বেসরকারি শিক্ষকদের বেহাল অবস্থায় রেখে বিশ্বমানের শিক্ষার্জন কি সম্ভব?

মো. বোরহান উদ্দিন সরকার

প্রকাশ: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৯:১৬ পিএম

মো. বোরহান উদ্দিন সরকার

মো. বোরহান উদ্দিন সরকার

শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। আমরা শিক্ষকরা এ সকল বাণী শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করি এবং সকলে এ বাণীগুলোকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- এ শিক্ষা কি স্বাক্ষরজ্ঞান নাকি মানসম্মত গুণগত শিক্ষা। যদি স্বাক্ষরজ্ঞানের শিক্ষা হয় তাহলে, কিছুই বলার নাই। কারণ, মসজিদ, মক্তব, মন্দির অথবা নৈশকালীন প্রতিষ্ঠান দিয়েও সম্ভব।  আর যদি জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো জন্য মানসম্মত গুণগত শিক্ষা ব্যবস্থার কথা বলি তাহলে অনেক কিছুই বলতে হয়। 

বাংলাদেশের অনেক গবেষক বলেন, দেশে মানসম্মত গুণগত শিক্ষার ব্যাপক অভাব রয়েছে। এ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য অনেক পরামর্শও দিয়ে থাকেন যা আলোর মুখ দেখে না। যদি, আলোর মুখ দেখতো তাহলে, হয়তো আমরা অনেক এগিয়ে থাকতাম। আজও বাংলাদেশে নিরক্ষরতার হার ২৫% রয়েছে। যা আমাদের জন্য শুভ সংকেত নয়। 

এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য শিক্ষার সকল দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে। শিক্ষাকে আরো সহজলভ্য করতে হবে। শিক্ষাকে আরো সহজলভ্য করতে প্রথম প্রয়োজন বেসরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে জাতীয়করণের আওতায় আনতে হবে। যে দেশে এখনো প্রায় ৯০% শিক্ষার্থী বেশি খরচ দিয়ে নিজেদের পড়ালেখা চালায়। সে দেশে কিভাবে মানসম্মত গুণগত  শিক্ষা কিংবা শিক্ষার বাড়বে। কারণ,  শিক্ষার ব্যয় বাড়লে দরিদ্র জনগোষ্ঠী কখনো শিক্ষার্জনে আগ্রহ দেখাবে না। যাহারা বেশি অর্থ ব্যয় করে শিক্ষার্জন করেন তাদের অনেকেই আবার পরবর্তী জীবনে দুর্নীতিপরায়ন হয়ে পড়েন। কারণ, তাদের সন্তানকেও বেশি ব্যয়ে শিক্ষার্জন করতে হবে। 

এবার আসি এই ৯০% শিক্ষার্থীরা কেমন বিদ্যালয়ের কেমন শিক্ষকদের কাছে থেকে বিদ্যার্জন করে। এসব প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত কিংবা নন এমপিভুক্ত। অর্থাৎ, কারো বেতন আছে আবার কারো বেতন নাই। যাদের বেতন আছে তা দিয়ে তাদের সংসার কোনোভাবে চললেও পরিবারের লোকজনদের কোন চাহিদাই পূরণ করতে পারে না। এমনকি তাদের পরিবারের কেহ অসুস্থ হলে অর্ধচিকিৎসা কিংবা বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করেন। এতো পড়ালেখা করে শিক্ষক হিসেবে বেতন ধরানোর জন্য অনেকের আর্শীবাদ চাইতে হয়। কী আশ্চর্য এই শিক্ষকতা। 

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে আমরাও এগিয়ে যাচ্ছি। ব্যয়বহুল এই জীবন-যাপনে এমপিওভুক্ত একজন শিক্ষক বাসা ভাড়া বাবদ পান ১০০০টাকা যা দিয়ে বাংলাদেশের কোন স্থানে বাসা ভাড়া পাওয়া সম্ভব নয়, বদলি না থাকায় শত সমস্যা থাকা সত্ত্বেও একই প্রতিষ্ঠানে জীবন পাড়ি দিতে হয়। ফলে শিক্ষকদের হতাশা দিন দিন বাড়ছে। চিকিৎসা ভাতা ৫০০টাকা, যা দিয়ে একজন ডাক্তারের পরামর্শ ফি হয় না। লজ্জাজনক উৎসব ভাতা ২৫%। দেখা যায় শিক্ষকদের চেয়ে কর্মচারী উৎসব ভাতা বেশি পাচ্ছেন। ভবিষ্যত নিশ্চয়তার জন্য নেই কোন অবসর ভাতা। সারাজীবনের সঞ্চিত অবসর কল্যাণের টাকা কবে পাবো নেই কোন নিশ্চয়তা। নিজের সঞ্চিত অবসর কল্যাণের টাকা পাওয়ার জন্য বিভিন্ন জায়গায় দৌঁড়াতে হয় এবং অনেক টাকাও খরচ করতে হয়। এত জ্বালা-যন্ত্রণা এবং দুঃখ-কষ্ট নিয়ে একজন শিক্ষক কতটা গবেষণা করতে সুযোগ পাবে, করতটা ভালো শিক্ষা তাহার শিক্ষার্থীর জন্য উপহার দিতে পারবে? সময় এসেছে এসব নিয়ে ভাববার। কারণ, শিক্ষক যদি আর্থিক সংকটের জন্য হতাশায় নিমজ্জিত থাকেন তাহলে শিক্ষা এবং শিক্ষার্থীদের নিয়ে ভাবার সুযোগ পাবেন কতটুকু? 

বিশ্বমানের শিক্ষা চাইলে যেমন বিশ্বমানের পরিবেশ প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন শিক্ষকদের উপযুক্ত সম্মান এবং সম্মানীর। উপযুক্ত সম্মান এবং সম্মানী না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধা তালিকায় থাকা শিক্ষার্থীরা এ পেশায় আসছে না। সমাজের উঁচুস্তরের মানুষরা শিক্ষকদের অভাব অভিযোগ নিয়ে তাচ্ছিল্য করছে। শুধু কি ভাড়াটিয়া লোকজন দিয়ে চলছে শিক্ষা অধিদপ্তর। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে শিক্ষকদের বেতনেরও কোন সম্পর্ক নাই। কর্তাগণ বেতন তুলছেন প্রতি মাসের প্রথম দিন আর তাদের অধীনস্থ শিক্ষকগণ বেতন পাচ্ছেন ১০/১৫দিন পর, এটা কি সুবিচার? নেই কোন পদোন্নতি। 

বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী, একজন অভিজ্ঞতা সম্পন্ন সহকারি শিক্ষক সহকারি প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে কমপক্ষে ৩ বছর পর প্রধান শিক্ষক পদে আবেদন করতে পারবেন। এটা কি কোন পদোন্নতি? যদি পদোন্নতি হয় তবে কেন প্রত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, কেন নিয়োগ পরীক্ষা, কেন নতুন করে বেতন ধরানোর ঝামেলায় পড়তে হয়? এই বাজে নিয়মটি শিক্ষকদের মধ্যে হতাশা তৈরি করছে।  কারণ, বারবার নিয়োগ নেয়ার ঝামেলা কখনো কি সঠিক ব্যবস্থা হতে পারে? এ নিয়মের পরিবর্তন জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রয়োজনে পূর্বের নিয়মে একটি নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতা সম্পন্ন সহকারি শিক্ষকদের সরাসরি প্রধান শিক্ষক পদে আবেদনের সুযোগ রেখে মন্দের ভালো করবে। এভাবে শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো পর্যালোচনা করে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিলে আমরা অবশ্যই বিশ্বমানের শিক্ষা উপহার দিতে পারবো। প্রতিটি নাগরিককে বিশ্বমানের শিক্ষা অর্জনের সুযোগ করে দিতে পারলে আমরা একদিকে যেমন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবো তেমনি অন্যদিকে সরকারের জনপ্রিয়তাও বাড়বে। 

লেখক: প্রধান সমন্বয়ক
বাংলাদেশ মাধ্যমিক সহকারি শিক্ষক সমিতি।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh