সাতচল্লিশের দেশভাগের তাৎপর্য, অতঃপর ...

গৌতম দাস

প্রকাশ: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০২:৩৬ পিএম

গৌতম দাস

গৌতম দাস

১৯৪৭ সালের দেশভাগ; মানে ‘ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া’ ত্যাগ করে চলে যাওয়ার সময় ব্রিটিশ শাসকদের এই কলোনিকে ভারত ও পাকিস্তান দুই স্বাধীন রাষ্ট্রে ভাগ ও ক্ষমতা হস্তান্তর করে দিয়ে যেতে হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান ছিল হিটলারের জার্মানির পক্ষশক্তি; কিন্তু যুদ্ধে তারা উভয়ে মিলে হয় পরাজিত শক্তি। ওই পরাজয়ের পর জাপানের আত্মসমর্পণের দিন ছিল ১৫ আগস্ট ১৯৪৫। ওই দিনটির সঙ্গে মিল রেখে, এর দ্বিতীয় বার্ষিকী ১৫ আগস্ট ১৯৪৭, দিনটিকেই স্বাধীন ভারতের প্রথম স্বাধীনতা দিবস বা ক্ষমতা হস্তান্তর দিবস হবে বলে ঠিক করা হয়েছিল।

দেশভাগের মানে অন্যদিক থেকে ভাইসরয়ের ক্ষমতা হস্তান্তরও বটে; কিন্তু ‘ভাইসরয়’ মানে কি? ভারতে ব্রিটিশ শাসনের প্রথম প্রায় একশ বছর আমরা ছিলাম ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দখল-শাসনে। ১৮৫৮ সাল থেকে ওই দখল-শাসন শেষ পর্যন্ত সরাসরি ব্রিটিশ রাজসরকারের শাসনের অধীনে চলে যায়। শেষের এই শাসনটি ছিল প্রায় নব্বই বছরের। আর ওই ব্রিটিশ শাসকপক্ষের সর্বোচ্চপদ বা রাজা/রানীর মুখ্য প্রতিনিধির পদকে বলা হতো ‘ভাইসরয়’। কথাটি আসলে ভাইস-রয় (রয়েল শব্দকে ছোট করে নেওয়া অংশ হলো ‘রয়’ সম্ভবত সেজন্য; অথবা অনেকে মনে করেন ফরাসি ভাষায় ‘রয়’ (আরওআই) মানে রাজা, সেখান থেকে এসেছে শব্দটি); যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় রাজা/রানীর প্রতিনিধি। ভারতের শেষ ব্রিটিশ ভাইসরয় ছিলেন লর্ড মাউন্টব্যাটন। তিনি চেয়েছিলেন নতুন দুই স্বাধীন দেশেরই ক্ষমতা হস্তান্তরের অনুষ্ঠানে তিনি নিজে উপস্থিত থাকবেন। তাই একই দিনে অনুষ্ঠান না করে একদিন আগে ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ পাকিস্তানে ক্ষমতা হস্তান্তর অনুষ্ঠান উদযাপন করা হয়েছিল। আর পরদিন ১৫ আগস্ট ভারতে তা করা হয়েছিল।

এরপর ভারত ও পাকিস্তান বলে কলোনিমুক্ত স্বাধীন দুই দেশ হয়ে যাওয়ার ঘটনাটিকেও প্রচলিত জনপ্রিয় ডাক নাম হিসেবে ‘দেশভাগ’ বলে ডাকার চল শুরু হয়। অনেক সময় একাডেমিক ভাষাতেও ‘দেশভাগ’ শব্দটি ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। যদিও এর সঙ্গে এক অনুষঙ্গ অনুমানও থাকতে দেখা যায়। প্রায় ব্যতিক্রমহীনভাবে সেটি হলো- ‘দেশভাগ’ জিনিসটি একটি খুবই নেগেটিভ ঘটনা। অর্থাৎ, শব্দ ব্যবহারকারী বক্তা যেন বলতে চাইছেন- দেশভাগ হওয়াটা ভালো হয়নি, না হলে ভালো হতো। তাই যাদের কারণে হয়েছে তারা যেন খারাপ লোক এবং ওই ঘটনা খারাপ হয়েছে। আমরা এখানে পরখ করে দেখব এ ব্যাপারটি।

তবে ‘দেশভাগ’ কেন ঘটল আর ঘটনাটি খারাপ বা নেতিবাচক কি-না সে আলাপে একটু পরে যাব। এর আগে, দেশভাগ খারাপ- একথার মানে কী? সেটি বুঝব। ‘দেশভাগ’ মানে কী? ‘দেশভাগ’ কেউ চায়নি, চাওয়ার কেউ ছিল না, এমন? এমনটা তো হতেই পারে না, কারণ চাহনেওয়ালা পক্ষ কেউ যদি নাই বা থাকে, তবে ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া ভাগ হলো কেন? তাই ভাগ যেহেতু হয়েছে; অতএব, চেয়েছে এমন জনগোষ্ঠীও ছিল এবং তারা উপেক্ষিত হওয়ার মতো অল্প জনসংখ্যা হওয়ারও কোনো কারণ নাই। তাহলে এরা কারা? এখান থেকেই আমরা কথা শুরু করব।

কথাটি উল্টো করে বললে, কারা মনে করেন দেশভাগ ইতিবাচক? কী নির্ণায়ক বৈশিষ্ট্য দিয়ে তাদের আলাদা করা বা চেনা যাবে? অনেকের মনে অনুমান হতে পারে, অন্তত যারা নবগঠিত স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের নাগরিক হয়েছিলেন, নিশ্চয় তারা সবাই দেশভাগ হওয়াকে সঠিক ও আপন ভাবতেন! এই অনুমানও ভিত্তিহীন, অন্তত পুরো সত্য নয়। যদিও একেবারে জন্মের পরপরই পাকিস্তানের মুসলমান জনগোষ্ঠীর কাছে দেশভাগ আপন ঘটনা ছিল অবশ্যই। বিশেষত, পশ্চিম পাকিস্তানে; তারা ভারত থেকে আলাদা রাষ্ট্র হওয়াকে নিজেদের জন্য একটি বড় অর্জন বলে মনে করে এসেছে, এখনো করে। যে কারণে, পাকিস্তানের বাইরে যারা, এই আমরা যা-ই মনে করি না কেন, পাকিস্তানের ভেতরে সর্বত্র আজও পাকিস্তান রাষ্ট্রলাভের প্রতীক হয়ে আছেন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ। ‘জাতির পিতা’ পরিচয়ে তিনি পাকিস্তানের সকল দলের রাজনীতিতে এক অবিতর্কিত গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব। যদিও পূর্ব-পাকিস্তানে ব্যাপারটি ছিল ভিন্ন। সে প্রসঙ্গে ধাপে ধাপে আসছি। 

এখানে একটি কথা বলে রাখা দরকার। পূর্ব-পাকিস্তান আর পশ্চিম-পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর মধ্যে দেশভাগ ব্যাপারটি নিয়ে অনুভব-অনুভূতির প্রতিক্রিয়ার মধ্যেও একটা বড় ভিন্নতা ছিল। যার মূল কারণ হলো- ভূমি মালিকানা ব্যবস্থার দিক থেকে পূর্ব ও পশ্চিমের অবস্থা একই ছিল না। দুইশ’ বছরের ব্রিটিশ শাসনামলজুড়েই পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ ছিল ভূমি মালিকানা ব্যবস্থার দিক থেকে ‘জমিদারি’। যার বেশিরভাগ জমিদার মালিকরা ছিল হিন্দু। মানে মুসলমান জমিদার কিছু ছিল বটে; কিন্তু সেটি যেন ব্যতিক্রম। অথবা এভাবে বলা যায়- জমিদারদের নিজেদের ‘কমন স্বার্থ’ কী হবে তা নির্ধারণে মুসলমান জমিদারদের কখনো কোনো ভূমিকা বা বক্তব্য ছিল এমন জানা যায় না। এর বিপরীতে পশ্চিম পাকিস্তানে ভূমি মালিকানা ব্যবস্থাটি ছিল ট্র্যাডিশনাল; যেটি মোগল আমল থেকে চলে আসছিল। যার মূল বৈশিষ্ট্য হলো- মোগল শাসক অথবা তার প্রতিনিধিকে আপন ভোগদখলে থাকা জমির খাজনা দেওয়া সাপেক্ষে জমিদার জমির মালিক। আর মালিক বলতে, খাজনাদাতার নামেই জমির টাইটেল জারি হতো। এটিই পাকিস্তানের পূর্ব আর পশ্চিমের সবচেয়ে বড় ফারাক ছিল।

সারা ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে হিন্দু জনসংখ্যা সেকালে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। দেশভাগের আগে সারা ভারতে মোট মুসলমান জনসংখ্যা ছিল মাত্র ২৫ কোটি। তাই সব মিলিয়ে এসবের প্রতিক্রিয়ায় ব্রিটিশ আমলে হিন্দুদেরই রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য ছিল সমাজের প্রায় সর্বত্র। এমনকি কেবল পূর্ববঙ্গকে বিচারে নিলে মুসলমানরা এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও হিন্দুদেরই রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য এখানে বজায় ছিল। এর পেছনের আরেক কারণ হলো- ব্রিটিশ-ভারতের রাজধানী হিসেবে কলকাতার উত্থান। যেভাবে এ উত্থান ঘটেছিল, সেদিকে তাকাতে হবে। 

তত্ত্বগতভাবে আধুনিককালের যে কোনো রাজধানী মানেই হলো- অন্যান্য প্রদেশ বা জেলাগুলো রাজধানীর চেয়ে অবকাঠামোর দিক থেকে হয় কম উন্নত বা পিছিয়ে পড়া; তাই পিছিয়ে পড়া এলাকার লোকজন সুযোগ-সুবিধা নিতে ও ভাগ্য-অন্বেষণে রাজধানীতেই এসে ভিড় করে থাকে। ফলে রাজধানী এক নতুন ধরনের মিশ্র জনগোষ্ঠীর নতুন (আধুনিক) ভাষার শহর হয়ে উঠে; কিন্তু কলকাতা সেদিক থেকে বেশ ব্যতিক্রম। ব্রিটিশ সংস্পর্শে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগার প্রথম প্রহরে রাজধানী বলে কলকাতা সুবিধা পেয়েছিল ঠিকই; কিন্তু এর বাইরে আরেক দিক হলো- কলকাতার সঙ্গে বাকি ভারত তো বটেই, এমনকি বাকি বঙ্গের সব ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল খুবই দুর্বল, পিছিয়ে পড়া ও অবিকশিত। এ কারণে বাংলার স্থানীয় শাসক শ্রেণিই কেবল রাজধানীতে প্রভাব-আধিপত্য জমিয়ে বসার সুযোগটুকু নিয়েছিল; কিন্তু এরাই বা কারা?

সারা বাংলা সমাজের প্রধান উৎপাদন ব্যবস্থা ছিল কৃষিভিত্তিক। ভূমি মালিকানা ব্যবস্থা জমিদারি বলে, হিন্দু জমিদাররাই ব্রিটিশ-কলোনি ক্ষমতার কোলে বসে ও ঔরসে কলকাতার শাসক শ্রেণি হয়েছিল। আর সেখান থেকেই কলকাতা বর্ণহিন্দুর রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্যের শহর হয়ে উঠেছিল। আবার আরেক দিক থেকে বলা যায় ভারত মানে সবসময় বর্ণহিন্দুর জাতপ্রথার শাসনটাই যেন আবার ‘জমিদার হিন্দু’ এই নতুন নামে ও জমিদার-প্রজা সম্পর্কের ঢংয়ে চেপে বসেছিল। যদিও এর ভেতরেও আরেক ভাগাভাগি বজায় থাকতে দেখা যেত। প্রজা বলতে সারা বাংলার হিন্দু ও মুসলমান উভয় ধরনেরই প্রজা থাকলেও, তাদের মধ্যে এক বড় ভাগাভাগি ছিল। সেটি কেমন বা কেন? 

প্রজাদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান ভাগ থাকলেও হিন্দু প্রজারা জমিদার হিন্দুদের সঙ্গে ‘সাংস্কৃতিক নৈকট্য’ অনুভব করত। মানে জমিদারদের কালচারাল হেজিমনিতে হিন্দু-প্রজাদেরও ভাগ আছে, শেয়ার আছে বা তারা সম্বন্ধযুক্ত বলে অনুভব করত এবং তারা মুসলমান প্রজাদের চেয়ে সামাজিক মর্যাদায় ওপরের বলে স্থান ও বিবেচনা পেত। জমিদারের বৈঠকখানায় হিন্দু প্রজারা আলাদা করে ভালো ট্রিটমেন্ট- আলাদা শতরঞ্জিপাতা আসন, সস্তা নারিকেলের মালার হুকার বদলে পিতলের হুকা, ভালো তামাক ইত্যাদি পেত। অর্থাৎ জাতপ্রথার প্রাবল্য বলবৎ থাকার প্রভাব ও অজুহাতে মুসলমান প্রজাদের সামাজিক মর্যাদা-অবস্থান হিন্দু নমঃশূদ্র বা চর্মকারের চেয়েও অন্তত আরেক ধাপ নিচে বিবেচনা করা হতো। আর কেবল জমিদার হিন্দুর দাপট ও পরিচয়ে সে একমাত্র শাসক ও শ্রেণির আধিপত্য, এই ধারণা বলবৎ রেখেছিল। কলকাতার জয়া চ্যাটার্জী ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত মূল ইংরাজি বই, যার অনুবাদ বইয়ের নাম ‘বাঙলা ভাগ হল’; সেখানে এদেরকেই “বাংলার হিন্দু ‘ভদ্রলোক’ বা এলিট” বলে চিনিয়েছেন।

কেন কলকাতা ব্যতিক্রম

কলকাতা ব্যতিক্রম হতে পেরেছিল- এর আরেকটি বড় ফ্যাক্টর ছিল। এখানে জমিদার হিন্দু যাদের বলছি, ইংরেজি ‘রেস’ অর্থে জাতি বুঝলে, এই জমিদাররা কোন রেস? এর জবাব হলো- তারা নিজেদের ‘বাঙালি’ বলে পরিচয় নির্মাণ করেছিল ও পরিচয় দিত। কথাটিকে ‘তারা বাঙালি ছিল’- এভাবে সরাসরি না বলে ঘুরিয়ে বলার কারণ আছে। পূর্ব-পশ্চিম মিলে যে সারা বঙ্গ অঞ্চল, তারা সকলে মিলেই যে ‘বাঙালি রেস’, সারা দুনিয়া বাঙালি বলতে তাদেরই চিনে, তাই এ কথাটি অস্বীকার করার কিছু নেই; কিন্তু কলোনি-ক্ষমতায় উত্থিত কলকাতা সেটি মেনে উত্থিত হয়নি। প্রথমত, আগেই বলেছি কলকাতা ক্ল্যাসিক্যাল কোনো স্বাভাবিক পরিণতির অর্থনৈতিক অর্থে ‘একিউমুলেশন অব ক্যাপিটাল’ বা সারপ্লাস যেখানে সঞ্চিত হয়, এমন নদী তীরের কোনো গঞ্জ বা শহর ছিল না। সে অর্থে কলকাতা কলোনি প্রভাব ও সংস্পর্শের বাইরে গড়ে ওঠা কোনো শহর নয়। যেমন- মোগল আমলেই, মানে ভারত কলোনি মাস্টারের হাতে পড়ার আগেই হায়দ্রাবাদ, লক্ষ্ণৌ বা দিল্লি বড় মোগল শহর হিসেবে হাজির ছিল। কোনো কলোনি দখলকারীর ছোঁয়া লাগা ছাড়াই, সুনির্দিষ্ট করে ব্রিটিশরা ভারত দখলের আগে থেকেই ভারতে বড় শহর ছিল। তাই হায়দ্রাবাদ, লক্ষ্ণৌ বা দিল্লি মোগল আমলেই বড় শহর, এগুলোকেই স্বাভাবিক পরিণতির শহর বলছি। আর কলকাতা ছিল এসবের বাইরে ব্রিটিশের হাতে গড়ে ওঠা শহর। যেমন- আফ্রিকায় কলোনি দখল হয়ে যাওয়া সবদেশের বেলায়, কলোনি মাস্টারের হাত ধরে আফ্রিকানরা প্রথম শহর কি, তা চিনেছিল। কলকাতার বেলায় তার অনেকটাই সত্য।

এই সুবিধাটাই কলকাতার জমিদার হিন্দুরা নিয়েছিল। এই শহরের স্থানীয় শাসক শ্রেণি হিসাবে নতুন উত্থিতরা হলো এই জমিদাররা। যেটিকে ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইনের (জমিদারি আইন) ফলাফল বলা যায়। দুটি জিনিস এই জমিদার হিন্দুরা নতুন আকার ও সংজ্ঞা দিয়ে নিয়েছিল। তা হলো- কারা এই হিন্দু বাঙালি? আর বাংলা ভাষা বলতে কোনটা বুঝাবে?

এ প্রশ্ন তোলা বাতুলতা হবে না- ব্রিটিশরা আসার আগে অতীতে বাংলার কোন কোণে ভাষা কতটুকু বিকশিত হয়েছিল, সেটি কেমন? আর্কিওলজি বা প্রাচীন ইতিহাসে কী পাওয়া গেছে, চর্যাপদ কী? না, আমি এসবের কথা এখানে তুলছি না। বরং আগেই বলেছি জমিদার হিন্দু শাসকরা মূলত বাঙালি কারা, এর নতুন আকার ও সংজ্ঞা তুলে ধরেছিল, তাতে ব্রিটিশরা আসার আগে আমরা কী, কেমন ছিলাম বলে যে যা-ই বুঝি না কেন! আর এখান থেকে জমিদার হিন্দুর তত্ত্বাবধানে নির্ধারিত হয়েছিল নতুন আকার ও সংজ্ঞায় যে বাঙালি কারা, বাংলা ভাষা কোনটা। যার স্পষ্ট উচ্চারণ ছিল- ‘মুসলমানরা বাঙালিই নয়।’ এটিই কলোনি-কলকাতার বাঙালির সংজ্ঞা। আর সংস্কৃত ঘেঁষা ও সংস্কৃত ব্যাকরণসম্মত করে (সঙ্গে ইংরেজ পাদ্রি ধর্ম প্রচারকদের স্বার্থ) যে বাংলা গদ্যভাষা খাঁড়া করা হয়েছিল, তা নিয়ে এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও আপত্তি ছিল। 

‘আধুনিক’ শব্দটি অদ্ভূত। এটি সবচেয়ে ভালো অপব্যবহার হয় কাউকে ‘আধুনিক নয়’ বলে দাবি করার মধ্য দিয়ে। অতএব, সে নিশ্চয় ‘পশ্চাতপদ’, এটি প্রমাণ হয়েছে বলে দাবি করা হয়, যাতে বিপরীতে নিজেকে প্রগতিশীল বলে প্রমাণ করা ও তুলে ধরা যায়। এসব বদ-মতলবের বাইরে বর্ণনা অর্থে এখানে ‘আধুনিক ভাষা’ বলে শব্দ যুগলটি ব্যবহার করব। বলাই বাহুল্য, এটি রেনেসাঁর পরিণতি অর্থে যে আধুনিক ধারণা, সে অর্থে ব্যবহার করা হচ্ছে না। 

যখন আমাদের ভূখণ্ডের সকল অংশের, সকল জেলা বা অঞ্চলের সকল প্রতিনিধিকে রাজধানীতে হাজির রেখে সকলের প্রভাব ও মিশ্রণে একটা ভাষা উত্থিত করার চেষ্টা করা হয়, সেটি আধুনিক বাংলা ভাষা। এটিকে ‘আধুনিক’ বলার সূত্র এটিই যে, সারা বাংলাদেশের সব জেলা-অঞ্চলকে রাজধানীতে বসবাস শুরু করানোটা চাট্টিখানি কথা নয় যে, এটি চাইলেই করা যায়। যেমন- এখনকার ঢাকাকে বলা যায় পারফেক্ট রাজধানী। কারণ বাংলাদেশের সব অঞ্চলের সঙ্গেই এর যোগাযোগের সব ব্যবস্থাই ভালো বলে সব অঞ্চলের লোক এখন ঢাকায় পাওয়া যাবে। ঢাকার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক ও কালচারাল পাড়াগুলোর অলিগলি পর্যন্ত সব অঞ্চলে তাদের অ্যাকসেস আছে। ফলে সব আঞ্চলিক ভাষারই প্রবেশ ও পৌঁছানো সহজ। ফলে ঢাকায় বাংলা ভাষা বলে যেটি দাঁড়াচ্ছে, তাকে প্রভাবিত করার সুযোগ এখন সব অঞ্চলের হাতের কাছে আছে। এখন যে কোনো অঞ্চলের ভাষার বা একটা শব্দের ভাবপ্রকাশের সক্ষমতা যত প্রবল বা তা যত কমিউনিকেটিং, সেই ভাষা বা শব্দ অন্যদের ওপর প্রভাব ফেলবে বেশি। অন্যরা সেই আঞ্চলিক শব্দ আপন করে নেওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি। এমন আদর্শ সুযোগটি ১৯৮২ সালের আগে বাংলাদেশে ছিলই না। এরপর ইকোনমিক বা কাঠামোগত প্রশাসনিক সংস্কারের কারণে আস্তে-ধীরে এটি বদলাতে শুরু করে আজ এই জায়গায় এসেছে।

ঠিক এর উল্টো ঘটেছিল সেই ১৮০০ সালের আশপাশের সময় থেকেই। সে সময়ের যোগাযোগ ব্যবস্থাই পুরো প্রিমিটিভ; ফলে অব্যবস্থার সুযোগটি কাজে লাগিয়ে জমিদার হিন্দু শ্রেণি যাকে ইচ্ছা বাদ দিয়েছে, বাঙালি জাত ও ভাষা কোনটা তা নিজের একক ইচ্ছা ও খেয়ালে নির্ধারণ ও হস্তক্ষেপ করেছে।

সার কথায় এটিকে আমরা বলতে পারি- বাংলা সমাজের প্রায় অর্ধেক অংশকে যারা ‘মুসলমান বলে বাঙালি নয়’ বলে মার্জিনালাইড প্রজা মাত্র করে রাখা হয়েছিল। আসলে কথাটি হলো- ফোলানো বেলুন টিপাটিপির মতো। একদিকটা চাপ ফেলে রাখবেন তো প্রতিক্রিয়ায় অন্যদিকটা বেশি ফুলে যাবে। মানুষের রেস (জাতি) পরিচয়ের বিষয়টি ডিএনএ, যাকে প্রচলিত কথায় রক্তের সম্পর্ক বলি, সেই সম্পর্কিত জাত। সে তুলনায় ধর্মীয় পরিচয়টি এথনোলজিক্যাল বা নৃতাত্ত্বিক অর্থে সামাজিক পরিচয়। কারও রেসিয়াল পরিচয় বদলানো যায় না, ধর্মীয়-সামাজিক পরিচয়গুলোর অনেকটাই হয়তো সচেতনে বদলে নেওয়া যায়। কাজেই জাত পরিচয়ে যে বাঙালি, সে আবার মুসলমান ধর্মীয় পরিচয়ের বলে এই অর্ধেক বাঙালি জনগোষ্ঠীকে কোণঠাসা করতে জমিদার হিন্দুরা তাদের বাঙালি রেস মানতে অস্বীকার করেছিল। এতে কী এসে যায়, যেখানে রেস পরিচয় বদলানো বা অস্বীকারঅযোগ্য। সেই জবাব বাঙালি মুসলমানরা জমিদার হিন্দু বা এ চিন্তার উত্তরসূরিদের দিয়েছিল। তারাই ১৯৭১ সালে এক সশস্ত্র যুদ্ধ করে নিজেদের বাঙালি মুসলমান বলে প্রতিষ্ঠা করেছিল ব্যাপকভাবে। কারণ মা আর সন্তানের প্রথম কথোপকথন কোন ভাষায় শুরু হবে, এটি বদলানো যায় না বললেই চলে। কলোনি-জমিদার আমল থেকেই মুসলমানদের বাঙালি বলতে অস্বীকৃতি যতটা তীব্র হয়েছিল, ততধিক বেগে মুসলমানরাই যে প্রকৃত বাঙালি তা প্রমাণ করে ছেড়েছিল- যারা ভাষার জন্য জীবন পর্যন্ত দিতে পারে। ফলে তারা রেসিয়াল বাঙালি কি-না, এই স্বীকৃতি কারও থেকে চায় নাই। নিজেই প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছে। 

তবু এটি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) উত্থান, গায়ের জোর খাটিয়ে সব করে ফেলবে এমন এক জবরদস্তি হিন্দুত্বের যুগ। চলতি বছর ছিল বিদ্যাসাগরের জন্মশতবার্ষিকী। ওদিকে ‘হিন্দু সংহতি’ বলে আরএসএসের এক অঙ্গসংগঠন, যারা গত অন্তত চার বছর ধরে প্রকাশ্যে জনসভা করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে নাম ধরে উস্কানি তৈরি করে চলেছে। ফেসবুক পেজে তাদের ভারচুয়াল উপস্থিতি দিয়ে এবার ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরের শেষে বাংলাদেশিদের কাছে পৌঁছে গিয়ে আক্রমণ শুরু করেছিল। তাদের স্লোগান ও বক্তব্য ছিল এমন, যেন তা সেই কলোনিযুগে জমিদার হিন্দুর বয়ানেরই পুনরাবির্ভাব। বক্তব্যগুলো এমন- ‘ধর্মের ভিত্তিতে বাংলা ভাগ হওয়ার পরে এই পশ্চিমবঙ্গ হলো বাঙালি হিন্দুর ন্যাচারাল হোমল্যান্ড। অর্থাৎ, এই মাটির মালিক হলো হিন্দু বাঙালিরা। তাই পশ্চিমবঙ্গের যাবতীয় সম্পদের ওপর অধিকার সর্বপ্রথম হিন্দু বাঙালির। পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ক্ষমতার স্বাভাবিক উত্তরাধিকার হিন্দু বাঙালির।’

‘বাংলাদেশী ভাষা পৃথক করো, সনাতনী বাংলা রক্ষা করো।

বিদ্যাসাগরের বাংলাকে বিকৃত করে যে ভাষা আজ বাংলাদেশে চলছে, তাকে কি বাংলা ভাষা বলা যায়?’

এসব কথার জবাব একটাই- যে পূর্ববঙ্গ বা মুসলমান অধ্যুষিত বাংলাদেশকে কলকাতার জমিদাররা বাঙালি স্বীকৃতি দেয়নি; আমরা তা চাইও না। অর্থাৎ আমরা তো বিদ্যাসাগরের বাংলা বলে যদি কিছু থাকে, এর থেকে বাইরে এবং অছ্যুৎ। আর আমরাও কী কলকাতার স্বীকৃতি কখনো চেয়েছি; বরং আমরা নিজেই প্রজা-বাঙালির বাংলাদেশ গড়ে নিয়েছি। অতএব, বিদ্যাসাগরের বাংলা বলে আরএসএসের কোনো প্রকল্প থাকলে, আমরা একে কেয়ার করি না, পাত্তা দেই না। বরং পরামর্শ থাকবে- দূরে থাকেন। দাদাগিরি করতে আসবেন না। চাইলে হিন্দুগিরি করেন, যদি কলকাতার তা সহ্য হয়। আমরা নিজেকে নিয়ে খুবই ভালো আছি।

সব ক্রিয়ারই নাকি প্রতিক্রিয়া থাকে, থেকে যায়। প্রতিক্রিয়া ঘটতে অনেক সময় হয়তো তা ফেভারেবল সুযোগের অপেক্ষা করে। আপনি কাউকে যেমন ট্রিট করবেন, নিচু দেখাবেন- পায়ের নিচে পিষবেন, অপমানে কোণঠাসা মার্জিনালাইজ করবেন- তার পুরোটা না হলেও, বড় কিছু প্রতিক্রিয়া আপনার ওপর পাল্টা আসবেই। সেটি চিন্তা করে তাই এর মুখোমুখি হতে তৈরি থাকতে পারেন। আপনি হয়তো তখন নাকিকান্না করবেন, অথবা পুরানো সেই দাপুটে আপনি এবার নিজেকে ভিকটিম হিসেবে তুলে ধরে উল্টো সহানুভূতি তৈরির চেষ্টা করবেন, এমনটিই দেখা যায়। ঠিক এই জিনিসটিই যেন ঘটেছিল পাকিস্তান আন্দোলনের পরিণতিতে স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্র কায়েমের পরে। কারণ পাকিস্তান মানে তার পূর্ব-পাকিস্তান অংশে, অর্থাৎ আগের পূর্ববঙ্গে স্থানীয় শাসক যে জমিদার হিন্দু ছিল, ১৯৪৭ সালে স্বাধীন পাকিস্তান কায়েম হওয়াতে বলাই বাহুল্য এবার আগের ওই জমিদার হিন্দুদেরই রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য যুগের অবসান ঘটেছিল। পূর্ববঙ্গে যখন জমিদার হিন্দু শাসন আধিপত্য হারিয়েছিল, তখনো বাংলার অপর অংশ পশ্চিম বাংলায় তাদের আধিপত্য কিন্তু আগের মতোই অটুট ছিল। তাই প্রথম প্রতিক্রিয়া হিসেবে তারা পূর্ব-পাকিস্তান থেকে পশ্চিমবঙ্গে মাইগ্রেশন বা স্থানান্তরিত হয়ে যায়; কিন্তু কলকাতা চলে যাওয়ায় তার ফেলে আসা জমিদারি বা জমি তো তখন আরেক রাষ্ট্রের অংশ হয়ে গেছে। কালক্রমে পূর্ব-পাকিস্তানের প্রাদেশিক পার্লামেন্টে ১৭৯৩ সালের পুরনো জমিদারি আইন বাতিল করে ১৯৫১ সালের ১৬ মে নতুন প্রজাস্বত্ব আইন (ল্যান্ড একুজেশন অ্যান্ড টেন্যান্সি অ্যাক্ট ১৯৫০) পাস হয়ে যায়। এই জমিদার উচ্ছেদ আইন এখনো বাংলাদেশের সংবিধানের অংশ হয়ে আছে। আর এতে জমিদারির শেষ ক্ষমতাটুকুও অন্তত পূর্ব-পাকিস্তানে বাতিল ও পরিসমাপ্তি লাভ করেছিল। এরই ফলাফল- আগে যারা প্রজা বা ভাগচাষি ছিল, তারা তখন থেকে সরকারকে খাজনা দেওয়া সাপেক্ষে আগের চাষাবাদের জমিরই মালিক বলে আইনি স্বীকৃতি পায়, তাদের নামেই টাইটেল জারি হয়। আর এই আইনটি তৈরির সময় যে সাধারণ ফর্মুলা অনুসরণ করা হয় তা হলো- অধিগ্রহণ আইন অনুসারে পাবলিক ইন্টারেস্ট বা জনস্বার্থে সরকার যে কোনো জমি ‘অধিগ্রহণ করা হলো’ বলে ঘোষণা দিতে পারে। এখনও বাংলাদেশের জমি অধিগ্রহণ আইনটি এরকমই আছে। সেই আইন দিয়েই প্রথমে পূর্ব-পাকিস্তানের সব জমি অধিগ্রহণ (ল্যান্ড একুজেশন) করে নেওয়া হলো বলে ঘোষণা জারি করা হয়। আর এর ফলে আগের সব জমিদারি মানে, জমিদারের মালিকানা টাইটেল বাতিল হয়ে যায়। ফলে এবার যে প্রজা যে জমি চাষাবাদ করত, এবার সেই প্রজার নামেই সরকারকে খাজনা দেওয়া সাপেক্ষে জমির মালিকানা টাইটেল জারি করে দেয়া হয়। আর এটিই হলো আজকের বাংলাদেশের ভূমি মালিক, যাদের পূর্বপুরুষের জমির টাইটেল কেড়ে নিয়ে ব্রিটিশ শাসনের শুরুর দিকে জমিদার নামে নতুন একটা শ্রেণির কাছে তাদের জমির নতুন টাইটেল করে দেওয়া হয়েছিল। এবার এই জবরদস্তির অবসান ঘটেছিল। পূর্ব পাকিস্তানের ‘প্রজারা’ জমির মালিক টাইটেল ফেরত পেয়েছিল তখন থেকেই। অতএব, পূর্ববঙ্গের প্রজা-কৃষকরা স্বাধীন পাকিস্তান কায়েম হওয়াতে ‘ডাইরেক্ট বেনিফিশারি’ হয়ে যায়, কারণ তারা জমি পেয়েছিল। এরাই ছিল পাকিস্তান আন্দোলন আর পাকিস্তান কায়েমের সরাসরি সমর্থক; কিন্তু এই অবস্থা পরবর্তী সময়ে একই রকম থাকেনি। কিছুদিনের মধ্যেই বিভ্রান্ত ও উল্টে যায়। কেন? 

ক্ষমতা সম্পর্কে বলা হয়- ক্ষমতার রূপ হয় দুটি বা ক্ষমতার প্রকাশ ঘটতে পারে দু’ভাবে। একটি হলো- ফিজিক্যাল ক্ষমতা; যেটি আমরা সকলেই চিনি বুঝি। মানে সৈন্য-সামন্ত আর অস্ত্র বা ব্যারাকে যা দেখা যায়, যেমন- বস্তুগত বা সামরিক ক্ষমতা। আর অন্যরূপটি হলো- ভাবগত ক্ষমতা। মানে বয়ান বা ইডিওলজি (ভাবাদর্শ) রূপে ক্ষমতা; কিন্তু এ দুইয়ের পারস্পরিক সম্পর্কটিকে অন্য ভাষায় বললে- কোনো ফিজিক্যাল ক্ষমতাই টিকবে না, যদি সে ক্ষমতা কায়েম বা কার্যকর হওয়ার পর এর সপক্ষে কোনো সাফাই বয়ান হাজির না থাকে। সে জন্য এটিকে ক্ষমতার ন্যায্যতা যোগানোও বলা হয়। পাকিস্তানের জন্ম অন্তত পূর্ব-পাকিস্তানে এমন সাফাই বয়ানের অভাবের সমস্যায় পড়েছিল। যেমন- কেন পাকিস্তান কায়েম সঠিক হয়েছিল, এর সপক্ষে অন্তত পূর্ব-পাকিস্তানে কোনো সাফাই-বয়ান হাজির ছিল না। যদিও কার্যত জমিদারি উচ্ছেদ ঘটে যায় ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকেই। তাই প্রজা-কৃষকের হাতে জমি আগেই ভোগদখলে চলে এসেছিল। আর আমরা দলিল হাসিল করেছিলাম ১৯৫১ সালে। তবে কেন পাকিস্তান আন্দোলন করা সঠিক ছিল আর পাকিস্তান কায়েম করা জায়েজ ছিল, এর সপক্ষে আমরা বয়ান-ন্যয্যতা তুলে আমাদের ইতিহাস লিখে নেইনি। এডুকেশন সিস্টেমে টেক্সটবুক লেখা হয়নি, ফলে তা পড়ানোও হয়নি; কিন্তু এটি কেন সম্ভব হয়নি? আবার এমনটি কী করে ঘটা সম্ভব হয়েছিল?

১৯৭১ সালের সঙ্গে তুলনা করলে আমরা দেখব- ১৯৭১ সালের স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে এই রাষ্ট্র কায়েম করা যে সঠিক হয়েছে, এ নিয়ে ইতিহাস লেখা হয়েছে। কালক্রমে যদিও মোটাদাগের মূল ইতিহাস এবং সঙ্গে এর মূল কাঠামো ও ঘটনাক্রম ঠিক রেখেও কোনো কোনো প্রসঙ্গে একাত্তর সালের ঘটনা বা বাংলাদেশের জন্ম নিয়ে দুই-তিনটি লিখিত ভাষ্য বা ব্যাখ্যা-বয়ান পাওয়া যায়। দুনিয়ার সব ইতিহাসের বেলায় ভাষ্য এমনই হয়। একদেশে কখনো একটি ইতিহাস, একটি বয়ান থাকে না; যদিও মোটাদাগে বলা ইতিহাসের মূল কাঠামোটি একই থাকে। মোটের ওপর একটি ইতিহাসের বয়ান থাকে, আর সেটি একাডেমিকভাবে শিক্ষাব্যবস্থায় পড়ানো হয়।

এবার তুলনা করেন ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান কায়েমের সঙ্গে। পাকিস্তান আন্দোলন করা সঠিক হয়েছিল, আমাদের এমন লিখিত ইতিহাস নেই, কখনোই করা হয়নি। ফলে সেটি আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠ্য ইতিহাসে নেই। বরং মজার কথা হলো- আজকের বাংলাদেশের পুরনো সকল প্রজা, যারা আমাদের পূর্বসূরিরা আমাদের বাপ-দাদাদের দাদারা; এদের প্রায় সবাই কিন্তু জমিদারি উচ্ছেদে ভূমিলাভের প্রথম সুবিধাভোগী। অথচ সেই আমরাই যখন মডার্ন এডুকেশন লাভের উদ্দেশ্যে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছি, সেখানে যে ইতিহাস বই পড়ানো হয়েছে, সেটি পাকিস্তানে বা পূর্ব-পাকিস্তানে নতুন করে লেখা হয়নি, এটি পাকিস্তানের ইতিহাস নয়। জমি পাওয়ার ইতিহাস নয়। আমরা দ্রুত কলকাতায় লেখা ও ছাপা হওয়া বইটিই আমাদের পাঠ্য করেছি, সেটি আসলে কলকাতার লেখা তাদের ইতিহাস, যেটি আমরা কপি করে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে ছেপেছিলাম। অথচ এক রাষ্ট্রের ইতিহাস বয়ান দিয়ে আরেক রাষ্ট্র চলতেই পারে না। কারণ সবারই জন্ম ইতিহাস ও সাফাই-ন্যয্যতা বয়ান আলাদা ও ভিন্নই হয়। অর্থাৎ আমরা ধরেই নিয়েছিলাম- কলকাতার ইতিহাসের ভাষ্য আর আমাদের (পূর্ব-পাকিস্তানের ইতিহাসের) ভাষ্য যেন একই। যেন কলকাতারটি যেহেতু কথিত ‘আধুনিক শিক্ষার’ বই, কাজেই তা পড়লেই পূর্ব-পাকিস্তানে আমাদের চলবে! অথচ দুটির বাস্তব ইতিহাস ভাষ্যের সবচেয়ে বিরাট ফারাক হলো- একটা জমিদার হিন্দুর ভাষ্য, আরেকটা প্রজার ভাষ্য। আর জমিদার হিন্দু সুনির্দিষ্ট করে মনেই করে- পাকিস্তান কায়েম তার সরাসরি স্বার্থবিরোধী। আর সেটি অন্তত এ কারণে যে, পাকিস্তান বাস্তবে আলাদা রাষ্ট্র হয়ে যাওয়াতেই পূর্ব-পাকিস্তানের আইনে জমিদারি উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া তারা ঠেকাতে পারেনি। কাজেই জমিদার হিন্দুর চোখে ‘দেশভাগ হওয়া’ ভুল হয়েছে। অথচ আমরা প্রজারা, পূর্ব-পাকিস্তানি বা বাংলাদেশিরা হলাম জমিদারি উচ্ছেদের সরাসরি সুবিধাভোগী। সেই আমাদেরই পাকিস্তান আমলে কমিউনিস্টরা প্রগতির লোভ দেখিয়ে ফুসলিয়েছিল যে কলকাতার ইতিহাস মানে ‘প্রগতি চিন্তাধারায়’ লেখা ইতিহাস। কিন্তু কে না জানে ‘প্রগতি চিন্তাধারীরা’ মনে করে ‘স্বদেশি আন্দোলন’ তাদের কাছে আপন ইতিহাস এবং কলকাতার বা জমিদার হিন্দুর ইতিহাস। এমনকি এখন স্বাধীন বাংলাদেশেও একাডেমিকভাবে যে ইতিহাসের টেক্সট পড়ানো হয়, সেটি কলকাতার জমিদার হিন্দুর অনুমোদিত হতিহাস- এটিকেই পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাস বলে পড়ানো হয়। 

একইভাবে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টিও মনে করতো বঙ্গভঙ্গ বা ১৯০৫ সালের বাংলা ভাগ করা (পূর্ববঙ্গ আর আসাম মিলে আলাদা নতুন প্রদেশ করা) ভুল। বঙ্গভঙ্গ ঠেকিয়ে দেওয়াকে কলকাতার বা জমিদার হিন্দু নিজের স্বার্থ মনে করেছিল। অথচ বাস্তবে পূর্ববঙ্গে ব্যাপারটি ছিল উল্টো। ১৯০৫ সালে পূর্ববঙ্গের প্রজারা মনে করেছিল ঢাকাকে রাজধানী করে আসামসহ বাংলায় নতুন প্রদেশ করা হলে সেটি কলকাতার নাগপাশ ত্যাগ করা হবে, আর সেটিই তাদের স্বার্থ। মূল কথা জমিদার হিন্দুর স্বার্থ কখনোই পূর্ববঙ্গের প্রজার স্বার্থ ছিল না। কাজেই বাংলার স্বার্থ বলে জমিদার হিন্দুর স্বার্থ আমাদের ওপর সবসময় চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে আর আমাদের তা উল্টে দিতে হয়েছে।

জয়া চ্যাটার্জির ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত ‘বাঙলা ভাগ হল’ বইটির সবচেয়ে খারাপ দিক ও ডিমেরিট হলো- বাংলা দু’বার ভাগ হলো, আর এই দু’বারই বাংলা ভাগ সঠিক কাজ বলে মনে করেছিল পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তান। বাস্তবে এটি তা-ই ঘটেছিল, এটি ছিল তাদের অনুভব এবং বলাই বাহুল্য কলকাতার জমিদার হিন্দুর ভাষ্যের চেয়ে আলাদা বা উল্টো। অথচ জয়া চ্যাটার্জি ওই বইয়ে বাংলা ভাগ একটা খারাপ কাজ এটি ধরে নিয়ে লিখেছেন, আমাদের ওপরে চাপিয়ে দিয়েছে। অথচ ফ্যাক্টস হলো- আমাদের অনুভব ছিল কলকাতার চেয়ে ভিন্ন। সরাসরি মিথ্যা কথাটি হলো- পূর্ব পাকিস্তানের প্রজা-কৃষক সবাই জমিদারি উচ্ছেদে জমির মালিক হয়েছিল অথচ তাদের সন্তানরা স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে শিখেছে জমিদাররাই সঠিক, পাকিস্তান কায়েম করা ঠিক হয়নি, ভুল।

সূর্যসেন, কল্পনা, প্রীতিলতারা সশস্ত্রভাবে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে লড়েছেন, পাশাপাশি জমিদাররাও সেসময় কলকাতার রাস্তায় মিছিল মিটিং করেছেন। কলকাতার জমিদারদের স্বার্থে পরিচালিত এসকল কর্মকাণ্ড স্বদেশিপনা এবং স্বদেশি আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে! অথচ ১৯০৫ সালে পূর্ববঙ্গ চেয়েছিল বাংলা ভাগ করে আসামকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকাকে রাজধানী করে নতুন প্রদেশ করতে। কলকাতার অধীনস্ততা থেকে বের হতে। আর বলাই বাহুল্য এটি কলকাতার জমিদার হিন্দু স্বার্থের পুরাপুরি বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গের স্বার্থ। এখানকার ‘কমিউনিস্টরা’ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরা মানেই তা বিপ্লবী কাজ, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কাজ ধরে নিয়েছে। প্রচার করেছে। দুঃখিত, নট নেসেসারিলি আপনাদের দাবি সত্য। সোজা কথাটা বললে, জয়া চ্যাটার্জী জবরদস্তিতে জমিদারের স্বার্থ ও দৃষ্টিভঙ্গিটা পূর্ববঙ্গ বা বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দিয়ে ওই বইটি লিখেছেন। সূর্যসেনের বাড়ি চট্টগ্রাম হতে পারে; কিন্তু তার রাজনৈতিক কর্মসূচি কলকাতার বাবু জমিদারদেরই স্বার্থ রক্ষা করেছে। আর সরাসরি কথাটি হলো- ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরা মানেই তা সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা নয়। এমনটি চালিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই; বরং এটি হয়েছে পুরাপুরি জমিদার স্বার্থে এবং পূর্ব কিংবা পশ্চিম সারাবাংলার প্রজা-কৃষকের সরাসরি স্বার্থবিরোধী। 

অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী কিংবা অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানসহ অনেকেই তাদের কিশোর-যৌবনকাল কাটিয়েছেন পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থেকে। তারা তখন টিনেজ বয়স পার হচ্ছিলেন। সে কথা তারা নিজেই পরিণত বয়সে তাদের আত্মজীবনীতে এমনকি গৌরবের বিষয় হিসেবেই তুলে ধরেছেন। তাহলে তারা বদলে গেলেন, প্রগতিবাদী হয়ে গেলেন কবে, কখন থেকে? প্রগতিবাদী হওয়া, জমিদারদের স্বদেশী আন্দোলনকে আপন করে নেওয়া- এমন পক্ষবাদী হয়ে গেলেন কখন? সেটি হলো- যখন পাকিস্তান কায়েম হয়ে গেছে অথবা তারা এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে গেছেন; কিন্তু ঢুকে দেখেছেন পূর্ব-পাকিস্তানের নিজের ইতিহাসের বই নেই। এবার পাকিস্তানের জন্মের সপক্ষে সাফাই বয়ানে লেখা পাকিস্তানের কোনো ইতিহাস তারা খুঁজে পাননি। তাই ‘প্রগতি’ মনে করে কলকাতা বা জমিদার হিন্দুর তত্ত্বাবধানে লেখা ইতিহাস পড়েই তাদের বড় হতে হয়েছে।

তবে পাকিস্তানের এই সংকট কেবল দু’চারজন শিক্ষকের জন্য বলে মনে করা একেবারেই ঠিক নয়, তা বড় ভুল হবে। আমি কেবল এখানে দু’জনের উদাহরণ দিয়ে দেখালাম সেকালের ইয়াং মুসলিম লীগারদের পরিণতি পাকিস্তান কায়েমের পরে কী হয়েছিল। প্রগতিবাদীতার লোভ দেখিয়ে কলকাতার জমিদার হিন্দুর স্বার্থবয়ানের ইতিহাসটাই তাদের নিজেদের ইতিহাস বলে গেলানো হয়েছিল।

আগেই বলেছি, জমির দলিল পেতে পেতে আমাদের বাপ-দাদাদের কমপক্ষে ১৯৫১ সাল লেগে গিয়েছিল; কিন্তু ১৯৫২ সাল থেকেই ভাষা আন্দোলন প্রবল হয়ে উঠেছিল। আর এটি হলো পাকিস্তানের দু’অংশের ইন্টিগ্রেশন কত দুর্বল ছিল তার প্রকাশ। আর স্বভাবত এতেই পাকিস্তানকে আপন মনে করতে গিয়ে পূর্ব-পাকিস্তান যে ধাক্কা খায় এর বড় চিহ্ন; কিন্তু সেটিই কী প্রথম? না, একেবারেই না; কিন্তু কীভাবে বুঝব আর মানব?

আওয়ামী লীগের জন্ম

আওয়ামী লীগের জন্ম হয়েছিল ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন। মুসলিম লীগের বিরোধী ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ মানে যেন এবার পাবলিকের মুসলিম লীগ গঠন হচ্ছে, এটি অবশ্যই যথেষ্ট বড় ধাক্কা। না এটি দল ভেঙে দল করার জন্য একেবারেই নয়। এদের ভুল হলো- আগের মুসলিম লীগ করাটাকে পুরোপুরি ভুল মনে করা। এর মূল কারণ, যারা পরবর্তীকালে আওয়ামী মুসলিম লীগ গড়েছিলেন, তারা দেশভাগের আগে থেকেই মুসলিম লীগের কোনো অর্জনকে আর নিজেদের অর্জন বলে মনে করা ছেড়ে দিয়েছিলেন। যেমন- জমিদার উচ্ছেদ আইন পাস করার চেয়ে গৌরবময় অর্জন মুসলিম লীগের আর কিছুই হতে পারে না। এটি শুরু হয়েছিল ১৯৩৭ সালের নির্বাচিত প্রথম বাংলার প্রাদেশিক সংসদ থেকে। সেখানে একটা জমিদার উচ্ছেদ কমিশন (ফ্লাউড কমিশন) গঠন করা থেকে। যেটি ১৯৪৬ সালের দ্বিতীয়বারের প্রাদেশিক সংসদের হাতে কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নের প্রসঙ্গ এলে প্রস্তাব উঠে যে স্বাধীন পাকিস্তানে বসে তা বাস্তবায়ন করা হবে বলে মুলতবি হয়েছিল। আর সত্যই ১৯৫১ সালে পূর্ব-পাকিস্তান প্রাদেশিক সংসদে জমিদারি উচ্ছেদ আইন পাস হয়ে যায়। অথচ ইতিমধ্যে নবগঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের এতে কোনো প্রতিক্রিয়া হয়েছিল কি-না জানা যায়নি। কেন?

এদিকে, ১৯৪৮ সালেই নতুন করে পূর্ব-পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করা হয়েছিল। যার মধ্যে নতুন করে প্রবেশ ঘটেছিল ব্যাপকসংখ্যক জমিদারি হারানো বা জমিদার সংশ্লিষ্ট হিন্দুর, যারা পাকিস্তান জন্ম নেওয়াতে তাদের আগের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক একচ্ছত্র ক্ষমতা খুইয়েছিল। তারাও উচ্ছেদ আইনের পক্ষে বা বিপক্ষে কোনো বিবৃতি দেয়নি। আজও কমিউনিস্ট পার্টি এ নিয়ে গর্বও করে না, নিন্দাও করে না। খুব সম্ভবত এসবের পেছনে মূল কথা- আসলে ততদিনে আমরা হারানো জমিদারি স্বার্থের দুঃখে ‘প্রগতিশীল’ হয়ে গিয়েছিলাম। যতটা প্রগতিশীল হয়ে গিয়েছিলাম, ততটাই যেন জমিদারি উচ্ছেদ বা প্রজার জমি পাওয়াকে আর ‘কমিউনিস্ট রাজনীতি’ বলে মনে হয়নি। আসলে পাকিস্তান কায়েমের পক্ষে কোনো বয়ান-ইতিহাস লেখা হয়নি- এই কথাটির তাৎপর্য সহজ কোনো বিষয় ছিল না। এর ভেতর দিয়েই কোথায় কী ক্ষয় ধরেছিল, তা ফুটে উঠে। যদি পাঠ করতে চাই, আমরা এখনো ধরতে পারি, ভুল শুধরাতে পারি; কিন্তু করব কী?

এদিকে, ১৯৫৪ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তাতে পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগ গো-হারা হেরে একেবারে উৎখাত-বেখবর হয়ে যায়। এতে ১৯৪৭ সাল থেকেই খাজা নাজিমুদ্দিন আর আকরাম খাঁদের হাতে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের যে স্থানীয় নেতৃত্ব দেওয়া হয়েছিল, তাতে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল কারা জিন্নাহ ও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের অনুগত; কিন্তু তারা পূর্ব পাকিস্তানকে প্রতিনিধিত্ব করে কতটুকু তা কোনো বিবেচ্য ছিল না। কেন এমনটি হলো, সে কথায় আসব একটু পরে।

আবার ফজলুল হক বা সোহরাওয়ার্দী দেশভাগের আগে একটি বড় সময় ব্যয় করেছেন কিভাবে দেশভাগ না করে কংগ্রেস বা মহাসভার সঙ্গে সরকার গড়া যায়। তাদের আগ্রহ ও স্বার্থ এতই সংকীর্ণ হয়েছিল। এই প্রশ্নে জিন্নাহর সঙ্গে তাদের বিরোধ সবচেয়ে বড় হয়ে যায়, যা আর জীবনে কখনোই মিটেনি। বরং জিন্নাহর চোখে এরাই দেশভাগে আলাদা পাকিস্তান রাষ্ট্র না করার পক্ষের ‘এজেন্ট’ বলে চিত্রিত হয়ে যায়। খাজা নাজিমুদ্দিন আর আকরাম খাঁদের সামনে এনে এদের হাতেই পূর্বপাকিস্তান মুসলিম লীগের নেতৃত্ব দেওয়ার পেছনে জিন্নাহপন্থীদের পক্ষে এটিই সাফাই ছিল। বদরুদ্দিন উমর এর অবস্থান ও ব্যাখ্যাটা হলো- জিন্নাহ বা পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের ‘খাজা-গজা প্রীতি’ মুসলিম লীগ ভেঙে যাওয়ার মূল কারণ। এ রকম ব্যাখ্যাদাতারাও অনেকে দেশভাগ ঘটা ব্যাপারটিকে ভালো ছিল না মনে করে থাকেন। 

হক বা সোহরাওয়ার্দী এরপর থেকে আর না মুসলিম লীগে না আওয়ামী মুসলিম লীগে সক্রিয় হয়েছিলেন। কেবল ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের আগে আগে তারা দু’জন সক্রিয় হন, তবে ঠিক কোনো দলের হয়ে নামার চেয়ে তারা ‘যুক্তফ্রন্টের’ নেতা এভাবে আবছা দলীয় পরিচয়ের মধ্যে দিন কাটিয়েছেন। তবে মুখ্য বিষয় ছিল মুসলিম লীগ বিরোধিতায় সেই দলটাকে বেইজ্জতি করে দেওয়া। এটিই মুখ্য বিষয় ছিল, পেরেছিলেনও তারা। সোহরাওয়ার্দী কলকাতা থেকে পাকিস্তানে ফেরেনই ১৯৫৪ নির্বাচনের আগে মাত্র। আর হক সাহেব পাকিস্তানেই ছিলেন, তবে রাজনীতিতে নয় কারণ তিনি হয়েছিলেন পূর্ব-পাকিস্তানের এটর্নি জেনারেল। ফলে দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান হয়ে যায় যেন বাপ-মা হারা এতিম কোনো সন্তান। যাকে নিয়ে গর্ব বা অর্জন বোধ করার কেউ নাই। কেবল তবু কীভাবে যেন ১৯৫১ সালের জমিদার উচ্ছেদ আইনটি পাস হয়ে গিয়েছিল। আবার পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা পাকিস্তানের সব ক্ষমতা একচেটিয়া নিজেদের হাতে কুক্ষিগত করতে কসুর ছাড়েনি। তাদের এসব কাজের পক্ষে একটিই ঠুনকো সাফাই ছিল- হক বা সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তান লাভ করার চেয়ে দুই বাংলার মুখ্যমন্ত্রিত্ব করতে আগ্রহী ছিলেন বেশি। ঠুনকো বলছি এজন্য যে, একবার পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে যাওয়ার পর আর এই অভিযোগ তোলা বা ধরে বসে থেকে আর এই অভিযোগে সারা পূর্ব-পাকিস্তানকে বঞ্চিত বা বৈষম্য করাটাও তো অন্যায্য কম নয়। এটিই তো ধীরে ধীরে পাকিস্তান ভাঙার দিকে যাওয়ার রাস্তা খুড়ে ফেলে, আর তাই তো ঘটেছিল।

কাগমারি সম্মেলন

আবার দেখা যাচ্ছে, হক বা সোহরাওয়ার্দী কেউ কিন্তু নবগঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগে হাল ধরেননি। এমনকি ৫৪ সালে নির্বাচিত হওয়ার পরও না। কেবল ১৯৫৭ সালে সোহরাওয়ার্দীর পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে শেষবার আপোষে (আমেরিকান মধ্যস্ততায়) কেন্দ্রীয় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সময়ই যা একটু ব্যতিক্রম হতে দেখা যায়। যেটি এক বছরও টিকেনি। আমেরিকা আর আস্থা ও ধৈর্য রাখতে পারেনি। আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালে সামরিক ক্ষমতা দখল করেছিল।

এবার এখানে তাহলে একটা উপ বা সাইড-ঘটনা বলি। তা হলো- আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হলেও হক বা সোহরাওয়ার্দীর বিহনে এতে এক ভাসানী ছাড়া (যিনি ঠিক মুসলিম লীগের লোক ছিলেন না) বড় নেতা কে ছিলেন? কেউ না। তাহলে ১৯৪৯ সালে জন্মের পরে আওয়ামী মুসলিম লীগ দল চালিয়েছিল কারা? চালিয়েছিল মূলত জমিদারি হারানো হিন্দু কমিউনিস্টরা। আবার এটিই ছিল জিন্নাহ-লিয়াকত ইত্যাদি পশ্চিমের নেতাদের পূর্বের আওয়ামী মুসলিম লীগ। হক বা সোহরাওয়ার্দীদের প্রতি আরেক বড় অভিযোগ- তারা সোভিয়েত-কমিউনিস্ট-জমিদারি হারানো হিন্দুদের চক্রে বা পাল্লায় পড়েছে। পাকিস্তানের পূর্ব-পশ্চিমের বিভেদ বাড়ার পেছনেও এগুলো বড় ভূমিকা রেখেছিল। কাগমারি সম্মেলনের (১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারি) তাৎপর্য হলো- হক বা সোহরাওয়ার্দীরা (মূলত সোহরাওয়ার্দীরা) প্রো- আমেরিকান অবস্থান নিলেন আর প্রগতি-কমিউনিস্টরা জমিদার পক্ষ, যেটি আসলে সোভিয়েত পক্ষ। এই পক্ষ এবার আওয়ামী মুসলিম লীগ ছেড়ে ভাসানি ন্যাপ গড়েছে। মূলত সোহরাওয়ার্দীর জীবনে পশ্চিমের সঙ্গে আমেরিকান মধ্যস্ততায় শেষ আপোষ করে প্রধানমন্ত্রী হওয়াই ছিল ভাসানি ন্যাপ জন্মের ব্যাকগ্রাউন্ড, যদিও এর স্থায়িত্ব মাত্র এক বছর। কারণ আইয়ুব খান ক্ষমতা নিয়েছিলেন।

জিন্নাহর উর্দু রাষ্ট্রভাষাকে ভেঙে দেখলে

একটু যদি পেছনে ফিরি, অনেকে ১৯৪৮ সাল থেকেই উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা নিয়ে জিন্নাহর জবরদস্তিকে দুই পাকিস্তানের বিভেদের একটা বড় কারণ মনে করেন। এক কথায় জিন্নাহ হয়তো ইতিবাচক ভেবেই জবরদস্তিটা করেছিলেন। 

শেষবিচারে, জিন্নাহর পাকিস্তান রাষ্ট্র চিন্তাও কিন্তু একটি নেশন-স্টেট জাতিচিন্তা। তবে কংগ্রেসের হিন্দু জাতিরাষ্ট্র চিন্তার চেয়ে তুলনায় স্বচ্ছ এবং সম-নাগরিক সাম্য নীতির মধ্যে থাকার আগ্রহ জানাশোনা থাকা অনেক বেশি, অন্তত বাকি মুসলিম লীগারদের চেয়ে অনেক বেশি। এমনকি লিয়াকত আলী খানের চেয়েও বেশি।

তবে জিন্নাহর ভাষা ইস্যুটি মূলত জবরদস্তি বলে, এটি ছিল তার সিরিয়াস ভুল পদক্ষেপ। তার উচিত ছিল আপত্তিগুলো শুনে বুঝতে মনোযোগ দেওয়া, এতে ভুল সংশোধনের সুযোগ হতেও পারত। তবে আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি, নেশন-স্টেট কায়েম করার রাজনীতি যারা করেন, একই জাতি পরিচয়ের রাজনীতি- এমনই ধরা খাওয়ার সম্ভাবনা থাকে সবসময়, এখানে অথবা সেখানে। তাই পরিষ্কারভাবে মনে রাখতে হবে- এটি মুসলিম জাতিবাদি বা মুসলিম জাতিরাষ্ট্র কায়েম যারা চায়, কেবল তাদের ত্রুটি নয়। এর ভালো উদাহরণ হলো- ভারতের নেহরু; আমরা অনেকেই জানি না যে, ঠিক জিন্নাহর মতোই জবরদস্তিতে রাষ্ট্রভাষা করার সমস্যা তিনিও তৈরি করেছিলেন বা পড়েছিলেন। কারণ নেহরুও ভেবেছিলেন সারাভারতের সবাইকে তিনিও এক জাতি করে গড়তে হিন্দি বলাবেনই, শেখাবেনই, রাজকার্য বা রাজভাষা বানাবেনই। স্কুলে হিন্দি শেখা বাধ্যতামূলক করেছিলেন। আর এখানেই ফলাফল খুবই নিম্নচাপ হয়েছিল। এতে পুরো দাক্ষিণাত্য, ভারতের দক্ষিণের কর্ণাটক থেকে তামিলনাড়ুসহ চার রাজ্য যারা অহিন্দিভাষী দ্রাবিড়ীয় প্রতিরোধ অঞ্চল, তারা হিন্দির বিরুদ্ধে ১৯৬২ সালে ব্যাপক আন্দোলন ও বিদ্রোহে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার হুমকিও দিয়েছিল। কারণ অহিন্দিভাষী দ্রাবিড়ীয় প্রতিরোধ হলো- ভারতীয় আদি ইতিহাসের আর্য আধিপত্য ঠেকানোর সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। সেই ঐতিহাসিক স্মৃতিতে ১৯৬২-৬৬ সাল পর্যন্ত লড়ে তামিলনাড়ু নিজেদের আঞ্চলিক দল ডিএমকে (দ্রাবিড়ীয় মুনেত্রা কাজাঘাম) গড়ে তুলেছিল। তারা ছাড়া কেউ আজও তামিল প্রাদেশিক সরকারে ক্ষমতায় আসেনি। সেই দুঃখ নিয়ে নেহরু ১৯৬৪ সালে মারা যান। পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুরকে আপোষ করতে হয়েছিল, আর সেই থেকে ভারতের সংবিধানে রাষ্ট্রভাষা বলে কিছু নেই। যদিও সরকারি দাপ্তরিক ভাষা বলে আছে, আর সেটি ইংরেজি। এটি মূলত জাতিরাষ্ট্র চিন্তার রাজনীতি যারা করেন, এমন একটি না একটি ‘জাতিবাদী পরিচয়ের’ রাজনীতি যারা করেন তাদের সমস্যা। ঠিক যেমন অন্যদিকে, মুসলমান মাত্রই তাদেরকে একই আরবি ভাষা রপ্ত করানো বা আরবি কালচার রপ্ত করিয়ে এক পরিচয়ে আনতে হবে এমন পরিচয়ের রাজনীতি- এটিও একই ‘জাতি’ চিন্তাগত মারাত্মক ত্রুটি। তবে মূল কথা- এটি পাকিস্তান বলে ‘উর্দুর’ সমস্যা নয় একেবারেই। এটি হিন্দু কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ নেহরুরও একই জাতি-রাষ্ট্র চিন্তা বা ত্রুটিপূর্ণ ‘পরিচয়ের রাজনীতি’ খাড়া করার গভীর সমস্যা। বাংলাদেশেও এমন বাঙালি জাতিরাষ্ট্র কায়েমের জিদে আমাদেরও নতুন করে ‘পাহাড়ি সমস্যার’ জন্ম দেওয়ার জালে ফাঁসতে হয়েছে। 

সবশেষ দুটি বাক্য বলে শেষ করব। আমাদের আদি-পাপ হলেন রাজা রামমোহন রায়। তাই তাকেই প্রথম আমাদের স্টাডি ও আমাদের নিজেকে রিভিউ করা এখান থেকে শুরু করা উচিত। ভারতের কমিউনিস্ট-প্রগতিশীলরা, যেমন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির মেনিফেস্টো লেখক, ব্রাহ্মসমাজের লোক, ইতিহাসের অধ্যাপক সুশোভন সরকার রামমোহনকে বাংলা ‘রেনেসাঁর আদিগুরু’ বলে বইয়ে লিখেছেন। সবাই জানেন ও মানেন, ১৮১৫ সালে রামমোহনই ব্রাহ্মসমাজ ও ব্রাহ্মধর্ম চালু করেছিলেন। তা হলে এখানে রেনেসাঁর আদিগুরুই আবার এক নয়াধর্ম চালু করেন কিভাবে? এটা কেমন কথা? আর সেই ধর্ম এখানে ইতিবাচকই বা হয় কিভাবে?

প্রগতিশীলদের এক প্রিয় ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তিনিও ব্রাহ্মধর্মের অনুসারী ছিলেন। কারণ তার দাদা দ্বারকানাথ শুধু রামমোহনের অনুসারী ছিলেন না, ১৮৩৩ সালে রামমোহন মারা গেলে তিনিই ব্রাহ্মসমাজের দায়িত্ব নিয়েছিলেন এবং রবীন্দ্রনাথ ১৯১১-১৫ সময়কালে ব্রাহ্মসমাজের মুখপাত্র ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।

রামমোহন ভাবতেন- এক. রাষ্ট্র মানেই তা নেশন-স্টেট, দুই. নেশন বা জাতি মানেই ধর্মের ভিত্তিতে জাতি। আমাদের আদি-পাপ এখান থেকেই শুরু।

এই বোধটুকুই বৈষম্যহীন সমানাধিকারের নাগরিক ধারণা বা রিপাবলিক ধারণা বুঝতে না পারা বা পৌঁছাতে না পারার প্রধান বাধা- আমাদের আদি-পাপ। আমরা তিন রাষ্ট্র (বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান) যার সরাসরি ভুক্তভোগী। আমাদের মুক্তি মিলবে কি-না, সেজন্য অন্তত রামমোহন পাঠ দিয়ে শুরু করতে পারি। 

২৩ নভেম্বর ২০২০

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh