায়ী হওয়ার প্রশ্নটি সামনে নিয়েই তালেবান সরকরের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ ও বিবেচনা করার প্রয়োজন রয়েছে বাংলাদেশের। তবে কলামের পরিসর বিবেচনায় এ সম্পর্কে আজ নয়, পরবর্তীতে মতামত প্রকাশ করা যাবে।

লেখক- কলাম লেখক, রাজনীতিক

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh