শফিক হাসান
প্রকাশ: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০২:৩৬ পিএম
প্রতীকী ছবি
জরাজীর্ণ ভবনে পাঠদান, আকাশের নিচে শিক্ষা কার্যক্রম- কাগজে মুদ্রিত এমনতর সংবাদে আজকাল ভ্রু কুঁচকাতে হয় বাবা-মাকে। একমাত্র সন্তানের ভর্তির চিন্তায় মশগুল তারা। ছেলের বয়স ছয় পেরোচ্ছে, এখনই স্কুলে ভর্তি না করালে পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়বে। যদিও বাসায় নিয়মিত ছয়জন শিক্ষক আসেন। প্রতিদিনই। সকাল আটটা থেকে সন্ধ্যা পাঁচটা পর্যন্ত তারা বিভিন্ন বিষয়ে পাঠ দিয়ে যান। বাবু কতটা আত্মস্থ করছে, তার ম্লান চেহারার দিকে তাকিয়ে বাবা-মা বুঝে উঠতে পারেন না। তবুও নিরাশ হন না- গাইতে গাইতেই তো গায়েন! ছেলে একদিন ঠিকই বিদ্বান হয়ে উঠবে। ফি-মাসে লাখ টাকা ব্যয় জলে ফেলবে না।
শহরের সেরা স্কুলটিতে ভর্তি হওয়া চাই। সংগ্রামী মানুষ হিসেবে কাজটা কঠিন, তবুও পিছিয়ে থাকলে চলবে না। স্লোগানে আছে- শিক্ষা সুযোগ নয়, অধিকার। ‘অধিকার’টি লঙ্ঘিত হচ্ছে পদে পদে। স্কুলে অল্প ক’টা আসনের বিপরীতে হাজার হাজার শিক্ষার্থী। এদের অভিভাবকের কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। ডোনেশনের জোর কিংবা বড়-ক্ষমতাশালী জায়গার সহায়তা নিয়ে সহজেই সন্তানকে ভর্তি করাতে সমর্থ হন নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। তারপর খবরটি আত্মীয়স্বজনকে শুনিয়েও শান্তি, আড্ডায়ও পাওয়া যায় বিশেষ স্পেস।
প্রত্যাশার দ্বিগুণ টাকা খরচ হলেও স্বস্তি, ভর্তি করানো গেছে পছন্দের স্কুলে। বাবুর পিঠে জমতে থাকে বইয়ের পাহাড়। বাড়ছে একটি-দুটি করে। ছোট ব্যাগে কুলোচ্ছে না; বাবা কিনলেন ঢাউস ব্যাগ। তার মনে অনেক স্বপ্ন-সম্ভাবনা খেলা করে। কিছুই হতে পারেননি জীবনে। অথচ কতকিছুই হওয়ার ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যন্ত পড়ার সুযোগ মেলেনি। বাবুই হবে তার ব্যর্থতার বিপরীতে ইচ্ছাপূরণের হাতিয়ার! কীর্তিমান সন্তানের বাবা হতে পারাটা আনন্দের।
বইয়ের ভারে বাবু কুঁজো হতে থাকে একটু একটু করে। মেরুদণ্ড ন্যূব্জ হতে থাকে। বাবার স্বপ্নরাজি আকাশ ছোঁয়- জিপিএ ফাইভ, প্রথম শ্রেণিতে প্রথম, বিসিএস, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, উন্নত রাষ্ট্রে আলিশান বাড়ি...। বাবু কিছু বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে থাকে। তবুও থামে না স্বপ্নকথন, রঙিন ভাবনার বুদ্বুদ।
জ্ঞানের বোঝা আরও বাড়ে। বৃহৎ থেকে বৃহত্তর হতে থাকলে বাবু একদিন পড়ে থাকে রাস্তায়। ওঠে না আর। শায়িত বাবুর পিঠের রহুরঙা ব্যাগটি উজ্জ্বল রোদে চকচক করে। খবর ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত। পরদিন স্কুল কর্তৃপক্ষের দেওয়া বিজ্ঞাপন ছাপা হয় কাগজে- সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীর অকাল প্রয়াণে আমরা ব্যথিত।
দেশের সেরা শিক্ষাবিদ বিবৃতি দেন- আমাদের জ্ঞানচর্চার যে আগ্রহ, ভালো চাকরি পেতে যে নিরন্তর অধ্যবসায় তা বিশ্বে বিরল। জ্ঞানকে সিঁড়ি বানিয়ে একদিন সর্বোচ্চ শিখরে উঠব আমরা। উন্নয়ন, অগ্রগতির যে পথরেখা, জিডিপির ঊর্ধ্বগতি, রেমিটেন্সের রেকর্ড সবকিছুর পেছনে প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে শিক্ষার সম্প্রসারণ। সংখ্যাটা বাড়ছে শনৈঃ শনৈঃ...।
শুধু শঙ্কা কাটে না বাবুর মায়ের। খুব বেশি আহাজারিও করেননি। অধিক শোকে পাথর হলে যা হয়! পাথর গলে বরফ হতে শুরু করলে হিসাব মেলাতে বসেন। তার বাবা কৃষক ছিলেন। ভূমিপুত্র নিজে যেমন কিছু হতে পারেননি, ছেলেমেয়েদেরও জজ-ব্যারিস্টার বানাতে পারেননি। তাতে কার কী ক্ষতি হয়েছে!